ইসলামি রাষ্ট্রের আয়ের উৎসসমূহ
ইসলামি রাষ্ট্রের আয়ের মূলনীতি কোন কোন খাত থেকে সাধারণতঃ ইসলামি রাষ্ট্রের আয় হয় তা বর্ণনা যাকাত, ওশর, খারাজ-এর পরিচয় অর্থনীতির ক্ষেত্রে যাকাত, ওশর ও খারাজ-এর গুরুত্ব ব্যাখ্যা করতে পারবেন।
রাষ্ট্রীয় আয়
রাষ্ট্র হচ্ছে নির্দিষ্ট একটি ভূখন্ডের জনসমষ্টিকে সুশৃংখল ও সুন্দরভাবে পরিচালনার জন্য বৃহৎ একটি সংগঠনের নাম। রাষ্ট্র নামক এ সংগঠনটি তার উপর অর্পিত জনসাধারণের নানা দায়িত্ব পালন করে থাকে। এসব দায়িত্ব পালনের জন্য তার অনেক অর্থের প্রয়োজন। এ প্রয়োজন মেটানোর জন্য জনসাধারণ ও অন্যান্য খাত হতে যে অর্থ আদায় করা হয় তা-ই রাষ্ট্রীয় আয়।
রাষ্ট্রীয় আয়ের প্রয়োজনীয়তা
একজন ব্যক্তির নিজের জীবনযাত্রা সুষ্ঠরূপে নির্বাহ করার জন্য অর্থ-সম্পদের প্রয়োজন হয়। একটি পরিবার পরিচালনার জন্যও অর্থের প্রয়োজন হয়। অর্থ ছাড়া ব্যক্তি, পরিবার কোন ক্রমেই জীবন ধারণ করতে সক্ষম হয় না। অনুরূপভাবে একটি সরকারের যাবতীয় প্রয়োজন পূরণ ও দায়িত্ব পালনের জন্যও অর্থ সম্পদের প্রয়োজন। ব্যক্তি তার অর্থনৈতিক চাহিদা পূরণের জন্য যেমনিভাবে নিজস্ব উপায় পন্থা অবলম্বন করে অর্থ উপার্জন করে অনুরূপভাবে রাষ্ট্রও দেশবাসীর নিকট হতে বিভিন্ন কর আদায় করে থাকে। দেশের অন্যান্য সম্পদ থেকে প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহ করে।
আরো পড়ুন: ইসলামি অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য বা রূপরেখা
রাষ্ট্রীয় আয়ের মূলনীতি
কুরআন ও হাদীসে মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে আয়ের মূলনীতি কি হবে তা যেমন বলে দেয়া হয়েছে অনুরূপভাবে রাষ্ট্রের আয়ের ব্যাপারেও সরকারকে কি কি কাজ করতে হবে তার মূলনীতি বর্ণনা করা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন-
"আমি এদেরকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠাদান করলে এরা সালাত আদায় করবে, যাকাত দেবে এবং সৎকাজের আদেশ দেবে এবং অসৎ কাজে নিষেধ করবে।" (সূরা আল-হাজ: ৪১)
এ আয়াত থেকে বুঝা যায়, আল্লাহতায়ালা রাষ্ট্র বা সরকারকে চার ধরনের কাজ করার দায়িত্ব দিয়েছেন। তন্মধ্যে একটি হল যাকাত ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। এর মাধ্যমে রাষ্ট্রের সুনির্দিষ্ট খাতের ব্যয় মেটানো সম্ভব। রাসূলুল্লাহ (সা.) ইসলামি রাষ্ট্রের আয়-ব্যায় এর মূলনীতি বর্ণনা করত গিয়ে বলেন-
(রাষ্ট্র কর্তৃক) তাদের (জনগণের) ধনীক শ্রেণীর লোকদের থেকে যাকাত গ্রহণ করা হবে এবং তা গরীবদের মাঝে বণ্টন করা হবে। (বুখারী)
উল্লিখিত বর্ণনা থেকে প্রমাণিত হয় যে, ইসলাম রাষ্ট্রকে আয় করার অধিকার প্রদান করেছে।
