বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি ব্যাখ্যা ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা সম্পর্কে আলোচনা করতে পারবেন। মুজিবনগর সরকার গঠনের প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করতে পারবেন। মুজিবনগর সরকারের ভূমিকা আলোচনা করতে পারবেন।

ভূমিকা

বাঙ্গালি জাতির ইতিহাসে মুক্তিযুদ্ধ সর্বাপেক্ষা গৌরবময় ঘটনা। ১৯৭১ সালের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাঙ্গালিরা একটি স্বাধীন জাতি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ রাষ্ট্র। দীর্ঘ নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং তাদের এদেশীয় এজেন্টদের গণহত্যার শিকার হয় ত্রিশ লক্ষ মানুষ। এক কোটি লোক শরণার্থী হিসাবে ভারত গমন করতে বাধ্য হয়। এ ছাড়া অপরিমেয় সম্পদহানি ঘটে। অগণিত মা-বোন ইজ্জত হারান। জাতিসংঘের এক হিসাব মতে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে সংগঠিত গণহত্যার হার পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বোচ্চ। কিন্তু এত হত্যা এবং ধ্বংসও বাঙ্গালির স্বাধীনতার স্পৃহাকে স্তব্ধ করতে পারে নি। '৭১ এর মার্চ মাসে যুদ্ধ শুরু হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই জনগণ প্রাথমিক অসংগঠিত অবস্থা কাটিয়ে উঠে। পরবর্তীতে মুক্তিযোদ্ধারা প্রবল বিক্রমে শত্রু বাহিনীর উপর আক্রমণ শুরু করে। সারা দেশব্যাপী মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধ সংগ্রাম মুক্তিযুদ্ধকে অপরিহার্য পরিণতির দিকে নিয়ে যায়। সাধারণ মানুষ মুক্তিযুদ্ধে শরীক হয়ে এই যুদ্ধকে নতুন মাত্রা দান করে। বাঙালি জাতির অপরিসীম সাহস ও ত্যাগ তিতিক্ষার বিনিময়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়। বাঙালিদের মুক্তিযুদ্ধে ভারত ও তৎকালীন সোভিয়েট ইউনিয়ন সকল দিক থেকে সক্রিয় সহযোগিতা প্রদান করেছিল। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন এর বিরোধিতা করে। জামাতে ইসলামী ও মুসলিম লীগের নেতা-সমর্থকরা রাজাকার, আল বদর, আল শামস্ বাহিনী গঠন করে পাক হানাদার বাহিনীর পক্ষ হয়ে গণহত্যা, অগ্নি সংযোগ, নারী ধর্ষণের মতো জঘন্য ও মানবতা বিরোধী অপরাধ সংঘটিত করেছিল। পাকিস্তানী বাহিনী তাদের হাতে অস্ত্রও তুলে দিয়েছিল। এই বাহিনীর সদস্যরা বিজয় দিবসের প্রাক্কালে ১৪ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক অধ্যাপক, সাংবাদিক, লেখক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, কবি, সাহিত্যিককে ধরে নিয়ে ঢাকার রায়ের বাজার ও মিরপুরে নৃশংসভাবে হত্যা করে বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করতে তৎপর হয়েছিল। এখানে একটি বিষয় স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে, মুক্তিযুদ্ধ আকস্মিক কোন ঘটনা নয়। পাকিস্তানী শাসকদের অন্যায় শাসন-শোষণের অবসান এবং গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পরিচালিত দীর্ঘদিনের আন্দোলন সংগ্রামেরই সফল পরিণতি গৌরবজ্জ্বল মুক্তিযুদ্ধ। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্রকাঠোমোয় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর থেকে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভপর্যন্ত কখনো বাঙ্গালিদের নায্য অধিকারগুলো পূরণ করা যায় নি। বরং আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক- সাংস্কৃতিক সকল ক্ষেত্রেই বৈষম্যের শিকার হতে হয়েছে। রাষ্ট্রিক শোষণের শিকার বাঙ্গালিরা শুরু থেকে সকল বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায় এবং সংগঠিত হয়। বায়ান্নোর মহান ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ছেষট্টির ছয় দফা আন্দোলন, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তর এর সাধারণ নির্বাচনে বাঙ্গালিদের জয়লাভ, একাত্তরের মার্চ মাসের অসহযোগ আন্দোলন এসবই স্বাধিকার আদায়ের দৃষ্টান্ত। এসব আন্দোলন সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় সংগঠিত হয় ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ।

