আল্লাহ তাআলার সঙ্গে সম্পর্ক সৃষ্টি করার সহজ পদ্ধতি
আজ এই আর্টিকেলটিতে আল্লাহ তাআলার সঙ্গে সম্পর্ক সৃষ্টি করার সহজ পদ্ধতি সর্ম্পকে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
হজরত আবু সাঈদ খুদরি রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অভ্যাস এই ছিল যে, যখন তিনি কোনো নতুন কাপড় পরিধান করতেন, তখন সেই কাপড়ের নাম নিতেন, চাই তা পাগড়ি হোক অথবা জামা হোক অথবা চাদর হোক। [১৪] সেটার নাম নিয়ে এই দুআ করতেন-
হে আল্লাহ! আপনার শোকর যে, আপনি আমাকে এই পোশাক পরিধান করিয়েছেন। আপনার কাছে এই পোশাকের কল্যাণ কামনা করছি এবং যেই কাজের জন্য এটা বানানো হয়েছে, তার মধ্য থেকে কল্যাণ কামনা করছি। আমি আপনার কাছে এই পোশাকের খারাবিতা থেকে পানাহ চাচ্ছি এবং যে খারাপ কাজের জন্য এটা বানানো হয়েছে, তার খারাবি থেকে পানাহ চাচ্ছি।
প্রত্যেক সময়ের আলাদা আলাদা দুআ
পোশাক পরিধানের সময় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাত এই ছিল যে, তিনি এই দুআ পড়তেন। যদি কারও এই দুআ মনে না থাকে, তখন উর্দুতেই পোশাক পরিধানের সময় এই শব্দগুলো বলবে। (আমরা যেহেতু বাংলা ভাষাভাষী, অতএব, আমরা বাংলাতেই এই শব্দগুলো পড়ে নিব) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের, এই উম্মতের ওপর এত বড় ইহসান যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পদে পদে আল্লাহ তাআলার কাছে দুআ চাওয়ার পদ্ধতি শিখিয়েছেন। আমরা তো সর্বোচ্চ পর্যায়ের মুখাপেক্ষী। কিন্তু আমরা চাওয়ার পদ্ধতি জানি না। আমাদের তো এটা জানা নেই যে, কি চাইতে হবে? এটাও জানা নেই যে, কিভাবে চাইতে হবে? কিন্তু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে পদ্ধতিগুলো শিখিয়ে দিয়েছেন যে, আল্লাহ তাআলার কাছে এভাবে চাও। সকাল থেকে নিয়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত অগণিত কাজ মানুষ করে থাকে। প্রায় সব কাজের জন্য রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আলাদা আলাদা দুআ শিখিয়েছেন। যেমন, তিনি বলেছেন যে, সকালে যখন ঘুম থেকে জাগ্রত হও, তখন এই দুআ পড়ো। যখন ইস্তিঞ্জার জন্য যাও, তখন এই দুআ পড়ো। ইস্তিঞ্জা থেকে ফারেগ হয়ে বাহিরে এসে এই দুআ পড়ো। যখন অজু করো, তখন এই দুআ পড়ো। ওজুর মাঝে এই দুআ পড়তে থাকো। অজু শেষ করার পরে এই দুআ পড়ো। যখন নামাজের জন্য মসজিদে প্রবেশ করো, তখন এই দুআ পড়ো। মসজিদে ইবাদত করতে থাক। এরপরে যখন মসজিদ থেকে বাহিরে বের হও, তখন এই দুআ পড়ো। যখন নিজের ঘরে প্রবেশ করো, তখন এই দুআ পড়ো। যখন বাজারে পৌঁছো, তখন এই দুআ পড়ো। কেমন যেন সর্বক্ষেত্রে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুআ শিখিয়ে দিয়েছেন যে, এই দুআ এভাবে পড়ো।
আরো পড়ুন: টাইফয়েড টিকাদান ক্যাম্পেইন ২০২৫
আল্লাহ তাআলার সঙ্গে সম্পর্ক সৃষ্টির পদ্ধতি