ব্যয়কে স্থায়ী নৈতিক নিয়মে বেঁধে দেয়া হয়েছে। এ নীতি অনুযায়ী রাজস্ব আদায়ে কারও উপর কোন প্রকার যুলম করা যাবে না। রাজস্ব আদায় করতে ন্যায়-পরায়ণতার প্রতি ইসলামি রাষ্ট্রের সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে এবং দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর (রা)-এর একটি বক্তব্যে উক্ত মূলনীতির প্রকাশ পায়। তিনি বলেন-
তিনটি হালাল পন্থা ভিন্ন অন্য কোনভাবে রাষ্ট্রীয় সম্পদে হস্তক্ষেপ করার আমার কোন অধিকার নেই। (১) সত্য ও ন্যায়-পরায়ণতার সাথে তা গ্রহণ করা। (২) ন্যায়-পথে তা ব্যয় করা। (৩) তাকে সকল প্রকার অন্যায় নীতির উর্ধ্বে রাখা (কিতাবুল হারাম-১১০)
ইসলামি রাষ্ট্র শুধু ব্যয় বহনের জন্যই আয় করে না, বরং দেশের গরীব, দু্যুখী ও অভাবগ্রস্থ মানুষের জন্য স্থায়ী কল্যাণ ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা চালু করা, বেকারত্ব দ র করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং ঋণীগ্রন্থ লোকদের সাহায্য করার জন্য আয়ের ব্যবস্থা করে।
ইসলামি রাষ্ট্রের আয়ের উৎস
ইসলামি রাষ্ট্রের আয়ের উৎস দু'ধরনের হতে পারে-
প্রথমতঃ ইসলামি শরীয়াত তথা কুরআন ও সুন্নাহ কর্তৃক নির্ধারিত আয়।
দ্বিতীয়ঃ শরীয়াত কর্তৃক নির্ধারিত নয়, তবে সমর্থন যোগ্য এমন আয়।
শরীয়ত তথা কুরআন ও সুন্নাহ কর্তৃক নির্ধারিত আয়ঃ
যে সব আয় ইসলামি রাষ্ট্রের জন্য শরীয়াত কর্তৃক নির্ধারন করা হয়েছে তা হল-
১। যাকাত-
২। ওশর বা এক দশমাংশ
৩। ওশরের অর্ধেক বা এক বিশমাংশ
৪। খুমুস বা এক পঞ্চমাংশ
৫। সাদকাতুল ফিতর
৬। মালিকানা বিহীন সম্পদ
শরীয়াত কর্তৃক নির্ধারিত নয় তবে শরীয়াত কর্তৃক সমর্থিত আয়ের মধ্যে পড়ে এমন আয়-
১। খারাজ বা অমুসলিমদের ভূমি থেকে আদায়কৃত কর
২। জিযিয়া বা অমুসলিমদের উপর ধার্যকৃত কর
৩। আমদানী শুল্ক
৪। জরুরি প্রয়োজনে নির্ধারিত কর
৫। সামরিক কর
৬। ঋণ গ্রহণের মাধ্যমে আয়।
প্রথম প্রকার আয়ের উৎসসমূহের বিশ্লেষণ
যাকাত
জনগণের মৌলিক চাহিদা তথা খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থান এর ব্যবস্থা করা ইসলামি রাষ্ট্রের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এছাড়া দারিদ্র বিমোচন, জনগণের কল্যাণ সাধন তার প্রধান কাজ। এ কাজগুলো সম্পাদন করতে যে অর্থের প্রয়োজন তার চাহিদা মেটাতে যাকাত হচেছ প্রধান উৎস।
কোন ব্যক্তির নিকট যদি পারিবারিক প্রয়োজন বাদ দিয়ে সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণের মূল্য পরিমাণ বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রৌপ্যের মূল্য পরিমাণ অর্থ থাকে এবং এক বছর তার নিকট জমা থাকে তবে উক্ত অর্থের আড়াই ভাগ যাকাত হিসেবে রাষ্ট্রকে প্রদান করা তার উপর ফরয।
