পাকিস্তানের ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্র

পাকিস্তানের ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্র  ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রের প্রকৃতি বিশ্লেষণ ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে পারবেন। ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রের অধীনে প্রবর্তিত যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার ব্যবস্থা ব্যাখ্যা ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রে প্রবর্তিত সংসদীয় ব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করতে পারবেন।

ভূমিকা

১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্র ছিল পাকিস্তানের প্রথম শাসনতন্ত্র। এটিকে বিলম্বিত শাসনতন্ত্র বলা চলে। সুদীর্ঘ ৯ বছর সাধনার পর শাসনতন্ত্র প্রণেতাগণ এ শাসনতন্ত্রটি দিতে পেরেছিলেন। ১৯৫৫ সালে পাকিস্তানে দ্বিতীয় গণ-পরিষদ গঠিত হয়। এর অগ্রভাগে ছিল তৎকালীন গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ। ১৯৫৫ সালের ৭ই জুলাই এ পরিষদের প্রথম অধিবেশন বসে। এ পরিষদের সদস্য সংখ্যা ছিল ৮০ জন। প্রথম গণ-পরিষদ শাসনতন্ত্র প্রণয়নে ব্যর্থতার পরিচয় দেয়। এ ব্যর্থতাকে পুঁজি করে দ্বিতীয় গণ-পরিষদ শাসনতন্ত্র রচনায় ব্যাপৃত হয়। এ পরিষদের উৎসাহ ও উদ্দীপনা শাসনতন্ত্র রচনাকে ত্বরান্বিত করে। ১৯৫৬ সালের ৯ই জানুয়ারি গণ-পরিষদে শাসনতন্ত্র বিল উত্থাপিত হয়। এ বিলের উপর আলোচনা-সমালোচনা চলে। আলোচনার পর ২৯শে ফেব্রুয়ারি গণ-পরিষদ পাকিস্তানে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ধরনের শাসনতন্ত্র গ্রহণ করে। অবশেষে ২রা মার্চ গভর্নর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা শাসনতন্ত্র বিলে সম্মতি দেন। ২৩ মার্চে এ শাসনতন্ত্র গৃহীত ও প্রবর্তিত হয়। পাকিস্তানের ইতিহাসে এ শাসনতন্ত্রটি ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্র নামে পরিচিত।

আরো পড়ুন: মন্ত্রিমিশন পরিকল্পনা: কংগ্রেস ও মুসলীম লীগের প্রতিক্রিয়া

১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রের সাধারণ বৈশিষ্ট্য

১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রের বৈশিষ্ট্যগুলো নিম্নরূপ:

(১) বৃহৎ শাসনতন্ত্র: ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রের প্রথম পরিচয় হল এটি ছিল একটি বৃহৎ শাসনতন্ত্র। মোট ১০৫ পৃষ্ঠার এ শাসনতন্ত্রে একটি প্রস্তাবনা (Preamble), ১৩টি অংশ (Part), ২৩৪টি বিধি (Article) এবং ৬টি তালিকা সন্নিবেশিত ছিল। এ শাসনতন্ত্রে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা ছাড়াও প্রাদেশিক শাসন ব্যবস্থার উল্লেখ ছিল। সুতরাং এ শাসনতন্ত্র ছিল আয়তনে বড়।

(২) লিখিত শাসনতন্ত্র: পাকিস্তানের প্রথম শাসনতন্ত্র ছিল লিখিত প্রকৃতির।

(৩) ইসলামী আদর্শ: ইসলামি আদর্শ ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্র ছিল মূলত একটি ইসলামি আদর্শ ভিত্তিক শাসনতন্ত্র। এ শাসনতন্ত্রে পাকিস্তানকে ইসলামি প্রজাতন্ত্র নামে আখ্যায়িত করা হয়। এর প্রস্তাবনায় ইসলামি সাম্য, স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও সহনশীলতার নীতি অনুসৃত হয়।

(৪) যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা: ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রে যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থার বিধান রাখা হয়। এ শাসনতন্ত্রে বলা হয় যে, পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান নিয়ে পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্র গঠন করা হবে। এতে কেন্দ্রীয় সরকার ও প্রাদেশিক সরকাগুলোর মধ্যে ক্ষমতা বণ্টনের বিধান রাখা হয়। এ ক্ষেত্রে অবশ্য ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনকে অনুসরণ করা হয়।