এভাবে প্রত্যেক ওঠা বসায় আলাদা আলাদা দুআ কেন শেখানো হয়েছে? এটা মূলত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ তাআলার সঙ্গে সম্পর্ক জুড়িয়ে দেওয়ার জন্য প্রেসক্রিপশন হিসেবে শিখিয়ে দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলার সঙ্গে সম্পর্ক সৃষ্টি করার সহজ এবং সংক্ষিপ্ত পদ্ধতি হলো যে, মানুষ সর্বক্ষেত্রে আল্লাহ তাআলার কাছে চাইতে থাকবে এবং দুআ করতে থাকবে। কুরআনুল কারিমে আমাদেরকে এই আদেশ দেওয়া হয়েছে যে-
হে ঈমানদারগণ, আল্লাহ তাআলাকে বেশি বেশি স্মরণ করো এবং বেশি বেশি তাঁর জিকির করো।
[সুরা আহজাব, আয়াত ৪১]
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে কেউ জিজ্ঞাসা করেছে যে, ইয়া রাসুলুল্লাহ। সবচেয়ে উত্তম আমল কোনটি? তখন নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন যে, সবচেয়ে উত্তম আমল হলো এই যে-
অর্থাৎ, তোমার জিব্বা সব সময় আল্লাহ তাআলার জিকিরের মাধ্যমে সিক্ত থাকবে।[১০] সব সময় জবানে জিকির চালু থাকবে। সারমর্ম হলো যে, বেশি বেশি জিকির করার আদেশ কুরআনুল কারিমে দেওয়া হয়েছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাদিসেও এর ফজিলত বর্ণনা করেছেন।
আল্লাহ তাআলা জিকির থেকে অমুখাপেক্ষী
এখন প্রশ্ন হয় যে, আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে বেশি বেশি জিকির করার আদেশ কেন করেছেন? (আল্লাহ তাআলার পানাহ) আমাদের জিকিরের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার কাছে কি কোনো উপকার পৌঁছে? আল্লাহ তাআলার এই জিকিরের কারণে কি মজা আসে যে, আমার বান্দা আমার জিকির করছে, এর কারণে তাঁর কি আনন্দ অনুভব হয়? বা তাঁর কোনো উপকার হাসিল হয়? সুস্পষ্ট কথা যে, যে ব্যক্তি আল্লাহ তাআলার মারেফাত রাখে এবং তাঁর ওপর ঈমান রাখে, সে এই বিষয়ের কল্পনাও করতে পারে না। কেননা, যদি সারা বিশ্ব সর্বদা, প্রতিটি মুহূর্তে আল্লাহ তাআলার জিকির করতে থাকে, তাহলে আল্লাহ তাআলার বড়ত্বের ক্ষেত্রে, তাঁর মর্যাদা ও সৌন্দর্যের ক্ষেত্রে এবং তাঁর মহত্বের ক্ষেত্রে এক অনু পরিমাণও বৃদ্ধি পাবে না। আল্লাহর পানাহ। যদি সমগ্র বিশ্ব মিলে এই বিষয়ের সংকল্প করে যে, আল্লাহ তাআলার জিকির করবে না, আল্লাহ তাআলাকে ভুলে যাবে, জিকির থেকে উদাসীন হয়ে যাবে, গুনাহে লিপ্ত হয়ে যাবে, নাফরমানিতে নিমগ্ন হয়ে যাবে, তাহলে তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব ও বড়ত্বের ক্ষেত্রে জাররা পরিমাণও কমতি আসবে না। ওই সত্তা তো অমুখাপেক্ষী। তিনি আমাদের জিকির থেকেও অমুখাপেক্ষী। আমাদের সিজদা থেকেও অমুখাপেক্ষী। আমাদের তাসবিহ থেকেও অমুখাপেক্ষী। তাঁব, আমাদের জিকিরের প্রয়োজন হয় না।
সমস্ত খারাবির মূল হলো আল্লাহ তাআলার স্মরণ থেকে গাফেল হওয়া
