ইসলামি অর্থনীতিতে যাকাত ব্যবস্থা
ইসলামি অর্থনীতিতে যাকাত ব্যবস্থা যাকাত শব্দের অর্থ বলতে পারবেন। যে সকল সম্পদের যাকাত আদায় করতে হবে তা নির্দেশ করতে পারবেন। যাকাতের নিসাব বর্ণনা করতে পারবেন। যাকাতের পরিমাণ সম্পর্কে আলোকপাত করতে পারবেন। যাকাতের শর্ত আলোচনা করতে পারবেন।
যাকাত ব্যয়ের খাতসমূহ বর্ণনা করতে পারবেন।
◆ যাকাতের আর্থ-সামাজিক গুরুত্ব বর্ণনা করতে পারবেন।
যাকাত শব্দের অর্থ
ইসলাম মানবজাতির একমাত্র পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। মানুষের ইহকালীন সুখ-সমৃদ্ধি ও পরকালিন শান্তিই এ ব্যবস্থার মূল কথা। এ পৃথিবীতে প্রকৃতিগতভাবে সব মানুষের আর্থিক অবস্থা সমান নয়। আল্লাহ বলেন-
আমিই তাদের মাঝে তাদের জীবিকা বণ্টন করি পার্থিব জীবনে এবং একজনকে অপরের উপর মর্যাদায় উন্নত করি, যাতে একে অপরের দ্বারা কাজ করাতে পারে।" (সূরা আয-যখরুফ: ৩২)
এ কারণেই মানুষ ধনী-গরীব বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত। ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষের এ অর্থনৈতিক বৈষম্য শুধু পরীক্ষার জন্য। গরীব তার দারিদ্রতা নিয়ে আল্লাহর বন্দেগীতে টিকে থাকতে পারে কি-না? আবার ধনী তার সম্পদের মোহে আল্লাহকে ভুলে থাকে, না-কি তার সম্পদ আল্লাহর দেয়া বিধান অনুযায়ী ব্যয় ও নিয়ন্ত্রণ? আল্লাহ ধনীর সম্পদ ব্যবহারের যে নীতিমালা দিয়েছেন তার অন্যতম প্রধান বিষয় হল, আর্থিক সাহায্যের মাধ্যমে সমাজের অক্ষম ও দুর্বল মানুষদের সবল করা। এ আর্থিক সাহায্য দুধরনের এক- অবশ্য পালনীয়, দুই- সেচ্ছায় প্রদেয়। প্রথম প্রকার বা অবশ্য পালনীয় সাহায্য বিভিন্ন প্রকার হতে পারে যেমন- যাকাত, ফিত্রা ইত্যাদি। আলোচ্য অংশে যাকাত সংক্রান্ত বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
যাকাত (১৩) শব্দটি আরবী। যার অর্থ- যে জিনিস ক্রমশঃ বৃদ্ধি পায় এবং পরিমাণে বেশী হয়। কেননা যাকাত দুজনেরই সম্পদ বৃদ্ধি করে। যাকাতদাতা যাকাত প্রদান করায় আল্লাহ তার সম্পদে বরকত দেন, ফলে তার সম্পদ বেড়ে যায়। দ্বিতীয়তঃ যাকাতগ্রহীতার সম্পদতো বাড়েই। যাকাতের অন্য অর্থ পবিত্রতা ও শুদ্ধকরণ। কেননা যাকাত প্রদানের মাধ্যমে মানুষের মন ও আত্মা পবিত্র হয়, তার সম্পদ শুদ্ধ হয়। যাকাতের এ অন্তনিহিত দু অর্থই আল্লাহ এক আয়াতের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করেছেন-
"তুমি তাদের সম্পদ থেকে সাদকা গ্রহণ করবে। এর দ্বারা তুমি তাদের পবিত্র ও পরিশোধিত করবে।" (সূরা আত-তাওবা: ১০৩)
