মন্ত্রিমিশন পরিকল্পনা কংগ্রেস ও মুসলীম লীগের প্রতিক্রিয়া

মন্ত্রিমিশন পরিকল্পনা: কংগ্রেস ও মুসলীম লীগের প্রতিক্রিয়া মন্ত্রি মিশন পরিকল্পনার পটভূমি সম্পর্কে বর্ণনা মন্ত্রি মিশন পরিকল্পনার বৈশিষ্ট্যগুলো মন্ত্রি মিশন পরিকল্পনার প্রতি মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের প্রতিক্রিয়া ব্যাখ্যা করতে পারবেন

মন্ত্রিমিশন পরিকল্পনার পটভূমি

১৯৪২ সালের ২৯ মার্চ ব্রিটিশ ক্যাবিনেটের একজন প্রভাবশালী মন্ত্রিস্যার স্টাফোর্ড ক্রীপসের দেওয়া খড়সা প্রস্তাব (যা "ক্রীপস প্রস্তাব" নামে পরিচিত) ভারতের রাজনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক সমস্যা সমাধানে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়। তাছাড়া, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসান, যুদ্ধোত্তর বিশ্বপরিস্থিতি, ব্রিটেনে শ্রমিক দলের নতুন সরকার গঠন, ভারতীয়দের স্বাধীনতার প্রত্যাশা ইত্যাদি ব্রিটিশ সরকারের ভারত নীতিকে মারাত্মকভাবে প্রভাবান্বিত করে। এ সময় ব্রিটেনের নতুন সরকার বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার অংশ হিসেবে ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক সমস্যা সমাধানে নতুন পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এর অংশ হিসেবে ১৯৪৬ সালের মার্চ মাসে ব্রিটিশ মন্ত্রিসভার তিনজন প্রভাবশালী মন্ত্রি যথা, ভারত সচিব লর্ড লরেন্স, বাণিজ্য বোর্ডের সভাপতি স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রীপস এবং নৌ-বিভাগের প্রথম লর্ড এ.ভি. আলেকজান্ডারকে নিয়ে গঠিত একটি মিশন ভারতে প্রেরণ করা হয়। ১৯৪৬ সালের ৫ মে থেকে এই মন্ত্রি মিশন সিমলাতে ভারতীয় নেতৃবৃন্দের সাথে ভারতবর্ষের ভবিষ্যৎ শাসনতান্ত্রিক রূপরেখা নিয়ে আলাপ আলোচনা করেন। আলোচনায় একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের রূপরেখা গণপরিষদ গঠন ইত্যাদি অত্যন্ত জটিল রাজনৈতিক বিষয় স্থান পায়। কিন্তু পরস্পর বিরোধী মনোভাবের কারণে এই আলোচনায় কোন ফলাফল পাওয়া যায় নি। যার ফলে, মন্ত্রিমিশন ১৯৪৬ সালের ১৬ মে ভারতের রাজনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে তাদের নিজস্ব চিন্তাধারা সম্বলিত একটি পরিকল্পনা ঘোষণা করেন। এই পরিকল্পনাই 'মন্ত্রি মিশন পরিকল্পনা' নামে অভিহিত।

আরো পড়ুন: বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন বঙ্গভঙ্গ: কারণ ও ফলাফল

মন্ত্রিমিশন পরিকল্পনার বৈশিষ্ট্য

এই পরিকল্পনার প্রস্তাবগুলো দুইভাবে বিভক্ত ছিল-স্বল্প মেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী। নিম্নে মন্ত্রিমিশন পরিকল্পনার বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হল:

১। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ ও দেশীয় রাজ্যগুলোর সমন্বয়ে একটি সর্বভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র গঠন করা হবে এবং যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে শুধুমাত্র দেশের প্রতিরক্ষা, যোগাযোগ ও বৈদেশিক সম্পর্ক এই তিনটি বিষয় ন্যস্ত থাকবে। কেন্দ্রীয় সরকার তার ব্যয়ভার মেটানোর জন্য অর্থ সংগ্রহ করার ক্ষমতা রাখবে।

২। কেন্দ্রীয় সরকারের আওতাভুক্ত বিষয় ছাড়া অন্য সকল বিষয়ের উপর প্রাদেশিক ও দেশীয় রাজ্য সরকারের কর্তৃত্ব থাকবে।