কিন্তু যা বলা হয়ে থাকে যে, আল্লাহ তাআলাকে বেশি বেশি স্মরণ করো। এর মাধ্যমে আমাদের উপকার হয়। এ কারণে যে, দুনিয়াতে যত অপরাধ, যত অন্যায় ও অশ্লীলতা হয়ে থাকে, যদি ওই সমস্ত অপরাধের মূলের দিকে তাকানো হয়, তাহলে বুঝে আসবে যে, এটা শুধুমাত্র আল্লাহ তাআলা থেকে গাফিলতির কারণেই হয়ে থাকে। যখন মানুষ আল্লাহ তাআলার স্মরণ থেকে গাফেল হয়ে যায়, আল্লাহ তাআলাকে ভুলে যায়, তখন গুনাহে লিপ্ত হয়ে যায়। কিন্তু যদি আল্লাহ তাআলার স্মরণ অন্তরে থাকে, আল্লাহ তাআলার জিকির অন্তরে থাকে এবং আল্লাহ তাআলার সামনে জবাব দেওয়ার অনুভূতি অন্তরে থাকে যে, একদিন আল্লাহ তাআলার সামনে দাঁড়াতে হবে, তখন গুনাহ হবে না। চোর যে সময় চুরি করে, ওই সময় সে আল্লাহ তাআলার স্মরণ থেকে গাফেল থাকে। যদি আল্লাহ তাআলার স্মরণ থেকে গাফেল না থাকত, তাহলে চুরি করত না। খারাপ ব্যক্তি যখন খারাপ কাজে লিপ্ত হয়, ওই সময় সে আল্লাহ তাআলার স্মরণ থেকে গাফেল থাকে। যদি আল্লাহ তাআলার স্মরণ থেকে গাফেল না থাকত, তাহলে সে খারাপ কাজে লিপ্ত হতো না। এ বিষয়টি কে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন যে-
অর্থাৎ, জিনাকারী যখন জিনা করে, ওই সময় সে মুমিন থাকে না। মুমিন হওয়ার অর্থ হলো যে, ঈমান ওই সময় তার কাছে উপস্থিত থাকে না। আল্লাহ তাআলার স্মরণ এবং তাঁর জিকির উপস্থিত থাকে না। যখন চোর চুরি করে, তখন ওই সময় সে মুমিন থাকে না। অর্থাৎ, যদি ওই সময় আল্লাহ তাআলার স্মরণ তার অন্তরে থাকত, তাহলে সে গুনাহ করত না। অতএব, সমস্ত অন্যায়, সমস্ত অপরাধ, সমস্ত জুলুম এবং সমস্ত খারাবি যা দুনিয়ায় চলছে, এর মূল ভিত্তি হলো আল্লাহ তাআলার জিকির থেকে গাফেল থাকা।
আল্লাহ তাআলা কোথায় গিয়েছেন
হজরত ফারুকে আজম রাদিয়াল্লাহু আনহু একবার সফরে যাচ্ছিলেন। জঙ্গলের সফর ছিল। ওই সময় বর্তমান জামানার মতো হোটেলের প্রচলন ছিল না। এজন্য, যখন ক্ষুধা লাগতো এবং সফরের পাথেয় শেষ হয়ে যেত, তখন আশপাশে বস্তি তালাশ করত যে, কাছেই কোনো বস্তি আছে কিনা? থাকলে সেখানে গিয়ে খানা খেয়ে নিবে। অতএব, হজরত ওমর ফারুক রাদিয়াল্লাহু তালাশ করে দেখলেন যে, বকরির একটা পাল চলতেছে। তিনি কাছে গিয়ে রাখালকে তালাশ করলেন। অতঃপর তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে, তাকে বললেন যে, আমি মুসাফির এবং আমার ক্ষুধা লেগেছে। তাই বকরির দুধ বের করে দাও এবং আমার থেকে এর পয়সা নিয়ে নাও। যাতে আমি দুধ পান করে নিজের ক্ষুধা মেটাতে পারি। এটা ওই সময়ের ঘটনা, যখন হজরত ওমর রাদিয়াল্লাহ আনহু অর্ধ জাহানের শাসক এবং বাদশা ছিলেন। উত্তরে রাখাল বলল যে, জনাব! আমি অবশ্যই আপনাকে দুধ দেবো। কিন্তু কথা হলো যে, এই বকরি আমার নয়, এগুলো আমার মালিকের। সে আমাকে বকরি চড়ানোর জন্য দিয়েছে। যার ফলে এই বকরি আমার নিকট আমানতস্বরূপ। এর দুধও আমার নিকট আমানত। এজন্য আমি মালিকের অনুমতি ছাড়া এই দুধ দিতে পারি না। এটা করতে আমি অপারগ। হজরত ওমর ফারুক রাদিয়াল্লাহু আনহুর অন্তরে এই খেয়াল এলো যে, একে একটু পরীক্ষা করে নেওয়া