ইসলামি বাণিজ্যিক ব্যাংকের কার্যাবলী
ইসলামি বাণিজ্যিক ব্যাংক
ইসলামি বাণিজ্যিক ব্যাংক প্রচলিত বাণিজ্যিক ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে আলাদা। এতে জনগণের আমানত গ্রহণ বা অর্থবিনিয়োগ কোনটাই সুদভিত্তিক নয়। ইসলামি ব্যাংক জনগণের কাছ থেকে সুদে ঋণ গ্রহণ করে না। আবার সুদে কাউকে ঋণ দেয় না।
ও.আই.সি. সচিবালয় ইসলামি বাণিজ্যিক ব্যাংকের যে সংজ্ঞা দিয়েছে তা নিম্নরূপ-
"Islamic Bank is a financial institution whose statutes, rules and procedures expressly state its commitment to the principles of Islamic Shariah and to the banning of the reciepts and payments of interest in on any of its operations."
"ইসলামি ব্যাংক এমন একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান যার মৌলিক বিধান, নীতিমালা ও কর্মপদ্ধতিতে শরী'আতের মূলনীতি অনুসরণের সুস্পষ্ট অঙ্গীকার থাকবে এবং যার সমুদয় কাজ ও লেন-দেন সুদমুক্ত।" ও.আই.সি'র উক্ত সংজ্ঞা ইসলামি কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও ইসলামি বাণিজ্যিক ব্যাংক সম্বন্ধে সুস্পষ্ট ধারণা দেয়। ইসলামি কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও ইসলামি বাণিজ্যিক ব্যাংক ও.আই.সি'র নীতিমালা অনুসরণ করে ব্যাংকিং কাজ পরিচালনা করে থাকে।
ইসলামি বাণিজ্যিক ব্যাংকের কার্যাবলী
যে সব আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইসলামি অর্থ ব্যবস্থা বাস্তবায়নে ইসলামি মূলনীতি অনুসারে অর্থ বিনিয়োগ করে এবং আর্থিক লেন-দেন করে থাকে, তাকে ইসলামি বাণিজ্যিক ব্যাংক বলা হয়। নিম্নে ইসলামি বাণিজ্যিক ব্যাংক এর কার্যাবলী আলোচনা করা হলো:
১. আমানত গ্রহণ: ইসলামি ব্যাংক ব্যবসায় ও শিল্পে বিনিয়োগের জন্য জনসাধারণের নিকট থেকে সুদবিহীন আমানত গ্রহণ করে। ব্যবসায় ও শিল্পে আমানত বিনিয়োগের ফলে যে লাভ হয় তার অংশ চুক্তি অনুসারে আমানতকারীকে প্রদান করা হয়। ইসলামি ব্যাংক সাধারণত নিম্নলিখিতভাবে আমানত গ্রহণ করে থাকে:
ক. চলতি হিসাব (Current Account): যে হিসাবে যখন তখন টাকা জমা দেয়া ও ওঠানো যায় তাকে চলতি হিসাব বা Current Account বলা হয়। যে কোন কোম্পানী, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, সরকারি বিভাগ, সংস্থা ও ট্রাষ্ট কিংবা ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ এ একাউন্ট খুলতে পারেন। এর জন্য সর্বনিম্ন ৫০০ টাকা দিতে হয়।
খ. লাভ-লোকসানে অংশীদারী মেয়াদী আমানত হিসাব: এক হাজার টাকা অথবা এর দ্বিগুণ, তিনগুণ প্রভৃতি হারে অর্থ জমা দিয়ে এ হিসাব খোলা যায়। বারো, আঠারো, চব্বিশ, ত্রিশ, ছত্রিশ মাস মেয়াদী নির্দিষ্ট সময়ের জন্য এ হিসাবে টাকা জমা রাখা যায়। এ একাউন্ট খোলার সময় নির্দিষ্ট মেয়াদ উল্লেখ করতে হয়। এ Account এর জন্য চেক বই দেওয়া হয় না। চেক বই এর পরিবর্তে প্রতিবার অর্থ জমা গ্রহণের বিনিময়ে টার্স ডিপোজিট রশিদ (PLS-TDR) ইস্যু করা হয়। লাভ-লোকসানের অংশীদারী মেয়াদিজমাকে এর প্রকৃতি অনুসারে দু'ভাগে ভাগ করা হয়। একটি হচ্ছে (১) অনুমোদন সমেত (with authorisation) এবং (ii) অনুমোদনহীন (without authorisation).
