মিথ্যার নিষিদ্ধতা ও তার প্রকারভেদ
মিথ্যার নিষিদ্ধতা ও তার প্রকারভেদ
ভূমিকা
মিথ্যা হারাম হওয়ার ব্যাপারে সামগ্রিকভাবে কুরআন-হাদিসের অনেক দলিল রয়েছে। এটা সবচেয়ে নিকৃষ্ট গুনাহ ও মারাত্মক খারাপ দোষ। কুরআন-সুন্নাহর দলিলের পাশাপাশি মিথ্যা হারাম হওয়ার ব্যাপারে উম্মতের ইজমা সংঘটিত হয়েছে। সেগুলো আলাদা আলাদা বয়ান করার প্রয়োজন নেই। এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, হারাম হওয়ার হুকুম থেকে যেসব মিথ্যাকে বাদ দেওয়া হয়, তা বর্ণনা করা এবং তার সূক্ষ্ম বিষয়গুলো সম্পর্কে অবিহিত করা। মিথ্যার প্রতি ঘৃণার জন্য সর্বসম্মতিক্রমে এই সহিহ হাদিসটিই যথেষ্ট।
হযরত আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহ আনহু থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন
মুনাফিকের আলামত তিনটি-
এক. যখন কথা বলে তখন মিথ্যা বলে।
দুই. ওয়াদা করলে তা ভঙ্গ করে।
তিন. তার কাছে কোনো আমানত রাখা হলে তার খিয়ানত করে।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনু আমর ইবনুল আস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-
যার মধ্যে চারটি অভ্যাস থাকবে সে খাঁটি মুনাফিক। আর যার মাঝে চারটির যেকোনো একটি অভ্যাস পাওয়া যাবে, তার মাঝে নিফাকের একটি অভ্যাস বিদ্যমান থাকবে, যতক্ষণ সে তা পরিত্যাগ না করে-
এক: তার কাছে কোনো আমানত রাখা হলে তার খিয়ানত করে।
দুই: কথা বললে মিথ্যা বলে।
তিন: ওয়াদা করলে তা ভঙ্গ করে।
চার: ঝগড়ার সময় অশ্লীল গালিগালাজ করে।
যেসব মিথ্যা হারাম নয়
হযরত উম্মু কুলসুম রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছেন-
যে ব্যক্তি মানুষের মাঝে ঝগড়ার সময় মীমাংসা করে দিতে ভালো কথা পৌঁছে দেয় অথবা ভালো কথা বলে। বাহ্যিক দৃষ্টিতে যদিও তা মিথ্যা হয়, তাহলে সে মিথ্যাবাদী নয়।
এই অংশটুকু সহিহ বুখারি, মুসলিম উভয়টিতে আছে। সহিহ মুসলিমে অতিরিক্ত আছে যে, হযরত উম্মু কুলসুম রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, তিনটি জায়গা ছাড়া আর কোনো জায়গায় প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মিথ্যা বলার অনুমতি দিয়েছেন বলে আমি শুনিনি।
এক: যুদ্ধ কৌশলের ক্ষেত্রে।
দুই: মানুষের বিবাদ মীমাংসা করার জন্য।
তিন: স্ত্রীর সাথে স্বামীর কথা বলা ও স্বামীর সাথে স্ত্রীর কথা বলার ক্ষেত্রে (প্রতারণা নয়, কেবল মনোরঞ্জনের জন্য)।
এই হাদিসে পরিষ্কারভাবে বলে দেওয়া হয়েছে যে, কিছু জায়গায় বিশেষ কল্যাণে মিথ্যা বলা জায়িয আছে। অবশ্য কোন কোন জায়গায় মিথ্যা বলা বৈধ, উলামায়ে কিরাম তার মূলনীতি নির্ধারণ করে দিয়েছেন। আমার দেখা সবচেয়ে উত্তম নীতি হলো, ইমাম গাজালি রহ বর্ণিত মূলনীতিসমূহ। তা হলো, মূলত কথা বলা হয় কোনো উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য। আবার প্রতিটি প্রশংসনীয় উদ্দেশ্য সত্য ও মিথ্যা উভয় ধরনের কথা বলেই হাসিল করা যায়। সে ক্ষেত্রে মূলনীতি হলো, প্রয়োজন না থাকলে মিথ্যা বলা হারাম।
পক্ষান্তরে যদি কেবল মিথ্যা বলেই উদ্দেশ্য হাসিল করতে হয়, সত্য বলে সম্ভব না হয়। আবার এই উদ্দেশ্যও যদি বৈধ হয়, তাহলে সে ক্ষেত্রে মিথ্যা বলাও বৈধ।
আর যদি উদ্দেশ্য এমন হয়, যা হাসিল করা ওয়াজিব, তাহলে সে ক্ষেত্রে মিথ্যা বলাও ওয়াজিব। যেমন-কোনো মুসলিম কোনো জালিমের ভয়ে আত্মগোপনে থাকে। আর এই ব্যাপারে কাউকে জিজ্ঞেস করা হয়, তাহলে ঐ মুসলিমকে হিফাজত করার জন্য মিথ্যা বলা ওয়াজিব।
