বাংলাদেশে ইসলামি ব্যাংক ও এর সম্ভাবনা

বাংলাদেশে ইসলামি ব্যাংক ও এর সম্ভাবনা বাংলাদেশে ইসলামি ব্যাংক প্রতিষ্ঠার ইতিহাস বাংলাদেশের ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় ইসলামিকরণের বাঁধাসমূহ উল্লেখ করতে পারবেন।

বাংলাদেশে ইসলামি ব্যাংক

বাংলাদেশে ইসলামি ব্যাংক প্রতিষ্ঠার প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয় অনেক আগে থেকেই। বিশেষ করে বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে মুসলিম বিশ্বে যখন ইসলামি পুনর্জাগরণের জোয়ার আসে এবং বিশ্বের মুসলিম মনীষীগণসুদবিহীন ইসলামি অর্থ ব্যবস্থার পক্ষে জোরালো বক্তব্য রাখতে শুরু করেন তখন বাংলাদেশের ইসলামি চিন্তাবিদঘনও থেমে থাকেননি। তাঁরা তখন ইসলামি ব্যাংকিং এর উপর বিভিন্ন প্রবন্ধ উপস্থাপন, কনফারেন্স, সেমিনার ও সিম্পোজিয়ামের মাধ্যমে সুদবিহীন ব্যাংকিং ব্যবস্থা প্রবর্তনের দাবী জানাতে থাকেন। বাংলাদেশর জনগণ মুসলমান হিসেবে ইসলামি অর্থনীতিতে বিশ্বাসী। তাঁরা সুদের অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছে। অর্থনীতিকে কুরআন ও সুন্নাহ নির্দেশিত নীতিমালার ভিত্তিতে গড়ে তোলার দাবী ও আকাঙ্ক্ষা তাঁদের দীর্ঘ দিনের লালিত। কিন্তু পরাধীন জাতির ইচ্ছে বা আকাঙ্ক্ষা থাকলে সবকিছু করতে পারে না। মুসলিম জনগণের দাবী ও আকাঙ্ক্ষা থাকলে সবকিছু করতে পারে না। সুমলিম জনগণের দাবী ও আকাঙ্ক্ষার প্রেক্ষিতে দেশ বিদেশের কয়েকজন বিশিষ্ট আলেম, ইসলামি চিন্তাবিদ, ব্যাংকার, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি এদেশে ইসলামি ব্যাংকিং ব্যবস্থা চালু করার এবং মুসলিম জাতিকে সুদের অভিশাপ থেকে রক্ষা করার জন্যে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।