আল্লাহ বলেন-
"তুমি তাদের সম্পদ থেকে সাদকা গ্রহণ করবে। এর দ্বারা তুমি তাদের পবিত্র ও পরিশোধিত করবে।" (সুরা আত-তাওবা: ১০৩)
রাসূল (সা) আল্লাহর নির্দেশের সার্বিক বাস্তবায়ন করতে গিয়ে ইয়ামেনের গভর্ণর মু'আয ইবনে জাবাল (রা) কে বলেন-
"তাদের ধনীদের থেকে যাকাত গ্রহণ করবে আর তা তাদেরই গরীব মানুষের মধ্যে বিতরণের ব্যবস্থা করবে।" (বুখারী)
যে সকল ব্যক্তি ও সম্পদ থেকে যাকাত আদায় করা হবে
যাকাত হচ্ছে ধনীদের সম্পদে গরীবদের অধিকার। আল্লাহতা'আলা শুধু ধনীদের সম্পদে যাকাত ধার্য করেছেন। ধনী বলতে এমন ব্যক্তিকে বুঝায় যার কাছে ব্যক্তি ও পরিবারিক খরচ বহন এবং ঋণের দায় শোধের পর সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রৌপ্যের বাজার মূল্য পরিমাণ অর্থ থাকে এবং তা ১ বছর পর্যন্ত তার হাতে বা ব্যাংকে জমা থাকে। এমন ব্যক্তির উপর যাকাত ধার্য করা হবে এবং তা আদায় করা হবে।
প্রধানতঃ দু'ধরনের সম্পদের ওপর যাকাত ধার্য করা হবে। (১) যা প্রকাশ্যভাবে যাচাই করা যায় এমন সম্পন যথা- গরু, ছাগল, উট প্রভৃতি গৃহপালিত পশু ইত্যাদি। (২) যা প্রকাশ্যভাবে যাচাই করা যায় না এমন সম্পদ-যথা- স্বর্ণ, রৌপ্য, নগদ অর্থ ও ব্যাবসায়িক পণ্য ইত্যাদি।
ওশর (এক দশমাংশ)
ওশর )عشر( আরবী শব্দ। শাব্দিকভাবে এর অর্থ হচ্ছে এক দশমাংশ বা দশভাগের এক ভগ।
ইসলামি অর্থনীতির পরিভাষায়, মুসলমানদের যে সকল জমি বৃষ্টি, ঝর্নাধারা, নদী ও খালের পানিতে সিক্ত হয়, কিংবা এমনিতেই সিক্ত থাকার ফলে ফসল ও ফলফলাদি উৎপন্ন হয় আর তাতে নিজস্ব প্রযুক্তি ব্যাবহার করে পানি সেচ করার প্রয়োজন হয় না। উক্ত জমিতে উৎপন্ন ফসলের দশভাগের একভাগ গরীবদের জন্য আল্লাহ নির্ধারণ করে দিয়েছেন। এর নাম হল ওশর।
ওশর ইসলামি রাষ্ট্রের আয়ের প্রধান একটি উৎস। ইসলামি রাষ্ট্র তার কর্মচারীদের মাধ্যমে ওশর আদায়ের ব্যবস্থা করবেন।
নিসফুল ওশর (এক বিশমাংশ)
নিসফ মানে অর্ধেক। আর ওশর মানে এক দশমাংশ। একত্রে শব্দ দুটোর অর্থ দাড়ায় এক দশমাংশের অর্ধেক বা বিশ ভাগের একভাগ।
সাধারণত যে সব জমিতে ফসল ও ফলফলাদি উৎপাদন করতে নিজস্ব প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে পানি সেচ দেয়া হয় এবং গোরব রাসায়নিক সার ও কিটনাশক ঔষধ ব্যবহার করে ফসল উৎপন্ন করা হয়। সে সব জমিতে উৎপাদিত ফসল ও ফলফলাদির বিশ ভাগের একভাগ রাষ্ট্রীয় কোষাগারের জন্য আদায় করা হয়।
খুমুস বা এক পঞ্চমাংশ
ইসলামি অর্থনীতিতে রাষ্ট্রীয় আয়ের উৎস হিসেবে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল কিছু কিছু সম্পদের এক পঞ্চমাংশ বা খুমুস রাষ্ট্রীয় কোষাগারের জন্য আদায় করতে নির্ধারণ করে দিয়েছেন।
