ইসলামি রাষ্ট্রের ব্যয়ের খাতসমূহ


◆ ইসলামি রাষ্ট্রের ব্যয়ের পরিধি কি তা বলতে পারবেন;


◆ আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত ব্যয়ের খাতসমূহ আলোচনা করতে পারবেন;


◆ রাষ্ট্র প্রধান ও পরামর্শসভা কর্তৃক ব্যয়ের খাতসমূহ বর্ণনা করতে পারবেন।

ভূমিকা 

পূর্বের পাঠে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ইসলামি রাষ্ট্র মূলত তার ব্যয়, নির্বাহ করার জন্যই আয় করে থাকে। তাই ব্যয়ের সুনির্দিষ্ট খাত আলোচনার পূর্বে প্রথমেই জানা দরকার ইসলামি রাষ্ট্রের ব্যয়ের পরিধি কতটুকু? অন্য কথায় বলা যায় ইসলামি রাষ্ট্রের এমন কি কি দায়িত্ব রয়েছে যা পালন করতে সরকারের অর্থ ব্যয় করা প্রয়োজন হয়।


সম্পদ বন্টনে ইসলামি রাষ্ট্রের দায়িত্ব ও কর্তব্য

একটি ইসলামি রাষ্ট্রের নিম্নে বর্ণিত ১১ ধরনের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অর্থ ব্যয় করতে হয়।


১. দ্বীন ইসলামের পূর্ণ প্রতিষ্ঠা করা, সুদৃঢ় ভিত্তির উপর তাকে স্থাপন করা ও সে অনুযায়ী জাতীয় পুনর্গঠনের ব্যবস্থা করা।


২. দেশ রক্ষার জন্য সকল প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা সম্পন্ন করা, সে জন্য শক্তিশালী সশস্ত্র বাহিনী এবং নৌ, স্থল ও বিমান বাহিনীকে ইসলামি আদর্শ অনুযায়ী সুসংগঠিত ও সুসংবদ্ধ করে গড়ে তোলা। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ


وَأَعِدُّوا لَهُمْ مَّا اسْتَطَعْتُمْ مِّن قُوَّةٍ وَمِن رِّبَاطِ الْخَيْلِ تُرْهِبُونَ بِهِ عَدُوَّ اللَّهِ


وَعَدُوَّكُمْ .


"তোমরা তাদের মুকাবিলার জন্য যথাসাধ্য শক্তি ও অশ্ব বাহিনী প্রস্তুত রাখবে, এর দ্বারা তোমরা আল্লাহর শত্রুদের ভীতিপ্রদর্শন করবে এবং তোমাদের শত্রুদেরও।" (সূরা আল-আনফাল: ৬০)


৩. অভ্যন্তরীণ শান্তি, শৃংখলা, শাসন ও বিচার-ইনসাফ সুপ্রতিষ্ঠিত করা, সেজন্য পুলিশ ও দেশরক্ষা বাহিনী প্রতিষ্ঠা করা, সকল প্রকার বিচারালয় স্থাপন ও ইসলামের নীতি অনুযায়ী তার পরিচালনা করা।


৪. দেশবাসীর নাগরিক অধিকার রক্ষা করা, অভাব-অভিযোগ ও পারস্পরিক ঝগড়া বিবাদের মীমাংসা করা। দুর্ভিক্ষ, বন্যা, খরা প্রভৃতি জরুরী পরিস্থিতিতে এককালীন সাহায্য ও বিনা সুদে ঋণ বিতরণ করা।


৫ সকল নাগরিকের মৌলিক প্রয়োজন পূরণ করার স্থায়ী ও নির্ভরযোগ্য ব্যবস্থা করা। অর্থনৈতিক পুনর্গঠন, উত্তরাধিকার আইন কার্যকরকরণ, সামাজিক জটিলতার মীমাংসাকরণ। সকল প্রকার প্রয়োজনীয় শিক্ষা দানের জন্য প্রাথমিক স্তর হতে বিশ্ববিদ্যালয় ও উচ্চস্তরের শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করা, বিনামূল্যে শিক্ষাদান ও জনস্বাস্থ্যের জন্য সকল প্রকার আয়োজন ও ব্যবস্থা করা।


৬. রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ যেমন-রাস্তা-ঘাট, পুল-রেললাইন, বিমানপথ, নির্মাণ, টেলিগ্রাম, টেলিফোন লাইনসহ সকল প্রকার প্রচার মাধ্যম স্থাপণ করা ইত্যাদি।


৭. বৈদেশিক বাণিজ্য ও আমদানী-রফতানীর জন্য সামুদ্রিক যান বাহন ও বন্দর স্থাপন, আলোক-স্তম্ভ ও বিমানঘাটি স্থাপন করা।


৮ কৃষিকার্যের উন্নতি বিধানের জন্য পানি সেচের বিভিন্ন উপায় অবলম্বন, বড় বড় পুকুর, খাল-নদী ও কূপ খনন, বাঁধ নির্মাণ করা, আধুনিক যন্ত্রপাতির আমদানী ও সার প্রয়োগে উৎপাদনের হার বৃদ্ধি করা।