যাক। সুতরাং হজরত ওমর ফারুক রাদিয়াল্লাহু আনহু ঐ রাখালকে বললেন যে, আমি তোমাকে একটা কৌশল শিখিয়ে দিচ্ছি। যদি তুমি এর ওপর আমল করো, তাহলে এতে তোমার উপকার হবে, আমারও উপকার হবে। ওই রাখাল জিজ্ঞাসা করল যে, সেটা কি? হজরত ওমর ফারুক রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন যে, তুমি এমন করো যে, একটা বকরি আমার কাছে বিক্রি করে দাও এবং এর যে মূল্য হবে, সেটা আমার থেকে নিয়ে নাও। এতে আমার তো উপকার এই হলো যে, আমি এই বকরিকে নিজের সঙ্গে নিয়ে সফর করব এবং যখন প্রয়োজন হবে, এর দুধ বের করে পান করব। আর তোমার ফায়দা হলো যে, তুমি বকরির মূল্য পেয়ে গেলে। থাকল মালিকের বিষয়। অতএব, মালিক যদি জিজ্ঞাসা করে যে, বকরি কোথায় গিয়েছে" তখন তুমি তাকে বলে দিবে যে, তাকে বাঘ নিয়ে গিয়েছে। এ কারণে যে, এই প্রকারের ঘটনা জঙ্গলের মধ্যে সংগঠিত হয়ে থাকে। এজন্য সে বিশ্বাস করবে। এতে তোমার উপকার হবে, আমারও উপকার হবে। যখন রাখাল এই বিষয়টি শুনল, তৎক্ষণাৎ সে মুখে এই কালিমা বলল, জনাব। আল্লাহ কোথায় গিয়েছেন? অর্থাৎ যদি এসব কাজ আমি করি, তাহলে যদিও মালিক দেখবে না, কিন্তু আল্লাহ তাআলা তো দেখছেন। এসব কিছু বাস্তবিকপক্ষে ধোঁকাবাজি ও মিথ্যা। আল্লাহ তাআলার সামনে গিয়ে কি উত্তর দিবো।
আরো পড়ুন: অন্তরের পবিত্রতা এবং তার প্রতিক্রিয়াসমূহ
জিকির থেকে উদাসীনতা, অপরাধের আধিক্যতা
এটা হলো আল্লাহ তাআলার জিকির, আল্লাহ তাআলার স্মরণ, যা অন্তরে এমনভাবে বসে গিয়েছে যে, যেকোনো সময়, জঙ্গলের নির্জনতায়ও, রাতের অন্ধকারেও আল্লাহ তাআলার জিকির অন্তর থেকে বের হয়নি। মোটকথা, হজরত ওমর ফারুক রাদিয়াল্লাহু আনহু যখন এই রাখালের উত্তর শুনলেন, তখন বললেন যে, যতক্ষণ পর্যন্ত তোমাদের মতো ব্যক্তি এই ভূপৃষ্ঠে বিদ্যমান থাকবে এবং যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ তাআলার সামনে উপস্থিত হয়ে উত্তর দেওয়ার অনুভূতি অন্তরে বিদ্যমান থাকবে, ওই সময় পর্যন্ত এই ভূপৃষ্ঠে জুলুম আসতে পারে না। এ কারণে যে, জবাবদিহিতার অনুভূতি এমন জিনিস, যা নির্জনতায়ও মানুষের অন্তরে পাহারাদার বসিয়ে দেয়। আর যদি এই অনুভূতি অবশিষ্ট না থাকে, তখন তার পরিণতি আপনারা দেখছেন যে, এখন পুলিশের সংখ্যা বেড়েছে, আদালতের সংখ্যা বেড়েছে, শাসকের সংখ্যা বেড়েছে, সৈন্যবাহিনী আছে, অলিতে গলিতে পাহারাদার বসানো আছে, কিন্তু এরপরেও ডাকাতি হচ্ছে। মানুষের জান, মাল, ইজ্জত, আক্রর ওপর কিভাবে আক্রমণ হচ্ছে" কিভাবে অপরাধ বেড়ে যাচ্ছে? এই সবকিছু কেন হচ্ছে? এ কারণে যে, অপরাধের মূল, ওই সময় পর্যন্ত শেষ হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ তাআলার স্মরণ এবং আল্লাহ তাআলার জিকির অন্তরে না বসবে এবং জায়গা করে না নিবে। যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ তাআলার সামনে উপস্থিতির অনুভূতি অন্তরে সৃষ্টি না হবে, যতক্ষণ পর্যন্ত