এ সকল সম্পদের মধ্যে গনিমতের মাল, খনিজ সম্পদ, সামুদ্রিক সম্পদ, মাটির নীচ থেকে প্রাপ্ত গচিছত সম্পদ উল্লেখযোগ্য।
আরো পড়ুন: উৎপাদনের উপকরণ হিসেবে সংগঠন
গনীমতের মাল
শত্রু পক্ষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ইসলামি রাষ্ট্রের সৈনিকগণ যে ধন-সম্পদ ও আসবাবপত্র লাভকরে থাকেন, ইসলামি পরিভাষায় তাকে গনীমতের মাল (Booty) বলা হয়। এ সম্পর্কে কুরআন মাজীদে আল্লাহ বলেন-
"জেনে রাখ, যুদ্ধে যা তোমরা লাভ কর তার এক-পঞ্চমাংশ আল্লাহর রাসূলের, রাসূলের স্বজনদের, ইয়াতীমদের, মিসকীনদের এবং পথচারীদের।" (সূরা আল-আনফাল-৪১)
যুদ্ধের ময়দানে শত্রুপক্ষের যে সব ধন-সম্পদ, অস্ত্র-শস্ত্র যানবাহন ও খাদ্যসামগ্রী মুসলমানদের হস্তগত হবে, তার পাঁচ ভাগের চার ভাগ বিজয়ী সৈনিকদের মধ্যে বণ্টন করা হবে, আর অবশিষ্ট এক-পঞ্চমাংশ ইয়াতিম, মিসকীন, অভাবী ও নিঃসম্বল পথিকদের মধ্যে বিতরণের জন্য ইসলামি রাষ্ট্রের বায়তুলমালে জমা করা হবে।
ইসলামের প্রথম দিকে সৈনিকদের জন্য কোন নির্দিষ্ট বেতন-ভাতা ছিল না। গনীমতের মালের চার-পঞ্চমাংশই তাদের মধ্যে বণ্টন করা হত। বর্তমান যুগে যেখানে সৈনিকদের বেতন নির্দিষ্ট রয়েছে সেখানে গনীমতের মাল তাদের মধ্যে বণ্টন করার প্রয়োজন নেই। বরং এ সম্পদ সৈনিকদের বেতন বাবদ খরচ করার জন্য সরকারী কোষাগারে জমা রাখা হবে।
খনিজ সম্পদ
খনিজ সম্পদ বলতে মাটির নিচে প্রাপ্ত ঐ সকল সম্পদ যা আল্লাহ তাআলা মানুষের কল্যাণে সৃষ্টি করে রেখেছেন, মানুষ নিজেরা পুতে রাখেনি। সে খনিজ সম্পদের মধ্যে স্বর্ণ, রৌপ্য, তাম্র, লৌহ, সীসা, দস্তা, তেল, গ্যাস, কয়লা ইদত্যাদি যাই হোকনা কেন তার কমপক্ষে এক-পঞ্চমাংশ রাষ্ট্রীয় আয়ের জন্য আদায় করতে হবে। ইমাম আবু ইউসুফ (র) লিখেছেন-
"এভাবে স্বর্ণ, রৌপ্য, তাম্র, লৌহ ও সীসা-দস্তা প্রভৃতি যাবতীয় খনিজ সম্পদ হতে (এক-পঞ্চমাংশ) রাজস্ব আদায় করতে হবে।"
মূলত জমির মালিক নিজস্ব খরচে খনিজ সম্পদ উত্তোলন করার বেলায় ইসলামি অর্থনীতিতে উল্লিখিত বিধানের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। খনিজ সম্পদের রয়ালটি নির্ধারণ করা ইসলামি রাষ্ট্রের উপর ন্যাস্ত হওয়া বাঞ্ছনীয়। কিন্তু বর্তমান যুগে খনিজ সম্পদের অবস্থা একইরূপ নয় এবং উৎপন্ন সম্পদের পরিমাণও এক রকম হয় না। এতদ্ব্যতীত উৎপন্ন খনিজ দ্রব্যের বিভিন্নতার দরুন মূল্যের দিক দিয়েও যথেষ্ট পার্থক্য হয়ে থাকে। এমন কি খনিজ দ্রব্য উৎপাদনের ব্যয়ও সকল খনিতে সমান হয় না। কাজেই প্রত্যেকটি খনিজ 'রয়ালটি'র কোন স্থায়ী পরিমাণ নির্ধারণ সম্ভব নয়। এর পরিমাণ নির্ধারণের ভার ইসলামি রাষ্ট্রের উপরই ন্যাস্ত হওয়া বাঞ্ছনীয়।