৯. প্রয়োজনীয় শিল্পের উন্নয়ন, জনগণের প্রয়োজনীয় পণ্যদ্রব্য উৎপাদন ও সুষ্ঠু বণ্টন ব্যবস্থা কার্যকর করা। যেন কেবল কৃষির উপর নির্ভরশীলতা হ্রাসপ্রাপ্ত হয় এবং জনগণও উন্নত জীবনমান উপযোগী প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সহজেই লাভ করতে পারে।


১০. পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্রের সঙ্গে বৈদেশিক সম্পর্ক স্থাপনের জন্য সকল মিত্র দেশে রাষ্ট্রদূত ও হাই কমিশনার স্থায়ীভাবে নিয়োগ প্রদান এবং তৎসংশ্লিষ্ট যাবতীয় খরচ বহন, দেশ-বিদেশে রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে যাতায়াত, নিজ দেশের বিভিন্ন কেন্দ্রীয় শহরে মুসাফিরখানা স্থাপন করা, যেন দেশী বা বিদেশী কোন ব্যক্তিই ফুটপাত বা গাছ তলায় অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে থাকতে বাধ্য না হয়।


১১. ভূমি, বন-জঙ্গল, ইত্যাদি জাতীয় সম্পদ সংরক্ষণ ও তার উন্নতি বিধান; কৃষক, মজুর ও শ্রমিকের অধিকার রক্ষার নিখুঁত ব্যবস্থা করা।


ব্যয়-নীতি

দেশের সার্বিক ব্যায় নির্বাহ করার জন্য রাজকোষে জনগণের হাড়ভাঙ্গা খাটুনির পরিশ্রমে উপার্জিত অর্থসম্পদ সঞ্চিত হয়ে থাকে। তাই রাষ্ট্রের দায়িত্বশীলদের এ অর্থ ইচ্ছেমত ব্যয় করার কোন সুযোগ নেই। ইসলাম এ ক্ষেত্রে যে মূলনীতি প্রদান করেছে তা হলো-


ব্যয়নীতি হবে অত্যন্ত সুষ্ঠু, সংযত ও সুবিচারপূর্ণ। এক্ষেত্রে পরিপূর্ণ সতকর্তা, বিচক্ষণতা, সামগ্রিক সামঞ্জস্য ও মিতব্যয়িতা রক্ষা করা ইসলামি রাষ্ট্র প্রধানসহ সরকারের মৌলিক দায়িত্ব।


ব্যয়ের খাতসমূহ

একটি রাষ্ট্র পরিচালনা করতে গিয়ে জনকল্যাণের জন্য যত ধরনের দায়িত্ব ও কর্তব্য ইসলামি রাষ্ট্রকে পালন করা প্রয়োজন তার সকল খাতেই ইসলামি ব্যয়নীতি অনুসরণ করে রাষ্ট্র তার সঞ্চিত সম্পদ ব্যয় করতে পারবে। তবে ইসলামি অর্থনীতিতে রাষ্ট্রের এমন কিছু আয়ের খাত রয়েছে যেগুলো সরকার নিজের ইচ্ছেমত যে কোন খাতে ব্যয় করতে পারবে না। স্বয়ং আল্লাহ তাআলা এর খাত নির্ধারণ করে দিয়েছেন। এসব বিচারে ইসলামি রাষ্ট্রের ব্যয়ের খাতসমূহকে দু'ভাগে ভাগ করা যায়।


১. আল-কুরআনে বর্ণিত নির্ধারিত ব্যয়ের খাত


২. অনির্ধারিত ব্যয়ের খাত।


আল-কুরআনের নির্ধারিত ব্যয়ের খাত

ইসলামি রাষ্ট্রের যত আয় হয়ে থাকে তার মাত্র তিন ধরনের আয় যেমন- গনীমতের মাল, ফাই বা বিনা যুদ্ধে লব্দ ধন-সম্পদ, যাকাত- এগুলোর জন্য আল্লাহ তাআলা ব্যয়ের খাত নির্ধারণ করে দিয়েছেন। অন্যান্য খাতের আয় ইসলামি রাষ্ট্র পার্লামেন্টের সিদ্ধান্ত ক্রমে জনকল্যাণমূলক যে কোন বৈধ খাতে ব্যয় করতে পারবে।


এখানে প্রথমে আল-কুরআনে বর্ণিত খাতগুলো উল্লেখ করা হল-


(ক) গনীমতের মালঃ এর ব্যয়ের খাত কুরআন মাজীদে নির্ধারিত করে দেয়া হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন-


وَاعْلَمُوا أَنَّمَا غَنِمْتُمْ مِّن شَيْءٍ فَأَنَّ لِلَّهِ خُمُسَهُ وَلِلرَّسُولِ وَلِذِي الْقُرْبَى


وَالْيَتَامَى وَالْمَسَاكِينِ وَابْنِ السَّبِيلِ.