এ ধরনের আরও অনেক উদাহরণ বিভিন্ন কিতাবে রয়েছে। তবে এসব ক্ষেত্রে তাওরিয়ার পন্থা অবলম্বন করাই সর্তকতা। তাওরিয়া হলো, সঠিক কোনো উদ্দেশ্যে এমনভাবে কথা বলা যে, বক্তা নিজের দিক থেকে মিথ্যাবাদী পরিগণিত হয় না, যদিও বাহ্যিকভাবে তাকে মিথ্যাবাদী মনে করা যায়। তবে ঐসব জায়গায় তাওরিয়া অবলম্বন না করে সরাসরি মিথ্যা বলে দেওয়াও হারাম নয়।
ইমাম গাজালি রহ. বলেন, এমন প্রতিটি বিষয়, যার সাথে নিজের বা অন্যের স্বার্থ জড়িত আছে, সে ক্ষেত্রে পূর্ববর্তী হুকুমই প্রযোজ্য হবে। নিজের স্বার্থ জড়িত রয়েছে এমন বিষয়ের উদাহরণ হলো, কোনো জালিম কাউকে গ্রেফতার করে তার সম্পদ দখল করার জন্য এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে। তখন তার জন্য অস্বীকার করা জায়িয আছে। অথবা বাদশাহ কোনো ব্যক্তিকে তার কৃত এমন কোনো মন্দ কর্মের ব্যাপারেঋ জিজ্ঞেস করে, যার হিসাব তার ও আল্লাহর মধ্যেই হবে। তখন তার জন্য সেটা অস্বীকার করা বৈধ। যেমন সে বলবে, আমি ব্যভিচার করিনি, আমি মদ্যপান করিনি।
অন্যের স্বার্থ জড়িত রয়েছে এমন বিষয়ের উদাহরণ হলো, কাউকে তার মুসলিম ভাইয়ের গোপন বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলো, আর সে তা অস্বীকার করল। এক্ষেত্রে তাকে সত্য-মিথ্যা উভয়টার অকল্যাণ নিয়ে ভাবা উচিত। অতঃপর যদি সত্যের মধ্যেই বেশি অকল্যাণ থাকে, তাহলে মিথ্যা বলবে। আর যদি মিথ্যাতেই বেশি ক্ষতি থাকে বা (কোনোটাতে বেশি ক্ষতি সেটা নিয়ে) সন্দেহ থাকে, তাহলে মিথ্যা বলা হারাম। নিজের স্বার্থের কারণে মিথ্যা বৈধ হওয়ার ক্ষেত্রে মিথ্যা না বলে সত্য বলা মুস্তাহাব। আর অন্যের স্বার্থে মিথ্যা বলা বৈধ হয়ে থাকলে অন্যের স্বার্থের ব্যাপারে ছাড় দেওয়া ঠিক নয়। ওয়াজিব ছাড়া এমন সাধারণ বৈধতার সবক্ষেত্রে মিথ্যা বর্জন করাই বাঞ্ছনীয়।
জেনে রাখা দরকার যে, আহলে সুন্নাতের মতানুযায়ী মিথ্যা হলো, কোনো বিষয়ে তার প্রকৃত বাস্তবতার বিপরীত সংবাদ দেওয়া, হোক তা জেনেশুনে ইচ্ছা করে অথবা না জেনে অনিচ্ছায়, তবে না জেনে অনিচ্ছায় হলে গুনাহ হবে না। গুনাহ হবে কেবল ইচ্ছা করে বলার ক্ষেত্রে। আমাদের দলিল হলো, প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাদিসে মিথ্যাকে ইচ্ছার সাথে সম্পৃক্ত করেছেন-
যে ব্যক্তি ইচ্ছা করে আমার নামে কোনো মিথ্যা হাদিস প্রচার করবে, সে জাহান্নামে তার ঠিকানা বানিয়ে নেয়।
বর্ণনার ক্ষেত্রে নিশ্চিত হওয়া জরুরি, কেবল শুনেই বর্ণনা করা নিষেধ আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
যে বিষয়ে তোমার কোনো জ্ঞান নেই, তুমি তার পেছনে পড়ো না। নিশ্চয় কান, চোখ ও অন্তর সবগুলোই (নিজ কৃতকর্ম সম্পর্কে) জিজ্ঞাসিত হবে।
[সুরা বনি ইসরাইল, আয়াত:৩৬]
মানুষ যা বলে, তা সংরক্ষণের জন্য সদাপ্রস্তুত একজন প্রহরী নিযুক্ত রয়েছেন। [সুরা কাফ, আয়াত ১৮]
নিশ্চয় আপনার পালকর্তা প্রতীক্ষা করছেন।
[সুরা গাশিয়া, আয়াত ১৪]
হযরত আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন-
যাচাই-বাছাই ছাড়াই) প্রত্যেক শোনা কথা বলে দেওয়া, মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য এটাই যথেষ্ট।
হযরত উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন-
শোনা কথা বলে বেড়ানোই মানুষের মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য যথেষ্ট।
মুসলিম শরিফে হযরত আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে এ জাতীয় বক্তব্য বর্ণিত আছে। এ অধ্যায়ে সাহাবায়ে কিরামের অনেক বক্তব্য পাওয়া যায়।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু অথবা হযরত হুজাইফা ইবনুল ইয়ামান রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি-
কোনো লোকের 'যাআমু' নামক বাহনটি কতই-না নিকৃষ্ট।