প্রয়োজনে সরকার খনিজ সম্পদের সংশ্লিষ্ট জমি অধিগ্রহণ করে তার পুরোটাই রাষ্ট্রীয় আয়ের উৎস হিসেবে গণ্য করতে পারে।
সামুদ্রিক সম্পদ
সকল প্রকার সামুদ্রিক সম্পদ ইসলামি রাষ্ট্রের আয়ের অন্যতম উৎস। সামুদ্রিক সম্পদ বিশেষ করে মৎস্য, মুক্তা আহরনের উপর কর ধার্য হতে পারে। হযরত উমর (রা) সামুদ্রিক সম্পদের উপর কর ধার্য করেন এবং তা যথাযথভাবে সংগ্রহ করার জন্য ভারপ্রাপ্ত কর্মচারী নিয়োগ করেছিলেন। কোন এক কর্মচারীর এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছিলন 'সমুদ্র হতে আহরিত সকল দ্রব্য হতেই রাজস্ব বাবদ এক-পঞ্চমাংশ আদায় করতে হবে। কারণ, এটাও আল্লাহ তাআলারই একটি দান। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) এ মতই পোষণ করতেন। নদী, ঝিল, বিল ইত্যাদি হতে ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যে বিপুল পরিমাণে যে মৎস্য উৎপাদন করা হয় তারও এক-পঞ্চমাংশ ইসলামি রাষ্ট্রের বায়তুলমালের প্রাপ্য হবে। হযরত উমর ইবনে আবদুল আযীযের মতেও জলভাগ হতে যা কিছু উৎপন্ন হবে, তা হতেও রাজস্ব আদায় করতে হবে। কারণ তা স্থলভাগের খনিজ সম্পদেরই সমতুল্য।
'আল্লাহ তাআলা সমুদ্রে যে সমস্থ সম্পদ সৃষ্টি করেছেন তা হতে রাজস্ব বাবদ এক-পঞ্চমাংশ আদায় করতে হবে।'
ভূ-গর্ভে গচ্ছিত সম্পদ
"ভূগর্ভ হতে প্রাপ্ত সম্পদ" অর্থাৎ কোন ব্যক্তির পুতে রেখে যাওয়া সম্পদ যা মালিক বা তার উত্তরাধিকারীরা ভাল করে জানে না। পরবর্তীতে কেউ তার সন্ধান পেল এবং তা উত্তোলন করল। এ ধরনের সম্পদও ইসলামি রাষ্ট্রের আয়ের উৎস হবে। এ ধরনের সম্পদকে "রিকায" বলে। আল্লাহর রাসূল এর উপর ইসলামি রাষ্ট্রের জন্য এক পঞ্চামাংশ কর নির্ধারণ করেছেন। রাসূল (স.) বলেন- "রিকাষ বা ভূগর্ত হতে প্রাপ্ত সম্পদের এক পঞ্চমাংশ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা হবে।"
সাদাকাতুল ফিতর
রমযান শেষে ঈদের দিন ধনী ব্যক্তিগণ গরীবদের মধ্যে যে শস্য কিংবা তার মূল্য বণ্টন করে থাকেন তাকে সাদকাতুল ফিতর বলে। এ সাদকা প্রত্যেক ধনী ব্যক্তি তার পরিবারের সকল সদস্যের পক্ষ হতে আদায় করতে বাধ্য। ইসলামি অর্থনীতির দৃষ্টিতে এটাকেও রাষ্ট্রীয় আয় হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। ইমাম বুখারী (রা) লিখেছেন- 'ইসলামি খিলাফতের যুগে এ সাদকাও রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা করা হত এবং তা হতে পরিকল্পনানুযায়ী নির্দিষ্ট এলাকার গরীবদের মধ্যে বণ্টন করা হত।'
মালিকানাহীন সম্পদ
