পাকিস্তানের ১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্র

https://www.easyinfobd.com/2025/06/g-bb.html

১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্র, ১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্র প্রণয়নের প্রক্রিয়া ১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা  ১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্রে প্রবর্তিত রাষ্ট্রপতি সরকার ব্যবস্থা ব্যাখ্যা করতে পারবেন, ১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্র ব্যর্থতার কারণ বিশ্লেষণ করতে পারবেন।

১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্র প্রণয়নের প্রক্রিয়া

১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্র হল পাকিস্তানের দ্বিতীয় শাসনতন্ত্র। পাকিস্তান সৃষ্টির দীর্ঘ ৯ বছর পর ১৯৫৬ সালের ২৩ মার্চ প্রথম শাসনতন্ত্র প্রণীত হয়। অল্প দিনের মধ্যেই এ শাসনতন্ত্রকে ব্যর্থতায় পেয়ে বসে। ১৯৫৮ সালেই এ শাসনতন্ত্রের সমাধি রচিত হয়। ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা আইয়ুব খানের চাপের কারণে পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারী করেন। এটি ছিল আসলে সামরিক অভ্যুত্থান। সামরিক বাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল মোহাম্মদ আইয়ুব খান প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক নিযুক্ত হন। তিনি এক ঘোষণায় পাকিস্তানের প্রথম শাসনতন্ত্র বাতিল ঘোষণা করেন। কেন্দ্রীয় সরকার ও প্রাদেশিক সরকারকে তিনি বরখাস্ত করেন। সাথে সাথে জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদগুলো ভেঙে দেন। সকল রাজনৈতিক দলগুলোকেও বাতিল করা হয়। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খাঁন পাকিস্তানের জন্য তাঁর নিজস্ব ধারায় একটি নতুন শাসনতন্ত্র প্রণয়নের মনোযোগী হন। তিনি ১৯৬০ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি ১১ সদস্য বিশিষ্ট একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়ন সংস্থা গঠন করেন। এ সংস্থা শাসনতন্ত্র প্রণয়নের জন্য কতিপয় প্রশ্নমালা রচনা করেন। এই প্রশ্নমালা আলোচনা ও পর্যালোচনার পর শাসনতন্ত্র সংস্থা ১৯৬১ সালের ৬ মে প্রেসিডেন্টের নিকট বিবরণী পেশ করেন। অবশেষে ১৯৬২ সালের ১লা মার্চ তারিখে প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আইয়ূব খান পাকিস্তানের জন্য আরেক নতুন শাসনতন্ত্র ঘোষণা করেন। এটিই পাকিস্তানের ইতিহাসে ৬২-এর শাসনতন্ত্র নামে পরিচিত।

আরো পড়ুন:

১৯৬২ সালের সংবিধানের বৈশিষ্ট্য

১৯৬২ সালের পাকিস্তানের শাসনতন্ত্রটি ছিল নানা করণে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এটি পাকিস্তানের ইতিহাসে দ্বিতীয় শাসনতন্ত্র নামে পরিচিত। এ সংবিধানের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করলে নিম্নোক্ত বৈশিষ্ট্যগুলো স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

(১) লিখিত শাসনতন্ত্র: ১৯৬২ সালের পাকিস্তানের শাসনতন্ত্রের প্রথম পরিচয় হল লিখিত। এ শাসনতন্ত্রটি ছিল একটি লিখিত দলিল। এ শাসনতন্ত্রে ১২টি অংশ, ২৫০টি অনুচ্ছেদ ও ৫টি তফসীলি অন্তর্ভুক্ত ছিল। এ শাসনতন্ত্র আকারে ছিল বৃহৎ।

(২) প্রজাতন্ত্র: প্রজাতন্ত্র পাকিস্তানের দ্বিতীয় শাসনতন্ত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্র পাকিস্তানকে একটি প্রজাতন্ত্র হিসাবে ঘোষণা করা হয়। এ শাসনতন্ত্রের নামকরণ করা হল "পাকিস্তান প্রজাতন্ত্রের শাসনতন্ত্র (Pakistan Republican Constitution)" রাষ্ট্র প্রধান ছিলেন প্রেসিডেন্ট। তিনি নির্বাচক মন্ডলী (Electoral College) কর্তৃক নির্বাচিত হতেন।