অন্তরে এই বিষয় জাগ্রত না হবে, ওই সময় পর্যন্ত হাজারো পাহারাদার বসিয়ে দাও, হাজারো সৈন্যবাহিনী ডেকে নাও, কিন্তু অপরাধ বন্ধ হবে না। মানুষের সামান্য অন্তরালেই অপরাধ শুরু হয়ে যাবে। বরং যে দৃষ্টি হেফাজতের জন্য নির্ধারণ ছিল, আজ ওই দৃষ্টি অপরাধ করেছে। যাদেরকে মানুষ জানমালের নিরাপত্তার জন্য বসিয়ে দিয়ে ছিল, তারাই মানুষের জানমালের ওপর ডাকাতি করছে। অতএব, যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহর জিকির এবং তাঁর স্মরণ অন্তরে না হবে, জবাবদিহিতার অনুভূতি অন্তরে না আসবে, ওই সময় পর্যন্ত অপরাধ নির্মূল হওয়া সম্ভব নয়।
অপরাধ নির্মূলের ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বক্তব্য
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অপরাধ নির্মূল করেছিলেন। কোনো পুলিশ নয়, কোনো আদালত নয়, কোনো সৈন্যবাহিনী নয়, বরং যার থেকে অপরাধ প্রকাশ পেয়েছে সে ক্রন্দন করতে করতে এসেছে যে, ইয়া রাসুলুল্লাহ! আমার ওপর শাস্তি আরোপ করুন। যাতে আমি আখিরাতে আজাব থেকে বেঁচে যাই। এমন সাজা জাবি করুন যে, পাথর মেরে মেরে আমাকে হত্যা করে ফেলুন। আমাকে রজম করে দিন। সুতরাং, বিষয়টি এমন ছিল যে, আল্লাহ তাআলার স্মরণ এবং তাঁর ভয় অন্তরে গেঁথে গিয়েছিল। এ কারণে বলা হচ্ছে যে, আল্লাহ তাআলার জিকির বেশি বেশি করো। অথচ, আমাদের জিকিরের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার কোনো উপকার হয় না। কিন্তু যত জিকির করবে, আল্লাহ তাআলার সামনে জবাব দেওয়ার অনুভূতি অন্তরে ততই সৃষ্টি হবে। এরপরে অপরাধ, গুনাহ, অন্যায় ও নাফরমানি থেকে বেঁচে যাবে, ইনশাআল্লাহ। এজন্যই বলা হয়ে থাকে যে, আল্লাহ তাআলার জিকির বেশি বেশি করো।
জবানের জিকিরও উপকারী এবং লক্ষণীয়
মানুষ বলে যে, যদি শুধুমাত্র জবানে আল্লাহ আল্লাহ করতে থাকে অথবা সুবহানাল্লাহ বলতে থাকে অথবা জবানে আলহামদুলিল্লাহ বলতে থাকে এবং অন্তর অন্যদিকে থাকে, চিন্তা-ভাবনা অন্যদিকে থাকে, তাহলে এতে কি ফায়দা হয়? স্মরণ রাখো যে, জবান দ্বারা জিকির করা এটা প্রথম ধাপ। যদি এই ধাপ অতিক্রম করতে না পারে, তাহলে দ্বিতীয় ধাপে কখনও পৌঁছতে পারবে না। জীবনেও পৌঁছতে পারবে না। আর যদি এই ধাপ অতিক্রম করে ফেলে এবং জবান দ্বারা আল্লাহ তাআলার জিকির করা শুরু করে দেয়, তাহলে কমপক্ষে একটি ধাপ অতিক্রম হলো। এরপরে এর বরকতে আল্লাহ তাআলা দ্বিতীয় ধাপও অতিক্রম করাবেন। এ কারণে এই জিকিরকে অনর্থক মনে করো না। এই জিকিরও আল্লাহ তাআলার নিয়ামত। যদি আমাদের সারা শরীর দ্বারা নাও হয়, অন্তত শরীরের একটি অঙ্গ আল্লাহ তাআলার স্মরণে মশগুল আছে। যদি এভাবে লেগে থাকে, তাহলে ইনশাআল্লাহ সামনে অগ্রসর হয়ে উন্নতি সাধন করবে।
আল্লাহ তাআলার সঙ্গে সম্পর্ক সৃষ্টির হাকিকত