ইমাম খাত্তাবি রহ. 'মাআলিমুস সুনান' নামক গ্রন্থে বলেছেন, এই হাদিসে প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মানুষ কথার শুরুতে যে 'তারা মনে করেছে' এ জাতীয় কিছু বলে এবং এর দ্বারা তার উদ্দেশ্য বোঝাতে যায়, সেটাকে একটি বাহনের সাথে তুলনা করেছেন। আর 'তারা মনে করেছে' জাতীয় কথা তো কেবল সূত্রহীন ও ভিত্তিহীন কথার ক্ষেত্রেই বলা চলে। সেটা শুধু আরেকজনকে শোনানোর জন্যই বর্ণনা করা হয়। প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ ধরনের কথা বর্ণনা করার নিন্দা করেছেন। আর বর্ণনাকৃত বিষয় সম্পর্কে আগেই যাচাই-বাছাই করে নিশ্চিত হতে আদেশ দিয়েছেন। অর্থাৎ যতক্ষণ কোনো প্রমাণ না পাওয়া যাবে, ততক্ষণ সেটা বর্ণনা করবে না।
ইঙ্গিতপূর্ণ কথা বলা এবং তাওরিয়ার পন্থা অবলম্বন করা
জেনে রাখা দরকার যে, এটি গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়। কেননা, এটা প্রচুর পরিমাণ ব্যবহৃত হয় এবং সমাজে বিষয়টি ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। তাই এর আলোচনায় সমধিক গুরুত্ব দেওয়া উচিত। আর যে এটা জানে, তার জন্য এ ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করা এবং সে অনুযায়ী আমল করা জরুরি। মিথ্যার অধ্যায়ে আমরা মিথ্যাকে মারাত্মক হারাম হওয়ার বিষয়টি বলে এসেছি। জবানের নিয়ন্ত্রণহীনতার ভয়াবহতার ব্যাপারেও বলেছি। আর এই আলোচনা হলো, তা থেকে নিরাপদ থাকার একটি পদ্ধতি।
জেনে রাখবেন যে, তারিজ ও তাওরিয়ার ব্যাখ্যা হলো, কোনো শব্দকে বাহ্যিকভাবে এক অর্থে ব্যবহার করা হয়; কিন্তু তুমি এমন ভিন্ন একটি অর্থ উদ্দেশ্য নিলে, যে অর্থ ঐ শব্দের মধ্যে আছে; কিন্তু অর্থটা বাহ্যিক অর্থের বিপরীতে। এটা এক ধরনের ধোঁকা ও প্রতারণা।
উলামায়ে কিরাম বলেন, যদি শরয়ি এমন কোনো কল্যাণ থাকে, যেটা শ্রোতাকে ধোঁকা দেওয়ার চেয়ে অগ্রগণ্য অথবা এমন কোনো প্রয়োজন যা এভাবে মিথ্যা বলা ছাড়া পূরণ হওয়ার নয়; এমন কোনো বিষয় যদি তাওরিয়া বা তারিজের দিকে উদ্বুদ্ধ করে, তাহলে এতে কোনো সমস্যা নেই। আর যদি এমন কোনো কারণ না থাকে, তাহলে এটা মাকরুহ বিবেচিত হবে, হারাম হবে না। তবে যদি এর মাধ্যমে কোনো অন্যায় পন্থা অবলম্বন করতে চায় বা কোনো সত্যকে প্রতিহত করতে চায়, তখন সেটা হারাম হয়ে যাবে। এই হলো এই অধ্যায়ের মূলনীতি।
এ ব্যাপারে বৈধতা দানকারী ও অবৈধকারী উভয় ধরনের দলিল বিদ্যমান। সেগুলো উপরিউক্ত মূলনীতি অনুযায়ী ধরতে হবে। তাওরিয়া নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে এসেছে-
হযরত সুফিয়ান ইবনু আসাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি-
এটা কি মারাত্মক খিয়ানত নয় যে, তুমি তোমার মুসলিম ভাইয়ের কাছে কোনো কথা এভাবে বর্ণনা করলে যে, সে তোমাকে সত্যবাদী মনে করছে, অথচ বাস্তবে তুমি মিথ্যাবাদী (তাহলে এটা মারাত্মক খিয়ানত)।
মুহাম্মদ ইবনু সিরিন বহ, বলেন, 'কথার ময়দান অনেক প্রশস্ত, চালাক ব্যক্তির মিথ্যা কথা বলার প্রয়োজন পড়ে না।'
ইমাম ইবরাহিম নাখয়ি বহ, বৈধ তারিজের একটি উদাহরণ বলেছেন, যখন কারও কাছে তোমার ব্যাপারে সংবাদ যাবে যে, তুমি তার ব্যাপারে কিছু বলেছ, তখন তুমি বলবে-
আমি এ বিষয়ে কিছু বলে থাকলে আল্লাহ তাআলা অবগত আছেন।
তাহলে শ্রোতা মনে করবে, তুমি তাকে কিছু বলোনি। অথচ তুমি উপরিউক্ত কথা বলে উদ্দেশ্য নিয়েছ যে, আমি যা বলেছি সেটা আল্লাহ তাআলা জানেন (অর্থাৎ, শব্দটি আরবিতে 'না' বোঝানোর জন্য আসে, আবার অনির্দিষ্টভাবে ব্যাপকতাও বুঝে আসে। তাহলে শ্রোতা নেতিবাচক অর্থ নিবে, আর তুমি অনির্দিষ্ট ব্যাপকতা বোঝাচ্ছ)।
