ইসলামের দৃষ্টিতে বাংলাদেশের ভূমিব্যবস্থা


ইসলামের দৃষ্টিতে বাংলাদেশের ভূমিব্যবস্থা বাংলাদেশে ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থার ইতিহাস পূর্ববঙ্গ জমিদারী দখল ও প্রজাস্বত্ব আইন ১৯৫০ এর প্রধান দিকগুলো পূর্ববঙ্গ জমিদারী ও প্রজাস্বত্ব আইন ১৯৫০ এর ফলাফল বাংলাদেশের ভূমি সংস্কার অধ্যাদেশ ১৯৮৪-এর প্রধান দিকগুলো ইসলামের দৃষ্টিতে বাংলাদেশের ভূমি ব্যবস্থা কেমন হওয়া উচিত তা উল্লেখ করতে পারবেন।

বাংলাদেশে ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থার ইতিহাস

১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজ উদ্দৌলার পরাজয়ের ফলে এ দেশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনে আসে। এরপর ১৭৬৩ সালে ইংরেজগণ সম্রাট শাহ আলমের কাছ থেকে দেওয়ানী লাভ করে। এরপরেই তারা এদেশে অস্থায়ী জমিদারী প্রথার সৃষ্টি করে। ১৭৯৩ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বড় লাট লর্ড কর্নওয়ালিশ বাংলাদেশে চিরস্থায়ী ভূমি বন্দোবস্ত প্রথা চালু করেন। এ বন্দোবস্তের ফলে এদেশের কিছু অর্থশালী লোক যাদের বেশিরভাগই ছিল হিন্দু তারা কোম্পানির নিকট থেকে জমিদারীর চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নেন। এ জমিদারগণই ইংরেজ আইনে ভূমির চিরস্থায়ী মালিক হলেন। জমিদারগণ নির্দিষ্ট তারিখে ইংরেজ সরকারের ট্রেজারীতে ভূমিরাজস্ব জমা দিতেন। তাদের ভূমিরাজস্বের পরিমাণ ছিল নির্দিষ্ট ও চিরস্থায়ী। ভূমিরাজস্বের পরিমাণ বাড়াতে বা কমাতে ইংরেজ সরকার কোন অধিকার রাখেনি। এ ব্যবস্থায় জমিতে কৃষকের কোন প্রকার মালিকানা বা অধিকার বহাল থাকল না। তারা শুধু জমিদারের মর্জিমত জমি চাষ করতে পারত। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বা জমিদারী ব্যবস্থা আমাদের দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবনকে পঙ্গু করে দিয়েছিল। এ বন্দোবস্ত তুলে দেয়ার জন্য বহুদিন থেকে দাবি উঠতে থাকে। এজন্য ১৯৩৮ সালে স্যার ফ্লাউডের নেতৃত্বে একটি কমিশন গঠন করা হয়, যা ফ্লাউড কমিশন নামে পরিচিত। বিভিন্ন অবস্থা পর্যালোচনা করে ফ্লাউড কমিশন চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত তথা জমিদারী প্রথা বিলোপের সুপারিশ করে। এর ফলে ১৯৫০ সালে পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদে পূর্ববঙ্গ জমিদারী দখল ও প্রজাস্বত্ব আইন পাস হয়। এ আইনবলে জমিদারী ব্যবস্থার অবসান ঘটে।

পূর্ববঙ্গ জমিদারী প্রথা ও প্রজাস্বত্ব আইন ১৯৫০

ফ্লাউড কমিশনের রিপোর্টের প্রেক্ষিতে তদানীন্তন মুসলিম লীগ সরকার পূর্ববঙ্গ জমিদারী দখল ও প্রজাস্বত্ব আইন পাস করেন। এর ফলে ১৭৯৩ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বিলুপ্ত হয়ে জমিদারী প্রথার অবসান ঘটে। এ আইনের প্রধান প্রধান দিকগুলো নিম্নে বর্ণিত হলঃ

১. সরকার ও কৃষকের মাঝে কোন মধ্যস্বত্ব থাকবে না। সরকার সরাসরি কৃষকের খাজনা গ্রহণ করবেন।

