বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন বঙ্গভঙ্গ: কারণ ও ফলাফল
বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন বঙ্গভঙ্গ: কারণ ও ফলাফল বঙ্গভঙ্গ সম্পর্কে বলতে পারবেন। বঙ্গভঙ্গের কারণ বিশ্লেষণ করতে পারবেন। বঙ্গভঙ্গের ফলাফল ব্যাখ্যা করতে সক্ষম হবেন।
ভূমিকা
১৯০৫-১৯১১ সালের বঙ্গভঙ্গ এবং বঙ্গভঙ্গ পরবর্তী ১৯১৯-১৯২২ সালের খিলাফত-অসহযোগ আন্দোলন ব্রিটিশ-ভারতের দুটি অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক ঘটনা। উভয় ঘটনা ছিল ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলন। এই প্রথম কোন রাজনৈতিক আন্দেলন ব্যাপক গণ ভিত্তি পায়। দুটি আন্দোলনই সর্বভারতীয় রূপ লাভ করে। তবে সংগত কারণেই প্রথমটি ছিল বাংলা ভিত্তিক। এ দুয়ের মধ্যে আর একটি পার্থক্য হলো, বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন যা কার্যত হিন্দু সম্প্রদায়ের আন্দোলনে পরিণত হয়। অথচ খিলাফত-অসহযোগ আন্দোলনে হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের সম্মিলন ঘটে। বলার অপেক্ষা রাখে না বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে বঙ্গভঙ্গের প্রভাব অপরিসীম। ৩টি ভাগে এ ইউনিটে উভয় আন্দোলনের কারণ, বিস্তার, লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, হিন্দু ও মুসলমানদের অন্তর্ভুক্তির প্রশ্ন, আন্দোলনের পরিণতি এবং এর রাজনৈতিক গুরুত্ব ও তাৎপর্য ইত্যাদি বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে।
আরো পড়ুন:
বঙ্গভঙ্গ
বাংলা ও ব্রিটিশ ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে বঙ্গভঙ্গ (১৯০৫-১৯১১) একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যা নিয়ে গঠিত ছিল বাংলা প্রদেশ বা বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি। কলকাতা ছিল এর রাজধানী। এটি ছিল ব্রটিশ ভারতের বৃহত্তম প্রদেশ। শাসন কার্যের সুবিধার্থে ব্রিটিশ সরকার বাংলা প্রেসিডেন্সির বিভক্তকরণের কথা চিন্তা করতে। থাকে। উদ্যোগী ভূমিকা পালন করেন স্যার রাম্পফিল্ড ফুলার এবং স্যার এন্ড্র ক্রেজার। তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের বড়লাট লর্ড কার্জনও বহুবার বিষয়টি আলোচনা করেন। অতঃপর ১৯০৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর বঙ্গভঙ্গ সম্পন্ন হয়। সৃষ্টি হয় ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও আসামকে নিয়ে 'পূর্ববঙ্গ ও আসাম নামে' এক নতুন প্রদেশ এবং এর রাজধানী হয় ঢাকা। নতুন প্রদেশের আয়তন ছিল ১,০৬,৫০৪, বর্গমাইল। এর লোকসংখ্যা ছিল ৩ কোটি ১০ লক্ষ। জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ছিল মুসলমান (১ কোটি ৮০ লক্ষ)।
বঙ্গভঙ্গের কারণ
বঙ্গভঙ্গের পেছনে প্রধান কারণগুলো ছিল নিম্নরূপ:
(১) শাসনতান্ত্রিক;
(২) রাজনৈতিক;
(৩) সামাজিক;
(৪) অর্থনৈতিক।
কারণগুলো নিচে পর্যালোচনা করা হল:
শাসনতান্ত্রিক কারণ