ইমাম ইবরাহিম নাখায় রহ, আরও বলেন, তুমি নিজের ছেলেকে এভাবে বলবে না যে, আমি তোমার জন্য মিষ্টি ক্রয় করব, বরং বলবে যে, আমি যদি তোমার জন্য মিষ্টি ক্রয় করি, তাহলে তুমি কী মনে করো? ইমাম নাখয়িকে জনৈক ব্যক্তি তালাশ করলে তিনি দাসীকে বললেন, তুমি তাকে বলে দাও যে, তাকে মসজিদে গিয়ে খোঁজ করেন। আরেকজন বলেন, আমার পিতা একটু আগে বেরিয়ে গেছেন।
ইমাম শাবি রহ, রেখা টেনে দাসীকে বলতেন, তুমি এখানে আঙুল রেখে বলো যে, তিনি এখানে নেই। এমনিভাবে কোনো বুযুর্গকে কেউ খানার দাওয়াত দিলে বলতেন, আমি এক নিয়তে আছি। তিনি যে রোজাদার তাকে এ কথা বোঝাতেন, মূলত এখানে তার খানা পরিত্যাগের নিয়ত থাকত। এমনিভাবে তুমি কি তাকে দেখেছ? এর জবাবে বলবে যে, আমি তাকে দেখিনি, অর্থাৎ আমি তার শ্বাসযন্ত্র দেখিনি। এ ছাড়াও এর অগণিত উদাহরণ পাওয়া যায়।
কোনো লোক যদি উপরিউক্ত পন্থায় কসম করে এবং কসমে তাওরিয়া করে, তাহলে সে কসম ভঙ্গকারী হবে না। চাই সে আল্লাহর নামে কসম করুক অথবা তালাক ইত্যাদিতে কসম করুক। এক্ষেত্রে তালাক ইত্যাদি সংঘটিত হবে না। এটা হলো তখন যখন মামলায় বিচারক কসম না করায়। কারণ, বিচারক আল্লাহর নামে কসম করালে তার নিয়তই বিবেচ্য হবে। আর যদি তালাকের ব্যাপারে কসম করায় তাহলে কসমকারীর নিয়ত বিবেচ্য হবে। কারণ, বিচারকের জন্য তাকে তালাকের কসম করানো বৈধ নয়, এক্ষেত্রে সে অন্যান্য মানুষের মতোই। আল্লাহ তাআলাই ভালো জানেন।
ইমাম গাজালি রহ, বলেন, আধিক্য বোঝানোর জন্য সাধারণত মানুষ বলে থাকে যে, তোমাকে ১০০ বার বলেছি, তোমাকে ১০০ বার ডেকেছি। এটাও হারাম এবং মিথ্যার অন্তর্ভুক্ত। এখানে মূলত সংখ্যা উদ্দেশ্য হয় না, আধিক্য উদ্দেশ্য হয়। সুতরাং যদি মাত্র একবারই ডেকে থাকে তাহলে এভাবে বলাটা মিথ্যে হবে। আর যদি এত বেশি বার ডাকে যে, সাধারণত মানুষ এতবার ডাকে না, তাহলে সে গুনাহগার হবে না। যদিও সংখ্যা ১০০ পর্যন্ত না পৌঁছায়। এ দুটোর মাঝে বিভিন্ন স্তর রয়েছে, যা অতিক্রমকারী অতিক্রম করে থাকে।
লেখক (ইমাম নববি রহ.) বলেন, আধিক্য বোঝানোর জন্য এ রকম বলার বৈধতা এবং এটা মিথ্যা না হওয়ার দলিল-
হযরত ফাতিমা বিনতু কায়েস রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন-
আবু জাহম। সে তো কাঁধ থেকে লাঠি নামায় না। আর মুআবিয়ার তো কোনো ধন-সম্পদই নেই। অথচ সর্বজনবিদিত যে, মুআবিয়ার পরার জন্য কাপড় ছিল এবং আবু জাহম ঘুম ও অন্যান্য সময় লাঠি নামিয়ে রাখত।
কেউ মন্দ কথা বললে করণীয়
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন
যদি তুমি শয়তানের পক্ষ থেকে প্ররোচিত হও, তাহলে আল্লাহর আশ্রয় গ্রহণ করো।
[সুরা হা-মিম সাজদাহ, আয়াত ৩৬]
যারা তাকওয়া অবলম্বন করে, শয়তান যখন তাদের প্ররোচিত করে তখন তারা (আল্লাহকে) স্মরণ করে। ফলে তৎক্ষণাৎ তাদের চোখ খুলে যায়।
[সুরা আরাফ, আয়াত ২০১]
যারা কখনো কোনো অশ্লীল কাজ করে ফেললে কিংবা নিজেদের ওপর জুলুম করে ফেললে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং আপন পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে, আল্লাহ তাআলা ছাড়া আর কে আছে পাপ মোচনকারী। আর তারা জেনে-বুঝে নিজেদের কৃতকর্মের পুনরাবৃত্তি ঘটায় না। তাদের প্রতিদান হলো, তাদের পালনকর্তার ক্ষমা এবং এমন জান্নাতসমূহ, যাতে প্রস্রবণ প্রবাহিত। সেখানে তারা অনন্তকাল থাকবে। আর কতইনা চমৎকার সৎকর্মশীলদের প্রতিদান। [সুরা আল-ইমরান, আয়াত ১৩৫-১৩৬]
হযরত আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন-
যে ব্যক্তি কসম করতে গিয়ে বলে, লাত ও উজ্জার কসম, সে যেন লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু পাঠ করে নেয়। আর যে ব্যক্তি তার সাথীকে বলে, এদিকে এসো জুয়া খেলি, সে যেন দান-খয়রাত করে।
জেনে রাখা দরকার যে, কেউ হারাম কথা বললে কিংবা হারাম কাজ করলে সাথে সাথে তার জন্য তাওবা করা ওয়াজিব। আর তাওবার রুকন তিনটি-