৩। ব্রিটিশ ভারত ও দেশীয় রাজ্যের প্রতিনিধিদের নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের-কেন্দ্রীয় আইনসভা ও শাসন বিভাগ গঠিত হবে। কেন্দ্রীয় আইন সভায় কোন সম্প্রদায়ের প্রধান মৌলিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হলে স্বার্থ সংশ্লিষ্ট সম্প্রদায়ের ভোটদানকারী সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থন প্রয়োজন হবে।

৪। ব্রিটিশ ভারতের প্রদেশগুলোকে তিনটি ভাগে বিভক্ত করা হবে। যথা-

"A" গ্রুপ মাদ্রাজ, বোম্বাই বিহার, উড়িষ্যা, মধ্যপ্রদেশ ও যুক্ত প্রদেশ- (৬টি হিন্দু প্রধান প্রদেশ) "B" গ্রুপ পাঞ্জাব, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও সিন্ধু (উত্তর-পশ্চিম ভারতের মুসলিম প্রধান ৩টি প্রদেশ)

"C" গ্রুপ বাংলাদেশ ও আসাম (পূর্ব ভারতের মুসলিম প্রধান প্রদেশ)।

প্রতিটি গ্রুপ তাদের স্বাতন্ত্র্য লাভ করবে এবং কেন্দ্রীয় সরকারের শাসন সংক্রান্ত বিষয়গুলো ছাড়া পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন অর্জন করবে।

৫। প্রতিটি গ্রুপের আলাদা শাসন বিভাগ ও আইন বিভাগ থাকবে, যা হবে প্রাদেশিক পর্যায়ের।

৬। সকল গ্রুপের প্রতিনিধি সমন্বয়ে গণপরিষদ গঠন করা হবে, যা যুক্তরাষ্ট্রের শাসনতন্ত্র রচনা করবে।

৭। দশ বছসর পর প্রদেশ ও আইনসভার সর্বসম্মতিক্রমে সংবিধান সংশোধন কিংবা পুনঃবিবেচনা করা যাবে-এই মর্মে যুক্তরাষ্ট্রীয় সংবিধানে একটি ধারা থাকবে।

৮। যে-কোন প্রদেশ সংবিধান রচিত হবার পর সংশ্লিষ্ট গ্রুপ থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে।

৯ ভারতের জন্য নতুন শাসনতন্ত্র প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত গভর্নর জেনারেল কর্তৃক ভারতবর্ষের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হবে।

১০ প্রস্তাবিত যুক্তরাষ্ট্র গঠনের পর দেশীয় রাজ্যগুলোর উপর থেকে ব্রিটিশ সার্বভৌম ক্ষমতা বিলুপ্ত হবে এবং দেশীয় রাজ্যগুলো তাদের ভবিষ্যৎ সম্পর্ক নির্ধারণের নিমিত্তে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আলাপ-আলোচনা করবে।

মস্ত্রিমিশন পরিকল্পনার প্রতি মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের প্রতিক্রিয়া

মস্ত্রি মিশন পরিকল্পনা মুসলিম লীগ ও কংগ্রেস উভয়ই গ্রহণ করে ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে।

মুসলিম লীগের অবস্থান

মুসলিম লীগ মন্ত্রিমিশন পরিকল্পনায় বাধ্যতামূলক গ্রুপিং ব্যবস্থা, প্রদেশগুলোর নিজস্ব সংবিধান প্রণয়ণের ক্ষমতা, স্বায়ত্তশাসন প্রদান ইত্যাদি মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার সপক্ষে চিন্তা করে ১৯৪৬ সালের ৬ জুন মন্ত্রি মিশন পরিকল্পনা গ্রহণ করতে সম্মত হয়। এরপর গর্ভনর জেনারেল কর্তৃক অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের প্রস্তাবেও মুসলিম লীগ রাজি হয়।

কংগ্রেসের অবস্থান

কংগ্রেস সভাপতি মাওলানা আবুল কালাম আজাদ মন্ত্রি মিশন পরিকল্পনাকে সর্বপ্রথম স্বাগত জানান। কিন্তু এ সময়ে কংগ্রেসের অভ্যন্তরীণ নেতৃত্বে রদবদল ঘটে। মাওলানা আজাদের স্থলে পন্ডিত জওহরলাল নেহেরু দলের সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি মন্ত্রি মিশন পরিকল্পনাকে আংশিকভাবে গ্রহণে সম্মতি দেন।