(৩) ইসলামি আদর্শ ইসলামি আদর্শ ১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্রের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। এ শাসনতন্ত্র পাকিস্তান রাষ্ট্রকে ইসলামি প্রজাতন্ত্র রূপে আখ্যায়িত করে। এ শাসনতন্ত্রে উল্লেখ করা হয় যে, পাকিস্তানে কোন ইসলাম বিরোধী আইন চালু করা যাবে না। সুতরাং এ শাসনতন্ত্রটি ছিল একটি ইসলামি আদর্শ ভিত্তিক শাসনতন্ত্র।

(৪) প্রস্তাবনা: ১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্রের একটি বিশেষ দিক হল এর প্রস্তাবনা। প্রস্তাবনার মাধ্যমেই এ শাসনতন্ত্রের সূচনা। পাকিস্তান রাষ্ট্রের আদর্শ, লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য প্রস্তাবনার মাধ্যমে উল্লেখ করা হয়।

(৫) নির্দেশিত নীতি্র: পাকিস্তানের ১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্রকে বিশ্লেষণ করলে নির্দেশিত নীতির উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। এ শাসনতন্ত্রে ২১টি মূলনীতির বিধান রাখা হয়।

(৬) মৌলিক অধিকার মৌলিক অধিকার ১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্রের একটি বিশেষ দিক। অন্যান্য সংবিধনের ন্যায় এ শাসনতন্ত্রে জনগণের মৌলিক অধিকার সন্নিবেশিত করা হয়। তবে প্রথম দিকে এ শাসনতন্ত্রে কোন মৌলিক অধিকারের বিধান রাখা হয় নি। পরে সংশোধনের মাধ্যমে এ শাসনতন্ত্রে মৌলিক অধিকার সংযোজন করা হয়।

(৭) রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্রে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসন ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়। এ শাসনতন্ত্র মতে প্রেসিডেন্ট ছিলেন দেশের প্রকৃত শাসনকর্তা। তার হাতে প্রভুত ক্ষমতা ন্যস্ত করা হয়। তিনি নির্বাচনী কলেজের দ্বারা ৫ বছরের জন্য নির্বাচিত হতেন। তিনি কোন আইন পরিষদের সদস্য ছিলেন না। এমনকি ঐ পরিষদের নিকট দায়ীও ছিলেন না।

(৮) দুস্পরিবর্তনীয় শাসনতন্ত্র দুস্পরিবর্তনীয়তা ১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্রের একটি উল্লেখযোগ্য দিক। ১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্র ছিল দুস্পরিবর্তনীয় প্রকৃতির। এ শাসনতন্ত্র পরিবর্তনের জন্য বিশেষ পদ্ধতির প্রয়োজন ছিল। সহজে এ শাসনতন্ত্রকে পরিবর্তন করা যেত না। জাতীয় পরিষদের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যদের অনুমোদন দ্বারা এ শাসনতন্ত্রকে পরিবর্তন করা যেত।

(৯) যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার ১৯৬২ সালের পাকিস্তান শাসনতন্ত্রের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এ শাসনতন্ত্রের শুরুতে পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার প্রবর্তনের বিধান রাখা হয়। এ শাসনতন্ত্রে বলা হয় যে, সবই থাকবে কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে এবং বাকী ক্ষমতা থাকবে প্রাদেশিক সরকারের কাছে।

(১০) গণভোট: ১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্রকে বিশ্লেষণ করলে গণভোটের বিধান লক্ষ্য করা যায়। এ শাসনতন্ত্রে গণভোটের ব্যবস্থা রাখা হয়। প্রেসিডেন্ট ও জাতীয় পরিষদের মধ্যে কোন বিষয়ে মত বিরোধ দেখা দিলে তা গণভোটের মাধ্যমে সমাধান করা হত।

(১১) এককক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা: এক কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা পাকিস্তানের দ্বিতীয় সংবিধানের আরেকটি বিশেষ দিক। এ শাসনতন্ত্রে পাকিস্তানে এক কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভার বিধান রাখা হয়। পাকিস্তানের আইনসভা প্রেসিডেন্ট ও এককক্ষ বিশিষ্ট জাতীয় পরিষদ সমন্বয়ে গঠিত হত। এ আইনসভায় একটি মাত্র কক্ষ ছিল।

(১২) মৌলিক গণতন্ত্র: ১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্রে মৌলিক গণতন্ত্রের ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। নির্বাচিত মৌলিক গণতন্ত্র দ্বারা গঠিত "নির্বাচকমন্ডলী" প্রেসিডেন্ট ও জাতীয় পরিষদের সদস্যদের নির্বাচিত করতেন। এ শাসনতন্ত্রে সংখ্যালঘুদের স্বার্থ রক্ষার বিধান রাখা হয়।

