অলসতার চিকিৎসা হলো তৎপরতা

আজ এই আর্টিকেলটিতে অলসতার চিকিৎসা হলো তৎপরতা সর্ম্পকে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।


ভূমিকা

আমি গত কয়েকদিন রেঙ্গুন এবং বার্মার আরও কয়েকটি শহরে সফরে ছিলাম। লাগাতার ১০-১২ দিন সফরে অতিবাহিত হয়েছে। [সুরা আনকাবুত, আয়াত ৬৯] বিরতিহীনভাবে বয়ানের ধারাবাহিকতা চলছিল। কোনো কোনো সময় একেক দিন ৪-৫ বার বয়ান হয়েছে। এ কারণে আওয়াজ বসে গিয়েছে এবং তবিয়তে ক্লান্তি চলে এসেছে। ঘটনাক্রমে আগামীকাল দ্বিতীয়বার মক্কা মদিনার সফর চলে এসেছে। এ কারণে আজ তবিয়তে অলসতা চলে এসেছিল এবং এই খেয়াল হচ্ছিল যে, যখন পূর্ববর্তী কয়েক জুমআ ছুটে গিয়েছে, তখন আরও এক জুমআ ছুটলে কি হবে? কিন্তু আমার শাইখ ডাক্তার সাহেবের একটি কথা স্মবণ হয়ে গিয়েছে। তা হলো এই যে, একবার তিনি বলেছেন, যখন কোনো মামুল পুরো করতে অলসতা চলে আসে, তখন সেখানেই মানুষের পরীক্ষা শুরু হয়ে যায়। এখন একটা অবস্থা তো হলো এই অলসতার সামনে ঢাল সমর্পণ করে দিবে এবং নফসের কথা মেনে নিবে। তাহলে এর ফল এই দাঁড়াবে যে, আজকে একটা মানুলে হাতিয়ার সমর্পণ করলে কাল অন্য আরেকটা মামুলে হাতিয়ার সমর্পণ করতে বাধ্য করবে। এরপরে আস্তে আস্তে অলসতার অনুগত হয়ে যাবে এবং এর অভ্যাসে পরিণত হয়ে যাবে। আর দ্বিতীয় অবস্থা হলো যে, মানুষ সাহসের সঙ্গে এই অলসতার মোকাবিলা করে মামুলকে অব্যাহত রাখবে। মেহনত এবং পরিশ্রম করে জোরপূর্বক এই কাজ করবে। তাহলে এই মেহনত ও কষ্ট এবং মোকাবিলা করার বরকতে আল্লাহ তাআলা ভবিষ্যতেও মানুলকে পুরো করার তাওফিক দান করবেন।

আরো পড়ুন: টাইফয়েড টিকাদান ক্যাম্পেইন ২০২৫

তাসাওউফের সারমর্ম দুটি বিষয়

এমন জায়গায় আমাদের হজরতওয়ালা থানভি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি একটা মালফুজ শোনাতেন। বাস্তবিক পক্ষে এই মালফুজ মনে রাখা দরকার ববং অন্তরে খোদাই করে রাখার যোগ্য। হজরত থানভি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলতেন যে, 'ওই সামান্য বিষয় যা তাসাওউফের সারমর্ম। তা হলো, যে সময় কোনো ইবাদাত আদায়ের ক্ষেত্রে অলসতা শুরু হবে, তখন ওই অলসতার মোকাবিলা করে ইবাদাত করবে এবং যে সময় কোনো গুনাহের ইচ্ছা জাগ্রত হবে, তখন ওই গুনাহের ইচ্ছার বিরোধিতা করে সে গুনাহ থেকে বেঁচে থাকবে। যখন এই বিষয়টা অর্জন হয়ে যাবে, তখন এরপরে আর অন্য কিছুর প্রয়োজন হবে না। এর মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার সঙ্গে সম্পর্ক সৃষ্টি হবে। এর মাধ্যমেই সম্পর্ক মজবুত হবে এবং এর মাধ্যমেই সম্পর্কের মধ্যে উন্নতি হবে।'