ইসলামি শরীয়াতের দৃষ্টিতে যাকাত ব্যবহার হয় ধন-সম্পদে আল্লাহ নির্ধারিত নির্দিষ্ট ও ফরযকৃত অংশ বোঝাবার জন্য। যেমন- পাওয়ার যোগ্য অধিকারী লোকদের নির্দিষ্ট অংশের ধনমাল দেয়াকেও যাকাত বলা হয়। নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিকদের সম্পদ এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর থেকে নির্দিষ্ট হারে সম্পদ আল্লাহ নির্ধারিত পথে ব্যয় করার নামই যাকাত।
অর্থনীতির ভাষায় যাকাত হল, বিত্তশীলদের উপর আরোপিত এক ধরনের কর।
যাকাত ব্যক্তির উপর সমাজের অধিকার। এ অধিকার পূর্ণ করা ইসলামি সমাজের প্রত্যেকটি মানুষেরই কর্তব্য। এ কর্তব্যের বিধান পবিত্র কুরআনে অসংখ্যবার উল্লেখ করা হয়েছে। বস্তুত ইসলামের অন্য কোন বিধান এত অসংখ্যবার উল্লেখ করা হয়নি। আল্লাহ বলেন-
"তোমরা সালাত কায়েম কর এবং যাকাত দাও"। (সূরা আল-বাকারা: ৪৩)
যাকাত আদায়যুক্ত সম্পদ
যাকাতের আবশ্যকতা শুধু সঞ্চিত অর্থ-সম্পদের উপর নয় বরং ব্যক্তির নিকট যে সম্পদ পুঞ্জীভূত হয়ে আছে তা নির্ধারিত নিসাব পরিমাণ হলেই তাতে যাকাত ফরয হবে। যেসব সম্পদে যাকাত ফরয তা হল:
১. নগদ টাকা-পয়সা
২. স্বর্ণ-রৌপ ও তার অলংকার
৩. খনিজ সম্পদ
৪. গবাদি পশু
৫ ব্যবসায়িক পণ্যসামগ্রী।
যাকাতের নিসাব
ইসলাম ক্রমবর্ধনশীল সম্পদের যে কোন পরিমাণের উপরই যাকাত ফরয করেনি। তা যত দূর্বল ও ক্ষীণ হোক না কেন। বরং যাকাত ফরয হওয়ার জন্য একটি নির্দিষ্ট পরিমাণের মাল হওয়া অপরিহার্য শর্ত বিশেষ। ফিকহ-এর পরিভাষায় তাকে নিসাব বলে। যাকাত আদায়ী সম্পদের শ্রেণীভেদে ভিন্ন ভিন্ন নিসাব রয়েছে। যেমন-
১. নগদ টাকা পয়সা: ৭.৫ ভরি সোনা বা ৫২.৫ তোলা রুপার সমমূল্যের টাকা।
২. স্বর্ণ-রৌপ্য: স্বর্ণ ৭.৫ ভরি, রৌপ্য ৫২.৫ তোলা।
৩. খনিজ সম্পদ: নির্ধারিত কোন নিসাব নেই। যত কমই হোক তাতে যাকাত দিতে হবে।
৪. গবাদি পশু: উট-৫টি গরু- মতভেদ আছে, তবে অধিকতর গ্রহণযোগ্য মত হল- ৩০টি ছাগল/ভেড়া/দুম্বা- ৪০টি
৫ ব্যবসায়িক পণ্যসামগ্রী: ৭.৫ ভরি সোনা বা ৫২.৫ তোলা রুপার সমমূল্যের সম্পদ।
যাকাতের হার
ইসলামে যাকাত ব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল, যাকাতের হার নির্ধারণ। এ হার স্থির এবং অপরিবর্তনীয়। বিভিন্ন সম্পদের যাকাতের হার নিম্নরূপ:
নগদ টাকা-পয়সা, সোনা, রুপা ও ব্যবসায়িক পণ্যের উপর- ২.৫%।
উট- ০৫ থেকে ০৯টি উটের জন্য- ১টি ছাগী
১০ থেকে ১৪টি উটের জন্য --- ২টি ছাগি
১৫ থেকে ১৯টি উটের জন্য ৩টি ছাগি
২০ থেকে ২৪টি উটের জন্য --- ৪টি ছাগি
২৫ থেকে ৩৫ টি উটের জন্য ১টি গরুর মাদী বাচ্চা যার বয়স ১ বছর অতিক্রান্ত হয়ে ২ বছরে পদার্পণ করেছে।
৩৬ থেকে ৪৫টি উটের জন্য- ২ বছরের পর ৩য় বছরে পদার্পণকারী বয়সের ১টি গাভী।
৪৬ থেকে ৬০টি উটের জন্য তিন বছর অতিক্রমকারী ৫ বছরের ১টি গাভী।
৭৬ থেকে ৯০টি উটের জন্য ২ বছর অতিক্রম করে ৩য় বর্ষে পদার্পণকারী উস্ট্রীর দু'টি বাচ্চা।