(১৩) স্বাধীন বিচার বিভাগ স্বাধীন বিচার বিভাগ এ শাসনতন্ত্রের আর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। এ শাসনতন্ত্রণ স্বাধীন বিচার বিভাগের বিধান রাখা হয়। ১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্রে বিচার বিভাগকে শাসন বিভাগ থেকে স্বতন্ত্র রাখার কথা বলা হয়। এ শাসনতন্ত্রে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষারও বিশেষ বিধান রাখা হয়।

(১৪) রাষ্ট্রভাষা এ শাসনতন্ত্রে রাষ্ট্রভাষার বিধান রাখা হয়। ৬২-এর শাসনতন্ত্রে বাংলা ও উর্দু ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এ সংবিধানে বলা হয় যে, প্রশাসনিক ক্ষেত্রে বাংলা ও উর্দু ভাষা ব্যবহার করা যেতে পারে।

পরিশেষে বলা যায় যে, ১৯৬২ সালের সংবিধানে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার কিংবা মৌলিক গণতন্ত্রী ব্যবস্থা প্রবর্তন করে সংবিধানে বড় ধরনের মৌলিক পরিবর্তন করা হয়।

১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্রে প্রবর্তিত রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার পদ্ধতি

রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্রে প্রবর্তিত একটি উল্লেখযোগ্য দিক। ১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্রে পাকিস্তানে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার প্রবর্তন করা হয়। শাসনতন্ত্র মতে রাষ্ট্রপতি শাসন বিভাগের প্রধান এবং তার নামে সকল কর্ম সম্পাদিত হবে। তিনি সাধারণত আইন বিভাগের নিয়ন্ত্রণ মুক্ত থাকবে। এ সরকার ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি প্রধান। সুতরাং রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও কার্যাবলি আলোচনার দাবিদার।

আরো পড়ুন:

প্রেসিডেন্টের যোগ্যতা

১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্রে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের বিশেষ বিধান রাখা হয়। কোন ব্যক্তিকে রাষ্ট্রপতির প্রার্থী হতে হলে নিম্নোক্ত যোগ্যতা থাকা আবশ্যক:

(১) তিনি হবেন একজন মুসলমান;

(২) তাঁর বয়স অন্যূন ৩৫ বছর হতে হবে;

(৩) তাঁকে জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হওয়ার যোগ্যতা সম্পন্ন হতে হবে।

প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ও অপসারণ

উপযুক্ত যোগ্যতা সম্পন্ন ব্যক্তি রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন। তিনি পাঁচ বছরের জন্য এ পদে নির্বাচিত হবেন। মৌলিক গণতান্ত্রিকভাবে সর্বজনিনভাবে নির্বাচিত আশি হাজার সদস্য নিয়ে গঠিত নির্বাচকমন্ডলীর (Electoral College) সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে তিনি নির্বাচিত হতেন। আবার নির্বাচক মন্ডলীর সদস্যরা সমসংখ্যক উভয় প্রদেশ থেকে প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হতেন। পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের যৌথ অনুমোদন সাপেক্ষে প্রেসিডেন্ট দু' মেয়াদের জন্য প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচনের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হতে পারতেন। জাতীয় পরিষদের অভিযুক্তকরণ ব্যতীত তাঁকে পদচ্যুত করা যেত না। জাতীয় পরিষদের স্পীকারের নিকট স্বহস্তে লিখিত পত্রে তিনি পদত্যাগ পত্র পেশ করতে পারতেন। প্রেসিডেন্টর পদ শূন্য হলে, বিদেশ গমন করলে অথবা অসুস্থ্য বা অন্য কোন কারনে স্বীয় দায়িত্ব পালনে অপারগতা প্রকাশ করলে জাতীয় পরিষদের স্পীকার অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন। শাসনতন্ত্রের ১৩ ধারা অনুযায়ী শাসনতন্ত্রের কোন ধারা লংঘন করলে অথবা গুরুতর অসদাচরণের দায়ে জাতীয় পরিষদের মোট সদস্যের এক-তৃতীয়াংশ সদস্যদের স্বাক্ষরযুক্ত লিখিত আবেদন স্পীকারের নিকট পেশ করে প্রেসিডেন্টের অপসারণ প্রস্তাব আনায়ন করতে পারতেন। জাতীয় পরিষদের মোট সদস্যদের তিন-চতুর্থাংশের ভোটে প্রস্তাবটি গৃহীত হলে প্রেসিডেন্ট পদত্যাগ করতেন।

