১৯৫৮ সালের সামরিক শাসন
১৯৫৮ সালের সামরিক শাসনের পটভূমি, ১৯৫৮ সালের সামরিক শাসন জারীর কারণ ব্যাখ্যা করতে পারবেন, ১৯৫৮ সালের সামরিক শাসনের ফলাফল বিশ্লেষণ করতে পারবেন।
১৯৫৮ সালের সামরিক শাসন জারীর পটভূমি
১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের অভূতপূর্ব সাফল্য ঘটে। এ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে পূর্ব বাংলার জনসাধারণ তাদের স্বাধীকারের ক্ষেত্রে নিজস্ব অভিমত ব্যক্ত করে। পক্ষান্তরে মুসলিমদের শোচনীয় পরাজয় ঘটে। মুসলিম লীগের শোচনীয় পরাজয়ের পর থেকে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী পূর্ব বাংলাকে বিভিন্ন দিক থেকে নিয়ন্ত্রণ করার কৌশল খুঁজতে থাকে। কেন্দ্রীয় শাসকগোষ্ঠী পূর্ব বাংলায় দমন নীতির আশ্রয় নেন। এ সময় পাকিস্তানের রাজনীতিতে আমলাদের অভাবনীয় প্রভাব বৃদ্ধি পায়। দেশের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক ব্যবস্থায় বিশৃংখলা দেখা দেয়। জনগণের জীবনে অনিশ্চয়তা নেমে আসে। এরূপ পরিস্থিতিতে কেন্দ্র ও প্রদেশের মন্ত্রিসভায় দ্রুত রদবদল লক্ষ্য করা যায়। রাজনৈতিক দলগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে। এরূপ অবস্থায় ১৯৫৮ সালের ৭ই অক্টোবর সমগ্র পাকিস্তানে সামরিক আইন জারী করা হয়। এভাবে পাকিস্তানে সংসসদীয় গণতন্ত্রের দ্বার রুদ্ধ হয়ে যায়।
আরো পড়ুন: ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থান, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও নির্বাচন
সামরিক শাসন জারীর কারণ
১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারী করা হয়। এ সামরিক শাসন জারীর কারণগুলো ছিল নিম্নরূপ:-
(১) পার্লামেন্টারি সরকারের ব্যর্থতা: পার্লামেন্টারী সরকারের ব্যর্থতা ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারির প্রথম কারণ। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের পর যুক্তফ্রন্ট সরকার বেশি দিন ক্ষমতায় থাকতে পারে নি। ১৯৫৬ সালের সংবিধানে প্রবর্তিত সংসদীয় সরকার যথার্থভাবে কাজ করতে পারে নি। ফলে সামরিক শাসন জারী করা হয়।
(২) উচ্চকাঙ্ক্ষা: সামরিক নেতাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা ১৯৫৮ সালের সামরিক শাসনের পথ প্রশস্ত করে। সামরিক বাহিনী আসলে একটি সুবিধাভোগী গোষ্ঠী। প্রতিরক্ষা ও অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃংখলা নিশ্চিত করা ছিল তাদের প্রধান কাজ। কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর অনেকদিনের লালিত উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করা।
(৩) বৃহৎ শক্তির ভূমিকা: বৃহৎ শক্তির ভূমিকা জারী সামরিক অভ্যুত্থানের একটি বড় কারণ। পাকিস্তানের সামরিক শাসন জারীর। চীন-সোভিয়েতে ও মার্কিন দ্বন্ধে পাকিস্তান একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। এ কারণে আমেরিকার ন্যায় বৃহৎ শক্তির ছত্রছায়ায় পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে।
(৪) আমলাদের প্রভাব: পাকিস্তানে ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারীর অন্যতম কারণ হল আমলাদের প্রতার। পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে আমলারা রাজনৈতিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিত। এক্ষেত্রে তাদের সাথে সেনাবাহিনীর একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে যা সেনাবাহিনীকে অভ্যুত্থানে প্ররোচিত করে।
(৫) মন্ত্রিসভার ভাঙ্গন: বার বার মন্ত্রিসভার ভাঙ্গন ১৯৫৮ সালের সামরিক শাসনের জন্য দায়ী। যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রিসভা গঠনের অল্প দিনের মধ্যে মন্ত্রিসভাকে ঘিরে বিতর্কের সূত্রপাত ঘটে। অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে মন্ত্রিসভা ভেঙ্গে পড়ে। ফলে সেনাবাহিনী হয়ে ওঠে আরও শক্তিশালী।
(৬) রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা: রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ১৯৫৮ সালের সামরিক শাসন জারীর একটি বিশেষ কারণ। ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্র কার্যকরী হবার পর পরই মন্ত্রিসভায় রদবদল ঘটে। এরূপ রদবদলের কারণে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা দেখা দেয়।
(৭) দুর্নীতি: দুর্নীতি সামরিক শাসন জারীর একটি অন্যতম কারণ। পাকিস্তানের রাজনীতিতেও এর ব্যতিক্রম নয়। পাকিস্তান সৃষ্টির পর বিশেষ করে প্রশাসনে ব্যাপক দুর্নীতি চলে। এ দুর্নীতির কারণে প্রশাসন অচল হয়ে পড়ে। সামরিক বাহিনী এ অজুহাতে রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করে।