মোটকথা, অলসতা দূর করার শুধুমাত্র একটাই রাস্তা অর্থাৎ, সাহসিকতার সঙ্গে অলসতার মোকাবিলা করা। মানুষ এটা মনে করে যে, শায়খ কোনো ওষুধ শরবত বানিয়ে পান করালে সমস্ত অলসতা দূর হয়ে যাবে এবং সব কাজ ঠিক হয়ে যাবে। স্মরণ রাখো যে, অলসতার মোকাবিলা সাহসিকতার সঙ্গে করতে হয়। এর অন্য কোনো চিকিৎসা নেই।

নফসকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে তার দ্বারা কাজ নাও

আমাদের হজরত ডাক্তার আব্দুল হাই সাহেব রহমতুল্লাহি আলাইহি বলতেন যে, নফসকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে তার দ্বারা কাজ নাও। এরপরে নিজের একটা ঘটনা শুনিয়েছেন যে, একদিন যখন তাহাজ্জুদের সময় ঘুম ভেঙে গিয়েছে তখন তবিয়তে অনেক অলসতা ও ক্লান্তি এসেছিল। অন্তরে খেয়াল এসেছে যে, আজকে তো তবিয়ত পুরোপুরি ঠিক নেই। দুর্বলতা ও ক্লান্তি আছে এবং বয়সও অনেক বেশি হয়েছে এবং তাহাজ্জুদের নামাজ ফরজ ওয়াজিব নয়, অতএব, ঘুমিয়ে থাকো। আজ যদি তাহাজ্জুদের নামাজ না পড়ো তাহলে কি ক্ষতি হবে" হজরতওয়ালা বলেন যে, আমি বললাম কথা তো ঠিক আছে যে, তাহাজ্জুদের নামাজ ফরজও নয়, ওয়াজিবও নয় এবং অন্যদিকে তবিয়তও ভালো নেই। কিন্তু এই সময় তো আল্লাহ তাআলার দরবারে কবুল হওয়ার সময়। হাদিস শরিফে এসেছে যে, যখন বাতের এক তৃতীয়াংশ অতিবাহিত হয়ে যায়, তখন আল্লাহ তাআলার বিশেষ রহমত জমিনবাসীর অভিমুখী হয় এবং আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে ঘোষণাকারী ডাকতে থাকেন যে, কোনো ক্ষমা প্রত্যাশী আছে। তাকে ক্ষমা করে দেওয়া হবে।

অতএব, এরকম বরকতময় সময় এমনিতেই অতিবাহিত করা ঠিক নয়। অতঃপর নিজের নফসকে সম্বোধন করে বললেন যে, আচ্ছা এমন করো যে, নামাজ পড়ো না। কিন্তু বিছানায় বসে যাও এবং বসে সামান্য দুআ করো। দুআ করার পরে আবার ঘুমিয়ে যেয়ো। সুতরাং আমি তৎক্ষণাৎ উঠে বসে গেলাম এবং দুআ করা শুরু করলাম। এরপরে দুআ করতে করতে নফসকে বললাম যে, মিয়া। যখন তুমি উঠে বসে গিয়েছ, তখন তোমার ঘুম তো চলে গিয়েছে এখন এমন করো যে, গোসলখানা পর্যন্ত চলে যাও এবং ইস্তিঞ্জা ইত্যাদি থেকে অবসর হয়ে স্বস্তির সঙ্গে শুয়ে পড়িও। সুতরাং আমি গোসলখানায় পৌঁছে গেলাম এবং ইস্তিঞ্জা ইত্যাদি থেকে ফারেগ হলাম। তখন চিন্তা করলাম যে, ওজুও করে ফেলি। এ কারণে যে, অজু করে দুআ করলে, কবুল হওয়ার আশা বেশি থাকে। সুতরাং অজু করে নিলাম। এরপরে ফিরে এসে বিছানায় বসে গেলাম এবং দুআ শুরু করলাম। এরপরে নফসকে বললাম যে, বিছানায় বসে দুআ হচ্ছে। দুআ করার তোমার যে জায়গা অর্থাৎ জায়নামাজ, ওখানে গিয়ে দুআ করো। এটা বলে নফসকে জায়নামাজ পর্যন্ত টেনে নিয়ে গেলাম। আর যখন জায়নামাজে পৌঁছলাম, তখন তাড়াতাড়ি দুই রাকাত তাহাজ্জুদের নিয়তে নামাজ পড়ে ফেললাম। এরপরে বললেন যে, এভাবে নফসকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে কাজ করতে হয়। যেভাবে এই নফস তোমাদের সঙ্গে নেক কাজে টালবাহানা করে, অনুরূপভাবে তোমরাও তার সঙ্গে এরকম আচরণ করো এবং তাকে টেনে নিয়ে যাও। ইনশাআল্লাহ, এর বরকতে আল্লাহ তাআলা এই আমলের তাওফিক দান করবেন।

