ভাষা আন্দোলন ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস ভাষা আন্দোলনের প্রকৃতি বিশ্লেষণ
ভাষা আন্দোলন ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস সম্পর্কে বর্ণনা দিতে পারবেন। ভাষা আন্দোলনের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করতে পারবেন, বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদ বিকাশে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করতে পারবেন।
ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস
বাঙ্গালির ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস এক রক্তরঞ্জিত ইতিহাস। ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙ্গালি জাতির জাতীয়তাবাদী আন্দোলন শুরু হয়। দীর্ঘ দু'শত বছর শাসনের পর এ উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটে। ১৯৪৭ সালে কেবলমাত্র ধর্মীয় চেতনাকে পুঁজি করে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটির সৃষ্টি হয়। পাকিস্তান সৃষ্টিস পর থেকে পাঞ্জাব ভিত্তিক পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী বাঙালি জাতিকে সুনজরে দেখে নি। বাঙালি জাতির উপর আধিপত্য কায়েমের বিশেষ পাঁয়তারা চলছিল। তারা চেয়েছিল বাঙালি জাতির ভাষা ও সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে দিতে শুধু সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে নয়, অন্যান্য ক্ষেত্রেও তারা বিমাতা সুলভ আচরণ করছিল। রাষ্ট্রভাষার দাবিতে তৎকালীন তমদ্দুন মজলিস সুপরিকল্পিতভাবে সুসংগঠিত আন্দোলন শুরু করে। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান সৃষ্টির মাত্র ১৭ দিন পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ অধ্যাপক আবুল কাশেম-এর নেতৃত্বে ১ সেপ্টেম্বর ৩ সদস্য বিশিষ্ট তমদ্দুন মজলিস। গঠিত হয়। এ সংগঠনের অন্য নেতৃদ্বয় ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও শামসুল আলম। সূচনালগ্ন থেকেই এ সংগঠনটি বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা করার দাবি উত্থাপন করেছিল। ১৯৪৮ সালে ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উত্থাপন করেছিলেন।
পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী এ দাবি প্রত্যাখ্যান করে উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এ সিদ্ধান্ত জোর করে বাঙালিদের উপর চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল। অথচ উর্দু ভাষা-ভাষী লোকের সংখ্যা ছিল সমগ্র পাকিস্তানে অনূর্ধ্ব শতকরা ৬.০০ ভাগ। পক্ষান্তরে, বাংলা ভাষা-ভাষী লোকের সংখ্যা ছিল শতকরা ৫৪৬ জন। তৎকালীন পাকিস্তানী বিভিন্ন ভাষা-ভাষীর পরিসংখ্যান ছিল নিম্নরূপ:
ভাষা= শতকরা হার
বাংলা=৫৪.৬
পাঞ্জাবী=৬.১
পশতু=২৭.১
সিদ্ধি=৪.৮
ইংরেজী=১.৪
সূত্র: ১৯৫১ সালের আদমশুমারী।
আরো পড়ুন:
১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ গঠিত পূর্ব বাংলা মুসলিম ছাত্রলীগ এর ইশতিহারে বাষ্ট্র ভাষার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদ জানান হয়। এতে সতর্ক বাণী উচ্চারণ করা হয়। কিন্তু ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকা সফরে এসে ঢাকার রমনা রেসকোর্সের এক জনসভায় ঘোষণা করেন, "Undu and Undate will be the cate lage of Pakistan" অর্থাৎ উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। এ ঘোষণার মাত্র তিন দিন পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হল এলাকায় এক সমাবর্তন অনুষ্ঠানে যোগ দেন। এ সমাবর্তন উৎসবে তিনি আবার ঐ ঘোষণার পুনরাবৃত্তি করেন। উপস্থিত ছাত্ররা খোলাখুলী ভাবে এ অগণতান্ত্রিক ও অন্যায় ঘোষণার প্রতিবাদ জানায়। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ভাষা আন্দোলনের দাবিতে দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়। পাকিস্তানী স্বৈরাচারী শাসকগোষ্ঠী পুলিশ বাহিনীকে ছাত্র-জনতার উপর লেলিয়ে দেয়। পুলিশ ছাত্র মিছিলের উপর লাঠি চার্জ করে। দীরে ধীরে আন্দোলন পরিপক্কতার আকার ধারণ করে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি "রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই" শ্লোগানে ঢাকার রাজপথ মুখরিত হয়। শান্তিপূর্ণ মিছিলের উপর তাবেদার পুলিশ বাহিনী গুলি চালায়। ফলে পুলিশের গুলিতে নিহত হয় বরকত, সালাম, জব্বার ও রফিক এবং নাম না জানা আরও অনেকে। ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে সারা দেশে প্রচন্ড বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হয়। গণ-বিস্ফোরণের কাছে পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী মাথা নত করতে বাধ্য হয়। তারা বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষারূপে মেনে নিতে বাধ্য হন। অবশেষে ১৯৫৬ সালের পাকিস্তানের প্রথম সংবিধানে বাংলাকে উর্দুর পাশাপাশি রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
জাতীয়তাবাদ বিকাশে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব
ভাষা আন্দোলন মূলত একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন। সাংস্কৃতিক আন্দোলন হলেও বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এর গুরুত্ব অপরিসীম ও সুদূরপ্রসারী। এ আন্দোলন প্রকৃতপক্ষে বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এ আন্দোলনের সাথে মিশে আছে শহীদের রক্ত। এ আন্দোলন কেড়ে নিয়েছে বহু বাঙালির প্রাণ। বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ভূমিকা নিম্নরূপ।