প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা ও কার্যাবলি

১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্রের একটি বিশেষ দিক হল রাষ্ট্রপতি শাসিত ব্যবস্থা। এ ব্যবস্থার কেন্দ্র বিন্দু হল প্রেসিডেন্ট। তিনি ছিলেন নির্বাহী প্রধান। প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা ও কার্যাবলিকে নিম্নোক্ত কয়েকভাবে ভাগ করে আলোচনা করা যেতে পারে।

১। শাসন সংক্রান্ত ক্ষমতা: ১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্র মতে প্রেসিডেন্ট ছিলেন শাসন ব্যবস্থার মধ্যমণি। তাঁকে কেন্দ্র করে সমস্ত শাসনকার্য পরিচালিত হত। তিনি প্রত্যক্ষভাবে অথবা তাঁর অধীনস্ত কর্মকর্তা ও কর্মচারিদের মাধ্যমে শাসনতন্ত্র মোতাবেক যাবতীয় শাসন সংক্রান্ত কার্যাবলি সম্পাদন করতেন। তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের প্রশাসনকে সচল রাখার জন্য যাবতীয় বিধি-বিধান নির্ধারণ করতেন। তাঁকে যথার্থভাবে সহযোগিতার জন্য কেন্দ্রীয় মন্ত্রি পরিষদ গঠন করতেন। এ পরিষদ তাঁকে যাবতীয় বিষয় সহযোগিতা করত। মন্ত্রি পরিষদ তাঁদের কার্যাবলীর জন্য প্রেসিডেন্টের নিকট দায়ী থাকতেন। প্রশাসনকে দক্ষ ও সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য দক্ষ প্রশাসকও তিনি নিয়োগ করতেন। যেমন পার্লামেন্টারী সেক্রেটারীদেরও নিযুক্ত করতেন। এছাড়া তিনি গভর্নর জেনারেল, এটর্নী জেনারেল, অডিটর জেনারেল এবং বিচার বিভাগের বিচারপতিদের নিযুক্ত করতেন। প্রশাসনিক ভাবে তাঁর অনুমোদন সাপেক্ষে প্রাদেশিক গভর্নরগণ প্রাদেশিক মন্ত্রি পরিষদ গঠন করতেন। তিনি ছিলেন দেশরক্ষা বাহিনীর সর্বাধিনায়ক। যাবতীয় দেশ রক্ষা সংক্রান্ত কাজ তাঁর নামেই সম্পাদিত হতো।

২। আইন সংক্রান্ত কাজ: আইন সংক্রান্ত কাজ পাকিস্তানের দ্বিতীয় শাসনতন্ত্রে প্রবর্তিত প্রেসিডেন্টের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। তিনি পার্লামেন্টের সঙ্গে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত ছিলেন। তাঁকে বাদ দিয়ে পার্লামেন্টকে কল্পনা করা যেত না। শাসনতন্ত্রের ১৯নং ধারা মতে প্রেসিডেন্ট ও এক কক্ষবিশিষ্ট জাতীয় পরিষদ নিয়ে পাকিস্তানের পার্লামেন্ট গঠিত হত। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহবান, স্বাগত ভাষণ এবং পরিষদ বাতিলের ক্ষমতা তাঁর উপর ন্যস্ত ছিল। জাতীয় পরিষদ কর্তৃক কোন বিল গৃহীত হলে তা সাথে সাথে প্রেসিডেন্টের নিকট প্রেরণ করা হত। তিনি সম্মতি দানে অপারগতা প্রকাশ করলে তা আবার জাতীয় পরিষদে যেত। পুনরায় জাতীয় পরিষদ এঐ বিল প্রেসিডেন্টের কাছে পাঠাত। দ্বিতীয় বার সর্বোচ্চ ৩০ দিন তিনি বিলটি আটকে রাখতে পারতেন। ৩১ দিনের মধ্য তিনি সম্মতি না দিলে বিলটিতে তাঁর সম্মতি আছে বলে ধরে নেয়া হত। তিনি জাতীয় পরিষদ কর্তৃক বিলে ভেটো দিতে পারতেন। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বন্ধ থাকা অবস্থায় জরুরি প্রয়োজনে তিনি অধ্যাদেশ জারী করতেন। জাতীয় পরিষদে কোন বিষয়ে মতানৈক্য দেখা দিলে তিনি তা নির্বাচক মন্ডলীর কাছে প্রেরণ করতেন।