এক: তাৎক্ষণিকভাবে পাপ থেকে বিরত হওয়া।
দুই: কৃতকর্মের ওপর অনুতপ্ত হওয়া।
তিন: ভবিষ্যতে কখনো এর পুনরাবৃত্তি না ঘটানোর দৃঢ় সংকল্প করা।
আর পাপের সাথে কোনো মানুষের হক জড়িত থাকলে এই তিনের সাথে আরেকটি জিনিস ওয়াজিব। তা হলো, এই অন্যায় (হক) মালিকের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া অথবা তার থেকে ক্ষমা চেয়ে নেওয়া। এর বিবরণ পূর্বে চলে গেছে। বিশেষ কোনো পাপ থেকে তাওবা করার সময় অন্যান্য সকল পাপ থেকেও তাওবা করা বাঞ্ছনীয়। তবে তাওবা বিশেষ কোনো পাপের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলেও তা সহিহ হবে। কোনো পাপ থেকে পূর্ববর্ণিত শর্তানুযায়ী তাওবার পর তাৎক্ষণিকভাবে আবারও এর পুনরাবৃত্তি ঘটালে দ্বিতীয়বার পাপিষ্ঠ হবে এবং এর থেকেও তাওবা করা ওয়াজিব হবে। পূর্বের তাওবা বাতিল হবে না। এটা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আকিদা বা মাজহাব, তবে উভয় মাসআলার ক্ষেত্রে মুতাজিলাদের মতবিরোধ রয়েছে।
যেসব শব্দ একদলের দৃষ্টিতে মাকরুহ, অথচ এগুলো মাকরুহ নয়
জেনে রাখতে হবে যে, এ অধ্যায় এজন্য আনা হয়েছে, যাতে বাতিল কথায় কেউ প্রতারিত না হয় এবং এগুলো বিশ্বাস না করে।
জেনে রাখা দরকার যে, শরিয়তের বিধান পাঁচটি-১. ওয়াজিব, ২. মুস্তাহাব, ৩ হারাম, ৪. মাকরুহ এবং ৫ মুবাহ। এগুলোর কোনোটাই শরয়ি দলিল ছাড়া প্রমাণ হয় না। আর শরিয়তের দলিলও প্রসিদ্ধ বিষয়। অতএব, যার পক্ষে দলিল থাকবে না, তার দিকে ভ্রুক্ষেপ করা হবে না এবং তা খণ্ডনেরও প্রয়োজন নেই। কারণ, সেটা যখন দলিল সমৃদ্ধ নয়, তাহলে খণ্ডনেরও কী প্রয়োজন? এতৎসত্ত্বেও উলামায়ে কিরাম এমন বিষয়ের খণ্ডনে দলিল উল্লেখের চেষ্টা করেছেন। এখানে আমাদের এই ভূমিকা উল্লেখের কারণ হলো, আমি যা উল্লেখ করব-অমুক একে মাকরুহ বলেছেন। অতঃপর বলব যে, মূলত এটা মাকরুহ নয় অথবা তার এ কথা বাতিল ইত্যাদি। তখন যাতে এসব বাতিল করার জন্য দলিলের প্রয়োজন না পড়ে। আর যদি কোথাও দলিল উল্লেখ করি, তাহলে সেটা হবে অতিরিক্ত। আমার এ অধ্যায় নিয়ে আসার উদ্দেশ্য হলো, শুদ্ধ ও অশুদ্ধের মাঝে পার্থক্য করা। যাতে করে এই বাতিল উক্তিকারী ব্যক্তির মর্যাদার কারণে কেউ প্রতারিত না হয়।
জেনে রাখা দরকার যে, আমি এসব মাকরুহ বলা ব্যক্তিদের নাম উল্লেখ করব না, যাতে তাদের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ না হয় এবং তাদের প্রতি মানুষের কুধারণা সৃষ্টি না হয়। এর দ্বারা তাদের দুর্নাম করাও উদ্দেশ্য নয়। আসলে তাদের থেকে বর্ণিত বাতিল উক্তি সম্পর্কে মানুষকে সতর্ক করাই একমাত্র উদ্দেশ্য। চাই এগুলো তাদের থেকে সহিহ সনদে বর্ণিত হোক অথবা না হোক। সহিহ হলেও তাদের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হবে না, যেমন অতীত হয়েছে। তবে কখনো আমি ভালো নিয়তে কিছু সংযোজনও করে থাকি।
ইমাম আবু জাফর নাহহাস রহ. তার কিতাব 'শরহু আসমায়িল্লাহি সুবহানাহু ওয়া তাআলা'-তে কিছু উলামায়ে কিরাম থেকে নকল করেছেন যে, তারা এ কথা বলতে অপছন্দ করতেন-
আল্লাহ পাক তোমাকে দান করেছেন)। তারা বলতেন, কেননা দানকারী প্রতিদানের আকাঙ্ক্ষা রাখে।
আমি (ইমাম নববি রহ.) বলি যে, এই হুকুম সুস্পষ্ট ভুল ও নিকৃষ্ট মূর্খতা। আর এই যুক্তি প্রদান করাও ভীষণ নিন্দনীয়।
হযরত উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সফরে নামায সংক্ষিপ্তকরণের ব্যাপারে বলেন-
এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে তোমাদের জন্য দানস্বরূপ, সুতরাং তার দান গ্রহণ করো।
হে আল্লাহ! আমাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দাও' বলা মাকরুহ নয়