(৫) প্রজাতান্ত্রিক গণতন্ত্র। পাকিস্তানের প্রথম শাসনতন্ত্রকে বিশ্লেষণ করলে প্রজাতান্ত্রিক গণতন্ত্রের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্র মতে পাকিস্তান ছিল একটি প্রজাতান্ত্রিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। এ শাসনতন্ত্রে দেশে গণতান্ত্রিক প্রতিনিধিত্ব শাসন চালু করার বিধান রাখা হয়। রাষ্ট্র প্রধান জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের দ্বারা নির্বাচিত হতেন।

(৬) সংসদীয় ব্যবস্থা: সংসদীয় ব্যবস্থা ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রের একটি উল্লেখযোগ্য দিক। এ শাসনতন্ত্রে পাকিস্তানে সংসদীয় শাসন প্রবর্তনের বিধান রাখা হয়। আরও বলা হয় যে, কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক মন্ত্রিসভ্য হবে প্রকৃত শাসন ক্ষমতার অধিকারী। শাসনতন্ত্র মতে মন্ত্রিসভা আইনসভার নিকট দায়ী থাকত।

(৭) মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি: এ শাসনতন্ত্রে জনগণের মৌলিক অধিকারের উল্লেখ ছিল। ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রে নাগরিকদের মৌলিক অধিকার রক্ষার ব্যবস্থা রাখা হয়। মৌলিক অধিকার সংরক্ষণের ব্যাপারে আদালতের প্রয়োজনীয় ভূমিকার কথা স্বীকার করা হয়।

(৮) এক কক্ষবিশিষ্ট আইনসভা: পাকিস্তানের প্রথম শাসনতন্ত্র কেন্দ্র ও প্রদেশে এক কক্ষবিশিষ্ট আইনসভ্য প্রবর্তন করে। এ শাসনতন্ত্রে উল্লেখ করা হয় যে, পাকিস্তানের আইনসভা হবে এক কক্ষবিশিষ্ট। কেন্দ্র ও প্রদেশের মধ্যে সমস্যা সমাধান ও আলোচনার জন্য এক কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভার বিধান রাখা হয়।

(৯) বিচার বিভাগের প্রাধান্য: ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রকে বিশ্লেষণ করলে বিচার বিভাগের প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়। এ শাসনতন্ত্রের বিচার বিভাগের প্রাধান্য স্বীকৃতি পায়। আরও উল্লেখ করা হয় যে, বিচার বিভাগই ব্যক্তি স্বাধীনতা রক্ষার প্রধান কবচ। তাছাড়া যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য বিচার বিভাগের প্রাধান্য স্বীকার করা হয়।

(১০) সমতার নীতি: সমতার নীতি ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রের একটি উল্লেখযোগ্য দিক। এ শাসনতন্ত্রের সমতার নীতি গৃহীত হয়। উভয় অঞ্চলের মধ্যে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সমতা আনার উদ্দেশ্যে এ নীতি গৃহীত হয়।

(১১) দ্বৈত ভাষা: এ শাসনতন্ত্রে রাষ্ট্রভাষা কিরূপ হবে তা নির্ধারণ করা হয়। পাকিস্তানের দুটি আঞ্চলিক ভাষা উর্দু ও বাংলাকে এ শাসনতন্ত্রে রাষ্ট্রভাষা রূপে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। পাসা-পাশি ইংরেজি ভাষাকে চালু রাখার বিধানও রাখা হয়। জনমতের উপর ভিত্তি করে এ বিধান রাখা হয়।

(১২) এককেন্দ্রিক ব্যবস্থা: পাকিস্তানে উক্ত শাসনতন্ত্রের মাধ্যমে এককেন্দ্রীক শাসন ব্যবস্থা উল্লেখ করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার বিধান রাখা হলেও এককেন্দ্রীক শাসন ব্যবস্থা পরিদৃষ্ট হয়। রাষ্ট্রের ঐক্য, সংহতি ও শান্তি-শৃংখলা বজায় রাখার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। সুতরাং এককেন্দ্রিকতা উক্ত শাসনতন্ত্রের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল।