৯১ থেকে ১২০টি উটের জন্য ৩ বছর অতিক্রম করে ৪র্থ বছরে পদার্পণকারী উস্ট্রীর ২টি বাচ্চা।
গরু- ৩০ থেকে ৩৯টি গরুর জন্য ১ বছর বয়সের ১টি বাছুর।
৪০ থেকে ৫৯টি গরুর জন্য ২ বছর বয়সের ১টি বাছুর।
৬০ থেকে ৬৯টি গরুর জন্য ১ বছর বয়সের ২টি বাছুর।
৭০ থেকে ৭৯টি গরুর জন্য ২ বছর বয়সের ১টি বাছুর ও ১ বছরের ১টি বাছুর।
৮০ থেকে ৮৯টি গরুর জন্য ২ বছর বয়সের ২টি বাছুর।
৯০ থেকে ৯৯টি গরুর জন্য ১ বছর বয়সের ৩টি বাছুর।
১০০ থেকে ১১৯টি গরুর জন্য- ২ বছর বয়সের ১টি বাছুর ও ১ বছরের ২টি বাছুর।
ছাগল/ভেড়া/দুম্বা:
৪০ টি থেকে ১২০টির জন্য- ১টি।
১২১ টি থেকে ২০০টির জন্য ২টি।
২০১ টি থেকে ৩৯৯টির জন্য ৩টি।
৪০০ টি থেকে ৪৯৯টির জন্য- ৪টি।
৫০০ টি থেকে ৫৯৯টির জন্য ৪টি।
অতঃপর প্রতি ১০০টির জন্য ১টি করে।
খনিজ সম্পদের যাকাত- ২০% বা একপঞ্চমাংশ।
যাকাতের শর্ত
যাকাত ব্যবস্থার জন্য কতিপয় শর্ত রয়েছে যা পূরণ করা আবশ্যক। ইসলামি ফিকহর দৃষ্টিতে সে শর্তগুলো নিম্নরূপ:
ইসলাম গ্রহণ
যাকাতের হুকুম মুসলমানদের জন্যই বাধ্যতামূলক। অমুসলিমদের উপর যাকাত ফরয নয়। কারণ যাকাত
ইসলামের অন্যতম স্তম্ভ। ইসলামের প্রথম স্তম্ভ তথা ঈমান আনলেই কেবল বাকী স্তম্ভগুলোর বিধান তার উপর প্রয়োগ করা হবে। যাকাত শুধু মুসলমানদের জন্য ফরয। তার প্রমাণ স্বরূপ আল্লাহর নিম্নোক্ত বাণী উল্লেখযোগ্য:
"তুমি তাদের সম্পদ থেকে সাদকা গ্রহণ করবে। এর দ্বারা তুমি তাদের পবিত্র ও পরিশোধিত করবে। তুমি তাদের দুআ করবে। তোমার দুআ তো তাদের জন্য চিত্ত স্বস্তিকর।" (সূরা আত্-তাওবা: ১০৩)
প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া
যাকাত ফরয হওয়ার অন্যতম শর্ত হচেছ প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া। অতএব, অপ্রাপ্ত বয়স্ক বা বালকের উপর যাকাত ফরয নয়। এ বিষয়ে ফকীহ তথা ইসলামি আইনশাস্ত্রে পারদর্শী পতিগণের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। কেউ কেউ বালকের সম্পদে যাকাত ফরয হওয়ার পক্ষে মতামত দিয়েছেন। তবে হানাফী মাযহাব অনুযায়ী বালকের সম্পদে যাকাত ফরয নয়।
জ্ঞানবান হওয়া
আকেল তথা সুস্থ বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তির উপর যাকাত ফরয। এ শর্তের ভিত্তিতে পাগল ও বিকৃত মস্থিষ্ক ব্যক্তির উপর আবশ্যকীয়তা প্রয়োগ হয় না। প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার মত এ শর্তের ব্যাপারে ফকীহগণ দু'দলে বিভক্ত হয়েছেন। কেউ বলেন, পাগলের মালের যাকাত দিতে হবে। আবার অন্যদের মতে পাগলের মালে যাকাত দিতে হবে না।
মালিকানা সম্পর্কিত শর্তাবলী
যাকাত ফরয হওয়ার জন্য সম্পদ ও তার মালিকানা সম্পর্কিত বিশেষ শর্তাবলী নিম্নরূপ:
পূর্ণাঙ্গ মালিকানা: সমস্ত ধন-সম্পদের মালিকানা আল্লাহর। আল্লাহ মানুষকে তা দান করেছেন। বান্দা আল্লাহর সম্পদের প্রতিনিধি। এ প্রতিনিধিত্বের অধিকারে বান্দা সে সম্পদ ভোগের অধিকার পায়। অতএব যেসব সম্পদে বান্দা পূর্ণাঙ্গ ভোগের মালিকানা পায় সেসব সম্পদেই কেবল যাকাত ফরয।
খ. প্রবৃদ্ধি: যাকাত ফরয হওয়ার দ্বিতীয় শর্ত হচ্ছে, যে মাল থেকে যাকাত গ্রহণ করা হবে সে মাল প্রবৃদ্ধিমান। হতে হবে। অর্থাৎ সে মাল তার মালিককে মুনাফা বাড়িয়ে দেবে। পরিমাণে ক্রমশ বাড়তে থাকবে।
গ. নিসাবের শর্ত: ইসলাম ক্রমবর্ধনশীল ধন-মালের যে কোন পরিমাণের উপরই যাকাত ফরয করেনি, তা যতই দুর্বল ও ক্ষীণ হোক না কেন, বরং যাকাত ফরয হওয়ার জন্য একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ মাল হওয়া অপরিহার্য শর্ত বিশেষ। ফিকহর পরিভাষায় তাকেই নিসাব বলে।
ঘ. মৌল প্রয়োজনের অতিরিক্ত হওয়া: কোন কোন ফকীহ মালের বর্ধনশীলতা ছাড়াও নিসাবের পরিমাণা মালিকের মৌল প্রয়োজনের অতিরিক্ত হওয়ার শর্ত করেছেন। হানাফী ফকীহগণের নিকট এটা আবশ্যকীয় বিধান।
৫. ঋণ মুক্তি: পূর্ণাঙ্গ মালিকানা ও নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হওয়ার সাথে সাথে এ শর্তও আরোপ করা হয়েছে যে, যাকাতদাতা সমস্ত প্রকার ঋন থেকে মুক্ত হবে। কেননা ঋণ মুক্ত করা যাকাতের উদ্দেশ্য। ইবনু রুশদ বলেন- ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির উপর থেকে যাকাত দেয়ার দায়িত্ব তুলে নেয়াই শরীয়াতের লক্ষ্য। শরীয়াতের দলীলাদি, তার অর্ন্তনিহিত ভাবধারা ও তার সাধারণ নীতিমালা সবকিছু থেকে একথাই প্রমাণিত হয়।
চ. এক হিজরী বছর অতিক্রমণ: সম্পদ মালিকের হাতে একবছর বা পূর্ণ চন্দ্র বার মাস- থাকলেই যাকাত ফরয হবে। পশু, নগদ সম্পদ ও ব্যবসায়িক পণ্যের ব্যাপারে এ শর্ত আরোপিত হয়েছে। বলা যায় এ হচ্ছে মূলধনের যাকাত। কিন্তু কৃষি ফসল, ফল-ফলাদি, মধু, খনি ও গচ্ছিত ধন ইত্যাদির ক্ষেত্রে একবছর কালের মালিকানার কোন শর্ত নেই। কেননা এগুলো হলো উৎপাদনের যাকাত।
যাকাতের প্রাপক
যাকাতের সম্পদ যেসব খাতে বন্টিত হবে তা আল্লাহ তাআলা স্পষ্ট করে নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন।
"সাদকা তো কেবল নিঃস্ব, অভাবগ্রস্ত ও তৎসংশ্লিষ্ট কর্মচারীদের জন্য, যাদের চিত্ত আকর্ষণ করা হয় তাদের জন্য, দাস মুক্তির জন্য, ঋণে ভারাক্রান্তদের আল্লাহর পথে ও মুসাফিরদের জন্য। এ হল আল্লাহর বিধান। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।" (সূরা আত-তাওবাহ: ৬০)
উপরোক্ত আয়াত থেকে প্রমাণিত হয়, আট শ্রেণীর লোক যাকাতের প্রাপক বা হকদার। সে আট শ্রেণী হল:
ফকীর-মিসকীন:
ফকীর-মিসকীনের সঠিক অর্থ নির্ধারণে ফকীহগণের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। কোন কোন ফকীহ মনে করেন: যারা দরিদ্র তবে ভিক্ষা করে না তারাই ফকীর, আর যারা দরিদ্র এবং ভিক্ষা করে তারা মিসকীন। অন্যান্য ফকীহগণ এর ঠিক উল্টা সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। অর্থাৎ যারা দরিদ্র তবে ভিক্ষা করে না তারাই মিসকীন আর যারা দরিদ্র ও ভিক্ষা করে তারাই ফকীর। (তাফসীরে তাবারী: ১৪/৩০৮)
আমাদের কথা হল, মিসকীন বলতে ঐসব লোকদেরকেই বুঝায়, যাদের কোন স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ নেই। আর ফকীর হল, ঐসব লোক যাদের সম্পদ আছে কিন্তু নিসাব পরিমাণ নেই। যেমন আল্লাহ কুরআনে বলেন-
"নৌকার ব্যাপার- এতো ছিল কতিপয় দরিদ্র ব্যক্তির তারা সমুদ্রে জীবিকা অন্বেষণ করতো।” (সূরা আল-কাহ্ফ: ৭৯)
যাকাত আদায়কারী: তারা হল, ইসলামি রাষ্ট্রের সে সব কর্মচারী যাদেরকে যাকাত বিভাগে নিয়োগ দেয়া হবে। তাদের দায়িত্ব হবে, ব্যক্তির সম্পদ হিসাব করে যাকাতের পরিমাণ নির্ধারণ, যাকাতের অর্থ সংগ্রহ, হিসাব রক্ষণ, বণ্টন ও সংরক্ষণ করা।
৪. নও মুসলিমঃ ভিন্ন ধর্মাবলম্বী যারা ইসলাম গ্রহণ করে, তারা নিজ পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। অনেক সময় দেখা যায় তারা উপার্জন থেকেও বঞ্চিত হয়। ফলে এসব লোকের তাৎক্ষণিক সমস্যার সমাধান কল্পে তাদের যাকাতের অর্থ গ্রহণের অধিকার দেয়া হয়েছে, যাতে তাদের এ আকস্মিক সমস্যা ঈমানের উপর প্রভাব ফেলতে না পারে।
৫. দাস মুক্তকরণেঃ যাকাতের অর্থ দাসমুক্ত করার ক্ষেত্রেও ব্যবহার করা হবে। যে সব দাস তাদের মালিকের সাথে এ মর্মে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে যে, নির্ধারিত অর্থের বিনিময়ে তারা মুক্ত হতে পারবে। তাদেরকে মুক্ত করার জন্য এ অর্থ ব্যায় করার বিধান রয়েছে। তাছাড়া বাজার থেকে দাস কিনে তাকেও মুক্ত করা যেতে পারে।
৬. ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি: যারা ব্যক্তিগত ও পারিবারিক প্রয়োজনে ঋণ করে কিন্তু তা পরিশোধ করার সামর্থ্য তাদের নেই তাদের সে প্রয়োজন পূরণের জন্য যাকাতের অর্থ প্রদান করা যেতে পারে। এদেরকে ফকীর-মিসকীনের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া যায় না, একইভাবে সামাজিক দায়িত্ব পালন করতে যেয়ে যদি কেউ ঋণ করে আর সে ঋণ শোধ করতে না পারে তবে যাকাতের অর্থ দিয়ে সে ঋণ শোধ করা যেতে পারে।
৭. আল্লাহর রাস্তা-'এর সঠিক ব্যাখ্যার ব্যাপারে আলিমগণের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। অনেকে একে শুধু জিহাদের মধ্যে সীমিত করেছেন। তবে গ্রহণযোগ্য কথা হল- ফি সাবিলিল্লাহ বলতে ঐ সব কিছুকে শামিল করে যা বান্দাকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে এবং যার মাধ্যমে আল্লাহর দ্বীনের অগ্রযাত্রা তরান্বিত হয়।