যদি রাষ্ট্রপতির পক্ষ থেকে ডাক আসে

আমাদের হজরত ডাক্তার সাহেব রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলতেন যে, যদি তুমি নিজের এই মামুল বানিয়ে রাখো যে, অমুক সময় আমি তিলাওয়াত করব অথবা অমুক সময় নফল নামাজ পড়ব। কিন্তু যখন ওই সময় এসেছে, তখন অলসতা আসছে এবং উঠতে মন চাচ্ছে না। তাহলে এমন সময় নিজের নফসকে সামান্য তরবিয়ত করো এবং এই নফসকে বলো যে, এই সময় তো তোমার অলসতা আসছে এবং বিছানা থেকে উঠতে মন চাচ্ছে না। কিন্তু এটা বলো যে, যদি এই সময় রাষ্ট্রপতির পক্ষ থেকে ডাক আসতো যে, 'আমি তোমাকে অনেক বড় পুরস্কার অথবা অনেক বড় দায়িত্ব দিতে চাচ্ছি।' এজন্য তুমি এই সময় আমার নিকট এসে যাও। ওই সময়ও কি তুমি অলসতায় পড়ে থাকবে? তুমি কি বার্তা নিয়ে আসা ব্যক্তিকে এই উত্তর দিবে যে, আমি এই সময় আসতে পারব না। কেননা এই সময় আমার ঘুম আসছে। যে ব্যক্তির মধ্যে সামান্যতম জ্ঞানও আছে, বাষ্ট্রপতির এই পয়গাম শুনে তার সমস্ত অলসতা, ক্লান্তি এবং ঘুম দূর হয়ে যাবে এবং খুশি মনে তৎক্ষণাৎ পুরস্কার অর্জনের জন্য দৌড়াতে থাকবে। যদি এই সময় পুরস্কার অর্জনের জন্য দৌড়াতে থাকে, তাহলে এর দ্বারা বুঝা যায় যে, অপারগতা ছিল না। যদি বাস্তবিক পক্ষে অপারগতা থাকত, তাহলে রাষ্ট্রপতির পুরস্কারের কথা শোনার পরেও হাত না। বরং বিছানায় শুয়ে থাকত। এরপরে এটা চিন্তা করো যে, একজন দায়িত্বশীল এবং রাষ্ট্রপতি, যিনি একেবারে অক্ষম, সর্বোচ্চ পর্যায়ের অক্ষম। তিনি যদি তোমাকে পুরস্কার অথবা দায়িত্বের জন্য ডাকেন, তাহলে তোমরা তার জন্য এত দৌড়াতে পারো। কিন্তু যিনি আহকামুল-হাকিমিন, যার কবজা ও কুদরতে সমস্ত কায়েনাত। যিনি একমাত্র দাতা এবং ছিনিয়ে নেওয়ার একচ্ছত্র মালিক। তাঁর পক্ষ থেকে ডাক আসছে, তখন তাঁব দরবারে উপস্থিত হওয়ার ক্ষেত্রে অলসতা করছ? এই বিষয়ের কল্পনা করার দ্বারা ইনশাআল্লাহ এই কাজের সাহস হয়ে যাবে এবং অলসতা দূর হয়ে যাবে।

আরো পড়ুন: অন্তরের পবিত্রতা এবং তার প্রতিক্রিয়াসমূহ

আজকের কাজ কালকের জন্য রেখে দিয়ো না

অনেক সময় এমন হয় যে, অন্তরে একটা নেক কাজের খেয়াল সৃষ্টি হয়েছে যে, এই নেক কাজ করা উচিত। কিন্তু মানুষের নফস এইভাবে ভুলিয়ে দেয় যে, এই কাজ তো ভালো। অতএব, কাল থেকে এই কাজ শুরু করবে। স্মরণ রাখো! এটা নফসের ধোঁকাবাজি। এ কারণে যে, ওই কাল আর আসবে না। যেই কাজ করার প্রয়োজন, তা আজই করো। বরং এখনই শুরু করে দাও। কি ভরসা আছে যে, কাল আসবে? কোনো জানা নেই যে, কালকে এই সময় পাওয়া যাবে? কি নিশ্চয়তা আছে যে, কালকে এই আগ্রহ থাকবে? কি ভরসা আছে যে, কালকে অবস্থা স্বাভাবিক থাকবে" কি নিশ্চয়তা আছে যে, কালকে জীবিত থাকবে? এজন্য কুরআনুল কারিমে ইরশাদ হয়েছে যে-