মোটকথা, আল্লাহ তাআলার জিকির এবং আল্লাহ তাআলার স্মরণ অন্তরে প্রতিষ্ঠা করার নামই হলো, 'তাআল্লুক মাআল্লাহ' অর্থাৎ, সবসময় আল্লাহ তাআলার সঙ্গে কিছু না কিছু সম্পর্ক কায়েম হলো। সুফিয়ায়ে কেরামদের সিলসিলায় রিয়াজাত, মুজাহাদা, অজিফা এবং বিভিন্ন আমল এই সবগুলোর সারমর্ম, খোলাসা ও উদ্দেশ্য শুধুমাত্র একটি জিনিস, তা হলো আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক মজবুত করা। এ কারণে যে, যখন আল্লাহ তাআলার সঙ্গে সম্পর্ক মজবুত হয়ে যায়, তখন মানুষের গুনাহও হয় না। এরপরে মানুষ আল্লাহ তাআলার ইবাদাতেও নিজেব সাধ্যানুযায়ী সর্বোত্তমভাবে করতে থাকে। এর পরে আখলাকে ফাজিলা অর্জন হয়ে যায় এবং আখলাকে রজিলা থেকে মুক্তি পেয়ে যায়। এই সমস্ত জিনিস আল্লাহ তাআলার সঙ্গে সম্পর্ক সৃষ্টির মাধ্যমে অর্জন হয়।
আরো পড়ুন: মানুষের প্রধান প্রধান হরমোন জনিত রোগের লক্ষণ সমূহ
সর্বদা চাইতে থাকো
আল্লাহ তাআলার সঙ্গে সম্পর্ক অর্জনের জন্য সুফিয়ায়ে কেরামদের এখানে বড় লম্বা-চওড়া মুজাহাদা এবং বিয়াজাত করানো হয়। কিন্তু আমাদের হজরত ডাক্তার আব্দুল হাই বাহুমাতুল্লাহি আলাইহি বলতেন যে, এই তাআল্লুক মাআল্লাহ অর্জন করার জন্য, আমি তোমাদেরকে একটি সংক্ষিপ্ত ও সহজ রাস্তা বলে দিচ্ছি। তা হলো এই যে, আল্লাহ ভাআলার কাছে সর্বদা এবং সর্বমুহূর্তে চাইতে থাক এবং চাওয়ার অভ্যাস করে ফেলো। প্রতিটি জিনিস আল্লাহ তাআলার কাছে চাও। যে কষ্ট, দুঃখ, পেরেশানি, যে প্রয়োজন হয়, সবকিছুই আল্লাহ তাআলার কাছে চাও। উদাহরণস্বরূপ, যদি গরম লাগে তাহলে বলো, হে আল্লাহ, গরম দূর করে দিন। কারেন্ট চলে গেছে তখন বলো, হে আল্লাহ, কারেন্ট দিয়ে দিন। ক্ষুধা লেগেছে তখন বলো, হে আল্লাহ, ভালো খাবারের ব্যবস্থা করে দিন। ঘরে প্রবেশ করছ তখন বলো, হে আল্লাহ, ঘরে ভালো দৃশ্য সামনে নিয়ে আসেন, শান্তির সংবাদ যেন পাই এবং পেরেশানি যেন না হয়। দফতরে প্রবেশ করার পূর্বে বলো, হে আল্লাহ, দফতরে যাচ্ছি সমস্ত অবস্থা ঠিক করে দাও। তবিয়ত অনুযায়ী করে দাও। অপছন্দনীয় জিনিস দূর করে দাও। কোনো কষ্ট যেন সামনে না আসে। বাজারে যাচ্ছ তখন বলো, হে আল্লাহ, অমুক জিনিস ক্রয় করতে যাচ্ছি, ন্যায্য মূল্যে ন্যায্য জিনিসের ব্যবস্থা করে দাও। সর্বদা, সর্বমুহূর্তে আল্লাহ তাআলার দিকে মনোযোগী হও এবং আল্লাহ তাআলার কাছে চাওয়ার অভ্যাস করো।
ছোট্ট একটি টিপস
ব্যস্তবতা হলো যে, এটা একেবারে সাধারণ বিষয়। এই কাজ এত সহজ যার কোনো সীমা নেই। এ কারণে এর কোনো মূল্য নেই। কিন্তু এই প্রেসক্রিপশনের ওপর আমল করে দেখো, আল্লাহ তাআলার সামনে সর্বদা কান্নাকাটি করো, যে বিষয়ে সামনে আসে এটাকে আল্লাহ তাআলার সামনে পেশ করো, হে আল্লাহ, এই কাজ করে দিন। যদি এব অভ্যাস করতে পারো, তাহলে কোনো মুহূর্তে আল্লাহ তাআলা থেকে চাওয়া ছাড়া খালি থাকবে না। উদাহরণস্বরূপ, সামনে থেকে একজন ব্যক্তি আপনার সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য আসছে, আপনি এক মুহূর্তের জন্য আল্লাহ তাআলার দিকে মনোযোগী করে নিলেন যে, হে