আরো পড়ুন: সংসদের কার্যপদ্ধতি ও বিভিন্ন কমিটি

মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট

পাকিস্তানী শাসকদের সব অনুমান ব্যর্থ করে আওয়ামী লীগ ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, বাঙ্গালিদের স্বাতন্ত্র্য ও স্বায়ত্তশাসনের লক্ষে পূর্ব বাংলার জনগণ আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে জয়ী করে। নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করায় রাষ্ট্র পরিচালনায় বাঙালিদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত

হয়। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭১ ঘোষণা করেন যে, ৩ মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হবে। এ ঘোষণার অন্তরালে ইয়াহিয়া খানের সামরিক চক্র জুলফিকার আলী ভুট্টোর সহায়তায় বাঙালিদের ক্ষমতার বাইরে রাখার চক্রান্ত শুরু করেন। অধিবেশন শুরুর মাত্র দু'দিন পূর্বে ১ মার্চ ১৯৭১ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করা হয়। ষড়যন্ত্রমূলক এই অগণতান্ত্রিক ঘোষণার সাথে সাথেই বাঙালিদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। জনগণ রাজপথে নেমে এসে বিক্ষোভ প্রদর্শন ও সরকারি সকল নিষেধাজ্ঞা অমান্য করতে শুরু করে। পাকিস্তান রাষ্ট্রকে চূড়ান্ত প্রত্যাখানের প্রতীক হিসাবে পাকিস্তানের পতাকা পুড়িয়ে দেয়।

পূর্ব পাকিস্তানে জনগণের দাবির মুখে ইয়াহিয়া খান ৬ মার্চ ঘোষণা করেন যে, ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসবে কিন্তু এর পূর্বে সংসদীয় দলগুলোর বৈঠকের প্রস্তাব দেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু এ প্রস্তাব প্রত্যাখান করেন এবং ৭মার্চ রেসকোর্সের ঐতিহাসিক জনসভায় আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। বিভিন্ন বাস্তব জটিলতার কারণে সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা না দিলেও তিনি সামরিক আইন প্রত্যাহার, সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে প্রেরণ, সাধারণ জনগণকে হত্যার তদন্ত এবং জন প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়ার জোর দাবি জানান। তিনি সকল সরকারি প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার নির্দেশ জারী করেন। ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু মুজিব ঘোষণা করেন, " এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।"

৭ মার্চের ভাষণের পর থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নির্দেশ পালন করে পূর্ব পাকিস্তানে অসহযোগ আন্দোলন চলতে থাকে। তিনি পূর্ব বাংলার প্রকৃত শাসকে পরিণত হন। জনসাধারণের সার্বিক অসহযোগিতায় ইয়াহিয়া খানের সরকার অচল হয়ে যায়। অসহযোগ আন্দোলনের কারণে ভীত হয়ে ইয়াহিয়া খান উদ্ভত সংকটের রাজনৈতিক সমাধানের অঙ্গীকার ব্যক্ত করে ১৫ মার্চ ঢাকায় আসেন এবং ২৪ মার্চ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবসহ অন্যান্য আওয়ামী লীগ নেতাদের সাথে আলোচনা চালান।

স্বাধীনতার ঘোষণা

২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সৈন্যরা অতর্কিতে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর সশস্ত্র আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মধ্যরাতে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হওয়ার পূর্ব মুহূর্তে অর্থাৎ ঘড়ির কাঁটা অনুযায়ী ২৬ মার্চ প্রত্যুষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সরাসরি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। একই ঘোষণায় তিনি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সর্বস্ব নিয়ে প্রতিরোধের নির্দেশ দেন। এতে বলা হয়:

This may be my last message. from today Bangladesh is independent. I call upon the people of Bangladesh wherever you might be and with whatever you have to resist the army of occupation to the last Your fight must go on until the last soldier of the Pakistan occupation army is expelled from the soil of Bangladesh and final victory is achieved."

