সুদের পরিচয় ও শ্রেণীবিভাগ ভোগ্য ঋণের সুদ বনাম বিনিয়োগ ঋণের সুদ

সুদের বিভিন্ন সংজ্ঞা ও পরিচয় ও  সুদের শ্রেণীবিভাগ  ভোগ্য ঋণের সুদ বনাম বিনিয়োগ ঋণের সুদ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।

সুদের সংজ্ঞা

নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পরিশোধের শর্ত সাপেক্ষে কোন নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থের বিপরীতে পূর্বনির্ধারিত হারে যে অধিক পরিমাণ অর্থ আদায় করা হয় এবং একই শ্রেণীভূক্ত মালের পারস্পরিক লেনদেন কালে চুক্তি মোতাবেক অতিরিক্ত যে পরিমাণ মাল গ্রহণ করা হয় তাকে 'সুদ' বলে।

পবিত্র কুরআনে সুদের প্রতিশব্দ হিসেবে 'রিবা' শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। আরবি 'রিবা' শব্দের অর্থ হচেছ বেশী হওয়া, বৃদ্ধি পাওয়া, মূল থেকে বেড়ে যাওয়া, বিকাশ ঘটা ইত্যাদি। ইসলামে 'রিবা' অর্থাৎ বৃদ্ধি পাওয়াকে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু সকল প্রকার বৃদ্ধিকে ইসলামে 'রিবা' বলে আখ্যায়িত করা হয়নি। কারণ ব্যবসা বাণিজ্যেও মূলধন বৃদ্ধি পেয়ে থাকে, যা 'মুনাফা' নামে আখ্যায়িত। মূলধনের এ বৃদ্ধি অর্থাৎ 'মুনাফা' সুদের অন্তর্ভুক্ত নয় এবং তা হারামও নয় বরং সম্পূর্ণ হালাল। ইসলামে একটি বিশেষ ধরনের বৃদ্ধিকে 'রিবা' বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে, যা প্রদত্ত মূলধনের উপর চুক্তি মোতাবেক আদায় করা হয়।

পবিত্র কোরআনের মোট সাতটি আয়াত এবং চল্লিশটিরও অধিক হাদীসের মাধ্যমে রিবার অবৈধতা, কৃফল এবং দাতা, সাক্ষী ও লেখকের খারাপ পরিণতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

আরে পড়ুন: উৎপাদনের উপকরণ হিসেবে সংগঠন

হাদীসের আলোকে সুদের সংজ্ঞা

পবিত্র কুরআনে সুদের সংজ্ঞা দেয়া না হলেও হাদীসে এর সংজ্ঞা এবং বিবরণ দেয়া হয়েছে এবং এরই ভিত্তিতে ফিকহবিদগণ রিবাকে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। নিম্নে রিবা বা সুদের কয়েকটি সংজ্ঞা উল্লেখ করা হল। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন-

১.  "যে ঋণ কোন মুনাফা টানে তাই রিবা (সুদ)।"

২. কিতাবুল ফিকহ আলাল মাযাহিবিল আরবাআ গ্রন্থে বলা হয়েছে-

একই জাতীয় কোন পণ্য সামগ্রীর পারস্পরিক লেনদেনের সময় কোন বিনিময় ব্যতীত এক পক্ষ কর্তৃক যে অতিরিক্ত সম্পদগ্রহণ করা হয়, সে অতিরিক্ত অংশকে বলা হয় 'সুদ'। যেমন কেউ এক কেজি চাল দিয়ে দেড় কেজি চাল নিল। এখানে অতিরিক্ত আধা কেজি চালের কোন বিনিময় দেয়া হয়নি। ইসলামি শরীয়াতে এ অতিরিক্ত আধাকেজি চাল গ্রহণ করাকে সুদ হিসেবে গণ্য করা হয়।

৩. সুদের সংজ্ঞা প্রসঙ্গে মুজামু লুগাতিল কুফাহা গ্রন্থে আছে-

"শরীয়াত সম্মত বিনিময় ব্যতীত চুক্তির শর্তানুযায়ী যে অতিরিক্ত গ্রহণ করা হয় তাকে 'সুদ' বলে।