"জেনে রাখ, যুদ্ধে যা তোমরা লাভ কর তার এক-পঞ্চমাংশ আল্লাহর রাসূলের, রাসূলের স্বজনদের, ইয়াতীমদের, মিসকীনদের এবং পথচারীদের।" (সূরা আল-আনফাল-৪১)


এছাড়া বাকী চার ভাগ- সামরিক লোকদের জন্য নির্ধারিত।


এ থেকে বুঝা যাচেছ, পাঁচ ভাগের একভাগ উল্লিখিত খাতে বন্টনের জন্য বায়তুল মালে জমা করা হত। আর বাকী চারভাগ যুদ্ধাদের মধ্যে সরাসরি বনটন করে দেয়া হত। কিন্তু নবী করীম (স)-এর ইনন্তিকালের পর গনীমতের মালের একপঞ্চমাংশকে পাঁচভাগে ভাগ করার পরিবর্তে তিন ভাগে ভাগ করা হত। খুলাফায়ে রাশেদুন কুরআনে উল্লিখিত রাসূল (স) এবং তাঁর নিকটাত্মীয়দের অংশ বাতিল করে দিয়েছিলেন। বর্তমানকালে উল্লিখিত অংশ দু'টি বাতিল করার পরিবর্তে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে রাখা এবং তা সামরিক বাহিনীর উন্নয়নে ব্যয় করাই উত্তম হবে বলে বিবেচনা করা হয়।


(খ) 'ফাই' ও বিনাযুদ্ধে লব্ধ ধন-সম্পদ: এর ব্যয়ের খাতও কুরআন মাজীদে নির্ধারিত করে দেয়া হয়েছে। এটা প্রথমত রাষ্ট্রীয় মালিকানার অন্তর্ভুক্ত হবে এবং রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রয়োজনে ব্যয় করা হবে। হযরত নবী করীম (স) এ ধরনের যাবতীয় মাল সম্পদকে নিজের তত্ত্বাবধানে ব্যয় ও বণ্টন করতেন। কুরআন মাজীদে আল্লাহ বলেন,


مَّا أَفَاءَ اللَّهُ عَلَى رَسُولِهِ مِنْ أَهْلِ الْقُرَى فَلِلَّهِ وَلِلرَّسُولِ وَلِذِي الْقُرْبَى وَالْيَتَامَىٰ وَالْمَسَاكِينِ وَابْنِ السَّبِيلِ كَيْ لَا يَكُونَ دُولَةً بَيْنَ الْأَغْنِيَاءِ مِنكُمْ.


"আল্লাহ জনপদবাসীদের নিকট থেকে তাঁর রাসূলকে যা কিছু দিয়েছেন তা আল্লাহর, তাঁর-রাসূলের, রাসূলের-স্বজনদের, ইয়াতীমদের, অভাবগ্রস্ত ও পথচারীদের, যাতে তোমাদের মধ্যে যারা বিত্তবান কেবল তাদের মধ্যেই ঐশ্বর্য আবর্তন না করে।" (সূরা আল-হাশর: ৭)


বর্তমানে রাসূল (স.) ও তাঁর নিকট স্ট্রীয়রা যেহেতু জীবিত নেই।


আয়াতে উল্লিখিত 'রাসূল এবং তাঁর নিকটাত্মীয়ের অংশ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে রাখা হবে এবং তা দেশবাসীর সামগ্রিক কল্যাণকর কাজে এবং দেশের যাবতীয় উন্নয়নমূলক পরিকল্পনায়- ব্যয় করা হবে। ইয়াতীম, মিসকীন ও নিঃস্ব পথিকের অংশ তাদের জন্যই ব্যয় করতে হবে।


খারাজ, জিযিয়ার অর্থ ফাই'র অন্তর্ভুক্ত। তাই খারাজ ও জিযিয়ার সম্পদ উল্লিখিতখাতে ব্যয় করা হবে।


(গ) যাকাতের সম্পদ: যাকাতের অর্থ-সম্পদ ব্যয় করার খাতও কুরআন মাজীদ নির্ধারিত করে দিয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন-


إِنَّمَا الصَّدَقَاتُ لِلْفُقَرَاءِ وَالْمَسَاكِينِ وَالْعَامِلِينَ عَلَيْهَا وَالْمُؤَلَّفَةِ قُلُوبُهُمْ وَفِي الرِّقَابِ وَالْغَارِمِينَ وَفِي سَبِيلِ اللهِ وَابْنِ السَّبِيلِ فَرِيضَةً مِّنَ اللَّهِ وَاللَّهُ عَلِيمٌ حكِيمٌ.


"সাদকা তো কেবল নিঃস্ব, অভাবগ্রস্ত ও তৎসংশ্লিষ্ট কর্মচারীদের জন্য, যাদের চিত্ত আকর্ষণ করা হয় তাদের জন্য, দাস মুক্তির জন্য, ঋণে ভারাক্রান্তদের আল্লাহর পথে ও মুসাফিরদের জন্য। এ হল আল্লাহর বিধান। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।" (সূরা আত-তাওবা: ৬০)।


এখানে আল্লাহ তাআলা যাকাত ব্যয়ের জন্য আটটি খাত নির্ধারণ করে দিয়েছেন তা নিম্নে উল্লিখ করা হলঃ


বেকার শ্রমজীবীদের সামাজিক নিরাপত্তা

যাকাত যাদের জন্য এবং যে সকল খাতে ব্যয় করা যাবে তার প্রথম খাত হল- কুরআনের পরিভাষায় 'ফকীর' আর ফকীর এমন মজুর ও শ্রমজীবীকে বলা হয়, শারীরিক দিক দিয়ে যে কর্মক্ষম হওয়া সত্ত্বেও প্রতিকূল অবস্থার কারণে বেকার ও উপার্জনহীন হয়ে পড়েছে। এ দিক বিবেচনায় সে সব অভাবগ্রস্ত মেহনতী লোককেও 'ফকীর' বলা যাবে, যারা কোন জুলম হতে আত্মরক্ষা করার জন্য নিজেদের জন্মভূমি ত্যাগ করে এসেছে। কোন সামরিক এলাকা হতে বিতাড়িত লোকদেরও 'ফকীর' বলা যাবে।