৮. মুসাফির: যারা সফরে গিয়ে বিদেশ-বিভুঁইয়ে অর্থাভাবে আটকে পড়েছে এবং দেশে ফিরে আসতে পারছে না, যে কাজে গিয়েছে তাও সম্পন্ন হচ্ছে না সে অবস্থায় তাদেরও যাকাতের অর্থ পাওয়ার অধিকার রয়েছে। কোন কোন ইসলামি অর্থনীতিবিদ মনে করেন, এ বিধানের আওতায় যাকাতের অর্থ পথিকদের জন্য রাস্তাঘাট মেরামত, পান্থনিবাস তৈরী ইত্যাদি কাজেও ব্যবহার করা যায়, যদিও এ ব্যাপারে ফকীহগণের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। (এম. এ. হামিদ: ইসলামি অর্থনীতি: ২২৯)
যাকাতের অর্থ-সামাজিক প্রভাব
যাকাত ব্যবস্থার যথাযথ বাস্তবায়ন মানব সমাজে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। যাকাত ব্যয়ের খাত ব্যাখ্যা করলে এ প্রভাব স্পষ্ট হয়ে উঠে। ব্যয়ের খাতের ভিত্তিতে যাকাতের আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত প্রভাব সৃষ্টি সম্ভব।
১. বেকার শ্রমজীবী ও রুযিহীনদের সামাজিক নিরাপত্তাঃ এ সম্পর্কে মাওলানা আব্দুর রহীম বলেন: কুরআনের পরিভাষায় ফকীর এমন মজুর ও শ্রমজীবীকে বলা হয়, শারীরিক স্বাস্থ্য ও শক্তির দিক দিয়ে যে খুব মজবুত এবং কর্মক্ষম হওয়া সত্তেও প্রতিকূল অবস্থার কারণে সে বেকার ও উপার্জনহীন হয়ে পড়েছে। কুরআন শরীফে ঠিক এ অর্থেই এটা ব্যবহৃত হয়েছে। এ দিক দিয়ে সে সব অভাবগ্রস্ত লোককেও ফকীর বলা যেতে পারে, যারা কোন জুলম থেকে আত্মরক্ষা করার জন্য নিজেদের জন্মভূমি ত্যাগ করে এসেছে। কোন সামরিক এলাকা থেকে বিতাড়িত লোকদেরও ফকীর বলা যেতে পারে। কুরাইশদের অত্যাচারে যেসব মুসলমান হিজরত করে মদীনায় আশ্রয় নিয়েছিলেন এবং রুযি-রোজগারের সন্ধানে ব্যতিব্যস্ত হয়েছিলেন, কুরআনে তাদেরকে ফকীর বলা হয়েছে। যেমন-
এ সম্পদ অভাব গ্রস্ত মুহাজিরদের জন্য যারা নিজেদের ঘর-বাড়ী ও সম্পত্তি থেকে বিতাড়িত হয়েছে। তারা আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি সন্ধান করে।" (সূরা আল-হাশর :৮)
২. অক্ষম লোকদের সামাজিক নিরাপত্তাঃ ফকীরদের মত মিসকীনদের জন্যও যাকাতের অর্থ নির্ধারিত করা হয়েছে। মিসকীনের পর্যায়ে তারাও পড়ে, দৈহিক অক্ষমতা যাদেরকে চিরতরে নিষ্কর্মা করে দিয়েছে, বার্ধক্য, রোগ, অক্ষমতা ও পংগুতা যাকে উপার্জনের সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করেছে অথবা যে ব্যক্তি উপার্জন করে বটে কিন্তু যা উপার্জন করে তা তার প্রকৃত প্রয়োজনের তুলনায় যৎকিঞ্চিত। ইমাম আবূ হানীফা (র) বলেন, মিসকীনের অবস্থা ফকীরের চেয়েও বেশী বিপর্যস্ত থাকে। কারণ অর্থনৈতিক অসামর্থই তাকে দরিদ্র ও অকর্মণ্য করে দিয়েছে। অতএব তাদেরকে এমন পরিমাণ অর্থ সাহায্য দিতে হবে যাতে তাদের প্রয়োজন মেটে এবং দারিদ্রতা থেকে মুক্তি পায়।