(১৩) সংমিশ্রণ: ১৯৫৬ সালের পাকিস্তানের শাসনতন্ত্রকে বিশ্লেষণ করলে দুস্পরিবর্তনীয় ও সুপরিবর্তনীয় নীতির সংমিশ্রণ লক্ষ্য করা যায়। এ শাসনতন্ত্র সংশোধনের ক্ষেত্রে বিশেষ পদ্ধতির প্রয়োজন পড়ত। আবার জাতীয় পরিষদে সাধারণ সংখ্যারিষ্ঠের দ্বারাই শাসনতন্ত্র সংশোধনী বিল গ্রহণ করা যেত।

(১৪) প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন: এটি ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রের একটি মৌলিক দিক। এ শাসনতন্ত্রে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন প্রবর্তন করা হয়। প্রদেশে দায়িত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে বিশেষ বিধান রাখা হয়। এ শাসনতন্ত্র মতে প্রাদেশিক মন্ত্রি পরিষদ প্রাদেশিক আইন পরিষদের নিকট দায়ী ছিল। (১৫) নির্দেশ নীতি: নির্দেশ নীতি

১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রের আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক। উল্লেখ্য যে, ভারত ও আয়ারল্যান্ডের শাসনতন্ত্রে অনুরূপ নির্দেশ নীতি গৃহীত হয়েছিল। এ নীতিগুলো কোনো আদালতে কার্যকরী হতো না। কিন্তু রাষ্ট্রীয় আদর্শ হিসেবে এগুলো রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষকে কর্মে অনুপ্রাণিত করত। বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব, সামাজিক, আর্থিক ও রাজনৈতিক ন্যায়নীতি-এর মধ্যে প্রনিধাণযোগ্য।

উপরে উল্লিখিত আলোচনার আলোকে বলা যায় যে, এগুলো হল ১৯৫৬ সালের পাকিস্তানের শাসনতন্ত্রের মূল বৈশিষ্ট্য।

১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রে যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার

১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রের একটি বিশেষ দিক হল যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার। উক্ত শাসনতন্ত্রে পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়। অধ্যাপক ডাইসি এর ভাষায় "আঞ্চলিক রাষ্ট্রসত্ত্বা অক্ষুন্ন রেখে জাতীয় ঐক্য ও ক্ষমতার সামঞ্জস্য বিধান করার রাজনৈতিক কৌশলই হল যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার।" উক্ত শাসনতন্ত্রে প্রবর্তিত যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করলে নিম্নোক্ত দিকগুলো স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

(১) সংবিধানের প্রাধান্য শাসনতন্ত্রই হল যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের সকল ক্ষমতার মূল উৎস। ১৯৫৬ সালের পাকিস্তান শাসনতন্ত্রে প্রবর্তিত যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার এ নীতির বাইরে নয়। কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকার শাসনতন্ত্রের মাধ্যমে মূলত পরিচালিত হত। তারা শাসনতন্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতা প্রাপ্ত হত।

(২) প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রে প্রবর্তিত যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন। কেন্দ্রীয় সরকার সাধারণত প্রাদেশিক বিষয়ে হস্তক্ষেপ করত না। অনেক ক্ষেত্রে প্রাদেশিক সরকারের সিদ্ধান্ত কার্যকরী ছিল।

(৩) দ্বৈত সরকার: দ্বৈত সরকার ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রে প্রবর্তিত যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের একটি মৌলিক দিক। উক্ত সরকার ব্যবস্থায় দ্বৈত সরকার ব্যবস্থার কথা বলা ছিল। অন্যান্য যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের ন্যায় উক্ত ব্যবস্থায় দু'ধরনের সরকার ব্যবস্থার বিধান ছিল। শাসনতন্ত্রের দ্বারা উভয় প্রকার সরকার নিয়ন্ত্রিত হত।

(৪) ক্ষমতার বণ্টন। উক্ত শাসনতন্ত্রে প্রবর্তিত যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় ক্ষমতা বণ্টন নীতি গৃহীত হয়। ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রের মাধ্যমে শাসন ক্ষমতাকে তিনটি ভাগে বিভক্ত করা হয়। যথা (১) যুক্তরাষ্ট্রীয় বিষয় (২) প্রাদেশিক বিষয় ও (৩) সংযুক্ত বিষয়।