অর্থাৎ, স্বীয় পরওয়ারদিগারের ক্ষমার দিকে দ্রুত দৌড়াও। দেরি করো না। ওই জান্নাতের দিকে দৌড়াও, যার প্রশস্ততা আসমান ও জমিনের সমপরিমাণ। [সুরা আল ইমরান, আয়াত ১৩৩]

মোটকথা, এটা আরজ করেছিলাম যে, আজ আমার অলসতা হয়েছিল, কিন্তু আমার শায়খের কথাটি মনে এসে গেল। যার কারণে আসার সাহস হলো এবং চলে এলাম।

নিজের ফায়দার জন্য উপস্থিত হই

দ্বিতীয়ত, এখানে মূলত আমি নিজের ফায়দার জন্য উপস্থিত হয়ে থাকি। আমি তো এটা মনে করি যে, আল্লাহ তাআলার নেক বান্দারা, নেক তলব নিয়ে দ্বীনের কথাবার্তা শোনার জন্য এখানে একত্রিত হয়। আমারও তাদের বরকত অর্জন হয়ে যায়। বিষয়টি নৃসত এই যে, যখন আল্লাহ তাআলার বান্দারা দ্বীনের জন্য কোনো জায়গায় একত্রিত হয়, তখন পরস্পরের একজন আরেকজনের ওপর বরকতের বারিধারা বর্ষণ হতে থাকে। এ কারণে আমি সর্বদা এই নিয়তে আসি যে. নেক লোকদের বরকত অর্জন করব।

জীবনের মুহূর্তগুলো কি কাজের জন্য

তৃতীয়ত, হজবত থানভি রাহমাতুল্লাহি আলাইহির একটা কথা মনে পড়ে গেল। এ বিষয়টাও আমি হজরতওয়ালার থেকেই শুনেছি। তিনি বলতেন যে, যখন হজরতওয়ালা মৃত্যু রোগে পতিত হয়ে শয্যাশায়ী হয়ে গেলেন এবং ডাক্তারগণ তাঁকে সাক্ষাৎ এবং কথাবার্তা বলতে নিষেধ করেছিলেন। একদিন তিনি চক্ষু বন্ধ করে বিছানার ওপর শুয়ে রইলেন। শুয়ে শুয়ে হঠাৎ চোখ খুলে ফেললেন এবং বললেন যে, মৌলভী শফি সাহেব কোথায়? তাকে ডেকে আনো। মৌলভী মুহাম্মদ শফি সাহেব দ্বারা উদ্দেশ্য আমার সম্মানিত পিতা। হজরতওয়ালা আমার সম্মানিত পিতাকে 'আহকামুল কুরআন' আরবি ভাষায় লেখার কাজে নিয়োজিত রেখেছিলেন। সুতরাং যখন আমার সম্মানিত পিতাজি আগমন করলেন, তখন তাঁকে বললেন যে, আপনি আহকামুল কুরআন লিখছেন। আমার এখনই খেয়াল এলো যে, কুরআনুল কারিমের অমুক আয়াত থেকে অনুক মাসআলা বের হয়। এই মাসআলা আমি এর পূর্বে কোথাও দেখিনি। যখন আপনি এই আয়াতের কাছে পৌঁছবেন, তখন এই মাসয়ালাও লিখে নিয়েন। এটা বলে অতঃপর চক্ষু বন্ধ করে শুয়ে রইলেন। এখন দেখুন যে, মৃত্যুর রোগে শয্যাশায়ী হয়েছেন কিন্তু অন্তর ও মস্তিষ্কে কুরআনুল কারিমের আয়াত এবং তার তাফসির ঘুরপাক খাচ্ছে। এর কিছুক্ষণ পর আবার চোখ খুললেন এবং বললেন যে, অমুক ব্যক্তিকে ডাকো। যখন ওই ব্যক্তি এসে গেল, তখন তার সম্পর্কে কিছু কথা বলে দিলেন। যখন বারবার তিনি এমন করছেন, তখন মাওলানা সাব্বির আলি সাহেব, যিনি হজরতের খানকার নাজিম ছিলেন এবং হজরতওয়ালার সঙ্গে বে-তাকাল্লুফ ছিলেন। তিনি বললেন যে, হজরত। ডাক্তারগণ এবং হাকিমগণ তো কথাবার্তা বলতে নিষেধ করে দিয়েছেন, কিন্তু আপনি বারবার লোকদেবকে ডেকে তাদের সঙ্গে কথা বলছেন। আল্লাহ তাআলার জন্য আপনি আমাদের ওপর দয়া করুন। তার উত্তরে হজরতওয়ালা বললেন যে, তুমি তো সঠিক কথা বলেছ। কিন্তু আমি তো এটা চিন্তা করি যে, জীবনের ওই মুহূর্তগুলো কোনো কাজের জন্য আর কারও খেদমতের মধ্যে ব্যয় হবে না? যদি কারও খেদমতে এই জীবন অতিবাহিত হয়ে যায়, তাহলে এটা আল্লাহ তাআলার নিয়ামত।