(সূত্র: হাসান হাফিজুর রহমান (সম্পাদিত), বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র: তৃতীয় খন্ড, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, তথ্য মন্ত্রণালয়, ১৯৮২, পৃঃ ১)

অর্থাৎ "এ আমার শেষবাণী। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের জনগণ তোমরা যে যেখানে থাকো, তোমাদের কাছে যা কিছু আছে তা নিয়ে শেষ পর্যন্ত দখলদার বাহিনীর প্রতিরোধ করো।"

বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার ইংরেজি বার্তাটি সারাদেশে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য তৎকালীন ইপিআর-এর ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে চট্টগ্রাম পৌঁছে দেওয়া হয়। এটি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র (চট্টগ্রাম) থেকে বার বার প্রচার করা হয় এবং লিফলেট আকারে বিলি করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের দলিলেও বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। 

বঙ্গবন্ধুর এই স্বাধীনতা ঘোষণা একই বেতার কেন্দ্র থেকে চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা ও জাতীয় পরিষদ সদস্যএম এ হান্নান ও আবুল কাশেম সন্দ্বীপসহ আরো কয়েকজন একাধিকবার পাঠ করেন। ২৭ মার্চ মেজর জিয়া (জিয়াউর রহমান) বঙ্গবন্ধুর নামে স্বাধীনতা ও বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সরকার গঠন সম্পর্কিত আরেকটি ঘোষণা দেন। (সূত্র: হাসান হাফিজুর রহমান (সম্পাদিত), বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র: তৃতীয় খন্ড, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, তথ্য মন্ত্রণালয়, ১৯৮২, পৃঃ ২।

মুজিবনগর সরকার গঠন

মুক্তিযুদ্ধকে সুষ্ঠুভাবে সংঘটিত, পরিচালিত ও রাজনৈতিক রূপ দেওয়ার উদ্দেশ্যে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যরা ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, তাঁর অনুপস্থিতিতে সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও তাজউদ্দিন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে একটি আনুষ্ঠানিক সরকার গঠনের ঘোষণা দেন। এছাড়া, একটি 'স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র'ও তারা গ্রহণ করেন। ১৭ এপ্রিল কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহাকুমার (তৎকালীন) বৈদ্যনাথ তলায় ('মুজিবনগর' নামে খ্যাত) দেশি-বিদেশি সাংবাদিক ও স্থানীয় বিপুল সংখ্যক জনগণের উপস্থিতিতে নবগঠিত সরকার (যা মুজিবনগর সরকার' নামে, পরিচিত) আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ গ্রহণ করে। একই অনুষ্ঠানে জনপ্রতিনিধিদের পক্ষে অধ্যাপক ইউসুফ আলী এম এন এ 'স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র' পাঠ করেন, যা বাংলাদেশের স্বাধীনতার 'সাংবিধানিক ঘোষণা' ('Constitutional Proclamation) হিসেবে চিহ্নিত। এতে বঙ্গবন্ধুর ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণাকে অনুমোদন করা হয়।

১৯৭০ সালের নির্বাচনে জনগণের সুস্পষ্ট 'ম্যান্ডেট' পেয়ে মেজরিটি পার্টির নেতা ও বাঙালি জাতির মুখপাত্র হিসেবে একমাত্র বঙ্গবন্ধুরই বাংলাদেশের 'স্বাধীনতা ঘোষণার' বৈধ ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব ছিল। তাই, বঙ্গবন্ধুর ২৬ মার্চের ঘোষণা অনুযায়ী ঐদিনটিকে আমরা স্বাধীনতা দিবস হিসেবে পালন করে থাকি। বঙ্গবন্ধুকে প্রধান করে মুজিবনগর সরকার গঠন এবং স্বাধীনতার 'সাংবিধানিক ঘোষণা'র পর আমাদের মুক্তিযুদ্ধ বৈধ নেতৃত্ব ও আইনগত ভিত্তি লাভ করে।

মুজিব নগর সরকারের গঠন নিম্নরূপ:

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান - রাষ্ট্রপতি

সৈয়দ নজরুল ইসলাম- উপরাষ্ট্রপতি

তাজউদ্দিন আহমদ- প্রধানমন্ত্রী

খন্দকার মোস্তাক আহমেদ- পররাষ্ট্র ও আইনমন্ত্রী

ক্যাপ্টেন এম. মনসুর আলী- অর্থ ও বাণিজ্য মন্ত্রী

এ এইচ এম কামারুজ্জামান- স্বরাষ্ট্র, যোগাযোগ ও ত্রাণ মন্ত্রী

এছাড়াও কর্নেল আতাউল গণি ওসমানীকে মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করা হয়। সিদ্ধান্ত গৃহিত হয় যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতিতে সৈয়দ নজরুল ইসলাম রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করবেন। বাস্তব