আল-কুরআনে বর্ণিত ফকীর শ্রেণীর মাঝে মজুর শ্রমিকরাও শামিল। তাদের সামাজিক নিরাপত্তা দানের জন্য যাকাত বাবদ সংগৃহীত অর্থের একটি অংশ নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। গরীবদের সাহায্য দান এবং সকল প্রকার দুঃখ-দুর্ভোগ ও অভাব-অনটন হতে মুক্তিদানই এর উদ্দেশ্য, যেন সমাজ জীবনে অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতায় তারা পূর্ণ শক্তি ও সামর্থ্য লাভ করতে পারে এবং জীবন-যাত্রার মান উন্নত করতে পারে। বস্তুত ইসলামি রাষ্ট্রের শ্রমজীবীদের জন্য এটা এক চিরস্থায়ী রক্ষাকবচ।


মিসকীন বা অক্ষম লোকদের সামাজিক নিরাপত্তা

'ফকীর'দের ন্যায় মিসকীনদের জন্যও যাকাতের অর্থ ব্যয় করা হবে। 'মিসকীন' ঐ ব্যক্তিকে বলে দৈহিক অক্ষমতা যাকে চিরতরে নিষ্কর্মা ও উপার্জনহীন করে দিয়েছে। বার্ধক্য, রোগ অক্ষমতা ও পংণ্ডত্য যাকে উপার্জনের সুযোগ-সুবিধা হতে বঞ্চিত করে দিয়েছে অথবা যে ব্যক্তি উপার্জন করতে পারে বটে, কিন্তু যা উপার্জন করে তা দ্বারা তার প্রকৃত প্রয়োজন পূর্ণ হয় না। অন্ধ, পক্ষাঘাতগ্রস্ত, পংগু ইত্যাদি সকল লোককেই 'মিসকীন' বলা যায়। তাদেরকে যাকাত ফান্ড থেকে এমন পরিমাণ অর্থ সাহায্য দেয়া উচিৎ যাতে তাদের প্রয়োজন মেটে এবং দারিদ্র্যের দুঃখময় পরিস্থিতি হতে মুক্তি পেতে পারে।


ইসলাম একদিকে লোকদেরকে ভিক্ষাবৃত্তি হতে নিবৃত্ত করেছে, অপরদিকে রাষ্ট্রীয় বাজেটে বেকার, পংগু, অক্ষম, পক্ষাঘাতগ্রস্ত ও উপার্জন ক্ষমতাহীন লোকদের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা দানেরও পূর্ণ ব্যবস্থা করেছে।


যাকাত বিভাগের কর্মচারীদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা

যাকাত বিভাগের কর্মচারীগণ দু'ভাগে বিভক্ত। একভাগ যাকাত আদায় করার কাজে নিযুক্ত থাকে, আর অপর ভাগ তা সুষ্ঠু ও সুনির্দিষ্ট পন্থায় বণ্টন করার কাজ সম্পন্ন করে। এই উভয় ধরনের কাজে যত কর্মচারী নিযুক্ত থাকবে, তাদের সকলের প্রকৃত প্রয়োজন পরিমাণ বেতন দেয়া এবং গোটা বিভাগে যা কিছু ব্যয় হবে তা যাকাত ফান্ড থেকে সমাধা করা হবে। প্রত্যেক কর্মচারীকে যোগ্যতা ও কর্মক্ষমতার অনুপাতে বেতন দেয়া হবে। তার নিম্নতম হার হচ্ছে ন্যূনতম প্রয়োজন পূরণ।


ক্রীতদাসদের মুক্তিবিধান

যাকাতের একটা অংশ দাসত্বের শৃংখলে আবদ্ধ লোকদের মুক্ত ও স্বাধীন করার কাজে ব্যয় করা যাবে। এ অর্থ লাভ করে তার বিনিময়ে নিজেকে গোলামীর বন্ধন হতে মুক্ত করতে পারবে।


ইসলামি আদর্শের সূচনালগ্নে আরবদেশে দাস-প্রথার খুব বেশী প্রচলন ছিল। ইসলামি রাষ্ট্র এই অমানবিক প্রথা বন্ধ করার দায়িত্ব গ্রহণ করে এবং সরকারী অর্থের সাহায্যে শান্তিপূর্ণভাবে এই প্রথার মূলোৎপাটনের ব্যবস্থা করে। ফলে খুলাফায়ে রাশেদূনের যুগে এই প্রথা চূড়ান্তভাবে রহিত হয়ে যায়।


বর্তমান যুগে দাস প্রথা নেই বললেই চলে। তাই এ যুগে দেশ রক্ষার জন্য অথবা অমুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে মুসলিম সৈনিকগণ যদি শত্রুর হাতে বন্দী হয়ে পড়ে, তবে তাদেরকে যাকাতের অর্থ দ্বারা মুক্ত করার ব্যবস্থা করা যাবে। ঘরের কাজের ছেলে ও মেয়েদেরকে কৃতদাস-দাসীদের অংশ দেয়া যেতে পারে। যাতে তারা আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ পায়।