৪. মুফতি আমীমুল ইহসান (র.) তাঁর কাওয়াইদুল ফিকহ গ্রন্থে লিখেছেন-"চুক্তিবদ্ধ দুই পক্ষের যে কোন এক পক্ষ পারস্পরিক লেনদেনে শরীয়াত সম্মত বিনিময় ব্যতীত শর্ত মোতাবেক যে অতিরিক্ত মাল গ্রহণ করে ডাকে 'সুদ' বলা হয়।

৫ আহকামুল কুরআন গ্রন্থে আল্লামা ইবনুল আরাবী (র) লিখেছেন-

রিবার আভিধানিক অর্থ হচেছ বৃদ্ধি। পবিত্র কুরআনে ঐ বৃদ্ধিকে বুঝানো হয়েছে যার বিপরীতে কোন বিনিময় নেই।"

৬. ফতোয়ায়ে আলমগীরীতে সুদের সংজ্ঞা প্রসঙ্গে বর্ণিত হয়েছে-"ইসলামি শরীয়াতে 'সুদ' ঐ মালকে বলা হয়েছে যে মালের পরিবর্তে লেনদেনকালে অতিরিক্ত অংশ হিসেবে প্রদান করা হয়, যার কোন বিনিময় নেই।"

৭. প্রসিদ্ধ ভাষাবিদ আবু ইসহাক আল যাজ্জাজ-এর মতে-

"যে ঋণের দরুন আসলের অতিরিক্ত নেয়া হয় তা সুদ"।

৮. ইমাম আবু বকর আল জাসসাস এর মতে,-"একটি নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য প্রদেয় ঋণে মেয়াদোত্তীর্ণের পর পূর্ব শর্ত অনুযায়ী আসলের অতিরিক্ত যে অর্থ আদায় করা হয় তা হচেছ সুদ।" (তাজুল আবুসঃ রিবা দ্রঃ)

এমনিভাবে বিভিন্ন মুসলিম মনীষীগণ বিশ্বনবী (স.)-এর হাদীসের ভিত্তিতে সুদকে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করে পৃথিবীর মানুষের সামনে পেশ করে গিয়েছেন। মোটকথা সর্বপ্রকার সুদ ইসলামে অবৈধ। সেটা জাহেলী যুগে প্রচলন থাকুক বা না থাকুক।

সুদের শ্রেণী বিভাগ

সুদ সাধারণত দুই প্রকার, যথা-রিবা আল-নাসিয়া এবং রিবা আল-ফাদল। রিবা আল-নাসিয়া রিবা আরবী শব্দ যার অর্থ বৃদ্ধি। কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কোন অর্থ বা পণ্য ঋণ হিসাবে প্রদানের বিনিময়ে ঋণগহীতার নিকট থেকে সময়ের ভিত্তিতে পূর্ব নির্ধারিত হারে ঋণ বাবদ বা পণ্যের অতিরিক্ত যে অর্থ বা পণ্য আদায় করা হয় তাকে বলা হয় রিবা আল-নাসিয়া'। যেমন, রহিম করিমকে ১০% হার সুদে এক বছরের জন্য ১,০০,০০০ টাকা ধার দিল। এক বছর পর করিমের কাছে রহিমের পাওনা হবে সুদাসল ১,১০,০০০ টাকা। একইভাবে যদি 'ক' 'খ'কে ধার হিসাবে দশ মণ ধান দেয় এই শর্তে যে, ৬ মাস পর "ক" ১০ মণ আসলের সাথে ১মণ অতিরিক্তসহ মোট ১১ মণ ধান পরিশোধ করবে তবে এই লেনদেনটি ও রিবা আল-নাসিয়া হিসেবে পরিগণিত হবে। অন্যদিকে রিবা আল ফাদল হচেছ, সমজাতীয় পণ্যের তারতম্যপূর্ণ তাৎক্ষণিক (on the spot) লেনদেন। যেমন, 'ক' যদি তার ২ কেজি সরু চালের বিণিময়ে 'খ' এর নিকট থেকে চার কেজি মোটা চাল গ্রহণ করে তবে তা রিবা আল-ফাদল হিসাবে গণ্য হবে। তবে কেউ যদি ভিন্ন জাতীয় দুটি দ্রব্যের লেনদেনের পরিমানের তারতম্য করে তবে তা রিবা আল-ফাদল হবে না। যেমন 'ক' এক কেজি চালের বিনিময়ে 'খ'-এর নিকট থেকে দুই কেজি আলু গ্রহণ করলো। এরূপ লেনদেন বৈধ।