১৮৬১ সালের ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অ্যাক্ট অনুসারে সৃষ্ট "বাংলা প্রদেশ"-এর আয়তন ছিল প্রায় দুলক্ষ বর্গ মাইল এবং লোকসংখ্যা ছিল পৌনে আট কোটি। এ বিশাল প্রদেশের শাসনভার একজন গভর্নরের উপর ন্যস্ত ছিল। ফলে এর শাসনতান্ত্রিক শৃঙ্খলা রক্ষা এবং ব্রিটিশ বিরোধী তৎপরতা দমন করা ছিল দুরূহ ব্যাপার।
তাই বাংলা প্রদেশকে বিভক্তিকরণে ইংরেজ সরকার সচেষ্ট হয়ে ওঠেন। অবশেষে লর্ড কার্জন বঙ্গ প্রদেশকে বিভক্ত করে নতুন প্রদেশ সৃষ্টি করেন।
রাজনৈতিক কারণ
বাংলা প্রদেশকে বিভক্ত করার পেছনে ইংরেজ শাসকদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যই মুখ্য ছিল। এ র্যাপারে, বিশেষ করে আমাদের এ দেশীয় লেখক, তথা ইতিহাসবিদগণ প্রায় একমত। ইংরেজদের উদ্দেশ্য ছিল বাঙালিদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রচেষ্টাকে বানচাল করা।
বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে ভারতীয় জনসাধারণের মাঝে জাতীয়তাবাদী চেতনা ক্রমশ প্রখর হয়ে উঠে। জাতীয় কংগ্রেসের ১৮৮৫ সালে জন্ম আন্দোলনের ধারাকে আরো বেশি বেগবান করে। এক্ষেত্রে বাংলা প্রদেশ ছিল অনেক অগ্রসর। যে কারণে সুচতুর ইংরেজ সরকার তদানীন্তন বাংলা প্রেসিডেন্সিকে বিভক্ত করে এ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন বন্ধ করার জন্য নতুন প্রদেশ সৃষ্টি করার কথা চিন্তা করে।
ভাগ কর শাসন কর নীতি
বঙ্গভঙ্গ মুসলমানদের আন্দোলন বা দাবির ফসল ছিল না। পরবর্তীতে এর ঘোর সমর্থক ও প্রবর্তক ঢাকার নবাব স্যার সলিমুল্লাহ স্বয়ং নিজে শুরুতে এ ব্যাপারে সন্দিহান ছিলেন বা এর প্রতি তাঁর সমর্থনও ছিল না। বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব ব্রিটিশ শাসকদের কাছ থেকে আসে। কার্যত এটি ছিল ব্রিটিশদের 'ভাগ কর শাসন কর নীতির' (Divide and Rule Policy) ফল। প্রস্তাবিত বঙ্গভঙ্গের পক্ষে মুসলিম জনমত গঠনের লক্ষ্যে ১৯০৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে পূর্ব বাংলার কয়েকটি বড় শহর ভ্রমণের সময় লর্ড কার্জন যে ভাষণ দেন তা ছিল এ ক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য। তাই বলা যায়, বঙ্গভঙ্গ ছিল ইংরেজদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের ফসল।
সামাজিক কারণ
ইংরেজ শাসনের শুরু থেকে বৈষম্যমূলক আচরণের ফলে মুসলমান সমাজ ধীরে ধীরে সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তাদের প্রাধান্য হারাতে থাকে। ফলে ১৯০৫ সালে পূর্ব বাংলার মুসলিম সমাজ তাদের হৃত গৌরব পুনরুদ্ধারের আশায় ব্রিটিশ সরকারের বঙ্গভঙ্গ প্রস্তাব জোরালোভাবে সমর্থন করে।
অর্থনৈতিক কারণ
কলকাতা ভিত্তিক সকল ব্যবসা-বাণিজ্য চলতে থাকায় এবং শিল্প কারখানা তৈরি হওয়ায় বঙ্গ প্রদেশের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাসমূহ তথা ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী অঞ্চলের জনসাধারণ ধীরে ধীরে অর্থনৈতিকভাবে কলকাতার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। কলকাতা ছিল মূলত হিন্দু সম্প্রদায় দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। যার কারণে হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য দেখা দেয়। এ বৈষম্যের হাত থেকে পরিত্রাণ লাভের লক্ষ্যে মুসলমান সম্প্রদায় বঙ্গভঙ্গ সমর্থন করে। এবং ঢাকা কেন্দ্রীক বিকাশের স্বপ্ন দেখতে থাকে।
