টাইফয়েড টিকাদান ক্যাম্পেইন ২০২৫

টাইফয়েড জ্বর থেকে আপনার শিশুকে সুরক্ষিত রাখতে সরকারের ইপিআই কর্মসূচির আওতায় দেশব্যাপী আগামী ১২ অক্টোবর ২০২৫ থেকে টিকাদান ক্যাম্পেইন শুরু হবে।


ভূমিকা

টাইফয়েড জ্বর (Typhoid Fever) একটি প্রতিরোধযোগ্য সংক্রামক রোগ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৯ সালের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবছর বিশ্বে প্রায় ৯০ লক্ষ মানুষ টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্ত হয় এবং এর মধ্যে প্রায় ১ লক্ষ ১০ হাজার জন মৃত্যুবরণ করে। উল্লেখ্য, আক্রান্ত ও মৃত্যুবরণকারীদের অধিকাংশই দক্ষিণ এশিয়া এবং সাব-সাহারান আফ্রিকায় বসবাসকারী মানুষ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, বিশ্বের উন্নত দেশ সমূহে এই রোগের প্রাদুর্ভাব অনেকাংশে কম হলেও বাংলাদেশ-সহ অনেক উন্নয়নশীল দেশে অন্যতম জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে রয়ে গেছে।

বাংলাদেশে টাইফয়েড জ্বর

বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্তের হার বাংলাদেশে অনেক বেশি। The Global Burden of Disease-এর সমীক্ষা অনুযায়ী ২০২১ সালে বাংলাদেশে প্রায় ৪,৭৮,০০০ জন টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্ত হয় এবং ৮,০০০ জন মৃত্যুবরণ করে যার মধ্যে ৬৮ শতাংশই শিশু।

টাইফয়েড জ্বর ও এর প্রভাব

টাইফয়েড জ্বর স্যালমোনেলা টাইফি (S. Typhi) নামক ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সৃষ্ট একটি সংক্রামক রোগ। টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্ত হলে আর্থিক ক্ষতি, দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক জটিলতা, এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। আরও আশংকার বিষয় হলো টাইফয়েড রোগীর চিকিৎসায় যে সকল এন্টিবায়োটিক ব্যবহৃত হয়, তার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ টাইফয়েড জ্বর নিরাময়ে কাজ করছে না। অর্থাৎ টাইফয়েড জীবাণু সে সকল এন্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন করেছে, ফলে ঔষধ প্রতিরোধী টাইফয়েড জ্বরের প্রকোপ প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। টাইফয়েড টিকা এই মারাত্মক ঔষধ প্রতিরোধী টাইফয়েড জ্বরের বিস্তার রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

আরো পড়ুন: আল্লাহ তাআলার কাছে মুহাব্বত কামনা করো 

টাইফয়েড জ্বর কীভাবে ছড়ায়

টাইফয়েড প্রধানত আক্রান্ত ব্যক্তির মলের সংস্পর্শে আসা দূষিত পানি বা খাবারের মাধ্যমে বিস্তার ঘটে এবং অন্যান্যদের মাঝে সংক্রমণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই জীবাণু একমাত্র মানুষের দেহেই অবস্থান করে এবং ২টি চক্রে বিস্তার লাভ করতে পারে।

সংক্ষিপ্ত চক্র (Short-cycle)

  • দূষিত খাবার গ্রহণের মাধ্যমে
  • দূষিত পানি পানের মাধ্যমে এবং
  • স্বাস্থ্যবিধি এবং স্যানিটেশন ব্যবস্থার অভাব থাকলে

দীর্ঘ চক্র (Long-cycle)

  • পরিবেশের দূষণ, যেমন: নর্দমার দূষিত পানি
  • অস্বাস্থ্যকর পদ্ধতিতে পাইপলাইনের পানি পরিশোধন করলে
  • পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ না করলে ল্যাব স্টাফ দ্বারা সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে
  • মানব মল অথবা অপরিশোধিত নর্দমার বর্জ্যকে কৃষিক্ষেতে সার হিসেবে ব্যবহার করলে