(৫) দ্বৈত নাগরিকত্ব দৈত্ব নাগরিকত্ব যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের একটি উল্লেখযোগ্য দিক। ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রে প্রবর্তিত যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা এর ব্যতিক্রম নয়। এ ব্যবস্থায় নাগরিককে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের বিধান রাখা ছিল।

(৬) বিচার বিভাগের প্রাধান্য: ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রে পাকিস্তানে প্রবর্তিত যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় বিচার বিভাগীয় প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়। উক্ত শাসনতন্ত্রের ব্যাখ্যা ও অভিভাবকত্ব করার দায়িত্ব সুপ্রীম কোটের উপর ন্যস্ত ছিল। কোন কোন আইনকে সুপ্রীম কোর্ট শাসনতন্ত্র বহির্ভূত (Ultra quires) বলে ঘোষণা দিত।

(৭) লিখিত ও দুস্পরিবর্তনীয় শাসনতন্ত্র: ১৯৫৬ সালে প্রবর্তিত শাসনতন্ত্রে যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের শাসনতন্ত্র ছিল লিখিত প্রকৃতির। এ শাসনতন্ত্রকে সহজে পরিবর্তন করা যেত না। শাসনতন্ত্র পরিবর্তনের জন্য বিশেষ পদ্ধতির প্রয়োজন পড়ত। এ শাসনতন্ত্রে কেন্দ্র ও প্রাদেশিক সরকারের বিবিধ বিষয় লিপিবদ্ধ করা ছিল।

আরো পড়ুন: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রের অধীনে সংসদীয় ব্যবস্থা

সংসদীয় ব্যবস্থা ১৯৫৬ সালের পাকিস্তানে প্রবর্তিত শাসনতন্ত্রের একটি বিশেষ দিক। ব্রিটিশ শাসনতন্ত্রের ন্যায় এ শাসনতন্ত্রের আইন পরিষদের প্রাধান্য স্বীকার করা হয়। উক্ত শাসনতন্ত্রের মাধ্যমে পাকিস্তানের সকল ক্ষমতা একজন প্রধান মন্ত্রি ও মন্ত্রি পরিষদের হাতে ন্যস্ত করা হয়। প্রধানমন্ত্রি ছিলেন মন্ত্রিপরিষদের সভাপতি ও পরিচালক। অন্যান্য মন্ত্রিদের প্রেসিডেন্টের সুপারিশক্রমে প্রধানমন্ত্রি নিযুক্ত করতেন। কিন্তু ১৯৫৮ সালের ৭ই অক্টোবর এ ব্যবস্থার অবসান ঘটে। এর কারণগুলো নিম্নরূপ:

(১) কেন্দ্রীয় সরকারের হস্তক্ষেপ: কেন্দ্রীয় সরকারের হস্তক্ষেপ ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রে প্রবর্তিত সংসদীয় ব্যবস্থার ব্যর্থতার প্রথম কারণ। কেন্দ্রীয় সরকার ঐ সংসদীয় ব্যবস্থার সাফল্যের জন্য কোনক্রমেই উপযোগী ছিল না। কখনও কখনও প্রাদেশিক মন্ত্রিসভা ভেঙ্গে কেন্দ্রের শাসন প্রতিষ্ঠিত করা হয়। ফলে সংসদীয় ব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে পড়ে।

(২) সুষ্ঠু নির্বাচন ব্যবস্থার অভাব: সুষ্ঠু নির্বাচন ব্যবস্থার অভাবে পাকিস্তানে প্রবর্তিত সংসদীয় ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ে। সংসদীয় ব্যবস্থার সফলতার অন্যতম পূর্ব শর্ত হল সুষ্ঠু নির্বাচন। তৎকালীন পাকিস্তানের মন্ত্রিসভায় সুষ্ঠু নির্বাচনের অভাব দেখা দেয়। নির্দিষ্ট সময়ে নিয়মিত নির্বাচন অনুষ্ঠানে অনীহা দেখা গেছে। ফলে সংসদীয় ব্যবস্থাকে ব্যর্থতায় পেয়ে বসে।