আরো পড়ুন: ইসলামি ব্যাংকের উৎপত্তি ও ক্রম বিকাশ

১৯৭৪ সালে বাংলাদেশের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর-এর শাসনামলে বাংলাদেশ পাকিস্তানের লাহোর সম্মেলনে ওআইসি'র সদস্য পদ লাভ করে এবং একই বছরের আগষ্ট মাসে বাংলাদেশ ইসলামি উন্নয়ন ব্যাংক (আইডিবি) চার্টারে স্বাক্ষর করে দেশের অর্থ ব্যবস্থা ইসলামি শরীআর ভিত্তিতে পুনর্বিন্যাস করার দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করে। ১৯৮১ সালে জানুয়ারী মাসে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান সৌদী আরবের তায়েফে অনুষ্ঠিত ওআইস'র তৃতীয় শীর্ষ সম্মেলনে ইসলামি দেশসমূহের মধ্যে ব্যবসা বাণিজ্যের সুযোগ সুবিধার জন্যে একটি স্বতন্ত্র ব্যাংকিং ব্যবস্থা চালু করার প্রয়োজনীয়তার কথা ব্যক্ত করেন। নভেম্বর, ১৯৮০ সালের প্রথম দিকে 'বাংলাদেশ ব্যাংক' দেশের বাইরের কয়েকটি দেশে ইসলামি ব্যাংকসমূহের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণের জন্যে প্রতিনিধি প্রেরণ করে। অতঃপর ১৯৮২ সালের নভেম্বর মাসে আইডিবি'র একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফর করেন এবং এখানে বেসরকারীভাবে যৌথ উদ্যোগে একটি ইসলামি ব্যাংক প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে গভীর আগ্রহ প্রকাশ করেন। তাঁরা লক্ষ করেন যে, এদেশে সুদবিহীন ইসলামি ব্যাংকিং ব্যবস্থার প্রতি জনগণের গভীর আগ্রহ রয়েছে এবং এ ব্যাপারে এখানে ইতোমধ্যে অনেক কাজও সম্পাদন করা হয়েছে। ১৯৭৭ সাল থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে ইসলামি ব্যাংকিং ব্যবস্থার উপর বেশ কয়েকটি সেমিনার, প্রশিক্ষণ কোর্স ও ওয়ার্কশপ অনুষ্ঠিত হয়েছে। দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টা ও সাধনার ফলে ইসলামি আদর্শে উদ্বুদ্ধ দেশ বিদেশের কয়েকজন বিশিষ্ট শিল্পপতি, ব্যবসায়ী ও ইসলামি সংস্থা ইসলামি ব্যাংকের ধারণাকে বাস্তবে রূপদান করতে উদ্যোগ গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে ব্যাংক ব্যবস্থায় ইসলামি শরীআ নীতিমালা পরিপূর্ণভাবে অনুসরণ করার এবং আর্থনীতিতে ন্যায়-নীতি, সুবিচার ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার নিয়ে ১৯৮৩ সালের ৩০শে মার্চ 'ইসলামি ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড' প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ১৯৮৩ সারের ১২ই আগস্ট আনুষ্ঠানিকভাবে এ ব্যাংক তার ব্যাংকিং কার্যক্রম শুরু করে। বিশ্বের ৫৬টি মুসলিম দেশের প্রতিনিধিত্বকারী অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান ইসলামি উন্নয়ন ব্যাংক, দুবাই ইসলামি ব্যাংক, বাহরাইন ইসলামি ব্যাংক প্রভৃতি ইসলামি ব্যাংক ও প্রতিষ্ঠান এ বংকের মূলধন যোগযন অংশগ্রহণ করে। বাংলাদেশে এ ব্যাংকের উদ্যোক্তাদের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ সরকার, আইসিবি, আইইআরবি, কয়েকটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠান এবং বাংলাদেশের ইসলাম প্রিয় ব্যক্তিবর্গ।

১৯৮৬ সালে বাংলাদেশে দ্বিতীয় ইসলামি ব্যাংক হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে 'আল বারাকা ব্যাংক লিমিটেড' নামে। পরবর্তীতে ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশে ইসলামি শরীআর ভিত্তিতে পরিচালিত আরো তিনটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এ তিনটি ইসলামি ব্যাংকের নাম হচ্ছে- (১) আল্ আরাফাহ ইসলামি ব্যাংক লিমিটেড, (২) সোস্যাল ইনভেষ্টমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড (৩) প্রাইম ব্যাংক লিমিটেড (ইসলামি শাখা) (৪) শাহজালাল ব্যাংক। এছাড়া বাংলাদেশে আরো একাধিক ইসলামি ব্যাংক প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।

বাংলাদেশে ব্যাংকিং ব্যবস্থার পূর্ণাংগ ইসলামিকরণ সময়ের দাবী। বেসরকারি খাতে যে দু'টো ইসলামি ব্যাংক কাজ করছে তারা বিভিন্ন সমস্যার কারণে প্রয়োজনীয় গতিশীলতা অর্জন করতে পারছে না। বাংলাদেশ সরকার নীতিগতভাবে দেশের সম্পূর্ণ অর্থ ব্যবস্থা ইসলামিকরণে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলেও আজ অবধি কোন ব্যাপক ও কর্যকর পন্থা গৃহীত হয়নি। নিম্নে বাংলাদেশে ব্যাংক ব্যবস্থা ইসলামিকরণের পথে অন্তরায়সমূহের কয়েকটি দিক উল্লেখ করা হলো:

বাংলাদেশের ব্যাংক ব্যবস্থায় ইসলামিকরণের পথে অন্তরায়

১. সরকারের কার্যকর পদক্ষেপের অভাব: প্রচলিত ব্যাংক ব্যবস্থাকে ইসলামি ব্যবস্থায় রূপান্তর করার জন্য প্রথম এবং প্রধান যে পদক্ষেপ দরকার তা হচ্ছে- এ ব্যাপারে ইতিবাচক ও বলিষ্ঠ সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং বাস্তবধর্মী একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন। কাজ যত মহৎ এবং কল্যাণকর হোক সিদ্ধান্ত এবং পরিকল্পনা ব্যতীত তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। বাংলাদেশ সরকার যদিও এ ব্যাপারে আশ্বাস দিয়েছে, কিন্তু বলিষ্ঠ পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি।