ইসলামি রাষ্ট্র সমগ্রদেশের সকল নাগরিকের দায়িত্ব পালন করে থাকে। অতএব দেশের যে সব ধন-সম্পদের কোন মালিক বা উত্তরাধিকারী নেই, তার মালিক হবে ইসলামি রাষ্ট্র। রাষ্ট্রীয় কোষাগারে তা জমা হবে এবং রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনেই তা ব্যয় করা হবে। হযরত উমর ফারুক (রা) মিসরের শাসনকর্তার এক প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন 'যে মৃত ব্যক্তির উত্তরাধিকারী নেই তার যাবতীয় ধন-সম্পত্তি বায়তুলমালে জমা হবে। নবী করীম (স) ইরশাদ করেছেন-
"যার কোন উত্তরাধিকারী নেই, তার উত্তরাধিকারী আমি। আমি-ই তার পরিত্যাক্ত সম্পত্তি পাব এবং তার পক্ষ হতে দায়িত্ব পালন করব। (কিতাবুল আমওয়াল-২২১)
বস্তুত নবী করীম (স) রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবেই এ কথা ঘোষণা করেছিলেন। সুতরাং এ সম্পদ রাষ্ট্রের। হযরত উমর ফারুক ও (রা) এরূপ নির্দেশ দিয়ে বলেছেন-
"যার উত্তরাধিকারী থাকবে, মৃত্যুর পর তার ধন-সম্পত্তি তার উত্তরাধিকারীদের মধ্যে বণ্টন কর। আর যার উত্তরাধিকারীরূপে পশ্চাতে কেউ নেই, তার ধন-সম্পদ মুসলমানদের বায়তুলমালে জমা করে দাও। (ফুতুহু মিসর ওআখবারূহা)
যেসব পড়ে থাকা মাল কোথাও পাওয়া যাবে এবং যার মালিক খুঁজে পাওয়া যাবে না, তাও অনুরূপভাবে ইসলামি রাষ্ট্রের আয়ের উৎস হবে।
দ্বিতীয় প্রকার আয়ের উৎসসমূহের বিশ্লেষণ
ইসলামি রাষ্ট্রের জন্য যে সকল আয়ের উৎস রয়েছে তন্মধ্যে দ্বিতীয় প্রকারে এমন কিছু খাত রয়েছে যার পরিমাণ আল্লাহ তাআলা কিংবা রাসূল (স) নির্ধারণ করে যান নি। তা নির্ধারণের দায়িত্ব ইসলামি রাষ্ট্রের উপর ন্যস্ত। সময় ও অবস্থার চাহিদার আলোকে ইসলামি সরকার তার পরিমাণ বাড়াতে বা কমাতে পারে। অবশ্য এ ক্ষেত্রেও কর নির্ধারণের মৌলিক নীতি অবশ্যই অনুসরণ করা হবে। উক্ত খাতগুলোর বিশ্লেষণ নিম্নরূপ:
খারাজ বা অমুসলিমদের ভূমি রাজস্ব
ইসলামি রাষ্ট্রের আয়ের উৎসসমূহের অন্যতম হচ্ছে (খারাপ)। খারাজ শব্দটি মূলত ফারসী থেকে এসে আরবী ভাষায় ব্যবহৃত হচ্ছে। শব্দটির অর্থ হল Tax (ট্যাক্স) বা কর।
ইসলামি অর্থনীতির পরিভাষায়, খারাজ বলতে অমুসলিমদের মালিকানা ও ভোগকৃত জমি হতে যে রাজস্ব আদায় করা হয় তাকে খারাজ বলে। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল, খারাজের কোন পরিমাণ নির্ধারণ করে দেননি। ইসলামি রাষ্ট্রই খারাজের পরিমাণ নির্ধারণ করবে। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্র কর নির্ধারণে এমন পদক্ষেপ গ্রহণ করবে যাতে কারো উপর অন্যায় না হয়।
বিশেষজ্ঞ একটি টিম গঠন করে তাদের মাধ্যমে খারাজ-এর পরিমাণ নির্ধারণ করা হবে। এক্ষেত্রে জমির পরিমাণ, গুণাগুণ ও উর্বরতা, পানি সেচের আবশ্যকতা ও অন্যাবশ্যকতার প্রতি অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। (বিস্তারিত ৩য় পাঠে)