ইমাম আবু জাফর নাহহাস রহ. পূর্বের বক্তা থেকে নকল করেছেন যে, তিনি
হে আল্লাহ! আমাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দাও) বলতে অপছন্দ করতেন। কেননা, তিনি সাওয়াবের প্রত্যাশী ছাড়া অন্য কাউকে মুক্তি দেন না।
আমি (ইমাম নববি রহ.) বলি যে, এই দাবি ও যুক্তি মারাত্মক ভুল ও শরিয়তের বিধান সম্পর্কে কঠিনতম মূর্খতা। আল্লাহ তাআলা কর্তৃক তার ইচ্ছানুযায়ী যদি সৃষ্টিকে ক্ষমা বিষয়ক সহিহ হাদিসগুলো অনুসন্ধান করি, তাহলে কিতাবের কলেবর অনেক বড় হয়ে যাবে।
হযরত আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন
যে ব্যক্তি কোনো গোলাম আজাদ করবে, আল্লাহ তাআলা তার প্রত্যেক অঙ্গের বদলে তার একটি অঙ্গ থেকে জাহান্নাম থেকে মুক্ত করে দিবেন।
হযরত আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন-
আল্লাহ তাআলা আরাফার দিন যত মানুষকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন, অন্য কোনো দিন এত মানুষকে মুক্তি দেন না।
আল্লাহর নামে এ রকম করো' বলা মাকরুহ নয়
কারও কারও বক্তব্য হলো, 'আল্লাহর নামের ওপর (নামে) এ রকম করো' বলা মাকরুহ। কারণ, আল্লাহর নাম সব কিছুর ওপরে। কাজি ইয়াজসহ অনেকে বলেছেন, এই বক্তব্য ভুল। সহিহ সনদে বর্ণিত আছে যে, প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কুরবানির সময় সাহাবায়ে কিরামকে বলেন-
তোমরা আল্লাহর নামের ওপর (বিসমিল্লাহ বলে) জবাই করো।
আল্লাহ আমাদেরকে তাঁর রহমতের নিবাসে একত্র করেছেন' বলা মাকরুহ নয়
ইমাম আবু জাফর নাহহাস রহ. ফকিহ ও আদিব আবু বকর মুহাম্মদ ইবনু ইয়াহিয়া থেকে নকল করেন যে, তিনি বলেছেন, এ রকম বলবে না যে, 'আল্লাহ তাআলা তাঁর রহমতের নিবাসে আমাদের একত্র করেছেন'। কারণ, আল্লাহর রহমত কোনো নিবাসের উর্ধ্বে। তিনি আরও বলেন, এও বলবে না যে, 'হে আল্লাহ! আপনার রহমতে আমাদের ওপর রহমত করুন।
আমি (ইমাম নববি রহ.) বলি যে, তার দাবিকৃত বাক্য দুটির কোনো দলিল আমাদের জানা নেই এবং এর কোনো দলিলও হয় না। কারণ, রহমতের নিবাস দ্বারা বক্তার উদ্দেশ্য হলো জান্নাত। পুরো বাক্যের অর্থ দাঁড়ায়-আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে জান্নাতে একত্র করেছেন, যা প্রশান্তিময় অবস্থান ও বসবাসের ঘর। সেখানে প্রবেশকারীরা আল্লাহর রহমতেই প্রবেশ করবে, যেই প্রবেশ করবে চিরদিন সেখানে বসবাস করবে। সে বিপদাপদ ও পঙ্কিলতামুক্ত থাকবে। আর এটা কেবল আল্লাহর রহমতেই অর্জন হবে। অতএব, সে যেন বলছে, আমাদের এমন জায়গায় একত্র করুন, যেখানে আমরা আপনার রহমত আহরণ করতে পারি।
হে আল্লাহ! আমাদেরকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিন' এবং 'হে আল্লাহ! আমাদের জন্য নবিজির সুপারিশ কবুল করুন' বলা মাকরুহ নয়
ইমাম আবু জাফর নাহহাস রহ. ঐ ফকিহ ও আদিব আবু বকর মুহাম্মদ ইবনু ইয়াহিয়া থেকে নকল করেন, তিনি বলতেন যে, এভাবে বলা যাবে না (হে আল্লাহ! আমাদেরকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিন)। এবং এও বলা যাবে না যে, হে আল্লাহ আমাদের জন্য প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুপারিশ কবুল করুন)। কারণ, সুপারিশ তো তার জন্যই করা হয়, যার জন্য জাহান্নাম অবধারিত হয়ে যায়।
আমি (ইমাম নববি রহ.) বলি যে, এটা গুরুতর অন্যায় ও সুস্পষ্ট মূর্খতা। যদি এই ভুলে মানুষ প্রতারিত হওয়ার আশঙ্কা না থাকত এবং তা লিখিত কিতাবাদিতে না থাকত তাহলে হয়তো আমি এটা নকল করার দুঃসাহস দেখাতাম না। অথচ অনেক সহিহ হাদিসে পরিপূর্ণ ঈমানদারকে উৎসাহ প্রদানে তাদের সাথে কৃত নববি সুপারিশের কথা এসেছে।
প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন-
যে ব্যক্তি মুআজ্জিনের উক্তির মতো আজানের জবাব দিবে, তার জন্য আমার সুপারিশ অবধারিত হয়ে যাবে।