১৯৭৫ বাংলাদেশ ওআইসি বেং আইডিবি-এর গঠনতন্ত্রের সাথে একমত হয়ে এ ব্যাংকের সদস্য পদ গ্রহণ করে। ১৯৮১ সালে মক্কায় অনুষ্ঠিত তৃতীয় ইসলামি শীর্ষ সম্মেলনে ঘোষণা করা হয়-

Strict adherence to Islam and Islamic Principles and values, as a way of life, constitutes the highest protection for Muslim against the dangers which confront them. Islam is the only path which can lead them to strenght, diginity, prosperity and a better future. অর্থাৎ "মুসলিমগণ যেসব বিপদের সম্মুখীন হয় তা থেকে রক্ষা পেতে জীবন ব্যবস্থা হিসেবে ইসলাম, ইসলামি নীতি ও মূল্যবোধ কঠোরভাবে আঁকড়ে ধরাই হচ্ছে আসল কাজ। ইসলামই হচ্ছে একমাত্র পন্থা যা তাদেরকে শক্তি, সম্মান, উন্নতি এবং উন্নত ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যেতে পারে।" উক্ত সম্মেলনে উপস্থিত থেকে এ ঘোষণার সাথে বাংলাদেশ ঐকমত্য পোষণ করে। আমাদের দেশে ইসলামি ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হওয়ার বহু পূর্বে বিভিন্ন দেশে ইসলামি ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ইসলামি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা ও এর মাধ্যমে পুরো অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ইসলামিকরণ সরকারের প্রচেষ্টায়ই সম্ভব।"

ইরান, পাকিস্তান ও সুদানের অভিজ্ঞতা আমাদেরকে এ শিক্ষাই দেয় যে, কেবল সরকারি পদক্ষেপই ব্যাংকিং তথা গোটা অর্থনীতিকে ইসলামিকরণ করার ক্ষমতা রাখে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের কার্যকর পদক্ষেপগ্রহণ অপরিহার্য। উল্লেখ্য যে, সুদের ন্যায় একটি জঘন্য হারাম থেকে দেশের মানুষকে বাঁচানোর প্রধান দায়িত্ব এদেশের সরকারেরই।

.শিক্ষার অভাব: ব্যাংক ব্যবস্থা ইসলামিকরণের দ্বিতীয় অন্তরায় হচ্ছে প্রয়োজনীয় শিক্ষার অভাব। আমাদের ২ দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ব্যাপকভাবে ইসলামি অর্থনীতি ও ব্যাংক ব্যবস্থা সম্পর্কে জানার ব্যবস্থা নেই। এমনকি, বাংলাদেশে ১৯৮৩ সালে ইসলামি ব্যাংক তার কার্যক্রম চালু করলে এ এখন পর্যন্ত পাস, বিএ/বিএসএস অনার্স কোর্সেও ইসলামি অর্থনীতি ও ব্যাংকিং বিষয়ে লেখাপড়া করার সুযোগ নেই। বাংলাদেশে বর্তমানে ৬টির অধিক ইসলামি ব্যাংক চালু থাকলেও ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়েও তা পড়ানো হচ্ছে না। ফলে লোকজন শিক্ষিত হচ্ছে বটে কিন্তু ইসলামি অর্থনীতি ও ব্যাংকিং এর দিক দিয়ে অপূর্ণ থেকে যাচ্ছে। তারা অন্যান্য ব্যবস্থার সাথে ইসলামি ব্যবস্থার তুলনা করতে সুযোগ পাচ্ছে না। আমাদের দেশে বেশ কয়েকটি ইসলামি ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দেশ জুড়ে এর অসংখ্য শাখা থাকলেও দেশে ইসলামি অর্থনীতি ও ব্যাংকিং বিষয়টিকে ব্যাপকভাবে পাঠ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত না করায় নানা রকম সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। যেমন-

ক. এক নতুন উদ্যোগ হিসেবে ইসলামি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা ও উন্নয়ন, সম্প্রসারণ ও অগ্রগতির জন্য যে ব্যাপক গবেষণা, পুস্তকাদি প্রণয়ন ও পথ নির্দেশনা দরকার এবং এজন্য যে ধরনের প্রতিভাধর যোগ্য লোক প্রয়োজন তা তৈরি হচ্ছে না।