টাইফয়েড জীবাণুর সুপ্তকাল

সাধারণত জীবাণু প্রবেশের পর গড়ে ৭ থেকে ১৪ দিনের মধ্যে টাইফয়েড জ্বর হয়, তবে কিছু ক্ষেত্রে এটি ৩ দিন থেকে ২ মাস পর্যন্ত হতে পারে।

ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী

  • ঘনবসতিপূর্ণ জনগোষ্ঠী, বস্তি বা নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠী
  • রোগ প্রাদুর্ভাব এলাকায় বসবাসকারী জনগোষ্ঠী
  • মহামারিতে আক্রান্ত এলাকায় ভ্রমণকারী
  • নিরাপদ পানি এবং স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশনের অভাব রয়েছে এমন এলাকায় বসবাসকারী জনগোষ্ঠী এবং
  • অনিরাপদ উপায়ে বা স্বাস্থ্যবিধি না মেনে খাবার প্রস্তুত বা পরিবেশনকারী

টাইফয়েড জ্বরের লক্ষণসমূহ

  • মৃদু জ্বর থেকে দীর্ঘস্থায়ী উচ্চ মাত্রার জ্বর (১০৩-১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট)
  • ক্লান্তি, মাথা ব্যথা, কাঁপুনি, ক্ষুধামন্দা, ও কাশি
  • শরীর ব্যথা, পেট ব্যথা (কোষ্ঠকাঠিন্য বা ডায়রিয়া থাকতে পারে বা নাও থাকতে পারে), বমি বমি ভাব বা বমি
  • অসুখের দ্বিতীয় সপ্তাহে যকৃৎ এবং প্লীহা বড় হয়ে যেতে পারে (Hepato-splenomegaly)
  • কিছু রোগীর ক্ষেত্রে র‍্যাশ বা শরীরে লালচে দানা থাকতে পারে

টাইফয়েড টিকাদান ক্যাম্পেইন-২০২৫

টাইফয়েড টিকা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা দ্বারা সুপারিশকৃত এবং নিরাপদ ও কার্যকর। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগে ইপিআই-এর ব্যবস্থাপনায় বিনামূল্যে এই টিকা প্রদান করা হবে।

টিকাদান ক্যাম্পেইন-এর উদ্দিষ্ট জনগোষ্ঠী

  • শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত প্রাক-প্রাথমিক থেকে ৯ম শ্রেণি/সমমান পর্যন্ত সকল ছাত্র-ছাত্রী
  • শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বহির্ভূত কমিউনিটির ৯ মাস থেকে ১৫ বছরের কম বয়সি সকল শিশু

কখন টিকা দেওয়া যাবে না

  • জ্বর (১০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট-এর বেশি) হলে
  • পূর্বে কোন টিকা দেওয়ার পর এলার্জির ইতিহাস থাকলে
  • টিকা গ্রহণের দিন অসুস্থ থাকলে
  • গর্ভবতী/দুগ্ধদানকারী মা হলে

টিকার জন্য রেজিস্ট্রেশন

টিকাপ্রাপ্তি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে উদ্দিষ্ট সকল শিক্ষার্থী এবং শিশুদের https://vaxepi.gov.bd ওয়েবসাইটে জন্ম নিবন্ধন সনদের ১৭ সংখ্যা দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করতে উদ্বুদ্ধ ও সহযোগিতা করবেন। পরবর্তীতে ঐ একই ওয়েবসাইট থেকে টাইফয়েড টিকাদান কার্ড ডাউনলোড করে টিকাদানের দিন নিয়ে আসতে বলবেন। উল্লেখ্য, টিকার প্রাপ্যতা অনুযায়ী যাদের ১৭ সংখ্যার জন্ম নিবন্ধন নেই অথবা যেসকল শিক্ষার্থী ৮ম/৯ম শ্রেণিতে পড়ে কিন্তু বয়স ১৫ বছরের বেশি, তাদের রেজিস্ট্রেশনের জন্য সংশ্লিষ্ট এলাকার স্বাস্থ্য সহকারী/টিকাদানকর্মীর সাথে যোগাযোগ করতে বলবেন।