ঋণ মুক্তির স্থায়ী ব্যবস্থা

যাকাতের একটা অংশ ঋণগ্রস্ত লোকদের সাহায্যার্থে ব্যয় করা হবে। ঋণগ্রস্ত লোক সাধারণত দু' ধরনের: (১) যারা নিজেদের নিত্য-নৈমিত্তিক প্রয়োজন পূর্ণ করার ব্যাপারে ঋণ গ্রহণ করে। এ ঋণগ্রস্ত লোক যদি নিজে ধনী না হয়, তবে তাদেরকে যাকাতের এ অংশ হতে সাহায্য করা যাবে। (২) দ্বিতীয় সেসব লোক, যারা মুসলমানদের সামষ্টিক কল্যাণ সাধন ও বিভিন্ন উন্নয়নমূলক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য ঋণ গ্রহণ করে। তারা ধনী হোক বা নির্ধন হোক- ঋণ শোধ করার পরিমাণ অর্থ যাকাতের অর্থ থেকে তাদেরকে দেয়া যাবে।


নবী করীম (স) ইসলামি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি হিসেবেই ঘোষণা করেছেন-


من ترك مالا فلورثته و من ترك كلا فإلينا


যে লোক ধন-সম্পত্তি রেখে মরে যাবে তা তার উত্তরাধিকারীদের মধ্যে বণ্টন করা হবে। আর যে লোক কোন ঋণের বোঝা অনাদায় রেখে মারা যাবে তার পরিত্যক্ত সম্পত্তি হতে যদি তা আদায় করা না যায়, তবে তা আদায় করার দায়িত্ব আমার উপর বর্তাবে। (মুসলিম)


নবী করীম (স.)-এর এ ঘোষণায় নিঃস্ব ঋণগ্রস্ত লোকদের ঋণ শোধ করার এবং তাদের পরিবার-পরিজনের জীবিকা-ব্যবস্থার ভার সরাসরিভাবে ইসলামি রাষ্ট্রের উপর অর্পণ করা হয়েছে।


বিনাসুদে ঋণ দান

ইসলামি রাষ্ট্র ঋণগ্রস্ত লোকদেরকে কেবল ঋণ-ভার হতে মুক্ত করবে তাই নয়, বরং জনগণকে উৎপাদনমূলক কাজে বিনিয়োগের জন্য প্রয়োজন অনুসারে ঋণ দেয়ারও ব্যবস্থা করবে। কিন্তু তা সুদের ভিত্তিতে হবে না। উপরন্তু যাকাতের যে অংশ ঋণ শোধ করার জন্য নির্ধারিত রয়েছে তা হতে বিনা সুদে ঋণ দেয়া যেতে পারে। ইসলামি অর্থনীতিতে সুদী কারবার ও সুদের লেন-দেন সম্পূর্ণভাবে অবৈধ।


খুলাফায়ে রাশেদুনের যুগে এ ব্যবস্থা বিশেষভাবে কার্যকর হয়েছিল বলে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক বায়তুলমলসমূহ এ জন্য তৎপর থাকত। ফলে সে সময় সুদী কারবারের অস্তিত্ব ছিল না।


ইসলাম ব্যক্তিগতভাবে বিনাসুদে ঋণ দেয়ার জন্য মুসলিম জনগণকে উৎসাহিত করেছে। ইসলামি রাষ্ট্রের উপরও উক্ত দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন-


مَّن ذَا الَّذِي يُقْرِضُ اللَّهَ قَرْضاً حَسَناً فَيُضَاعِفَهُ لَهُ أَضْعَافًا كَثِيرَةً


"কে সে, যে আল্লাহকে করযে হাসানা দেবে? তিনি তার জন্য তা বহু গুণে বাড়িয়ে দেবেন।" (সূরা আল-বাকারা: ২৪৫)


ইসলামের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা

যাকাতের একটা অংশ ব্যয় হবে আল্লাহর পথে। 'আল্লাহর পথে' কথাটি ব্যাপক তাৎপর্যপূর্ণ। আল্লাহর নির্দেশিত পথে প্রত্যেক জন কল্যাণকর কাজে- দ্বীন ইসলামের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে যত কাজ করা সম্ভব সেই সব ক্ষেত্রেই এই অর্থ ব্যয় করা যাবে।