(৮) যোগ্য নেতৃত্বের অভাব: ১৯৫৮ সালে যোগ্য নেতৃত্বের ব্যর্থতার অভাবের কারণে পাকিস্তানে সামরিক বাহিনী ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। পাকিস্তান সৃষ্টির পর রাজনীতিতে সুষ্ঠু ও যোগ্য নেতৃত্বের অভাব পরিলক্ষিত হয়। যার পরিপ্রেক্ষিতে মন্ত্রিসভা ভেঙে পড়ে। জনপ্রিয় নেতা এ.কে. ফজলুল হক ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মত নেতাদের রাজনীতি থেকে দূরে অবস্থানের কারণে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করে।
(৯) মুসলিম লীগের সমর্থন: ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের শোচনীয় পরাজয় ঘটে। মুসলিম লীগের সদস্যগণ বিভিন্ন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। অবশেষে তারা সামরিক বাহিনীকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের প্রতি তাদের সমর্থন জানায়।
আরো পড়ুন: সামরিক শাসনের বেসামরিকীকরণ প্রক্রিয়া: জিয়া ও এরশাদ শাসনামল
১৯৫৮ সালের সামরিক শাসনের ফলাফল
১৯৫৮ সালের সামরিক শাসনের ফলাফল সুদূর প্রসারী। এ শাসনের ফলাফল ছিল নিম্নরূপ:
(১) শাসনতন্ত্র বাতিল: ১৯৫৮ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পরবর্তী প্রথম ফল হল শাসনতন্ত্র বাতিল। সামরিক শাসকগণ ক্ষমতায় এসে প্রথমে পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র বাতিল করে। প্রেসিডেন্ট এক ঘোষণায় ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্র বাতিল করেন।
(২) রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ: সামরিক শাসকগণ ক্ষমতাসীন হয়েই রাজনীতিতে বিশেষ ভাবে নজর দেয়। জেনারেল আইয়ুব খান ক্ষমতাসীন হয়েই রাজনীতি নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ নেন। এ লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারগুলোকে বরখাস্ত করে। এভাবে তারা রাজনীতিতে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন।
(৩) একনায়কতান্ত্রিক শাসন: একনায়কতান্ত্রিক শাসন ১৯৫৮ সালের সামরিক শাসনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। জেনারেল আইয়ুব খান রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণ করেই একনায়কতান্ত্রিক মনোভাব পোষণ করেন। ফলে দেশে এককেন্দ্রিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। সবকিছুই কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।
(৪) রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস: রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করে দেওয়া সামরিক শাসনের পরবর্তী রূপ। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খানের সহযোগীরা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠাগুলোকে ধ্বংস করে দেয়। বিশেষ করে তারা যুক্তফ্রন্টের ভাঙ্গন অনিবার্য করে তোলে।
(৫) মৌলিক গণতন্ত্র প্রণয়ন: মৌলিক গণতন্ত্র ১৯৫৮ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পরবর্তী ফসল। জেনারেল আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারি করে মৌলিক গণতন্ত্র নামে একটি অভিনব ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। এভাবে সামরিক সরকার রাজনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণ করে।
(৬) মামলা নির্যাতন ও দমননীতি: ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানের রাজনীতিতে সামরিক বাহিনী অধিষ্ঠিত হয়। ক্ষমতায় এসে তারা রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে মামলার জালে আবদ্ধ করেন। মামলা মোকদ্দমা ও নির্যাতন-দমন নীপীড়নের দ্বারা রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে দূর্বল করে ফেলে।
সারকথা
১৯৫৮ সালের সামরিক অভ্যুত্থান পাকিস্তানের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি কালো অধ্যায়। একটি বিশেষ লক্ষ্যণীয় যে পরবর্তীকালে পাকিস্তানের রাজনীতিতে সামরিক হস্তক্ষেপ একটি নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপারে পরিণত হয়। জেনারেল জিয়াউল হক এবং ১৯৯৯ সালে জেনারেল পারভেজ মোশাররফ ক্ষমতা গ্রহণ করে এ সত্যটি আবারও প্রমাণ করেছেন। সামরিক শাসন সুস্থ্য রাজনীতিকে ধ্বংস করে দেয়। ১৯৫৮ সালের পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী ক্ষমতাসীন হয়ে সামরিক আইনের মাধ্যমে দেশ শাসন করে। তারা ক্ষমতাসীন হয়ে শাসনতন্ত্র বাতিল, একনায়কতান্ত্রিক শাসন প্রবর্তন এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার করতে থাকে। আইয়ুব সরকার জনগণের অনুভূতি উপলব্ধি করতে না পেরে একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত নেয়। ফলশ্রুতিতে বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদ শক্তিশালী হয়। জন্ম নেয় একটি স্বাধীন ও স্বার্বভৌম দেশ যার নাম বাংলাদেশ।
এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url