ইসলাম ধর্ম ও পবিত্র কোরআন-হাদিসের আলোকে টিকা দেওয়ার গুরুত্ব

ইসলামী শরীয়তের হুকুম হলো মহান আল্লাহ তা'য়ালাই রোগ দিয়েছেন এবং তিনিই সুস্থ করবেন। এ আকিদা-বিশ্বাস পোষণ করে কেউ যদি পথ্য বা ঔষধ গ্রহণ করে, তবে এটাই আল্লাহর রাসুলের সুন্নাত। কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন "প্রত্যেক রোগের শেফা রয়েছে।" মানুষ হয়তো গবেষণা করে সে ঔষধ বের করতে পারে অথবা পারে না। আমরা আল্লাহ তা'য়ালার হুকুমে রোগাক্রান্ত হই এবং আল্লাহই দয়া করে ঔষধের মাধ্যমে সকল প্রকার রোগ হতে আমাদেরকে আরোগ্য দান করেন। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তা'য়ালা বলেন, যখন আমি অসুস্থ হই, তিনিই (আল্লাহ) আমাকে আরোগ্য দান করেন। ( সূরা আশ-শুরা-৮০ )

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, "তোমরা চিকিৎসা গ্রহণ কর, কেননা আল্লাহ তা'য়ালা যত রোগ দিয়েছেন, তার সবগুলোর জন্য আরোগ্যের ব্যবস্থা করেছেন, তবে মৃত্যু ও বার্ধক্য ব্যতীত” ( আহমাদ ও ইবনে হিব্বান )

বর্তমান সময়ে চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে টিসিভি টিকা আবিষ্কার করেছে, যা শিশুদের টাইফয়েড জ্বর প্রতিরোধে এক নতুন দিগন্ত হিসেবে কাজ করবে। সুতরাং টিকা কিংবা ভ্যাকসিন মানুষের জন্য সতর্কতামূলক প্রতিরোধ ব্যবস্থা। এটি গ্রহণ করা তাওয়াক্কুল বিরোধী কাজ নয়, বরং এটা হাদিস অনুমোদিত ইসলামের বড় একটি শিক্ষা।

ধর্মীয় নেতা হিসেবে আপনি যেভাবে ভূমিকা রাখতে পারেন

  • শুক্রবার মসজিদে জুমু'আর নামাজের প্রাক খুতবার আলোচনায় টাইফয়েড টিকা সম্পর্কে আলোচনা করে টিকার মূল বার্তাগুলো পৌঁছাতে পারেন।
  • কমিউনিটিতে আয়োজিত বিভিন্ন আলোচনায় অংশ নিয়ে টাইফয়েড টিকা সম্পর্কে আলোচনা করে টিকার মূল বার্তাগুলো পৌঁছাতে পারেন।
  • নিজের বাড়িতে বসবাসকারী এবং প্রতিবেশীর প্রতিটি উদ্দিষ্ট শিশুকে টাইফয়েড টিকা প্রদানের জন্য অভিভাবকদের পরামর্শ দিতে পারেন।
  • মসজিদের মাইক ব্যবহার করে টিকাদানের তারিখ ও কেন্দ্রের অবস্থান জনগণকে জানাতে সহায়তা করতে পারেন।
  • নিজ এলাকায় বাদ পড়া শিশুদের টিকাদান কেন্দ্রে আনতে সাহায্য করতে পারেন।

[ ৯ মাস থেকে ১৫ বছরের কম বয়সি সকল শিশু এবং প্রাক-প্রাথমিক থেকে নবম শ্রেণি/সমমান পর্যন্ত সকল শিক্ষার্থীদেরবিনামূল্যে ১ ডোজ টাইফয়েডের টিকা দিন ]

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url