২. পরিবার পিছু ১০০ বিঘা অথবা মাথাপিছু ১০ বিঘার অধিক জমির মালিক কেউ থাকতে পারবে না।

৩. দরিদ্র চাষীদের মধ্যে উদ্বৃত্ত জমি বিতরণ করা হবে। যাদের তিন একর বা এর চেয়ে কম জমি আছে তারাই দরিদ্র চাষী হিসেবে গণ্য হবে।

৪. জমিদারগণকে তাদের স্বার্থহানির জন্য ক্ষতিপূরণস্বরূপ তাদের আয়ের ৮ গুণ পর্যন্ত দেয়া হবে। ক্ষতি পূরণের টাকা নগদ অথবা ৪০ বছরে আদায়যোগ্য ৩% সুদে বন্ডের মাধ্যমে পরিশোধ করা হবে।

৫. জমির খাজনা উৎপন্ন ফসলের ১০% এর বেশি হবে না। ৩০ বছরের মধ্যে খাজনা দ্বিতীয়বার বাড়ানো যাবে না।

৬. জমির মালিক কৃষক হবে এবং মালিকানা বংশ পরম্পরায় পুরুষানুক্রমে উত্তরাধিকারের মাধ্যমে হস্তান্তর করাও যাবে।

৭. কোন পল্লী এলাকায় ৭৫% ভূগি মালিকের অনুরোধে সরকার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জমি বাধ্যতামূলক একত্রীকরণের ব্যবস্থা করবেন।

৮ কোন জমি বিক্রির ক্ষেত্রে জমির পার্শ্ববর্তী জমির মালিকের অগ্রাধিকার থাকবে।

৯. প্রকৃত চাষীগণই জমি ক্রয় করতে পারবে। প্রকৃত চাষী ছাড়া অন্য যে কোন ব্যক্তি সরকারের অনুমতি নিয়ে জমি ক্রয় করতে পারবে।

পূর্ববঙ্গ জমিদারী দখল ও প্রজাস্বত্ব আইন, ১৯৫০-এর ফলাফল

১. এ আইন জমিদারী প্রথাকে চিরতরে বিলোপ করে।

২. জমিদারের নায়েব, গোমস্তা, পাইক-পেয়াদার অত্যাচার থেকে কৃষকগণ রেহাই পায়।

৩. প্রকৃত চাষীগণ জমির মালিক হয়। তাদের সাথে সরকারের যোগাযোগ ঘটে।

৪. পূর্বের চিরনির্দিষ্ট ভূমিরাজস্ব বিলুপ্ত হয়ে অনেকগুণ বেশি ভূমিরাজস্ব সরকারের হাতে আসে।

৫ জমিদারগণের জমিদারী না থাকায় তারা তাদের অর্থ শিল্পে বিনিয়োগ করার সুযোগ পায়, ফলে দেশে শিল্পায়ন শুরু হয়ে যায়।

তবে জমিদারী প্রথা বিলোপ আইনের বহু দিকেই ত্রুটি ছিল বলে তা কৃষকদের জন্য প্রয়োজনীয় সুবিধা বয়ে আনতে পারেনি। এজন্য পরবর্তীকালে এ আইনের অনেক সংশোধনী আনা হয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার নতুনভাবে ভূমি সংস্কার করে বিভিন্ন সময়ে বেশ কয়েকটি আইন প্রণয়ন করেছেন। এসব আইনের মধ্যে ১৯৭২ সালের ভূমি সংস্কার এবং ১৯৮৪ সালের ভূমি সংস্কার আইন উল্লেখযোগ্য।

ভূমি সংস্কার অধ্যাদেশ ১৯৮৪

১৯৮২ সালে সংগঠিত ভূমিসংস্কার কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী সরকার ভূমি সংস্কার অধ্যাদেশ ১৯৮৪ জারি করেন। এ সংস্কার আদেশের প্রধান দিকগুলো নিম্নে তুলে ধরা হলো-