৩। অর্থ সংক্রান্ত কাজ: অর্থ সংক্রান্ত বিষয়ে প্রেসিডেন্ট প্রভূত ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। তাঁর এ ক্ষমতা ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। প্রেসিডেন্টের সুপারিশ ছাড়া কোন বিল পাস করা যেত না। আর্থিক বছরের প্রারম্ভে তিনি জাতীয় পরিষদে বাজেট করতেন। এ বাজেট আলোচনার পর সার্বিকভাবে গৃহীত হত। স্থায়ী ব্যয়ের ব্যাপারে মতামত প্রদানের ক্ষমতা তার অর্থ সংক্রান্ত ক্ষমতার অন্তর্ভুক্ত ছিল। আবার বাজেটে বরাদ্দকৃত অর্থ প্রয়োজন মিটাতে অপর্যাপ্ত হলে একটি অতিরিক্ত বাজেট (Suplementary) জাতীয় পরিষদে পেশ করতেন। এক কথায় জাতীয় অর্থ সংক্রান্ত কাজ তাঁর নামে সম্পাদিত হতো।

৪। বিচার সংক্রান্ত কাজ: তৎকালীন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট কিছু কিছু বিচার সংক্রান্ত কাজও করতেন। তিনি বিচার কার্য সুষ্ঠু ও দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনার জন্য সুপ্রীম কোর্ট ও হাইকোর্টের বিচারপতিদের নিযুক্ত করতেন। তিনি সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের ক্ষমা প্রদর্শন করতে পারতেন। এমন কি বিচারের রায়ও স্থগিত করার ক্ষমতা তাঁর এ বিচার কার্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল।

৫। জরুরি ক্ষমতা তৎকালীন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট কতিপয় জরুরি ক্ষমতা ভোগ করতেন। যুদ্ধ বা বহিরাক্রমণ আসন্ন এরূপ পরিস্থিতিতে দেশে জরুরি অবস্থা জারী করতেন। তবে এরূপ জরুরি ঘোষণা দ্রুত সময়ে জাতীয় পরিষদে প্রেরণ করতে হত। এরূপ পরিস্থিতিতে মোকাবেলার জন্য অর্ডিন্যান্স জারী ও প্রণয়ন করতেন। তাঁর এ অর্ডিন্যান্স বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। জাতীয় পরিষদ এ অর্ডিন্যান্স বাতিল করতে পারত না। আবার জরুরি অবস্থা অপসারিত হলে অর্ডিন্যান্সটি বাতিল বলে গণ্য হত। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন চলাকালে বিশেষ "আইন প্রণয়নমূলক ক্ষমতা" প্রয়োগের অধিকার তাঁর উপর ন্যস্ত ছিল।

সুতরাং বলা যায় যে, ১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্রে প্রবর্তিত রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ছিল অপরিসীম। তিনি একাধারে ছিলেন শাসন বিভাগের প্রধান আবার আইন বিভাগেরও প্রধান। তাঁর নামে যাবতীয় কার্যাবলী সম্পন্ন হত। তাই কেউ কেউ বলেছেন "The position of the President was the central point of the 1962 constitution."

আরো পড়ুন:

১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্রের ব্যর্থতা

১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্র দিনে দিনে তার গ্রহণযোগ্যতা হারায়। অবশেষে এটি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। ১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্র ব্যর্থতার কারণগুলো নিম্নরূপ:

(১) রাষ্ট্রপতির বিপুল ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির বিপুল ক্ষমতা ১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্রের ব্যর্থতার প্রথম কারণ। ১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্রের মাধ্যমে ঐতিহ্যবাহী পার্লামেন্টারী শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তে প্রেসিডেন্টন্সিয়াল শাসন পদ্ধতি প্রবর্তন করা হয়। রাষ্ট্রপতি প্রভূত ক্ষমতার মালিক হন। ফলশ্রুতিতে পার্লামেন্টের সদস্যদের মনে অসন্তোষ দানা বেঁধে উঠতে থাকে।

(২) আইন বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ: আইন বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ ১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্র ব্যর্থতার একটি বিশেষ কারণ। এ শাসনতন্ত্রের দ্বারা শাসন বিভাগকে আইন বিভাগের উপর তদারকীর দায়িত্ব দেওয়া হয়। ধীরে ধীরে আইন সভা ক্ষমতাহীন হয়ে পড়ে। রাজনৈতিক কার্যকলাপের উপর এর গুরুত্ব হ্রাস পেতে থাকে।