আরো পড়ুন: ইসলামের দৃষ্টিতে ব্যবসা ও শরীআতের দৃষ্টিতে ব্যবসায়ের গুরুত্ব
জিযিয়া বা অমুসলমানদের উপর ধার্যকৃত কর
জিযিয়া কর ইসলামি রাষ্ট্রের আয়ের আর একটি প্রধান উৎস। ইসলামি রাষ্ট্রের অনুগত অমুসলিম নাগরিকদের নিকট হতে রাষ্ট্রীয় প্রয়োজন পুরণের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ একটি বিশেষ কর গ্রহণ করা হবে। ইসলামের অর্থনৈতিক পরিভাষায় তাকে 'জিযিয়া কর' বলে। 'জিযিয়া কর' অর্থ 'বিনিময়'; রাষ্ট্র প্রজা-সাধারণের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব গ্রহণ করে, তাদেরকে নিরাপত্তা দান করে, তাই-এর বিনিময়ে প্রয়োজন অনুযায়ী রাষ্ট্র কর আদায় করার অধিকার রাখে। 'জিযিয়া' অনুরূপ একটি কর। কুরআন মাজীদের নিম্নোদ্ধৃত আয়াতে এ কথাই বলা হয়েছে।
"যে পর্যন্ত না তারা নত হয়ে স্বহস্তে নিষিয়া দেয়।" (সূরা আত-তাওবাহ: ২৯)
অর্থাৎ ইসলামি রাষ্ট্রের অধীন অমুসলিম প্রজাদের প্রধানত দু'টি কর্তব্য রয়েছে। রাষ্ট্রের পূর্ণ আনুগত্য ও বশ্যতা স্বীকার করা এবং রাষ্ট্রীয় কার্যপরিচালনায় আর্থিক প্রয়োজন পুরণের জন্য সাধ্যানুসারে নির্ধারিত কর প্রদান করা।
বাহ্যত মনে হতে পারে যে, জিযিয়া কর নির্ধারণের মাধ্যমে ইসলামি রাষ্ট্র অমুসলমানদের প্রতি সমান আচরণ করেনি। কিন্তু গভীরভাবে চিন্তা করলে দেখা যায় যে, ইসলামি রাষ্ট্রকে হেফাজত করা, তার কল্যাণে সর্বশক্তি নিয়োগ করার মূল দায়িত্ব মুসলমানদের উপর, তা সত্ত্বেও তারা রাষ্ট্রের ব্যয় মেটাতে ওশর, নিসফ (অর্ধ) ওশর ইত্যাদি কর প্রদান ছাড়াও যাকাত প্রদান করে থাকে এবং প্রয়োজনে নিজেদের জীবন ও সম্পদ দিয়ে দেশকে রক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ করে। অমুসলিমদের উপর যাকাত নেই, দেশ রক্ষার কাজে তারা কোন অর্থ ব্যয় কিংবা জীবন দান করেনা অথচ দেশের সার্বিক সুবিধা তারাও ভোগ করে। তাই রাষ্ট্রীয় ব্যয়ে সমতা নিয়ে আসার জন্য। তাদের উপর জিযিয়া কর ধার্য করা হয়েছে।
জিযিয়া করের পরিমাণ ইসলামি আইনে নির্ধারিত নেই। এটা রাষ্ট্রের উপর ন্যাস্ত। অবস্থা ও চাহিদার আলোকে এ করের পরিমাণ কম বা বেশী হতে পারে।
জিযিয়া সাধারণত মুদ্রায় আদায় করা হবে। কিন্তু পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে বিশেষ কোন শিল্পপণ্যের আকারেও তা আদায় করা অসংগত হবে না। নবী করীম (স) ও খুলাফায়ে রাশেদুন বিভিন্ন শিল্পোৎপাদনকারীদের নিকট হতে জিযিয়া বাবদ শিল্পপণ্যও গ্রহণ করেছেন।
ব্যবসা পণ্যে ধার্যকৃত কর