১. পরিবার পিছু জমির মালিকানা ১০০ বিঘায় আগের মত বলবৎ থাকবে।

২. যে পরিবারে ৬০ বিঘার বেশি কৃষিজমি আছে তারা আর কোন জমি ক্রয় করতে পারবে না। যাদের ৬০ বিঘার কম আছে তারা ক্রয়ের মাধ্যমে জমির মালিক হতে পারেন তবে নতুন ও পুরাতন জমির মোট পরিমাণ ৬০ বিঘার বেশি হতে পারবে না।

৩. জমিতে কর্মরত বর্গাচাষী আগামী পাঁচ বছরের জন্য বর্গাচাষী হিসেবে আইনগত স্বীকৃতি পাবেন।

৪. বর্গাশর্ত পালন সাপেক্ষে এবং জমির মালিক নিজে জমি চাষে না আনলে বর্গাচাষী পারস্পরিক সম্মতিক্রমে পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্য বর্গাচাষী হিসেবে পরিগণিত হবেন।

৫. জমির উৎপাদিত ফসল তেভাগা নীতিতে বন্টিত হবে। মালিকানার জন্য ৩৩.১০% শ্রমের জন্য ৩৩.১০% এবং উৎপাদনের উপকরণের জন্য ৩৩.১০%।

৬. বর্গাচাষী বর্গাশর্ত পূরণ করলে তাকে জমি থেকে উৎখাত করা যাবে না।

৭. কৃষকদের ঋণের দায়ে বাস্তুভিটা থেকে উৎখাত করা যাবে না।

৮. খাস জমি কেবল বিত্তহীন কৃষকদের মাঝে বন্টন করা হবে। ১৯৮৭ সালের মার্চ মাস থেকে খাস জমি বন্টনের কাজ শুরু হয়েছে।

৯. পল্লী এলাকায় বসতযোগ্য জমিও বিত্তহীনদের মাঝে বন্টন করা হবে। তবে বড় বড় শহরে ৫ কাঠার বেশি বসতযোগ্য জমি বন্টন করা যাবে না।

১০. ভরণপোষণের নিম্নতম প্রয়োজন, শ্রম, উৎপাদনশীলতা ও কর্মসংস্থানের মাত্রা সংরক্ষণের জন্য কৃষি শ্রমিকের মজুরি ৩.২৭ কেজি বা সাড়ে তিন সের চাল বা সমমূল্যে ধার্য করা হয়।

বাংলাদেশে অতীতকাল থেকে যে ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থা বিদ্যমান ছিল বা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সরকার যে ভূমি সংস্কার করেছেন, সে বিষয়ে ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে কোন সমালোচনা হয়েছে বলে তেমন কিছু জানা যায় নি। বাংলাদেশের ভূমি ব্যবস্থা ইসলামি ভূমি ব্যবস্থারই প্রায় অনুরূপ।

হযরত ফারুকে আযম (রা) সপ্তম শতাব্দীতে যে ভূমি সংস্কার করেছিলেন তা শুধু সপ্তম শতাব্দীতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তা ইসলামি রাষ্ট্রগুলোতে বাস্তবায়িত হয়েছে। কারণ, মহানবী (সা) বলেছেন-

অর্থাৎ "তোমাদের কর্তব্য আমার সুন্নাহ ও খোলাফায়ে রাশিদীনের সুন্নাহ আঁকড়ে ধরা।
উমর ফারুক (রা)-এর রাজস্ব সংস্কারকে সামনে রেখে বাংলাদেশের ভূমিস্বত্ব সম্পর্কে বলা যায়:

ভূমি সংস্কারের উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে চাষী জমির (প্রতিনিধিত্বমূলক) মালিক হবে, অন্য কেউ নয়। এজন্য কোন সাহাবীকে হিজাযের বাইরে তিনি জমি ক্রয় করতে দেননি। এক চাষী যতটুকু জমি নিজে চাষ করতে পারবে, ততটুকু জমিই সে মালিকানায় রাখতে পারবে, এর বেশি নয়। অতএব, বাংলাদেশে ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থা যা ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে হওয়া উচিত, তার মধ্যে থাকবে-