(১) জাতীয় চেতনা সৃষ্টি: জাতীয় চেতনা সৃষ্টিতে ভাষা আন্দোলনের গুরুত অপরিসীম। এ আন্দোলন বাঙালি জাতির ভাষা ভিত্তিক জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটায়। এ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি নিজেদের স্বতন্ত্র রাজনৈতিক স্বাধীকার সম্পর্কে সচেতন হয়। নিপীড়িত ও গর্বিত বাঙালি জাতির মনে রাজনৈতিক সচেতনতা তীব্র থেকে তীব্রতর হতে শুরু করে।
(২) দাবি আদায়: বাঙালিদের দাবি আদায়ের একটি বিশেষ পদক্ষেপ হল এ আন্দোলন। ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি বহু ত্যাগের বিনিময়ে জাতীয়তাবাদী দাবি আদায়ের শিক্ষা পায়। তারা ধীরে ধীরে দাবি আদায়ের ক্ষেত্রে সোচ্চার ভূমিকা পালন করে। তারা আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার কায়েমের সংগ্রাম চালিয়ে যাবার লক্ষ্যে দৃঢ় সংকল্প পোষণ করে।
(৩) একাত্বতা ঘোষণা: একাত্বতা ঘোষণায় ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। এ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বিশেষ করে বুদ্ধিজীবী সমাজ জনগণের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে। ছাত্র, কৃষক, জনতা, শ্রমিক ও বুদ্ধিজীবী সকলে একই কাতারে শামিল হয়। ফলে সকলের মধ্যে জাতীয়তাবাদী বন্ধন সৃষ্টি হয়। আর এ একাত্বতাবোধ জাতীয়তাবাদ বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
(৪) শহীদ দিবসের মর্যাদা: শহীদ দিবসের মর্যাদা ভাষা আন্দোলনের একটি সফল দিক। ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালি জাতি শহীদ দিবসের মর্যাদা উপলব্ধি করতে শিখেছে। এ উপলব্ধি বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশে কার্যকর ভূমিকা পালন করেছে।
(৫) সাম্প্রদায়িকতা রোধ: সাম্প্রদায়িকতা রোধকল্পে ভাষা আন্দোলনের অবদান কম নয়। এ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালিদের মনে সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী মনোভাব গড়ে ওঠে। এ সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী মনোভাব জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে আরও গতিশীল করে তোলে।
(৬) পরবর্তী আন্দোলনের ডাক: ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি পরবর্তী আন্দোলনের ডাক দেয়। ভাষা আন্দোলনের মধ্যে পরবর্তী আন্দোলনের বীজ নিহিত হয়। এ আন্দোলন পরবর্তী আন্দোলনকে আরও জোরদার করে তোলে। ফলে জাতীয়তাবাদ বিকাশের পথ আরও সুগম হয়।
(৭) মধ্যবিত্ত শ্রেণীর গুরুত্ব বৃদ্ধি: ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে মধ্যবিত্ত শ্রেনির গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। এ আন্দোলনে পূর্ব বাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণী প্রভাবশালী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। অতীতে এ অঞ্চলে সমাজের উচ্চ শ্রেণীর যারা রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হত। এ পথ ধরে মধ্যবিত্ত শ্রেণী ৭১-এর আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়ে। পরবর্তীতে ১৯৫৪ সালে বাঙালিদের যুক্ত ফ্রন্টের বিজয়, ছয় দফা ও ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলন, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে ঐতিহাসিক বিজয় এবং সর্বোপরি ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার যুদ্ধে উক্ত আন্দোলনের প্রভাব। ছিল অভাবনীয়।
আরো পড়ুন:
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ২১শে ফেব্রুয়ারি
মহান একুশে চেতনা আমাদের সাহিত্য, সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক পরিমন্ডলে দৃশ্যমান। নতুন শতকের অতি বিস্ময়কর ও গৌরবদীপ্ত চমক হল বাংলা ভাষার বিজয়। এ চমক নতুন সহস্রাব্দের। বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসের সাথে এ বিজয়ের স্মৃতি ম্লান। ১৯৯৯ সালের নভেম্বর মাসে জাতিসংঘের অঙ্গ সংগঠন ইউনেস্কো (UNESCO)-এর বিশ্বব্যাপী ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস (International Mother Language Day) পালনের মধ্য দিয়ে বিশ্বের দরবারে স্বীকৃতি পেল বাংলা ভাষা। এটি আমাদের অহংকার ও গৌরব।
সারকথা
সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিতে পাকিস্তান সৃষ্টির পর পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী বাঙ্গালি জাতিকে সুনজরে দেখেনি। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ১৯৪৮ সালের ২১শে মার্চের অশোভন ও অযৌক্তিক ঘোষণার সাথে সাথে বাঙালি ছাত্র জনতা দুর্বার আন্দোলনের ডাক দেয়। দীর্ঘ কয়েক বছর সংগ্রামের পর ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষা আন্দোলনের চূড়ান্ত রূপায়ন ঘটে। পরবর্তীতে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা দিতে বাধ্য হয়। বাঙ্গালিরা এখানে থেমে থাকে নি। অবশেষে ১৯৯৯ সালের নভেম্বর মাসে UNESCO ঘোষণার মধ্যদিয়ে বাঙ্গালি জাতি মাতৃভাষাকে বিশ্বের মানচিত্রে স্থান করতে সক্ষম হয়েছে।
এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url