রিবা আল-নাসিয়া কুরআনের আয়াত দ্বারা সুস্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ। পবিত্র কুরআনের সূরাহ আল-বাকারার ২৭৫ নং আয়াতে সুদকে শয়তানী উন্মাদনা বলে উল্যেখ করে বলা হয়েছে- "ঐ ব্যক্তিরা যারা সুদ গ্রহণ করে, দাঁড়াতে পারবেনা, ঐরূপ ব্যতীত যেমন দাঁড়ায় একজন, যাকে শয়তান তার স্পর্শ দিয়ে উন্মাদনার দিকে নিয়ে যায় কারণ তারা বলে; বাণিজ্য সুদের মত। কিন্তু আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন এবং সুদকে হারাম করেছেন। অতঃপর যার কাছে তার পালনকর্তার পক্ষ থেকে উপদেশ এসেছে এবং সে বিরত হয়েছে, পূর্বে যা হয়ে গেছে তা তার। তার ব্যাপার আল্লাহর উপর নির্ভরশীল। আর যারা পুণরায় সুদ খায় তারাই দোজখে যাবে; তারা সেখানেই চিরকাল অবস্থান করবে।" পক্ষান্তরে, রিবা আল-ফাদল তথা সমজাতীয় পণ্যের তারতম্যপূর্ণ লেনদেনের ফলে সৃষ্ট সুদ আল্লাহর রাসূল (স) কর্তৃক নিষিদ্ধ।

সরল সুদ বনাম চক্রবৃদ্ধি সুদঃ রহিম ১২% সুদে ১ লক্ষ টাকা মূল্যের প্রতিরক্ষা সঞ্চয়পত্র কিনলো। ৫ বছর পর সে ১ লক্ষ ৬০ হাজার টাকা পাবে। এটি হচেছ সরল সুদের উদাহরণ। অন্যদিকে রহিম কোন সুদী বানিজ্যিক ব্যাংক থেকে ১ লক্ষ টাকা ১০% সুদে ৫ বছরের জন্য ধার নিল। প্রথম বছর শেষে ১ লক্ষ টাকা আসলের সাথে ১০ হাজার টাকা সুদ যুক্ত হয়ে মোট ১ লক্ষ ১০ হাজার টাকা দ্বিতীয় বছরের আসল হিসাবে বিবেচিত হবে। অর্থাৎ দ্বিতীয় বছরে ১,১০,০০০ টাকার সাথে ১০% হারে ১১,০০০ টাকা সুদ যুক্ত হয়ে সুদাসলে ১,২১,০০০ টাকা তৃতীয় বছরের জন্য আসল হিসাবে বিবেচিত হবে। এভাবে প্রতিটি হিসেব শেষে সুদ পূণঃবিনিয়োগের ধারণার ভিত্তিতে ক্রমাগত আসলের পরিমাণ বৃদ্ধি এবং তার উপর পরবর্তী সুদ নির্ণয় প্রক্রিয়ার নাম চক্রবৃদ্ধি সুদ।

পবিত্র কুরআনে সাধারণভাবে সুদ হারাম করার পাশাপাশি বিশেষভাবে চক্রবৃদিধ সুদ হারাম করা হয়েছে। সুরাহ আল-ইমরানের ১৩০ নং আয়াতে বলা হয়েছে, হে বিশ্বাসীগণ, তোমরা দ্বিগুন চতুর্গুন হারে সুদ খেওনা।

আল্লাহকে ভয় করো। আশা করা যায় তোমরা কল্যাণ লাভ করতে পারবে, পবিত্র কুরআনে বিশেষভাবে চক্রবৃদ্ধি সুদ নিষিদ্ধ করার ফলে কিছু কিছু লোকের মাঝে এই ভুল ধারণার সৃষ্টি হয়েছে যে, সরল সুদ হয়তো অতটা খারাপ নয় এবং সরল সুদের লেনদেন করা যেতে পারে। এ ধারণা একবারেই ভুল। কারণ, বিশেষ পরিস্থিতিতে প্রথম দিকে আল্লাহ পাক চক্রবৃদ্ধি সুদের নিষেধাজ্ঞার কথা উল্ল্যেখ করলেও কুরআনের অন্য সাধারণভাবে সুদ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বিশেষ করে কুরআনের যে আয়াতে সুদের বিরুদ্ধে আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (স) এর পক্ষ থেকে যুদ্ধের ঘোষণা দেয়া হয়েছে সেখানে সাধারণভাবে (unqualified) সুদের উল্যেখ করা হয়েছে।