১. একজন চাষী স্বহস্তে যে পরিমাণ জমি চাষ করতে পারবে, ততটা জমির মালিক সে হতে পারবে। মোটামুটি হিসেবে এ পরিমাণ ১৫ বিঘা হতে পারে।

২. জমির অনুপস্থিত মালিকানা যতদূর সম্ভব স্বীকার করা হবে না। কারণ, জমির অনুপস্থিত মালিক তো চাষী নয়। সম্পত্তির মালিকানা একজন মুসলমানকে যতটা পরহেযগার বানায়, তার চেয়ে ঢের বেশি তাকে ফাসিক বানায়। অবাধ মালিকানা তাই পাপের দরজাগুলো ধীরে ধীরে খুলে দেয়। তবে যারা অকৃষিকাজে ব্যস্ত, অথচ তা থেকে আয়ের পরিমাণ স্বল্প, তারা জমির অনুপস্থিত মালিক হতে পারেন। তবে তাদের চাষযোগ্য জমির পরিমাণ এতটুকু হওয়া উচিত, যাতে কৃষি ও অকৃষি খাতের মোট আয় থেকে তার পরিবারের ভরণ-পোষণ মোটামুটি চলে।

৩। উৎসাহব্যঞ্জক শর্তের বর্গাদারগণ বর্গাজমি চাষ করতে পারে। এক্ষেত্রে ইমাম আবু ইউসুফ (রহ) ও ইমাম মুহাম্মদ (রহ)-এর মতানুসারে বর্গাচাষ হবে।

৪। ইসলামের মিরাসী আইন আল্লাহ প্রদত্ত। তা সংস্কার বা সংশোধনের অধিকার কোন ব্যক্তি বা রাষ্ট্রের নেই। ভূমি সংস্কারে মিরাসী আইনের কারণে যে জটিলতা দেখা দিয়েছে, তার নিরসনের জন্য সমবায়ের মাধ্যমে চাষ এবং খন্ডিত জমি রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে একজন চাষীকে একস্থানে দেয়ার ব্যবস্থা করা যায়।

৫। গ্রামে বা শহরে ৫ কাঠার বেশি জমি পরিবারের বসবাসের জন্য ব্যক্তি মালিকানায় রাখা উচিত হবে না।

৬। সরকারি অফিস, শিল্প প্রতিষ্ঠান প্রভৃতির জন্য জমির সীমাবদ্ধতা থাকবে না বটে, তবে যাতে অপচয় বা অপব্যয় না হয়, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে।

৭. জমিদারী ও সামন্তপ্রথার মত স্বত্ব থাকবে না।

৮। উদ্বৃত্ত জমি ভূমিহীনদের মাঝে বণ্টিত হবে।

সারকথা 

পরিশেষে বলা যায়, উক্ত ভূমি ব্যবস্থা গৃহীত হলে আশা করা যায় যে, বাংলাদেশে ভূমিহীন, বিহীন ও প্রান্তিক চাষী বলে কেউ থাকবে না। শহরে বা নগরে বস্তির সংখ্যা কমবে। ব্যক্তিগত মালিকানায় অবাধ সম্পত্তি রেখে সুদ ও ঘুষ বর্জন করলেও বা যাকাত-ফিতরা আদায় করলেও তাতে ভূমিহীন-বিত্তহীনদের সংখ্যা কমবে না। মনে রাখা দরকার যে, যাকাত-সাদকাহ গ্রহণের জন্য নাগরিক তৈরি করা ইসলামের উদ্দেশ্য নয়। বর্তমান বাংলাদেশকে ঋণমুক্ত দেশ হিসেবে গড়তে হবে।

সীমাহীন সম্পত্তি মানুষকে মানুষ করার চেয়ে অমানুষ করে বেশী। সম্পত্তিহীনতাও মানুষকে মানুষ করার পরিবর্তে অমানুষ করে। এ মনুষ্যত্বহীনতা দু'টি বিপরীত মেরু থেকেই ঘটে থাকে। প্রকৃত মনুষ্যত্ব মাঝামাঝি অবস্থায় নিহিত আছে।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url