দুনিয়ার পদ ও পজিশন

এই খাদেমিয্যাত বড় আশশ্চর্যজনক। আল্লাহ তাআলা স্বীয় অনুগ্রহে এটা আমাদের অন্তরে সৃষ্টি করে দেন। প্রত্যেকের সেবক হও। নিজের মধ্যে খেদমতের জজবা সৃষ্টি করো। হজরত ডাক্তার সাহেব বাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলতেন যে দুনিয়ার সমস্ত পদের অবস্থা হলো যে, যদি মানুষ তা অর্জন করতে চায়, তাহলে এটা অর্জন করা তার আয়ত্তাধীন নয়। উদাহরণস্বরূপ, অন্তর চাইতেছে যে, আমি রাষ্ট্রপতি হবো, কিন্তু রাষ্ট্রপতি হওয়া তার আয়ত্তাধীন নয়। অন্তর চাইতেছে যে, আমি প্রধানমন্ত্রী হবো, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হওয়া তার অধীনে নয়। অথবা অন্তরে চাইতেছে যে, কোনো পার্টির মেম্বার হবো, এটাও তার নিয়ন্ত্রণে নয়। অথবা কোনো অফিসার হতে চাচ্ছে, চাকরি অর্জন করতে চাচ্ছে, এখন এর জন্য দরখাস্ত দাও, ইন্টারভিউ দাও এবং সমস্ত কষ্ট করার পরে যখন ওই পদ অর্জন হয়ে গিয়েছে, তখন মানুষ হিংসা করতে লাগে যে, এই ব্যক্তি আমাদের থেকে অগ্রসর হয়ে গিয়েছে আর আমরা পিছে রয়ে গিয়েছি। এখন তার বিরুদ্ধাচরণ করতে লাগে যে, কিভাবে এই পদ এবং দায়িত্ব তার থেকে ছিনিয়ে নেওয়া যায়” সুতরাং যত ভালোই প্রধানমন্ত্রী হোক না কেন? এখন শেষ হয়ে গিয়েছে। দায়িত্ব ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্রপতি হয়েছিল, শেষ হয়ে গিয়েছে। দুনিয়ার সমস্ত পদ ও পজিশনের একই অবস্থা যে, এটা অর্জন নিজের অধীনে নয়। আর যদি অর্জন হয়েও যায় তাহলে এর ওপর স্থির থাকা নিজের অধীনে নয়। এরপরে মানুষ এর ওপর হিংসাও করে। এরপর হজরতওয়ালা বলতেন যে, আমি তোমাদেরকে এমন একটা আলাদা পদের কথা বলছি, যা অর্জন করাও নিজের অধীনে আর যদি তোমরা ওই পদ অর্জন করো, তাহলে কোনো ব্যক্তি তোমাদের ওপর হিংসাও করবে না। কেউ তোমার সঙ্গে লড়াই করবে না এবং কেউ তোমাকে এ থেকে সরিয়ে দিবে না। তা হলো খেদমতের পদ। তুমি খাদেম হয়ে যাও। এই পদ নিজের অধীনে। এর জন্য আবেদনেরও প্রয়োজন নেই, ইন্টারভিউ দেওয়ার প্রয়োজন নেই, ইলেকশনের প্রয়োজনও নেই। যদি এই পদ অর্জন হয়ে যায়, তাহলে এর ওপর অন্য মানুষ হিংসাও করবে না। এ কারণে যে, এই ব্যক্তি তো খেদমত করছে। তখন অন্য ব্যক্তি এর ওপর কি হিংসা করবে? কোনো ব্যক্তি তোমাকে এই পদ থেকে সরিয়ে দিতে পারবে না। এ কারণে তিনি বলেছেন যে, খাদেম হয়ে যাও। নিজের পরিবারের খাদেম হয়ে যাও। ঘরের যে কাজ করবে, খেদমতের নিয়তে করো। নিজের স্ত্রীর খাদেম, নিজের বাচ্চার খাদেম, নিজের বন্ধুবান্ধবদের খাদেম এবং যাবা সাক্ষাৎ করতে আসবে তাদেরও খেদমত করো। আল্লাহ তাআলার মাখলুকের এবং আল্লাহ তাআলার নেক বান্দাদের খেদমত করো। যে কাজই করো খেদমতের নিয়তে করো। যদি ওয়াজ করো, সেটাও খেদমতের জন্য করো। যদি লেখালেখি করো, সেটাও খেদমতের জন্য করো। এই খাদেমের পদ অর্জন করো। এ কারণে যে, সমস্ত ঝগড়া মাখদুম হওয়ার মধ্যে হয়ে থাকে। এজন্য হজরতওয়ালা নিজের সম্পর্কে বলতেন যে, আমি তো নিজে নিজেকে খাদেম মনে করি। নিজের স্ত্রীরও খাদেম, নিজের বাচ্চারও খাদেম, নিজের মুরিদদেরও খাদেম, নিজের আত্মীয়-স্বজনদেরও খাদেম। এটা এমন পদ যাতে শয়তানি ওয়াসওয়াসাও কম হয়। এ কারণে যে, অহংকার, আত্মগৌরব, বড়াই ইত্যাদি ওই সমস্ত পদের মধ্যে সৃষ্টি হয়, যা দুনিয়াবি দৃষ্টিতে বড় মনে করা হয়।