নিঃস্ব পথিকদের প্রয়োজন মেটানো

যাকাতের একটা অংশ 'ইবনুস সাবীল' বা নিঃস্ব পথিকদের জন্য ব্যয় করা যাবে। যেসব লোক কোন পাপ-উদ্দেশ্যে নয় বরং কোন সদুদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে দেশ ভ্রমণে বের হয় এবং পথিমধ্যে সম্পূর্ণভাবে নিঃসম্বল হয়ে পড়ে, তাদেরকে যাকাতের এ অংশের টাকা হতে এমন পরিমাণ দান করা যাবে, যেন তা দ্বারা তাদের তাৎক্ষণিক অনিবার্য প্রয়োজন পূর্ণ হয় এবং নিজ ঠিকানায় ফিরে যেতে পারে। এমন কি, যেসব মেহনতী ও শ্রমজীবী লোক কাজের সন্ধানে এক স্থান হতে অন্য স্থানে যেতে চায়; কিন্তু তাদের পথ খরচের সংস্থান হয় না বলে যেতে পারে না, এরূপ লোকদের যাকাতের এ অংশের অর্থ হতে যাতায়াতের খরচ দান করা যাবে। কোন গ্রামবাসী শ্রমিক শহরে এসে উপার্জন করতে থাকা অবস্থায় অনিবার্য কোন কারণে যদি তাকে গ্রামে ফিরে যেতে হয়, এবং তার পথ খরচের কোন অর্থ না থাকে, তাকে লোকদের দ্বারে দ্বারে ভিক্ষার হাত দরাজ করতে বাধ্য না করে ইসলামি রাষ্ট্র যাকাতের এ অংশ থেকে তার প্রয়োজন পূরণ করে দেবে। এসব আকস্মিক প্রয়োজনশীল লোকের নিজ নিজ ঘরে যদি বিপুল পরিমাণের অর্থ-সম্পদও থেকে থাকে, তবুও তাকে এ সময় যাকাতের অর্থ হতে সাহায্য দান করা শরীঅত সম্মত কাজ হবে। এ ব্যাপারে ইসলামি শরীআত অনুমতি প্রদান করেছে।


যাকাতের এ অংশের অর্থ হতে কেবল যে নগদ টাকা দিয়ে বিপদগ্রস্তদের সাহায্য করা হবে তাই নয়। পথিকদের জন্য মুসাফিরখানা, ওয়েটিং রুম, গণ-গোসলখানা ও সৌচাগার ইত্যাদি তৈরী করা যেতে পারে। যেসব রাস্তাঘাট ও পুল ভেঙ্গে যাওয়ার দরুণ সাধারণ লোকদের পথ চলাচল কঠিন হয়ে পড়ে তাও এ অংশের অর্থ দ্বারা মেরামত বা পূণনির্মাণ করা যেতে পারে।


অনির্ধারিত ব্যয়ের খাত

পূর্বের আলোচনায় ইসলামি রাষ্ট্রের অর্থ ব্যয়ের যে সকল খাত কুরআনে নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে তা উল্লেখ করা হয়েছে। উল্লিখিত খাতগুলোর বাইরেও এমন অনেক খাত রয়েছে যেগুলো সম্পাদন করা ইসলামি রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব।


ইসলামি অর্থনীতিতে বিভিন্ন প্রয়োজনে রাষ্ট্রীয় অর্থ ব্যয় করার সীমাবদ্ধ অনুমতি ইসলামি রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহীকে প্রদান করা হয়েছে। উপরে বর্ণিত নির্ধারিত খাতের ব্যয় ব্যতীত রাষ্ট্রের অন্যান্য খাতের ব্যয় তিনি পার্লামেন্টে বা মজলিসে শুরার সাথে পরামর্শ করে করতে পারবেন। নিম্নে এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি খাতের উল্লেখ করা হল-


রাষ্ট্রপ্রধানের বেতন ভাতা

ইসলামি রাষ্ট্রের রাষ্ট্র-প্রধানের বেতন বায়তুলমাল হতেই আদায় করা হবে। নবী করীম (স) মুসলমানদের সামগ্রিক আয় হতে যে অংশ গ্রহণ করতেন, তা হতেই তাঁর নিজের পরিবার-পরিজনের জীবিকা নির্বাহ হত।


তাঁর ইস্তিকালের পর প্রথম খলীফা হযরত আবূ বকর (রা) খলীফা নির্বাচিত হওয়ার পূর্বে ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। খলীফা নির্বাচিত হবার পর হযরত উমর ফারুক (রা) মুসলমানদের পক্ষ হতে বললেন: "আপনি ব্যবসায়কার্যে লিপ্ত হলে মুসলমানদের সামগ্রিক ও রাষ্ট্রীয় কার্য অনেকখানি ব্যাহত হবে। অতএব আপনি ব্যাবসায় ত্যাগ করুন।"


হযরত আবু বকর (রা) নিজের রাষ্ট্রীয় কর্তব্য ও পরিবারবর্গের জীবিকা নির্বাহের দায়িত্বের কথা চিন্তা করে বললেনঃ "জনগণের সামগ্রিক ও রাষ্ট্রীয় কর্তব্য পালন করার সঙ্গে সঙ্গে ব্যবসায়-বাণিজ্যও চালিয়ে যাওয়া কিছুতেই সম্ভব নয়। এ কাজে পরিপূর্ণ মনোনিবেশ ও ঐকান্তিকতার সাথে আত্মনিয়োগ করা আবশ্যক। ওদিকে আমার ও পরিবারবর্গের জীবিকা নির্বাহের জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদের প্রয়োজনও রয়েছে।"


তখন মুসলমানদের মজলিসে শূ'রায় খলীফাকে বেতন দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় এবং তাঁর প্রয়োজন অনুযায়ী অর্থ ইসলামি রাষ্ট্রের বায়তুলমাল হতে তাকে দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়।


রাষ্ট্র-প্রধানকে কী পরিমাণ বেতন দেয়া হবে, এ সম্পর্কে হযরত উমর ফারুক (রা.)-এর একটি নীতিকথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি বলেছেন-


أنا و مالكم كولي اليتيم إن استغنيت استعففت وإن افتقرت أخذت بالكفاف أو أكلت بالمعروف.