বস্তুত ১৯০৫ সালের ১ সেপ্টেম্বরে লর্ড কার্জন কর্তৃক বাংলা প্রদেশ বিভক্তিকরণ বা বঙ্গভঙ্গের মূলে শাসনতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক কারণই ছিল মুখ্য।
আরো পড়ুন:
বঙ্গভঙ্গের ফলাফল
নতুন প্রদেশ সৃষ্টির ফলে মুসলিম সমাজের মধ্যে যেনো প্রাণ চাঞ্চল্য ফিরে আসে। আধুনিকতার ছোঁয়া লাগে প্রদেশের রাজধানী ঢাকায়। অনেক কলকারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয়। এ সময় এলিট মুসলমান সমাজ ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত করে। এ মুসলিম লীগের মাধ্যমেই পরবর্তীতে জন্ম নেয় উচ্চবিত্ত মুসলিম সমাজের সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। কলকাতা কেন্দ্রিক হিন্দু এলিট সম্প্রদায় বঙ্গভঙ্গকে সঠিকভাবে মেনে নিতে পারে নি। তারা আশঙ্কা করলেন মুসলমান সমাজের ওপর তাদের আধিপত্য হারানোর এবং তাদের ব্যবসায়িক ক্ষতির। ফলে, ইংরেজ শাসকদের উদ্দেশ্য সার্থক হয় এবং হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট হয়ে যায়। বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে তারা পরস্পরের মুখোমুখি দাঁড়ায়। সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সম্মিলিত জাতীয়তাবাদী শক্তি শুরুতেই দুর্বল হয়ে যায়।
সারকথা
১৯০৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর ব্রিটিশ ভারতের বড়লাট লর্ড কার্জন বাংলাকে দুটি স্বতন্ত্র প্রদেশে বিভক্ত করেন। পূর্ব বাংলা ও আসাম নিয়ে নতুন প্রদেশ সৃষ্টি হয়। ঢাকা ছিল এর রাজধানী। পশ্চিম বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা ও ছোট নাগপুর নিয়ে গঠিত হয় অপর প্রদেশ। কলকাতা ছিল এর রাজধানী। বঙ্গভঙ্গের কারণগুলোকে শাসনতান্ত্রিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক এ ভাবে ভাগ করা যায়। এর মধ্যে শাসনতান্ত্রিক বা প্রশাসনিক এবং রাজনৈতিক কারণই ছিল মুখ্য। অর্থাৎ প্রশাসনিক কাজের সুবিধা এবং ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ধর্মনির্বিশেষে বাঙালিদের ঐক্যবদ্ধ শক্তিশালী রাজনৈতিক অবস্থান গ্রহণের সম্ভাবনা বানচাল -এ দুটিই ছিল ব্রিটিশদের প্রধান বিবেচ্য বিষয়। বঙ্গভঙ্গের মাধ্যমে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ নতুন প্রদেশ 'পূর্ব বাংলা ও আসাম'-এর প্রতিষ্ঠা পূর্ব বাংলার পশ্চাৎপদ উচ্চবিত্ত মুসলমান সম্প্রদায় তাদের উন্নতি-অগ্রগতির একটি স্থায়ী সুযোগ হিসেবে দেখে। তাই তারা একে স্বাগত জানায়। পক্ষান্তরে নানা কারণে হিন্দু সম্প্রদায় এর উচ্চবিত্ত অংশ একে মেনে নিতে পারে নি। তারা এর বিরুদ্ধে
এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url