এখন খাদেমের পদে কি বড়ত্ব আছে? এ কারণে শয়তানি ওয়াসওয়াসাও আসে না। যার ফলে এটা অর্জনের চেষ্টা করো।

আরো পড়ুন: মিথ্যার নিষিদ্ধতা ও তার প্রকারভেদ সর্ম্পকে বিস্তারিত আলোচনা

বুজুর্গদের খেদমতে উপস্থিত হওয়ার উপকারিতা

মোটকথা, আমি এটা বলছিলাম যে, আজকে তো অলসতা হচ্ছিল, কিন্তু আমার হজরতওয়ালার কথা স্মরণ হয়ে গেল যার ফলে সাহস হয়ে গেল। আল্লাহওয়ালাদের সঙ্গে সম্পর্ক কায়েম করার কারণে এমনই উপকার হয়। এখন মনে নেই যে, এই বিষয়টি হজরতওয়ালা কখন কোথায় বলেছেন? আমার পক্ষ থেকে তলব ছিল না, আগ্রহ ছিল না, এমনকি কোনো চেষ্টাও ছিল না। কিন্তু হজরতওয়ালা জোরপূর্বক কিছু কথা কানে ঢেলে দিয়েছেন। এখন ওই কথাগুলা আলহামদুলিল্লাহ সময়মতো স্মরণ হয়ে যায় এবং কাজে আসে।