"আমি ও তোমাদের সামগ্রিক ধন-সম্পদের উদাহরণ হল- ইয়াতীমের ওপর অভিভাবকের ধন-সম্পদের সমতুল্য অর্থাৎ আমি যেন ইয়াতীমের মালেরই রক্ষনাবেক্ষণকারী। অতএব আমি যদি ধনী হই তবে আমি বায়তুলমাল হতে কিছুই গ্রহণ করব না। আর যদি দরিদ্র ও অভাবী হই, তাহলে প্রয়োজন অনুযায়ী বেতন গ্রহণ করব। অথবা ন্যায়সংঙ্গতভাবে তা থেকে আহার করব। (কিতাবুল খারাজ, ইমাম আবু ইউসুফ, পৃ:১১৭)


এ থেকে বোঝা যায় ইসলামি রাষ্ট্রের রাষ্ট্র-প্রধানের বেতনের হার নির্ধারণের ক্ষেত্রে তার প্রয়োজন ও সাম্প্রতিক দ্রব্য-মূল্য বিবেচনায় রাখা হবে। সময় ও অবস্থার আলোকে বেতন কম-বেশী হবে।


সরকারী কর্মচারীদের বেতন

ইসলামি রাষ্ট্রের রাষ্ট্র-প্রধানের ন্যায় অন্যান্য সরকারী কর্মচারীদের বেতনও বায়তুলমাল হতে প্রদান করা হবে। কারণ তারা সকলেই জনগণের সামগ্রিক ও সামাজিক রাষ্ট্রীয় কাজকর্ম আঞ্জাম দেয়ার ব্যাপরে আত্মনিয়োগ করে থাকে। অতএব জনগণের সামষ্টিক ধনভান্ডার-বায়তুলমাল হতে তাদের জীবিকা নির্বাহের ব্যবস্থা করে দেয়াটাই স্বাভাবিক। নবী করীম (স.) নিজে সরকারী কর্মচারীদের বেতন দিয়েছেন এবং খুলাফায়ে রাশেদুনের যুগেও অনুরূপ করা হয়েছে।


ইসলামি অর্থনীতি সাধারণভাবে সকল প্রকার শ্রমিকের বিশেষ করে সরকারী কর্মচারীদের-বেতনের হার নির্ধারণের মূলনীতি উপস্থাপন করেছে।


ইসলামি অর্থনীতি অনুযায়ী সরকারী কর্মচারীদের বেতন নির্ধারণের ব্যাপারে কর্মচারীর যোগ্যতা ও কাজের স্বরূপ এবং প্রয়োজন ও ভরণ-পোষণের দায়িত্ব সম্পর্কে বিশেষ বিবেচনা করে থাকে। নবী করীম (স.)-এ সম্পর্কে নিম্নলিখিত একটি নীতি ঘোষণা করেছেন:


"যে লোক আমাদের সরকারী কর্মচারী হবে, (সে যদি বিবাহ না করে থাকে, তবে। সে যেন বিবাহ করে। তার কোন একজন চাকর না থাকলে সে একজন চাকর নেবে। তার ঘর না থাকলে সে একটি ঘর নেবে। এর অধিক যে গ্রহণ করবে সে হয় বাড়াবাড়িকারী, না হয় চোর হিসেবে গণ্য হবে।" (আবু দাউদ কিতাবুল খারাজ)


লাওয়ারিস শিশুদের লালন-পালন

লা-ওয়ারিস শিশু সন্তানদের প্রতিপালন করাও ইসলামি রাষ্ট্রের কর্তব্য। যে সন্তান নিজে উপার্জনে সক্ষম নয়, যার নিজের কোন অর্থ-সম্পদ নেই, কিংবা যার কোন অভিভাবক বা কোন নিকটাত্মীয়ও এমন নেই যে তার ভরণ-পোষণের দায়িত্ব গ্রহণ করতে পারে; ইসলামি রাষ্ট্রই তার লালন-পালন ও জীবিকার ব্যবস্থা করার জন্য দায়িত্ব নিবে। তবে ইসলামি রাষ্ট্র এ ধরনের সন্তানদের নিষ্কর্ম রসে খেতে দেবে না বরং তাদের জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা করে দেবে এবং স্বাধীনভাবে জীবিকা উপার্জনের উপযোগী করে গড়ে তুলার জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ সান করবে। অমুসলিমদের লা-ওয়ারিস সন্তানদের সম্পর্কেও এ নীতি প্রযোজ্য হবে।


কয়েদী ও অপরাধীদের ভরণ-পোষণ

যেসব অপরাধীকে কারাদন্ডে দর্শিত করা হবে, যেসব অপরাধীর বারবার অপরাধের দরুন তাদেরকে দীর্ঘকাল বন্দী করে রাখার সিদ্ধান্ত হবে, তাদের ভরণ-পোষণের প্রয়োজনীয় দ্রব্য পরিবেশন করা ইসলামি রাষ্ট্রের দায়িত্ব। আর তা বায়তুলমাল হতে প্রদান করা হবে। যেসব লা-ওয়ারিস কয়েদী মৃত্যুমুখে পতিত হবে, তাদের দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করাও ইসলামি রাষ্ট্রেরই দায়িত্ব হবে।