৩. যাকাত বিভাগের কর্মচারীদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা: যাকাত বিতা সম্পদ হিসেবে শেষে যাকাতের পরিমাণ নির্ধারণ করবে, যারা যাকাত আদার করাব, তার যথাযথ হিসাব করবে, যাকাতের মালামাল সংরক্ষণ করবে এবং যারা উক্ত সম্পর ফণ্টন করবে তাদের বেতন দেওয়া এবং গোটা যাকাত বিভাগের যা কিছু ব্যয় হবে তা যাকাতের সম্পদ থেকে ব্যয় করার অনুমতি আল্লাহ দিয়েছেন। এ বেতনের হার কর্মচারীদের যোগ্যতা ও মানবিক প্রয়োজনের ভিত্তিতে প্রাণান করা হবে।
৪. দ্বীন ইসলামের সংরক্ষণ: যাকাত ব্যয়ের অন্যতম খাত হল, মানুষের চিত্ত আকর্ষণ করার জন্য যায়। আল-কুরআনে বর্ণিত খাদের মন জয় করা আবশ্যক' শখের বিভিন্ন অর্থ হতে পারে। এর এক অর্থ সওমুসলিম হতে পারে। নও-মুসলিমদের ইসলাম গ্রহণের পরপরই আর্থিক সমস্যা দেখা দেয়ার সম্ভাবনা থাকে তাদের সে সমস্যা সমাধান কল্পে এ অর্থ ব্যয়িত হতে পারে। আবার যাদের ইসলামের প্রতি দুর্বলতা রয়েতে তাদের মন আকর্ষণের ক্ষেত্রেও ব্যয় করা যেতে পারে। কিংবা মুসলমানদের উপর কোথাও অত্যাচার হলে এবং তা অর্থ সম্পদ দ্বারা বন্ধ করা সম্ভব হলে সেখানেও এ অর্থ ব্যয় করা যাবে।
এক কথায় দ্বীনি উম্মত হিসেবে মুসলমানদের সংরক্ষণের জন্য এ খাতে অর্থ ব্যয় করা হবে।
৫. ক্রীতদাস মুক্তকরণ: দাস-প্রথার মাধ্যমে মানুষের ব্যক্তি স্বাধীনতাকে হরণ করা হয়। ইসলাম নান প্রাগা বন্ধ করার পদক্ষেপ নেয় এবং সরকারী অর্থের সাহায্যে এর মূলোচ্ছেদের ব্যবস্থা করে। যাকাতের অর্থ ক্রীতদাসদের মুক্তিবিধানের জন্য ব্যয়িত হতে পারে। তাছাড়া কাফিরদের সাথে সংগ্রামে বন্দী হওয়া মুসলিম মুজাহিদগণের মুক্ত করার জন্য এখাত থেকে অর্থ ব্যয় করা যাবে।
৬. ঋণগ্রস্ততের সহযোগিতা: যাকাতের অর্থ দু' ধরনের ঋণগ্রস্তদের ঋণ পরিশোধ করার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হবে। যারা নিজেদের জীবনধারণের প্রয়োজনীয় সামগ্রী পূর্ণ করার ব্যাপারে ঋণ করে। দ্বিতীয়তঃ যে সব লোক, যারা মুসলমানদের প্রয়োজনীয় সামষ্টিক কল্যাণ সাধন ও সামাজিক উন্নয়নের জন্য ঋণ নেয়। এ উভয় প্রকার ঋনগ্রস্তদের ঋণ পরিশোধের স্থায়ী ব্যবস্থা হিসেবে যাকাতের প্রভাব অনস্বীকার্য।
৭. ইসলামের প্রচার ও সমাজ জীবনে তার বাস্তবায়ন: ফি সাবিলিল্লাহ বা আল্লাহর রাস্তায় যাকাতের অর্থ ব্যয়িত হবে। আল্লাহর রাস্তা একটি ব্যাপক অর্থবোধক শব্দ। যেসব ভাল কাজের মাধ্যমে আল্লাহ দ্বীনের প্রচার-প্রসার, ও প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সম্ভব্য সে সব খাতই এর অর্ন্তভুক্ত।