ওই কথা তোমাদের হয়ে গিয়েছে, সময়মতো স্মরণ হয়ে যাবে

হজরত বলে বলতেন যে, মজলিসে যে কথাবার্তা হয় কিছু লোক এটা মনে করে যে, এই কথাকে মুখস্থ করে নেবো। কিন্তু এই কথা মুখস্থ হয় না। এরপরে নিজের ঘটনা শুনিয়েছেন যে, আমিও হজরত থানভি রাহমাতুল্লাহি আলাইহির মজলিসে যখন উপস্থিত হতাম, তখন দিল চাইত যে, হজরতওয়ালার কথাগুলোকে লিখে নেবো। কিছু লোক লিখত। আমি দ্রুত লিখতে পারতাম না। এই কারণে আমি লেখা ছাড়া বসে থাকতাম। একদিন আমি হজরতওয়ালা রাহমাতুল্লাহি আলাইহির কাছে আরজ করলাম যে, হজরত। আমার দিল চায় যে, মালফুজাত লিখব কিন্তু লিখতে পারি না এবং মনেও থাকে না, বরং ভুলে যাই। হজরত থানভি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি উত্তরে বললেন যে, লেখার প্রয়োজন কি? নিজে সাহেবে মালফুজ কেন হচ্ছ না? হজরতওয়ালা বললেন যে, আমি তো ঘাবড়ে গেলাম যে, আমি কিভাবে সাহেবে মালফুজ হতে পারব? এরপরে হজরত রহমতুল্লাহি আলাইহি বললেন যে, কথা মূলত এই যে, যে বিষয়টি হক হয় এবং সঠিক বুঝশক্তির ওপর এর ভিত্তি হয়, সঠিক চিন্তা-ভাবনার ওপর ভিত্তি হয়, যখন এরকম কথা তোমার কানে গিয়ে পড়বে এবং তোমার অন্তর এটাকে গ্রহণ করে নিবে, তখন ওই বিষয়টি তোমার হয়ে গেল। এখন চাই ওই বিষয়টি হুবহু ওরকম শব্দে মনে থাকুক অথবা না থাকুক। যখন সময় আসবে ইনশাআল্লাহ ওই সময় এটা স্মরণ হয়ে যাবে এবং এর ওপর আমলের তাওফিক হয়ে যাবে। বুজুর্গদের খেদমতে যাওয়া এবং তাদের কথাবার্তা শোনার এটাই উপকার হয় যে, তাঁরা কথা কানে ঢেলে দেন এবং ঢালতে থাকেন এ পর্যন্ত যে ওই কথাবার্তা মানুষের তবিয়তে ঢুকে যায় এবং সময়মতো স্মরণ হয়ে যায়।

জোরপূর্বক কানে কথা ঢেলে দাও

আমি আজকে চিন্তা করেছি যে, হজরত পিতাজি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি, হজরত ডাক্তার সাহেব রহমতুল্লাহি আলাইহি এবং হজরত মাসিহুল্লাহ খান সাহেব রহমাতুল্লাহ আলাইহি। এই তিন বুজুর্গের সঙ্গে আমার তাআল্লুক। আমার অবস্থা তো ধ্বংসাত্মক ছিল, কিন্তু আল্লাহ তাআলা এই বুজুর্গদের খেদমতে উপস্থিতির তাওফিক দান করেছেন। এটা তাঁর দয়া ও অনুগ্রহ ছিল। এখন যদি সারাজীবনও এর শুকরিয়া আদায় করি, তাহলেও শুকরিয়া আদায় হবে না। এই বুজুর্গরা কিছু কথাবার্তা জোরপূর্বক কানে ঢেলে দিয়েছেন। নিজের পক্ষ থেকে যার প্রতি কোনো আকাঙ্ক্ষা ছিল না এবং আগ্রহ ছিল না। আজ যদি আমি ওই কথাগুলোকে নম্বর দিয়ে লিখতে চাই, যা ওই বুজুর্গদের মজলিসে শুনেছিলাম, তাহলে এসব বিষয় স্মরণে আসাও দুষ্কর। কিন্তু কোনো না কোনো সময় ওই কথাগুলো স্মরণে এসে যায়। বুজুর্গদের সঙ্গে সম্পর্কের এটাই ফায়দা। এটা যেভাবে বুজুর্গদের খেদমতে হাজিরির নিয়ামত, তাদের কথাবার্তা সোনার নিয়ামত, অনুরূপভাবে ওই বুজুর্গদের মালফুজাত, হালাত, তাঁদের জীবনী পড়া এবং তার দ্বারা উপকৃত হওয়াও একটা নিয়ামত। এখন এই হজরতগণ জীবিত নেই, কিন্তু তাঁরা আলহামদুলিল্লাহ সমস্ত কথাবার্তা লিখে রেখে গিয়েছেন। এগুলোকে মুতাআলা করা উচিত, তাহলে এই কথাগুলো কাজে এসে যাবে। আল্লাহ তাআলা স্বীয় দয়া ও অনুগ্রহে আমাদেরকে ওই বুজুর্গদের পদাঙ্ক অনুসরণের তাওফিক দান করুন।