ইমাম হাফিজ ফকিহ আবুল ফজল ইয়াজ রহ. কতই-না সুন্দর বলেছেন, সালাফে সালিহিন রাহিমাহুমুল্লাহ কর্তৃক প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুপারিশ কামনা করা এবং এর প্রতি তাদের আগ্রহের বিষয়টি সুপ্রসিদ্ধ বর্ণনা দ্বারা প্রমাণিত। তিনি আরও বলেন, অতএব, যারা একে অপছন্দ করেন এবং একে পাপিষ্ঠদের সাথে সংযুক্ত করেন, তাদের কথায় কর্ণপাত করা যাবে না। কারণ, সহিহ মুসলিম ইত্যাদির হাদিসে সুপারিশের মাধ্যমে কিছু লোকের বিনা হিসেবে জান্নাতে যাওয়া এবং কিছু লোকের জান্নাতে স্তর বৃদ্ধির কথা প্রমাণিত রয়েছে। তিনি আরও বলেন, প্রত্যেক বুদ্ধিমান লোকই নিজের শিথিলতার স্বীকারকারী, ক্ষমার মুখাপেক্ষী এবং ধ্বংসের আশঙ্কাকারী। অতএব, এমন কথার বক্তারও মাগফিরাত ও রহমতের প্রত্যাশা করা অনুচিত। কারণ, এগুলো পাপিষ্ঠদের জন্য। এগুলো সালাফ-খালাফের প্রসিদ্ধ দুআর খিলাফ।
আমি আমার রব রব্বে কারিমের ওপর ভরসা করেছি' বলা মাকরুহ নয়
ইমাম আবু জাফর নাহহাস রহ. ঐ আবু বকর থেকে নকল করেন, তিনি বলতেন যে, তুমি এ রকম বলবে না- আমি আমার রব রাব্বে কারিমের ওপর ভরসা করেছি), বরং বলবে-আমি আমার রাব্বে কারিমের ওপর ভরসা করেছি)।
আমি (ইমাম নববি রহ.) বলি যে, তার কথার কোনো ভিত্তি নেই।
বাইতুল্লাহর তওয়াফকে শাওত বা দাওর বলা মাকরুহ নয়
একদল উলামায়ে কিরাম থেকে কথিত আছে যে, তারা বাইতুল্লাহর তাওয়াফকে শাওত (রাউন্ড) বা দাওর (চক্র) বলতে অপছন্দ করেন। তারা বলেন, বরং প্রথমবারকে বলা হবে তাওফাহ, দ্বিতীয়বারকে তাওফাতাইন, তৃতীয়বারকে তাওফাত এবং সপ্তমবারকে তাওয়াফ।
আমি (ইমাম নববি রহ.) বলি যে, আমার জানা মতে তাদের এ কথার কোনো ভিত্তি নেই। এগুলো জাহিলি যুগের শব্দ হওয়ার কারণে হয়তোবা তারা অপছন্দ করেছেন, তবে এতে কোনো অপছন্দনীয়তা নেই। এটাই সর্বাধিক সহিহ।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন-
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের তিন শাওতে (চক্রে) দুলে দুলে চলতে নির্দেশ দিয়েছেন। কেবল তাদের প্রতি করুণা হিসেবে সকল শাওতে (চক্র) দুলে দুলে চলতে নির্দেশ দেননি। [১]
আমরা রমমজানের রোজা রেখেছি' এবং 'রমজান এসেছে' বলার হুকুম
আমরা রমজানের রোজা রেখেছি এবং রমজান এসেছে ইত্যাদি দ্বারা রমজান মাস উদ্দেশ্য নিলে এটা মাকরুহ হওয়ার ব্যাপারে মতবিরোধ রয়েছে। পূর্বসূরি একদল আলিমের মতে, মাস বৃদ্ধি করা ছাড়া কেবল রমজান বলা মাকরুহ। এ বিষয়ে হাসান বাসরি ও মুজাহিদ রহ. থেকে বর্ণিত। ইমাম বাইহাকি রহ. বলেন, তাদের উভয় পর্যন্ত সনদ দুর্বল। আর আমাদের উলামাদের মাযহাব হলো, এ রকম বলা মাকরুহ যে-'রমজান এসেছে, রমজান প্রবেশ করেছে বা রমজান উপস্থিত হয়েছে' অথবা এ জাতীয় কিছু, যাতে এগুলো দ্বারা মাস লক্ষ হওয়ার কোনো আলামত থাকে না। তবে সাথে মাস বোঝায় এমন কোনো আলামত থাকলে মাকরুহ হবে না। যেমন 'আমি রমজানের রোজা রেখেছি, আমি রমজানের রাতে কিয়াম করেছি, রমজানের রোজা ফরজ এবং বরকতময় মাস রমজান হাজির হয়েছে অথবা এ জাতীয় কোনো বাক্য। আমাদের উলামায়ে কিরামগণ এমনটাই বলেছেন।
ইমাম কাজি আবুল হাসান মাওয়ারদি তার কিতাব আল-হাবি-তে। এবং আবু নাসর ইবনু সাব্বাগ তার আশ-শামিল কিতাবে আমাদের উলামায়ে কিরাম থেকে এমনটাই নকল করেছেন। তাদের ছাড়া অন্যান্য উলামায়ে কিরামও আমাদের উলামায়ে কিরাম থেকে মুক্তভাবে নকল করেছেন। তারা নিন্মোক্ত হাদিস দ্বারা দলিল প্রদান করেছেন-
হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন-
তোমরা রমজান বলো না। কারণ, রমজান আল্লাহর নামসমূহের এক নাম। তবে তোমরা 'রমজান মাস' বলো।[১৯]