কারণে এ সরকার ভারতের মাটিতে থেকে কার্যক্রম পরিচালনা করতেন বলে একে প্রবাসী সরকারও বলা হয়।

আরো পড়ুন: ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থান, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও নির্বাচন

মুজিবনগর সরকারের ভূমিকা

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে তাজউদ্দিন আহমদের সুযোগ্য নেতৃত্বে মুজিবনগর সরকার ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে। একটি সার্বভৌম সরকারের সকল ক্ষমতা প্রয়োগে মুজিবনগর সরকার সফল হয়েছিল। দেশকে পাকিস্তানী কবল মুক্ত করার মূল লক্ষ্য সামনে রেখে মুজিব নগর সরকার গঠিত হয়। মুক্তিবাহিনী, নিয়মিত বাহিনী, গেরিলা বাহিনীকে সংগঠিত করে নেতৃত্ব দেওয়া- তাদের বীরত্বের কথা জাতিকে জানানো, বহির্বিশ্বে জনমত সৃষ্টি এসব কাজই প্রবাসী সরকার সাফল্যের সাথে পালন করে। যুদ্ধ চলাকালে মুজিবনগর সরকারের ভূমিকা নিম্নে আলোচনা করা হলো:

স্বাধীন বাংলাদেশের রূপরেখা

১৯৭১ সালের ১০ মে মুজিবনগর সরকার স্বাধীন বাংলাদেশের ভবিষ্যত রূপরেখা ঘোষণা করে। এ ঘোষণায় বলা হয়- বাংলাদেশ সমাজতন্ত্রী আদর্শ গ্রহণ করবে। বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন হবে এবং ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা বাতিল করা হবে।

বিশ্ব শান্তি পরিষদে প্রতিনিধি প্রেরণ

পাকিস্তানী বাহিনীর গণহত্যা এবং বাঙালিদের স্বাধীনতা যুদ্ধের বাস্তব অবস্থা বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরার জন্য বুদাপেষ্টে অনুষ্ঠিত বিশ্ব শান্তি পরিষদের সম্মেলনে প্রতিনিধিদল প্রেরণ করা হয়। ১৩-১৬ মে' ১৯৭১ এ অনুষ্ঠিত এই সম্মেলন বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্ব জনমত গড়ে তোলায় সহায়তা করে।

বেসামরিক প্রশাসন প্রতিষ্ঠা

যুদ্ধকালীন অবস্থাতেই মুজিবনগর সরকার প্রতিটি জেলার জন্য জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে পূর্ণাঙ্গ প্রশাসনিক টিম গঠন করে। এর লক্ষ্য ছিল প্রশাসনিক শূন্যতা পূরণ করা। একটি সার্বভৌম সরকারের সকল ক্ষমতা প্রয়োগে মুজিবনগর সরকার সফল হয়েছিল।

পুনর্বাসন ও পুনর্গঠন

দেশের অভ্যন্তরে ক্ষতিগ্রস্ত এবং ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী শরনার্থীদের পুনর্বাসনের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণের ব্যবস্থা গ্রহণ মুজিব নগর সরকারের অন্যতম সাফল্য। গৃহনির্মাণসামগ্রী, কৃষিউপকরণ, স্বাস্থ্যসেবা, যোগাযোগ ব্যবস্থা সচল করা- এসবই সরকারের কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত ছিল।

সারকথা

১৯৭০ সালের সাধারন নির্বাচনে জয়লাভ করলেও পাকিস্তানী শাসকচক্র বাঙ্গালিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করার চক্রান্ত শুরু করে। নায্য অধিকার আদায়ের দাবিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাঙ্গালিরা মার্চ মাসে অসহযোগ আন্দোলন শুরু করে। আন্দোলনের কারণে ভীত হয়ে পাকিস্তানী শাসকচক্র সংকট নিরসনের জন্য আলোচনা শুরু করলেও গোপনে সামরিক প্রস্তুতি গ্রহণ করে। অবশেষে ২৫ মার্চের মধ্য রাত্রিতে (ঘড়ির কাটা অনুযায়ী ২৬ মার্চ) বঙ্গবন্ধু সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। ১০ এপ্রিল ১৯৭১ মুজিবনগর সরকার গঠিত হয়। ১৭এপ্রিল প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রীসভা আনুষ্ঠানিক ভাবে শপথ গ্রহণ করেন।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url