ওজর ও অলসতার মধ্যে পার্থক্য

মোটকথা, আমি এটা আরজ করছিলাম যে, যখনই অলসতা আসবে ওই অলসতার মোকাবিলা করা উচিত এবং মামুলকে পুরো করা উচিত। দেখুন ওজর ভিন্ন জিনিস এবং অলসতা ভিন্ন জিনিস। যদি ওজরের কারণে মামুল ছুটে যায়, তাহলে কোনো চিন্তা নেই। উদাহরণস্বরূপ, রোগের কারণে মামুল ছুটে গিয়েছে অথবা সফরের কারণে মামুন ছুটে গিয়েছে, এতে কোন সমস্যা নেই। এ কারণে যে, আল্লাহ তাআলা এর ওপর ধরপাকড় করবেন না। যেহেতু ওজরের কারণে সুযোগ দেওয়া হয়েছে, তখন নিজে পাবন্দি করার কে? এ কারণে কোনো ওজরের ফলে এটা ছুটে যাওয়ায় চিন্তিত হওয়া উচিত নয়।

এ রোজা কার জন্য রাখা হয়েছিল

আমাদের হজরত ডাক্তাব আবদুল হাই সাহেব রহমতুল্লাহি আলাইহি হজবত খানভি রাহমাতুল্লাহি আলাইহির এই কথা নকল করেছিলেন যে, এক ব্যক্তি রমজানে অসুস্থ হয়ে গিয়েছে এবং অসুস্থতার কারণে রোজা ছুটে গিয়েছে। এখন তার এ বিষয়ে চিন্তা হচ্ছে যে, রমজানের রোজা ছুটে গিয়েছে। হজরত বলেন যে, চিন্তা করার কোনো বিষয় নেই। এ কারণে যে, এটা দেখো যে, তোমরা রোজা কার জন্য রাখছ? যদি তোমরা নিজ সত্তার জন্য, নিজের মন খুশি করার জন্য, নিজের আগ্রহ পুরো করার জন্য বোজার রেখে থাক, তাহলে নিঃসন্দেহে এর ওপর চিন্তা ও কষ্ট করো যে, অসুস্থতা এসে গিয়েছে এবং রোজা ছুটে গিয়েছে। কিন্তু যদি আল্লাহ তাআলার জন্য রোজা রাখো, তাহলে চিন্তা করার প্রয়োজন নেই। এ কারণে যে, আল্লাহ তাআলা নিজেই বলে দিয়েছেন যে, অসুস্থতায় রোজা ছেড়ে দাও। অতএব, যদি ওজরের কারণে রোজা কাজা হয়ে যায় অথবা মামুল ছুটে যায়। উদাহরণস্বরূপ, অসুস্থতা, সফর, মহিলাদের শারীরিক সমস্যা অথবা অন্য কোনো বিশেষ প্রয়োজন ছিল, যা দ্বীনের তাকাজা, এ কারণে মামুল ছুটে গিয়েছে। যেমন মা-বাবা অসুস্থ, তাঁদের খেদমত করছে, তাঁদের খেদমতের কারণে মামুল ছুটে গিয়েছে, তাহলে এ কারণে একেবারেই চিন্তিত হওয়া, পেরেশান হওয়া উচিত নয়। কিন্তু অলসতার কারণে মামুল ছেড়ে দেওয়া উচিত নয়। ওজরের কারণে যদি ছুটে যায় তাহলে এর ওপর চিন্তিত হওয়া উচিত নয়।

অলসতার চিকিৎসা

অলসতার একটামাত্র চিকিৎসা আছে। তা হলো, তার মোকাবিলা করো এবং তার সঙ্গে কঠোরতা করো এবং সাহসিকতার সঙ্গে মোকাবিলা করো। এর চিকিৎসা হিম্মত ব্যবহার করা ছাড়া অন্য কিছু নয়। যদি আমাদের জিন্দেগিতে শুধুমাত্র এই বিষয়টিও চলে আসে, অর্থাৎ 'অলসতাব মোকাবিলা করা' তাহলে বুঝে নাও যে, অর্ধেক কাজ হয়ে গেল। এরপরে বাকি অর্ধেক কাজ অর্জনের চেষ্টা করো। আল্লাহ তাআলা স্বীয় দয়া ও অনুগ্রহে অলসতার মোকাবিলা করার হিম্মত ও তাওফিক দান করুন। আমিন।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url