প্রত্যেক রাষ্ট্রই নিজ দেশের শিল্প-বাণিজ্যের উৎকর্ষ সাধন এবং বৈদেশিক শিল্পপণ্যের আমদানীকে নিরুৎসাহিত করার চেষ্টা করে থাকে। ইসলামি রাষ্ট্রকে এজন্য সর্বপ্রথম বৈদেশিক পণ্য আমদানী নিয়ন্ত্রণ করতে এবং তার উপর শুল্ক ধার্য করতে হয়। অনুরূপভাবে অন্য রাষ্ট্রের যেসব নাগরিক ইসলামি রাষ্ট্রের অধীনে থেকে ব্যবসায়-বাণিজ্য করবে এবং অর্থ বিনিয়োগ করবে তাদের উপরও এ শুল্ক ধার্য করা হবে। কারণ তাদের জানমাল ও ব্যবসা বাণিজ্যের নিরাপত্তা প্রদানের দায়িত্ব ইসলামি রাষ্ট্রের উপর অর্পিত এবং এ দায়িত্ব পালনের বিনিময়ে তাকে অবশ্যই প্রয়োজনী শুল্ক আদায় করতে হবে। ইসলামের ইতিহাসে হযরত উমর ফারুক (রা)-এর সময়ই এ শুল্ক সর্বপ্রথম ধার্য হয়েছিল। বস্তুত এ শুল্ক প্রদান করেই বিদেশী নাগরিকগণ ইসলামি রাজ্যে ব্যবসায়-বাণিজ্য ও জান-মালের পূর্ণ নিরাপত্তা লাভ করতে পারে।
এ ধরনের করের পরিমান- অবস্থা, সম্পদ ও চাহিদার প্রেক্ষিতে ইসলামি রাষ্ট্র নির্ধারণ করবে। আর আদায়কৃত শুল্ক রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা করা হবে।
জরুরি প্রয়োজনে নির্ধারিত কর
ইসলামি রাষ্ট্রের কোষাগার বিশেষ সময় বা পরিস্থিতিতে সম্পূর্ণরূপে শূন্য হয়ে পড়ে। কিংবা ব্যয় অপেক্ষা আয় কমে যায়। জরুরি পরিস্থিতির উদ্ভব হওয়ার ফলে যেমন কোন নতুন জাতীয় কল্যাণমূলক পরিকল্পনা কার্যকর করার জন্য অধিক অর্থের প্রয়োজন হয়ে পড়ে, অথবা সকল প্রকার আয়ের পরেও রাজ্যের সকল মানুষের মৌলিক চাহিদা পূর্ণ করা সম্ভব না হয়; বা বন্যা, দুর্ভিক্ষ, যুদ্ধ ও বৈদেশিক আক্রমণের সম্ভাবনা দেখা দেয়, তখন ইসলামি রাষ্ট্র দেশবাসীর উপর অতিরিক্ত কর ধার্য করতে পারবে।
তাবুক যুদ্ধের সময় নবী (সা) যাকাত, ওশর ইত্যাদি আদায় করার পরও আকস্মিকভাবে আরো অধিক অর্থের প্রয়োজন বোধ করেছিলেন এবং মুসলমানদের কাছে তিনি সে জন্য অর্থ সাহায্যের দাবি পেশ করেন।
সাময়িক কর
সাধারণত ইসলামি রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয় কার্য সমাধানের জন্য এবং দেশ ও স্বাধীনতা রক্ষার জন্য বায়তুলমালে সম্পদ জমা থাকলে জনগণের উপর অতিরিক্ত কর ধার্য করা ঠিক নয়। তবে দেশ ও স্বাধীনতা রক্ষার জন্য যদি ইসলামি রাষ্ট্রে অর্থের খুবই প্রয়োজন হয় এবং বায়তুলমালে সম্পদের ঘাটতি পড়ে তখন জনগণের সম্পদের উপর যে কর নির্ধারণ করা হয় তাকে সাময়িক কর বলে।
ঋণ গ্রহণের মাধ্যমে আয়
সাধারণভাবে রাষ্ট্রের যে আয় হয়ে থাকে, সেই অনুসারেই রাষ্ট্রের যাবতীয় খরচ বহন করা বাঞ্ছনীয়। অবশ্য জরুরি পরিস্থিতিতে আকস্মিক প্রয়োজন দেখা দিলে জরুরি কর ধার্য করে তা পূরণ করতে হয়। কিন্তু তাতেও যদি প্রয়োজন পূর্ণ না হয় তখন সরকারকে শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে ঋণ গ্রহণ করতে হয়।
এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url