আরে পড়ুন: ইসলামের দৃষ্টিতে ব্যবসা ও শরীআতের দৃষ্টিতে ব্যবসায়ের গুরুত্ব

ভোগ্য ঋণের সুদ বনাম বিনিয়োগ ঋণের সুদ

কেউ যখন তার জীবন ধারনের প্রয়োজনে ঋণ গহণ করে তখন তাকে বলা হয় ভোগ্য ঋণ (consumption credit)। যেমন ফ্রিজ বা গৃহস্থালীর আসবাবপ এ ক্রয়ের জন্য ঋণ। পক্ষান্তরে, কেউ যখন উৎপাদন কিংবা ব্যবসায়িক কর্মকান্ড পরিচালনার জন্য ঋণ গ্রহণ করে তখন তাকে বলা হয় বিনিয়োগ ঋণ (investment credit)। তথাকথিত উদারপন্থী কিছু মুসলিমের ধারণা, ভোগ্য ঋণের বেলায় সুদ পুরোপুরি নিষিদ্ধ হলেও বিনিয়োগ ঋণের বেলায় সুদ সম্ভবতঃ অতটা নিষিদ্ধ নয়। তাদের এ ধারণার পিছনে যুক্তি হলো, প্রথমতঃ বাণিজ্যিক ঋণগ্রহীতা গৃহীত ঋণের টাকা দিয়ে যেহেতু ব্যবসা করছেন লাভের উদ্দ্যেশ্যে, সুতরাং তার উপার্জিত লাভ থেকে একটি নির্দিষ্ট হারে সুদ দেয়াতে আপত্তির কি থাকতে পারে? তাদের দ্বিতীয় যুক্তি হচেছ এই যে, রাসুল (স) এর যুগে মূলতঃ ভোগের উদ্দ্যেশ্যেই ঋণ দেয়া নেয়া হতো। এমতাবস্থায়, আধুনিক যুগে ব্যবসা বাণিজ্যের জন্য গৃহীত ঋণের জন্য সুদ গ্রহণ ও প্রদান অবৈধ না হওয়াই যুক্তিযুক্ত। ব্যবসায়িক সুদের বৈধতার প্রবক্তাদের প্রথম যুক্তি ধোপে টেকে না এজন্য যে, ব্যবসায়ে লাভের সম্ভাবনার পাশাপাশি লোকসানের ও ঝুঁকি থাকে। সুতরাং লোকসানের ঝুঁকি পুরোটাই উদ্যোক্তার মাথায় চাপিয়ে মূলধনের যোগানদাতা নিশ্চিত লাভের নৌকায় পা রাখবেন এটা মোটেই মেনে নেয়া যায় না। তাদের দ্বিতীয় যুক্তিও অকার্যকর কারণ- রাসূল (স) এর যুগে যে বাণিজ্যিক প্রয়োজনেও সুদে ঋণ আদান-প্রদান হতো তা ইতিহাস থেকে প্রমাণিত

কোমল সুদ বনাম কঠোর সুদঃ ফেউ কেউ আবার সুদকে কোমল ও কঠিন এ দু'ভাগে বিভক্ত করার ব্যর্থ চেষ্টা করেন। সুদের হার অপেক্ষাকৃত স্বল্প ও শর্তাবলী নরম বা সহজ হলে তাকে কোমল সুদ এবং এর উল্টো হলে তাকে কঠোর সুদ বলে আখ্যায়িত করা হয়। সে সাথে যুক্তি দেখানো হয় যে, কঠোর সুদ হারাম হলেও কোমল সুদ হারাম না হওয়াই উচিৎ। এ ধারণা ভ্রান্ত, কারণ ইসলামি উসুলের একটি বড় বিধান হলো এই যে, যে জিনিসের বেশী হারাম তার অল্প ও হারাম। যেমন, মদ খাওয়া, মিথ্যা বলা ইত্যাদি। অল্প মদ বা আংশিক মিথ্যা যেমন বৈধতা পেতে পারে না, তেমনি অল্প বা হালকা সুদও বৈধতা পাওয়ার কোন যুক্তি নেই।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url