৮. নিঃস্ব পথিকদের পাথেয় সংস্থান: যারা সৎ উদ্দেশ্য বা দেশ ভ্রমণের উদ্দেশ্যে বের হয়ে পথিমধ্যে নিঃসম্বল হয়ে পড়েছে, তাদেরকে যাকাতের সম্পদ থেকে এমন পরিমাণ দেয়া যাবে যাতে তাদের আকস্মিক প্রয়োজন পূর্ণ হয় এবং স্বগৃহে ফিরে আসতে পারে। এ ব্যাপারে মাওলানা আব্দুর রহীম বলেন, যেসব মেহনতী ও শ্রমজীবী লোক কাজের সন্ধানে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যেতে চায় কিন্তু অর্থাভাবে যেতে পারে না এরূপ লোকদের ইসলামি রাষ্ট্রের বায়তুলমালের থেকে এ অংশের অর্থ থেকে যাতায়াত খরচ প্রদান করবে।
এম. এ. হামিদ আর্থ-সামাজিক পরিমন্ডলে যাকাতের প্রভাব বর্ণনা করতে যেয়ে নিম্নোক্ত বিশেষ কিছু বিষয়ের অবতারণা করেছেন।
১. দারিদ্র্য বিমোচন: যাকাতের অর্থ আদায় এবং তার পরিকত্তিতে ও যথাযথ ব্যবহার হলে দারিদ্র্য বিমোচনে তার প্রভাব পড়বেই। কয়েকটি দেশের সমীক্ষা থেকে দেখা গেছে, যাকাতের মাধ্যমে সেসব দেশের বার্ষিক মোট দেশীয় আয়ের ৩%-৪% পর্যন্ত ধনীদের থেকে গরীবদের কাছে হস্তান্তরিত হয়েছে।
২. বণ্টন: যাকাত ধনীদের থেকে দরিদ্রের নিকট হস্তান্তরিত আয়। সকল ইসলামি অর্থনীতিবিদ একমত যে, যাকাত যদি যথাযথভাবে আদায় ও বন্টিত হয় তবে তা মুসলিম দেশগুলোতে অর্থনৈতিক উন্নতির স্তর নির্বিশেষে বিরাজমান মারাত্মক আয় ও ধনবণ্টন বৈষম্য দূরীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সমর্থ হবে।
৩. ভোগ: যাকাত যেহেতু ধনীদের (যাদের MIC বা প্রান্তিক ভোগ প্রবনতা কম) কাছ থেকে দরিদ্রদের (যাদের MPC বেশী) কাছে হস্তান্তর আয় সেহেতু অর্থনীতিতে এ ধরনের ব্যয়ের ফলে সামাজিক ভোগব্যয় বহুগুণ বৃদ্ধি পায়।
৪. সঞ্চয় ও বিনিয়োগঃ যদি বিনিয়োগ করার জন্য উদ্যোগ না থাকে তবে ক্রমাগত যাকাত প্রদানের ফলে এক সময় সম্পদ হ্রাস পেয়ে নিসাবের নিচে চলে আসবে। যাকাতের এই শান্তিধর্মী প্রকৃতি মানুষকে তার সম্পন অব্যবহৃত বা অলসভাবে ফেলে না রেখে উৎপাদনমূলক বা অন্য কোন লাভজনক কাজে বিনিয়োগ করতে উৎসাহিত করে। এর নীট ফল সম্পদের উপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে, নেতিবাচক নয়।
৫. স্থিতিশীলতাঃ যাকাতের মাধ্যমে যদি পর্যাপ্ত অর্থ পাওয়া যায় তাহলে তার অংশবিশেষ চক্র-বিরোধী কৌশল ব্যবহারের জন্য কাজে লাগানো যেতে পারে। এ জন্য ইসলামি অর্থনীতিতে বিশেষজ্ঞদের মতে, মুদ্রাস্ফীতির চাপের সময়ে যাকাতের অর্থের বৃহত্তম অংশ মূলধনী পণ্য আকারে বিতরণ এবং মুদ্রা সংকোচনের সময় ভোগদ্রব্য বা নগদ আকারেই তা বিতরণের উদ্যোগ নেয়া উচিৎ। অবশ্য এটা একেবারেই বিশেষ এক কৌশল হিসেবে বিবেচিত হবে।
এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url