এই হাদিসটি দুর্বল। স্বয়ং ইমাম বাইহাকি রহ. একে দুর্বল আখ্যায়িত করেছেন। এব দুর্বলতা সুস্পষ্ট। কারণ, আল্লাহর নামসমূহের ওপর অনেকেই কিতাবাদি লিখেছেন, কিন্তু কেউই রমজান নামটি উল্লেখ করেননি।
আমি (ইমাম নববি রহ.) বলি, সহিহ মত মনে হয় তাই (আল্লাহ তাআলাই ভালো জানেন) যা ইমাম বুখারি রহ. (তার সহিহ বুখারিতে) এবং অন্যান্য মুহাক্কিক উলামায়ে কিরাম বলেছেন, যে যেভাবেই বলে বলুক না কেন, এতে সার্বিকভাবে কোনো অপছন্দনীয়তা নেই। কারণ, দলিল ছাড়া মাকরুহ সাব্যস্ত হয় না, আর এটা মাকরুহ হওয়ার বিষয়ে কোনো দলিল নেই; বরং এর বিপরীতে হাদিসে এ বিষয়ের বৈধতা প্রমাণিত। এ ব্যাপারে সহিহ বুখারি ও সহিহ মুসলিম ইত্যাদিতে অগণিত হাদিস বিদ্যমান। আমরা সেগুলো একত্র করতে গেলে শতাধিক হয়ে যাবে, তবে মাত্র একটি হাদিস দ্বারা লক্ষ্যে পৌঁছে যাওয়া যায়।
হযরত আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন-
রমজান আগমন করলে জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেওয়া হয়। আর শয়তানকে শিকলবন্দি করা হয়। (১০০।
সহিহাইনের কোনো বর্ণনায় এই হাদিসে আছে, 'যখন রমজান প্রবেশ করে'। [১০১] সহিহ মুসলিমের এক বর্ণনায় আছে 'যখন রমজান হয়'।[১০২]
সহিহ হাদিসে আছে-'তোমরা রমজানের অগ্রবর্তী হয়ো না'।[১০০]
সহিহ হাদিসে বর্ণিত হয়েছে ইসলামের মূলভিত্তি পাঁচটি জিনিসের ওপর। তন্মধ্যে রয়েছে-'রমজানের রোজা'। [১০৪] এ রকম আরও অনেক প্রসিদ্ধ সহিহ হাদিস পাওয়া যায়।
সুরা বাকারা' ইত্যাদি বলা মাকরুহ নয়
পূর্ববর্তীদের কারও কারও থেকে কথিত আছে যে, তারা সুবা বাকারা, সুরা নিসা, সুরা দুখান, সুরা আনকাবুত, সুরা রুম, সুরা আহযাব ইত্যাদি বলাকে অপছন্দ করতেন। তারা বলতেন, বরং এভাবে বলবে, ঐ সুরা যাতে বাকারা আলোচিত হয়েছে, ঐ সুরা যাতে নিসা আলোচিত হয়েছে ইত্যাদি।
আমি (ইমাম নববি রহ.) বলি যে, এ কথা নিতান্ত ভুল ও সুন্নাহর বিপরীত। হাদিসে অসংখ্য জায়গায় এ রকম ব্যবহার বিদ্যমান।
হযরত আবু মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন-
যে ব্যক্তি রাতে সুরা বাকারার শেষ দুই আয়াত পাঠ করবে, এটা তার নিরাপত্তার জন্য যথেষ্ট হয়ে যাবে।
এ রকম আরও অগণিত হাদিসে নববি রয়েছে।
আল্লাহ তাআলা তাঁর কিতাবে বলেন' বলা মাকরুহ নয়
হযরত মুতাররিফ রহ. থেকে বর্ণিত আছে, তিনি এ রকম বলতে অপছন্দ করতেন যে, 'আল্লাহ তাআলা তাঁর কিতাবে বলেছেন', বরং এভাবে বলবে যে, আল্লাহ তাআলা বলেন। এটা বর্তমান ও ভবিষ্যৎ কালবাচক ক্রিয়া হওয়ার কারণে হয়তোবা তিনি অপছন্দ করেছেন। অথচ আল্লাহর বাণী হচ্ছে তার কথা বা কালাম, যা কাদিম (অবিনশ্বর)।
আমি (ইমাম নববি রহ.) বলি, এ বক্তব্য গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ, বহু সহিহ হাদিসে বিভিন্নভাবে এর ব্যবহার পাওয়া যায়। আমি শরহে সহিহ মুসলিমে ১০৬] এবং আদাবুল কুররাতে
এ বিষয়ে সতর্ক করেছি। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
আর আল্লাহ পাক সত্য বলেন।
[সুরা আহযাব, আয়াত ৪]
হযরত আবু জর গিফারি রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন-
আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লা বলেন, যে ব্যক্তি একটি নেককাজ করবে তার জন্য এব সমপরিমাণ দশটি সাওয়াব থাকবে।
হযরত আবু তালহা রাদিয়াল্লাহু আনহু প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলেন, হে আল্লাহর রাসুল! নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা বলেছেন-
তোমরা ততক্ষণ পর্যন্ত পরিপূর্ণ কল্যাণ অর্জন করতে পারবে না, যতক্ষণ নিজের প্রিয় বস্তু আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় না করবে।
এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url