(৩) আঞ্চলিকতা: আঞ্চলিকতা ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রে প্রবর্তিত সংসদীয় ব্যবস্থা ব্যর্থতার একটি বিশেষ কারণ। পাকিস্তানের অঞ্চল ভিত্তিক রাজনীতি সংসদীয় ব্যবস্থাকে দুর্বল করে ফেলে। পাকিস্তান সৃষ্টির শুরু থেকে রাজনৈতিক ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। তারা পূর্ব বাংলাকে অবহেলার দৃষ্টিতে দেখাত। ফলে সংসদীয় ব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে পড়ে।

(৪) পদস্থ কর্মকর্তাদের প্রভাব: পদস্থ কর্মকর্তাদের প্রভাব পাকিস্তানের সংসদীয় ব্যবস্থাকে ব্যর্থতায় পর্যবসিত করে। পাকিস্তানের উচ্চ পদস্ত কর্মকর্তারা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আধিপত্য বিস্তার করেছিল। বিভিন্ন প্রদেশে পদস্থ ব্যক্তিগণ রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অনধিকার প্রভাব বিস্তার করত। তারা প্রদেশে অবস্থান করেও কেন্দ্রীয় রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করত।

(৫) ইস্কান্দার মির্জার ক্ষমতা লিলা: পাকিস্তানের রাজনীতিতে ইস্কান্দার মির্জার ক্ষমতা লিন্দা সংসদীয় ব্যবস্থাকে দুর্বল করে দেয়। প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মীর্জা ছিলেন অত্যন্ত ক্ষমতা লিন্দু। তিনি রাজনীতিতে সর্বদা নিজের আধিপত্য বজায় রাখতে চেয়েছিলেন। এমনকি তিনি নীতি গর্হিত ষড়যন্ত্র, কোন্দল ও কার্যকলাপে লিপ্ত হতেন। অবশেষে পুনরায় তাঁর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সম্ভাবনা বিলুপ্ত জেনে তিনি সংসদীয় ব্যবস্থার উপর আঘাত হানেন।

(৬) নেতৃত্বের অভাব: পূর্ব পাকিস্তানে নেতৃত্বের অভাব ছিল না, কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানে নেতৃত্বের অভাব ছিল, বিশেষ করে পাকিস্তানকে এক শাসন ব্যবস্থার অধীনে রাখার মত দৃঢ় নেতৃত্বের অভাব ছিল।

(৭) আমলাদের মনোভাব: আমলাদের মনোভাব ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রে প্রবর্তিত সংসদীয় ব্যর্থতায় একটি অন্যতম কারণ। ব্রিটিশ শাসনামলে এ অঞ্চলে রাজনৈতিক নেতৃত্বের অভাব পরিলক্ষিত হয়। নেতৃত্বের অভাবের কারণে আমলারা অত্যন্ত প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন। এমনকি তারা রাজনীতিতে অনুচিত হস্তক্ষেপ করত। এরূপ পরিস্থিতিতে সংসদীয় ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ে।

উপরে উল্লিখিত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রে প্রবর্তিত সংসদীয় গণতন্ত্র সার্থকভাবে কাজ করতে পারে নি। যার পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তানের সংসদীয় ব্যবস্থা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।

সারকথা

১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্র ছিল পাকিস্তানের প্রথম শাসনতন্ত্র। পাকিস্তান সৃষ্টির দীর্ঘ ৯ বছর পর শাসনতন্ত্র বিশেষজ্ঞগণ এ শাসনতন্ত্রটি প্রণয়ন করেছিলেন। এ শাসনতন্ত্রের অধীনে পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন ও সংসদীয় ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। কিন্তু এ শাসনতন্ত্র যথার্থভাবে কাজ করতে পারেনি। এ শাসনতন্ত্র দিনে দিনে অকার্যকর হয়ে পড়ে। শাসনতন্ত্রের এ ব্যর্থতার জন্যে (পশ্চিম পাকিস্তানের) শাসকবর্গই দায়ী ছিলেন। যার পরিপ্রেক্ষিতে শাসনতন্ত্র রচনার আড়াই বছরের মধ্যেই এটি বাতিল ঘোষণা করা হয় এবং সামরিক শাসন জারী করা হয়।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url