গ. লাভ-লোকসানের অংশীদারী আমানত হিসাব: এ হিসাব ন্যূনতম ১০০ টাকা জমা দিয়ে খোলা হয়। প্রতি বছর ছ'মাস অন্তর জুন এবং ডিসেম্বর মাসে Account এ জমাকৃত অর্থের লাভ-লোকসানের হিসাব করা হয়।
. নিরাপত্তা হিসাব: (Payment order/Security Deposit) এ একাউন্টে ইসলামি ব্যাংক রশিদ প্রদান করে সুদমুক্ত আমানত গ্রহণ করে থাকে। টেন্ডার বা অন্যকোন চুক্তির ক্ষেত্রে এ রশিদ Security Deposit ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এ ধরনের আমানতের ক্ষেত্রে ইসলামি ব্যাংক কোন প্রকার মুনাফা প্রদান করে না।
৬. লাভ-লোকসানে অংশীদারী বিশেষ নোটিশ ডিপোজিট হিসাব: এ ধরনের হিসাব খোলার নিয়ম প্রায় চলতি হিসাব খোলার মতই। ন্যূনতম অর্থ জমা দিয়ে যে কোন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান এ হিসাব খুলতে পারে। যতবার ইচ্ছা টাকা জমা দেয়া যায়। কিন্তু ওঠানোর ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সময় অর্থাৎ সাতদিন আগে টাকার পরিমাণ জানিয়ে চিঠি দিতে হয়। এ হিসেবে দৈনিক উৎপাদনের ভিত্তিতে হিসাব করে ব্যাংক ঘোষিত হারে লাভ-লোকসান প্রদান করা হয়। ন্যূনতম পরিমাণ সংরক্ষণ না করা হলে লভ্যাংশ প্রদান করা হয় না।
২. বিনিয়োগ: ইসলামি বাণিজ্যিক ব্যাংক বিনিয়োগের ক্ষেত্রে শুধু মুনাফা অর্জনের উপরেই গুরুত্বারোপ করে না। বিনিয়োগের ভিত্তিতে যাতে সামাজিক কল্যাণ অর্জিত হয় সেদিকেও দৃষ্টি রাখে। নিম্নে ব্যাংকের বিনিয়োগ নীতির পদ্ধতিগুলো উল্লেখ করা হলোঃ
ক. সরাসরি বা প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ: ইসলামি ব্যাংক শিল্প, কৃষি, বাণিজ্য, পরিবহন, স্থাবর সম্পত্তি এবং গৃহ নির্মাণ (Real Estate and Housing) প্রভৃতি খাতে স্বল্প অথবা মধ্যম ও দীর্ঘ মেয়াদের জন্য সরাসরি মূলধন বিনিয়োগ করে।
খ. মুদারাবা স্বনিয়োজিত উদ্যোক্তার মাধ্যমে বিনিয়োগ: মুদারাবা বলতে এমন একটি চুক্তি বুঝায়- যার শর্তানুসারে একপক্ষ অর্থাৎ ব্যাংক মূলধন যোগান দেয় এবং অন্যপক্ষ অর্থাৎ স্বনিয়োজিত উদ্যোক্তা চুক্তির নির্ধারিত অনুপাত অনুযায়ী লাভের জন্য তার দক্ষতা, প্রচেষ্টা, শ্রম ও প্রয়োজনীয় ব্যবসায়িক প্রজ্ঞা নিয়োজিত করেন। এ জাতীয় বিনিয়োগের কয়েকটি দিক হল-
- চুক্তির শর্তানাযায়ী মুনাফা ব্যাংক এবং উদ্যোক্তার মধ্যে বন্টন করা হয়।
- ব্যাংক শুধু প্রকৃত লোকসানের দায়িত্ব গ্রহণ করে।
- উদ্যোক্তা বা তার কর্মচারী বা প্রতিনিধি কর্তৃক শর্ত লংঘন, অবহেলা, অদম্য ব্যবস্থাপনা ইত্যাদির কারণে কোন লোকসান হয়ে থাকলে সে ক্ষেত্রে ব্যাংক উদ্যোক্তার নিকট থেকে ন্যায্য ক্ষতিপূরণ আদায় করে নেয়ার অধিকার রাখে।