(৩) রাজনীতি নির্ভরশীলতা: রাজনীতি নির্ভরশীলতার কারণে ১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্র ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। আইয়ুব খান চেয়েছিলেন জাতীয় পরিষদের নব-নির্বাচিত সদস্যগণ কোন রাজনৈতিক দলের অনুগত থাকবে না। কিন্তু বাস্তবে হয় এর পরিপন্থী। ফলে জাতীয় পরিষদের সদস্যগণ নিরপেক্ষতা হারিয়ে ফেলেন।

(৪) ভোটাধিকারের অস্বীকৃতি: ১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্রের ব্যর্থতার অন্যতম আরেকটি কারণ হল ভোটাধিকারের অস্বীকৃতি। ১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্রে প্রাপ্ত বয়স্কদের ভোটাধিকার নীতিকে অস্বীকার করা হয়। তাই এ শাসনতন্ত্র প্রবর্তনের পর পর প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকারের দাবিতে একটি দুর্বার আন্দোলন গড়ে ওঠে। যা এ শাসনতন্ত্রকে ব্যর্থতার গহব্বরে নিক্ষেপ করে।

(৫) মৌলিক অধিকার অস্বীকৃতি: মৌলিক অধিকার নাগরিক জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মৌলিক অধিকার ছাড়া নাগরিক জীবন কল্পনা করা যায় না। কিন্তু ১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্রে প্রাথমিকভাবে এ অধিকারগুলোর কোন বিধান ছিল না। ফলে জনমনে অসন্তোষ দানা বেঁধে ওঠে।

(৬) অর্থনৈতিক বৈষম্য: অর্থনৈতিক বৈষম্য ১৯৬২ সালের পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র ব্যর্থতায় জন্য বিশেষভাবে দায়ী। ১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্র প্রবর্তনের পর পরই পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়তে থাকে। এ ব্যাপক বৈষম্য পূর্ব পাকিস্তানবাসীকে আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করে। আইয়ূব সরকার এ অবস্থা নিরসনে ব্যর্থতার পরিচয় দেয়। ফলে শাসনতান্ত্রিক অচলতা দেখা দেয়।

(৭) অগণতান্ত্রিক শাসন: আইয়ুব সরকারের অগণতান্ত্রিক শাসন ১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্রের ব্যর্থতার একটি অন্যতম কারণ। তিনি ধীরে ধীরে পাকিস্তানে স্বৈরাচারী শাসন কায়েম করতে থাকেন। নতুন শাসনতন্ত্র প্রবর্তনের পর থেকে জনগণ এ শাসনতন্ত্রকে তীব্র ভাষায় নিন্দা জানায়। ফলে এ শাসনতন্ত্র ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।

(৮) সুষ্ঠু নেতৃত্বের অভাব: সুষ্ঠু নেতৃত্বের অভাবে পাকিস্তানের ১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্র অকার্যকর হয়ে পড়ে। ঐ শাসনতন্ত্র প্রবর্তনের পর পরই সীমিত রাজনৈতিক দল গড়ে ওঠে। সীমিত রাজনৈতিক দল গড়ে উঠলেও এর একটিও জাতীয় ভিত্তিতে সুসংগঠিত হয় নি। ফলশ্রুতিতে সুষ্ঠু নেতৃত্বের অভাব দেখা দেয়। উল্লিখিত সীমাবদ্ধতার কারণে ১৯৬২ সালের পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।

সারকথা

১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্র ছিল পাকিস্তানের শাসনতান্ত্রিক ইতিহাসের দ্বিতীয় শাসনতন্ত্র। এ শাসনতন্ত্রটি আকারে ছিল বৃহৎ। এ শাসনতন্ত্রের কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য ছিল অন্যান্য শাসনতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য থেকে ভিন্ন প্রকৃতির। এ শাসনতন্ত্রে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার ওপর বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করা হয়। শাসনতন্ত্র প্রবর্তনের পর পর তৎকালীন শাসকগণ স্বৈরাচারী মনোভাব পোষণ করতে শুরু করেন। জনমনে বিক্ষোভ দানা বেঁধে ওঠে। এক পর্যায়ে স্বৈরাচারী সরকার গণআন্দোলনকে স্তব্ধ করার জন্য জুলুম ও নির্যাতনের পথ বেছে নেয়। কিন্তু গণআন্দোলনের মুখে সামরিক শাসক আইয়ুব খান পদত্যাগে বাধ্য হন। ফলে এ শাসনতন্ত্র ব্যর্থতায় পর্যবেশিত হয়।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url