খ. ইসলামি ব্যাংক পরিচালনার জন্য যে দরণের যোগ্যতা সম্পন্ন জনশক্তির প্রয়োজন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো তা সরবরাহ করছে না। এছাড়াও গোটা ব্যাংক ব্যবস্থ্য ইসলামিকরণের জন্য যে বিপুল সংখ্যক জনশক্তির প্রয়োজন তাও তৈরি হচ্ছে না।

৩. দক্ষ জনশক্তির অভাব: ব্যাংকিং ব্যবস্থা ইসলামিকরণের পথে তৃতীয় বড় অন্তরায় হচ্ছে প্রয়োজনীয় দক্ষ জনশক্তির অভাব। প্রচলিত ব্যাংকসমূহ ইসলামিকরণ করতে হলে প্রথমে ব্যাংকে কর্মরত লোকদেরকেই তা করতে হবে। কিন্তু ইসলামি ব্যাংকের ধারণা, লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, কর্মনীতি প্রচলিত ব্যাংক থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ও ঝুঁকিপূর্ণ। এ নব ব্যবস্থা সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন ছাড়া ব্যাংকসমূহ পরিচালনা করা মোটেই সম্ভব নয়। তাই ব্যাংকসমূহ এবং সরকারের যৌথ প্রশিক্ষণ একাডেমী প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সহজেই এ সমস্যা কাটিয়ে উঠা সম্ভব।

৪. প্রয়োজনীয় আইন কাঠামোর অভাব: দেশে ইসলামি ব্যাংক প্রতিষ্টা লাভ করেছে বটে। কিন্তু এর জন্য প্রয়োজনীয় আইন আজও প্রণীত হয়নি। এ দিকে প্রচলিত আইনের সাথে সামঞ্জস্য না থাকায় ব্যাংকগুলো যথাযথভাবে কাজ করতে পারছে না। ইসলামি ব্যাংকিং লেন-দেনে চুক্তি ভংগ হলে ইসলামি আইন অনুসারে গঠিত আদালতে তার সমাধান হওয়া উচিত। কিন্তু আজও তা কায়েম হয়নি।

 আরো পড়ুন: ইসলামি ব্যাংক ও সুদভিত্তিক ব্যাংকিং পদ্ধতির মধ্যে পার্থক্য

৫. ইসলামি বিনিয়োগের পরিবেশের অভাব: দেশে ইসলামি বিনিয়োগের পরিবেশ না থাকায় ইসলামি ব্যাংকসমূহকে বিনিয়োগ বিমুখ করে রাখছে এবং রাখবে। এ থেকে উত্তরণ ঘটাতে হলে ইসলামি মুদ্রাবাজার, পুঁজিবাজার গঠন হওয়া দরকার। ইসলামি নীতিমালা মুতাবেক আর্থ-সামাজিক কাঠামো ঢেলে সাজানো না হলে ইসলামি ব্যাংকিং ব্যবস্থা আশানুরূপ ফল লাভ করতে পারবে না।

৬. আয়কর আইন: দেশের প্রচলিত আইন ইসলামি ব্যাংকিং এর পক্ষে এক বড় সমস্যা। আয়করের উচ্চহার ও আয়কর প্রশাসকের অমনোযোগের দরুণ দেশের ব্যবসায়ীদের মধ্যে আয়কর ফাঁকি দেয়ার প্রবণতা বর্তমান রয়েছে। করের হার কমিয়ে এমন ব্যবস্থা কায়েম করতে হবে যাতে ফাঁকি দেয়ার প্রবণতা আদৌ না থাকে। এং যাকাতের মত অবশ্য দেয়সহ অন্যান্য জনকল্যাণমূলক দান যাতে আয়কর মুক্ত হয় সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে।

৭. কোম্পানি আইনে প্রয়োজনীয় সংশোধনীর অভাব: বর্তমান কোম্পানি আইন রচিত হয়েছিল ব্রিটিশ আমলে। সময়ের আবর্তনে এ আইন আজ স্বাধীন দেশের জন্য যথেষ্ট উপযোগী বলে প্রমাণিত হচ্ছে না। এ আইন সংশোধন করে কোম্পানি গঠনকে আরো গণমুখী ও গতিশীল করা এবং ইসলামি ব্যাংকিং কোম্পানি প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা সহজতর করা দরকার। তা না হলে ইসলামি ব্যাংকিং ব্যবস্থা বাধাগ্রস্থ হবে।