আল্লাহ, এই ব্যক্তি ভালো সংবাদ নিয়ে আসুক, কোনো খারাপ সংবাদ নিয়ে যেন না আসে। হে আল্লাহ, এই ব্যক্তি যে কথা বলতে চায়, এটার ভালো ফলাফল বের করে দিন। ডাক্তারের কাছে ওষুধের জন্য যাচ্ছ, তখন বলো, হে আল্লাহ, এই ডাক্তারের অন্তরে সঠিক বিষয় ঢেলে দিন। সঠিক ওষুধ তার অন্তরে ঢেলে দিন। কেমন যেন প্রত্যেক ক্ষেত্রে আল্লাহ তাআলার কাছে চাওয়ার অভ্যাস করে ফেলো। এটা ছোট্ট একটি টিপস ও প্রেসক্রিপশন। হজরত ডাক্তার সাহেব রহমতুল্লাহি বলতেন যে, এই টিপসের ওপর আমল করে দেখো, কি থেকে কি হয়ে যায়? মানুষ এর কারণে কোথেকে কোথায় পৌঁছে যায়?
জিকিরের জন্য কোনো পাবন্দি ও শর্ত নেই
যে সমস্ত মাসনুন দুআ আছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এগুলোর মাধ্যমে এই প্রেসক্রিপশনের দিকে নিয়ে আসছেন যে, যখন কোনো অবস্থা সামনে আসবে, আল্লাহ তাআলার কাছে চাইবে এবং দুআ করবে। আল্লাহ তাআলা এই চাওয়াকে এবং ফরিয়াদকে এত সহজ করে দিয়েছেন যে, এর ওপর কোনো পাবন্দি ও শর্ত লাগাননি। বরং যে কোনো অবস্থায় আল্লাহ তাআলার কাছে চাও, তাতে ওজুর শর্ত নেই, কেবলামুখি হওয়ারও শর্ত নেই, এমনকি অপবিত্র অবস্থায়ও দুআ করা নিষেধ নয়। যদিও এই অবস্থায় কুরআনুল কারিম তিলাওয়াত করা বৈধ নয়। কিন্তু দুআ করতে পারবে। এমনকি, যে সময় মানুষ বাথরুমে থাকে, ওই সময় মুখে কোনো দুআ পড়া উচিত নয়। জবানের মাধ্যমে জিকির করা উচিত নয়। ওই সময়ও অন্তরে জিকির করতে কোনো নিষেধ নেই। মোটকথা, আল্লাহ তাআলা এই জিকিরকে এত সহজ করে দিয়েছেন যে, কোনো পাবন্দি ও শর্ত আরোপ করেননি। বিশেষ কোনো পদ্ধতি নির্ধারণ করেননি। যদি সুযোগ হয় তাহলে ওজুসহ কেবলামুখি হয়ে, হাত উঠিয়ে আল্লাহর কাছে চাও। কিন্তু যদি এরকম সুযোগ না হয়, তাহলে ওজুর শর্ত নেই, হাত ওঠানোর শর্ত নেই, মুখে বলার শর্ত নেই। বরং অন্তরে অন্তরে আল্লাহ তাআলার কাছে চাও। হে আল্লাহ, এই কাজ করে দিন। হজরত থানভি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন যে, যখন কোনো ব্যক্তি প্রশ্ন করার জন্য আসে এবং এসে বলে যে, হজরত। একটি বিষয় জিজ্ঞাসা করা দরকার, তখন ওই সময় তৎক্ষণাৎ অন্তরে আল্লাহ তাআলার দিকে মনোযোগী হয়ে দুআ করো যে, হে আল্লাহ, জানা নেই যে, এই ব্যক্তি কি প্রশ্ন করবে? হে আল্লাহ, এর প্রশ্নের সঠিক উত্তর আমার অন্তরে ঢেলে দিন। কখনওই আমল থেকে দূরে থাকবে না। বরং সর্বদাই আমল করতে থাকবে।
মাসনুন দুআর গুরুত্ব
এখন সর্বক্ষেত্রে আল্লাহ তাআলার কাছে চাওয়ার কৌশল রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম শিখিয়েছেন। চাওয়ার বিশেষ বিশেষ জায়গা বলে দিয়েছেন যে, এই জায়গায় আল্লাহর কাছে চেয়ে নাও। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এই বড় অনুগ্রহের ওপর কুরবান হয়ে যাওয়া উচিত যে, তিনি দুআ করাও শিক্ষা দিয়েছেন। তোমরা নিজেরা কি চাইবে? কোন পদ্ধতিতে চাইবে? কোন শব্দে চাইবে?