গ মুশারাকা অংশীদারী বিনিয়োগ: মুশারাকা বলতে এমন ব্যবসায়িক চুক্তি বুঝায় যার অধীনে ব্যাংক মূলধনের একটি অংশ যোগন দেয় এবং বাকি অংশ যোগান দেয় বিনিয়োগ গ্রাহক। এ পদ্ধতি অনুযায়ী-
- মূলধন সরবরাহের আগেই মুনাফা বণ্টনের অনুপাত ব্যাংক ও বিনিয়োগ গ্রাহকের সম্মতিতে এ চুক্তিনামায় নির্ধারিত হয়।
- ব্যবসায়ে প্রকৃত লোকসানের ক্ষেত্রে ব্যাংক ও বিনিয়োগ গ্রাহক মূলধনের আনুপাতিক হারে তা বহন করে।
ঘ. মুরাবাহা চুক্তির ভিত্তিতে লাভে বিক্রয়: গ্রাহকের অনুরোধে নির্ধারিত মালামাল বিক্রির জন্য ব্যাংক গ্রাহক সংগ্রহ করে এবং তা চুক্তির ভিত্তিতে কিছু লাভসহ গ্রাহকের কাছে বিক্রি করে। মুরাবাহা চুক্তির বৈশিষ্ট্য হল-
- এ পদ্ধতিতে তিনটি পক্ষ থাকে যথা- ব্যাংক, বিক্রেতা (যার নিকট থেকে ব্যাংক মাল ক্রয় করে) এবং ক্রেতা (যার নিকট ব্যাংক মাল বিক্রি করে)।
- মালামালের দাম ও লাভের অংক ব্যাংক ও বিনিয়োগ গ্রাহক উভয়েরই জানা থাকতে হয়।
- ব্যাংক বিনিয়োগ গ্রাহকের নিকট থেকে প্রস্তাবিত মালের মূল্যের ২৫/৩০ ভাগ জামানত হিসেবে গ্রহণ করতে পারে।
ঙ. বায়-ই-মুয়াজ্জাল বা বাকিতে বিক্রয়: বায়-ই-মুয়াজ্জাল বলতে ব্যাংক কর্তৃক মুনাফার উদ্দেশ্যে বাকিতে মাল বিক্রয়ের জন্য বিনিয়োগ গ্রাহক ও ব্যাংকের মধ্যে চুক্তিকে বুঝায়। এ পদ্ধতির বিশেষ দিক হল:
- এ পদ্ধতিতে ব্যাংক গ্রাহকের অনুরোধে কৃষি ও শিল্পসহ বিভিন্ন খাতের উপকরণ ও মালামাল ক্রয় করে গ্রাহকের নিকট তা বাকিতে বিক্রয় করে।
- গ্রাহকগণ চুক্তি অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ে মালের নির্ধারিত মূল্য পরিমোধ করেন।
- চুক্তিপত্রে পণ্যের ধরণ, গুণাগুণ, পরিমাণ, বিক্রয় মূল্য, সরবরাহের স্থান, সময়, গ্রাহক কর্তৃক মূল্য পরিশোধের সময়-সীমা ও পদ্ধতি ইত্যাদি চুক্তিপত্রে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়।
- এ পদ্ধতিতে ব্যাংক সাধারণত কৃষি ও শিল্প পণ্য অগ্রিম ক্রয় করে থাকে।
- এ পদ্ধতিতে ব্যাংক হচ্ছে ক্রেতা এবং গ্রাহক হচ্ছে বিক্রেতা।
- ব্যাংক এ ধরনের চুক্তি সম্পাদনের সময় গ্রাহককে অর্থের যোগান দেয়।
- গ্রাহক এ পদ্ধতির ভিত্তিতে পণ্য ক্রয় করার আগ্রহ ব্যক্ত করে ব্যাংকের কাছে অনুরোধ জানায় এবং তার নির্ধারিত অংশের টাকা ব্যাংকে জমা দেয়।
- গ্রাহকের অংশের টাকার সাথে ব্যাংক তার অংশের টাকা যোগ করে সমুদয় মূল্য পরিশোধ করে।
এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url