আরো পড়ুন: জাতীয় সংসদের গঠন ক্ষমতা ও কার্যাবলি

মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের দ্বন্দ্ব

মুসলিম লীগ মন্ত্রি মিশন পরিকল্পনাকে সম্পূর্ণভাবে গ্রহণ করলেও, কংগ্রেস মন্ত্রি মিশনের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন ও বাধ্যতামূলক গ্রুপিং ব্যবস্থাকে মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানায়। ফলে ব্রিটিশ সরকার অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পূর্ব ঘোষণা থেকে সরে এসে ১৯৪৬ সালের ২৬ জুন নিজেদের মনোনীত সদস্যদের নিয়ে এক তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের ঘোষণা দেন। ২৯ জুন মন্ত্রি মিশন দেশে ফিরে যায়। মুসলিম লীগ ব্রিটিশ সরকারকে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকারী হিসাবে আখ্যায়িত করে এবং পাকিস্তান সৃষ্টির লক্ষ্যে ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট প্রত্যক্ষ সংগ্রামের' (Direct Action) ডাক দেয়। ইতোমধ্যে কংগ্রেস অন্তবর্তীকালীন সরকার গঠনের প্রস্তাব মেনে নিলে ব্রিটিশ সরকার ১৯৪৬ সালের ১২ আগস্ট উভয় দলকে কেন্দ্রে সরকার গঠনের জন্য আমন্ত্রণ জানায়। কিন্তু মুসলিম লীগ এ আমন্ত্রণ গ্রহণে অসম্মতি জানায় এবং প্রত্যক্ষ সংগ্রামের' কর্মসূচিতে অনড় থাকে। ১৬ আগস্ট কলকাতায় এক ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত হয়, যা ইতিহাসে 'Great Calcutta Killing' নামে অভিহিত। ব্রিটিশ সরকার জওহরলাল নেহেরুকে সহ-সভাপতি করে ১৯৪৬ সালের ২৪ আগষ্ট কেন্দ্রে কংগ্রেস মনোনীত ১২ সদস্য বিশিষ্ট একটি শাসন পরিষদ গঠন করে। প্রতিবাদে মুসলিম লীগ ১ সেপ্টেম্বর "কালো দিবস পালন করে। উদ্বৃত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় বারবার মুসলিম লীগকে আমন্ত্রণ জানানো হলে জিন্নাহ লীগের পক্ষে লিয়াকত আলী খানসহ ৫ জন সদস্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে যোগদানের জন্য মনোনীত করেন। কিন্তু পরস্পর বিরোধী অবস্থান দিন দিন বাড়তেই থাকে। ফলশ্রুতিতে অচিরেই মন্ত্রি মিশন পরিকল্পনা সম্পূর্ণ অকার্যকর হয়ে পড়ে।

সারকথা

ভারতের রাজনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে ১৯৪৬ সালের মার্চ মাসে ব্রিটিশ মন্ত্রিসভার তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি মিশন এ দেশে প্রেরণ করা হয় যা মন্ত্রি মিশন নামে পরিচিত। অনেক আলাপ-আলোচনা শেষে ১৯৪৬ সালের ১৬ মে মিশন একটি পরিকল্পনা ঘোষণা করে। এটি মন্ত্র মিশন পরিকল্পনা' নামে অভিহিত। এর প্রস্তাবগুলো দু'ভাগে বিভক্ত ছিল যথা, স্বল্প মেয়াদী ও দীর্ঘ মেয়াদী। প্রথমটির অংশ হিসেবে কংগ্রেস, মুসলিম লীগ ও অন্যদের নিয়ে কেন্দ্রে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের কথা বলা হয়। দ্বিতীয় ভাগে ভারত বিভক্তির পরিবর্তে খুবই শিখিল একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় ঐক্যবদ্ধ রাখার সুপারিশ করা হয়। সে মতে পরিকল্পনাটি অনেক ক্ষমতা ওকর্তৃত্ব অর্পণ করে ভারতের প্রদেশগুলোকে "A", "B" I "C" এই তিনটি গ্রুপে বিভক্ত করা হয়। মুসলিম লীগ ও এর নেতা জিন্নাহ মন্ত্রি মিশন পরিকল্পনা সম্পূর্ণভাবে গ্রহণ করেন। কিন্তু কংগ্রেস ও এর সভাপতি পন্ডিত জওহরলাল নেহেরু এটি পুরোপুরি গ্রহণে অসম্মতি জানান। ফলে মন্ত্রি মিশন পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। এরই ধারাবাহিকতায় মুসলিম লীগের 'প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস' পালন উপলক্ষে ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট কলকাতায় ইতিহাসের এক ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত হয়, যা 'গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং' নামে অভিহিত। এরপর উভয় দল একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে যোগদান করলেও তা কোন ইতিবাচক ফলাফল বয়ে নিয়ে আসে নি।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url