ক্ষতিপূরণ দান

ইসলামি রাষ্ট্রের কোন উন্নয়ণমূলক কাজের জন্য কিংবা যুদ্ধের ঘাঁটি নির্মাণ, সৈনিকদের চলাচল অথবা বৈদেশিক আক্রমণের ফলে নাগরিকদের বিশেষ কোন ক্ষতি সাধিত হলে তার ক্ষতিপূরণ প্রদান করা ইসলামি রাষ্ট্রের কর্তব্য। হযরত উমর ফারুক (রা)-এর নিকট একজন কৃষক এসে অভিযোগ করল যে, সিরিয়ার একদল সৈন্য পথ অতিক্রম করার সময় তার শস্যক্ষেত নষ্ট হয়ে গিয়েছে। এ কথা শুনে তিনি বায়তুলমাল হতে তার ক্ষতিপূরণ বাবদ দশ হাজার দিরহাম প্রদান করেন।


অমুসলিমদের আর্থিক নিরাপত্তা

ইসলামি অর্থনীতিতে সামাজিক নিরাপত্তা শুধু মুসলিম নাগরিকদের দান করা হয়নি, প্রকৃতপক্ষে ধর্ম, বর্ণ ও গোত্র নির্বিশেষে সকল দেশবাসীই এ নিরাপত্তা লাভ করতে পারবে। ইসলামি অর্থনীতিতে যেসব স্থানে 'মিসকীন' শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে এবং রাষ্ট্রীয় ধন-সম্পদে তাদের অধিকারের কথা ঘোষণা করা হয়েছে, সকল ক্ষেত্রেই ধর্ম, বর্ণ ও জাতি নির্বিশেষে নিঃস্ব-দরিদ্র নাগরিকদের বুঝানো হয়েছে।


হযরত আবু বকর (রা.) এর সময় ইসলামি রাষ্ট্রের পক্ষ হতে হযরত খালিদ ইবন ওলীদ (রা.) 'হীরা' বাসীদের সাথে যে সন্ধি চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করেছিলেন তাতে তিনি স্পষ্টভাবে লিখেছিলেন-


"এবং আমি তাদেরকে এ অধিকার দান করলাম যে, তাদের কোন বৃদ্ধ যদি উপার্জন ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে কিংবা কারো উপর কোন আকস্মিক বিপদ এসে পড়ে, অথবা কোন ব্যক্তি যদি সহসা এত বেশী দরিদ্র হয়ে পড়ে যে, তার সমাজের লোকেরা তাকে ভিক্ষা দিতে শুরু করে, তখন তার উপর ধার্যকৃত জিবিয়া কর প্রত্যাহার করা হবে, তার ও তার সন্তানদের ভরণ-পোষণ ইসলামি রাষ্ট্রের বায়তুলমাল হতে ব্যবস্থা করা হবে যতদিন সে ইসলামি রাষ্ট্রের নাগরিক হয়ে বসবাস করবে।'


হযরত উমর (রা.) এক বৃদ্ধ ইয়াহুদী ব্যক্তিকে ভিক্ষা করতে দেখে এর কারণ জিজ্ঞেস করলেন। উত্তরে সে বলল, আমাকে জিযিয়া আদায় করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে, কিন্তু তা আদায় করার আমার কোন সামর্থ্য নেই। হযরত উমর (রা.) এটা শুনে তাকে নিজের ঘরে নিয়ে গেলেন, বায়তুলমাল খাজাঝীকে ডেকে বললেন এর অবস্থার প্রতি লক্ষ কর, এর জন্য ভাতা নির্ধারণ করে দাও, এবং এর নিকট হতে জিযিয়া নেয়া বন্ধ কর।' অতঃপর বললেন: "আল্লাহর শপথ, এর যৌবনকালকে আমরা কাজে ব্যবহার করব, আর বার্ধক্যের অক্ষম অবস্থায় তাকে অসহায় করে ছেড়ে দেব, তা কোন মতেই ইনসাফ হতে পারে না।"



সারকথা

ইসলামি রাষ্ট্রের ব্যয়ের খাত অনেক। নাগরিকের কল্যাণে সকল কাজ আঞ্জাম দেয়া ইসলামি রাষ্ট্রের দায়িত্ব। বিভিন্ন দায়িত্বের মধ্য থেকে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি খাতের কথা উল্লেখ করা হল।


আধুনিক যুগে জনগণের কল্যাণে যে সকল মন্ত্রণালয় গঠিত হয় এবং মন্ত্রণালয়ের অধীনে যে সকল কর্মকান্ড সম্পাদিত হয়, সকল কাজের ব্যয়ভার ইসলামি রাষ্ট্র বহন করবে। শুধু যাকাত, গনীমাত ও ফাই এর সম্পদ নির্ধারিত খাতে ব্যয় করতে হবে।


তবে ইসলামি রাষ্ট্র তার কোন সম্পদ শরীয়ত সম্মত নয় এমন কোন কাজে ব্যয় করতে পারবে না।



এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url