৮. প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও প্রচারণার অভাব: ইসলামি ব্যাংকিং ব্যবস্থা সম্পর্কে সর্বমহলে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য কোন সার্বিক ও ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। প্রশিক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থাকা বাঞ্ছনীয়। ইসলামি ব্যাংক ট্রেনিং এন্ড রিসার্চ একাডেমী এবং ইসলামি ইকনমিক রিসার্চ ব্যুরো যে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তা প্রয়োজনের তুলনায় উল্লেখযোগ্য নয়।

৯. ইসলামি বীমা ও অন্যান্য সহযোগী প্রতিষ্ঠানের অভাব: সার্বিক কার্যক্রম শরী'আতের সীমার মধ্যে পরিচালনা করা সত্ত্বেও কেবল টাকার জন্য সুদী কোম্পানীর দারস্থ হতে হয়। এতে ব্যাংকের পুরো আয় সন্দেহযুক্ত হয়ে পড়ে। সুতরাং ব্যাংক ব্যবস্থা ইসলামিকরণের সাথে বীমাকেও ইসলামিকরণ জরুরি। তবে ইদানীং কয়েকটি ইসলামি বীমা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। সরকার এ ব্যাপারে বাস্তব সহযোগিতা প্রদান করলে এবং অন্যান্য বীমা কোম্পানীকে ইসলামিকরণের উদ্যোগ নিলে সম্পূর্ণ অর্থনীতিকে ইসলামিকরণ সহজতর হবে।

১০. ইসলামি ফিনান্সিয়াল ইনস্ট্রুমেন্টের অভাব: ইসলামি শরীআ অনুসারে বিভিন্ন ধরন ও মেয়াদী ফিনান্সিয়াল ইনস্ট্রমেন্টের অভাব ইসলামি ব্যাংকিংকে কার্যকর বিনিয়োগ থেকে বঞ্চিত করছে। এজন্য মুদারাবা সার্টিফিকেট, ইসলামিক ইনভেস্টমেন্ট সার্টিফিকেট, মুদারাবা বন্ড, পার্টিসিপেশন টার্ম সার্টিফিকেট, ইসলামিক কমার্শিয়াল পেপার, সলিডারিটি বন্ড ইত্যাদি চালু করা প্রয়োজন।

১১. কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যবস্থা ইসলামিকরণের লক্ষ্যে গবেষণা কোষের অভাব: বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যবস্থা ইসলামিকরণে যথেষ্ট অবদান রাখছে। আমাদের দেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংক- বাংলাদেশ ব্যাংকের গবেষণা বিভাগে ১৪ ডিসেম্বর, ১৯৯২ তারিখে "ইসলামি অর্থনীতি সেল" নামে একটি সেল গঠন করা হয়েছে। তবে এ পর্যন্ত এ সেলের কার্যক্রম যথাযথভাবে শুরু হয়নি।

১২. সরকারি অর্থায়নে সুদবিহীন সার্টিফিকেট চালুর অভাব: সরকারের অর্থ ঘাটতি পুরণের জন্য বিভিন্ন মেয়াদী সুদমুক্ত বন্ড, সার্টিফিকেট তৈরি না হলে ইসলামি ব্যাংকসমূহ তাদের উদ্বৃত্ত তারল্য খাটাতে পারবে না। সরকার যদি সুদমুক্ত বন্ড, সার্টিফিকেটের পরিবর্তে লাভ-ক্ষতিজনক বন্ড চালু করত, তবে ইসলামি ব্যাংকসমূহে স্বীয় অলস অর্থ এরূপ বন্ডে খাটাতে পারত। ফলে ইসলামি ব্যাংকিং ব্যবস্থাও অধিকতর কার্যকর হত।

বহুমাত্রিক সমস্যার সমাধানে ইসলামি শরী'আ বিশ্বজনীনভাবে কাজ করে আসছে। যা শত শত বছর যাবত মানুষের কল্যাণ সাধন করে চলছে। মানব জীবনের সকল দিক ও বিভাগ সম্পর্কে ইসলামের একটা নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গী রয়েছে। বর্তমান বিশ্বের আর্থিক সমস্যা সমাধানে বিশেষ করে ব্যাংকিং সমস্যা সমাধানেও ইসলাম যে সুষ্ঠু সমাধান দিতে পারে আজকের ইসলামি ব্যাংকের উত্তরোত্তর অগ্রগতি এর জ্বলন্ত প্রমাণ।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url