তোমাদের তো চাওয়ার ঢংও আসে না। এই চাওয়ার ঢংও আমি তোমাদেরকে শিখিয়ে দিচ্ছি যে, এটা চাও। এভাবে চাও। এই শব্দে চাও। এই সব কিছু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শিখিয়ে দিয়েছেন। এখন আমাদের কাজ হলো যে, ওই দুআগুলোকে মুখস্থ করব। যখন ওই সময় আসবে, তখন খেয়াল করে ওই দুআ করব। সুতরাং এতটুকুই কাজ। সমস্ত কাজ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম করে গিয়েছেন। খাবার পাকিয়ে পুরো উম্মতের জন্য রেখে গিয়েছেন। এখন উম্মতের কাজ হলো যে, এই খাবার উঠিয়ে নিজের গলাধঃকরণ করবে। সুতরাং এতটুকু কাজই আমাদের থেকে হয় না। উলামায়ে কেরাম দুআয়ে মাসুরা এবং মাসনুন দুআর নামে অগণিত কিতাব লিখে দিয়েছেন। তাতে ওই দুআগুলোকে সংকলন করেছেন। যাতে প্রত্যেক মুসলমান সহজভাবে এগুলোকে মুখস্থ করতে পারে। পূর্ববর্তীকালে মুসলমানদের মাঝে এই প্রচলন ছিল যে, যখন কোনো বাচ্চা কথা বলতে শুরু করত, তখন সর্বপ্রথম তাকে দুআর শিক্ষা দিতেন যে, বেটা! বিসমিল্লাহ পড়ে খাবার খাও। খাবার খাওয়ার পরে এই দুআ পড়ো। বিছানায় যখন ঘুমাতে যাও, তখন এই দুআ পড়ো। কাপড় পরিধানের সময় এই দুআ পড়ো। এর ফল এই ছিল যে, ওই কাজের জন্য নিয়মতান্ত্রিক ক্লাস করার প্রয়োজন হতো না। এরপরে বাল্যকালে মুখস্থ শক্তি এমন হয়ে থাকে, যেমন পাথরের ওপর রেখা। সারাজীবন এটা মুখস্থ থাকে। এখন বড় বয়সে মুখস্থ করা সহজ কাজ নয়। কিন্তু এটা করণীয় বিষয়। প্রত্যেক মুসলমান এটাকে গনিমত মনে করবে। এই মাসনুন দুআ অনেক লম্বা-চওড়া নয়। বরং ছোট ছোট হয়ে থাকে। প্রতিদিন একটা মুখস্থ করে নাও। এরপরে জায়গা মতো এটাকে পড়ার দৃঢ়সংকল্প করে নাও যে, যখন ওই সময় আসবে এই দুআ অবশ্যই পড়বে। এরপরে দেখো যে, আল্লাহ তাআলার কিভাবে নূর ও বরকত দান করেন? আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে সর্বক্ষেত্রে তাঁর জিকির করা এবং তাতে মশগুল থাকার তাওফিক দান করেন। আমিন।
এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url