শিশুদের জন্য মোবাইল ব্যবহারের ক্ষতিকর দিক সমূহ
শিশুদের জন্য মোবাইল ব্যবহারের ক্ষতিকর দিক সমূহ (Harmful Effects of Mobile Use on Children) অত্যন্ত বিস্তৃত এবং গুরুত্বপূর্ণ। অত্যাধিক মোবাইল ব্যবহারের ফলে শিশুদের শারীরিক এবং মানসিক উভয় ক্ষেত্রেই গুরুতর প্রভাব পড়তে পারে।
আসক্তি এবং মানসিক স্বাস্থ্যে বিরূপ প্রভাব
শিশুদের মধ্যে মোবাইল ফোনের প্রতি আসক্তি তৈরি হওয়া একটি প্রধান সমস্যা। অতিরিক্ত স্ক্রিন টাইম তাদের মানসিক বিকাশে বাধা দেয় এবং বিভিন্ন মানসিক স্বাস্থ্য ঝুঁকির জন্ম দেয়।
- আসক্তি সৃষ্টি: ক্রমাগত নোটিফিকেশন এবং দ্রুত বিনোদনমূলক কন্টেন্ট শিশুদের মধ্যে এক ধরনের আসক্তি তৈরি করে, যা অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কাজ থেকে তাদের মনোযোগ সরিয়ে দেয়। গবেষণা অনুসারে, আসক্ত শিশুরা অন্যদের তুলনায় মারাত্মক মানসিক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে থাকে।
- আচরণগত সমস্যা ও আবেগ নিয়ন্ত্রণ: অতিরিক্ত স্ক্রিন টাইম শিশুদের মধ্যে ঘন ঘন মেজাজ বদল (Mood Swings), বিনা কারণে রেগে যাওয়া, এবং খিটখিটে ও জেদি হওয়ার মতো আচরণগত সমস্যা সৃষ্টি করে। তারা নিজেদের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতেও সমস্যার সম্মুখীন হয়।
- উদ্বেগ ও বিষণ্ণতা: সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ক্রমাগত অন্যের জীবনযাত্রার সঙ্গে নিজেদের তুলনা করা, অথবা সাইবার বুলিংয়ের শিকার হওয়া শিশুদের মধ্যে উদ্বেগ (Anxiety) এবং বিষণ্ণতা (Depression) বাড়িয়ে দিতে পারে।
- সামাজিক বিচ্ছিন্নতা: মোবাইলে অতিরিক্ত সময় কাটানোর ফলে শিশুরা পরিবার, বন্ধু-বান্ধব ও খেলার সাথীদের সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এর ফলে তাদের সামাজিক দক্ষতা (Social Skills) এবং সহমর্মিতা (Empathy) বিকাশে বাধা আসে।
- ভুলে যাওয়া ও মনোযোগের ঘাটতি: স্ক্রিনে দ্রুত পরিবর্তনশীল কনটেন্ট মনোযোগের পরিসর (Attention Span) কমিয়ে দেয়, যার ফলে শিশুদের মনোযোগের ঘাটতি (Attention Deficit) দেখা দেয় এবং কোনো কাজে বেশিক্ষণ মনোযোগ ধরে রাখা কঠিন হয়।
মস্তিষ্কের বিকাশ ও শিক্ষায় ক্ষতি
শিশুদের মস্তিষ্কের দ্রুত বিকাশ ঘটে শৈশবে। এই সময়ে মোবাইল ফোনের ব্যবহার তাদের জ্ঞানীয় (Cognitive) ও ভাষা বিকাশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
- ভাষা বিকাশে বিলম্ব: যেসব শিশু অতিরিক্ত সময় মোবাইল দেখে, তাদের কথা বলায় দেরি হতে পারে। মস্তিষ্কের বিকাশ নির্ভর করে পরিবেশের সঙ্গে ভাববিনিময় ও খেলার মাধ্যমে শেখার ওপর। মোবাইল ব্যবহার শিশুদের এই সুযোগ সীমিত করে দেয়।
- জ্ঞানীয় দক্ষতার ক্ষতি: সৃজনশীল খেলাধুলা বা নতুন কিছু অনুসন্ধানের সুযোগ কমে যাওয়ায় শিশুদের চিন্তাশক্তির বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। এটি তাদের সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা (Problem-solving skills) এবং কল্পনাশক্তিকে (Creativity) ব্যাহত করে।
- পড়াশোনায় অমনোযোগ: মোবাইল ফোনের লোভনীয় অ্যাপস ও গেমসের প্রতি আকর্ষণ পড়ুয়াদের মনোযোগ নষ্ট করে। এর ফলে তারা একাডেমিক কাজে মনোনিবেশ করতে ব্যর্থ হয় এবং পরীক্ষায় খারাপ ফল করতে পারে।
শারীরিক স্বাস্থ্য ঝুঁকি
অত্যাধিক মোবাইল ব্যবহারের সঙ্গে যুক্ত শারীরিক সমস্যাগুলো দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্য ঝুঁকির কারণ হতে পারে।
- চোখের সমস্যা: মোবাইল ফোনের স্ক্রিন থেকে নির্গত নীল আলো (Blue Light) চোখের রেটিনা ও কর্নিয়াকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। দীর্ঘক্ষণ স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকলে চোখের চাপ (Eye Strain), চোখ শুকিয়ে যাওয়া, ঝাপসা দেখা, এমনকি ক্ষীণদৃষ্টি বা মায়োপিয়া (Myopia) হওয়ার আশঙ্কা বাড়ে।
- ঘুমের ব্যাঘাত: রাতে ঘুমানোর আগে মোবাইল ব্যবহার করলে স্ক্রিনের নীল আলো মেলাটোনিন (Melatonin, যা ঘুম নিয়ন্ত্রক হরমোন) উৎপাদনে বাধা দেয়। ফলে শিশুদের নিদ্রাহীনতা বা ইনসোমনিয়া এবং ঘুমের অনিয়ম দেখা দেয়, যা তাদের মেজাজ ও শেখার ক্ষমতাকে প্রভাবিত করে।
- স্থূলতা ও অঙ্গবিন্যাস সমস্যা: অতিরিক্ত স্ক্রিন টাইমের কারণে শিশুদের শারীরিক কার্যকলাপ (Physical Activity) কমে যায় এবং তারা আসীন জীবনধারা (Sedentary Lifestyle) বেছে নেয়। এর ফলস্বরূপ স্থূলতা বা ওজন বৃদ্ধি এবং হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ে। দীর্ঘক্ষণ ঘাড় ঝুঁকিয়ে ফোন ব্যবহারের কারণে 'টেক্সট নেক' (Text Neck) সহ কোমর ও ঘাড়ের ব্যথা সৃষ্টি হতে পারে।
- বিকিরণ (Radiation) ঝুঁকি: মোবাইল ফোন রেডিওফ্রিকোয়েন্সি (RF) বিকিরণ নির্গত করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এই বিকিরণকে 'সম্ভবত কার্সিনোজেনিক' (Probably Carcinogenic to Humans) হিসেবে শ্রেণীবদ্ধ করেছে। শিশুদের মস্তিষ্ক ও কানে নন-ম্যালিগন্যান্ট টিউমার হওয়ার উচ্চতর আশঙ্কা থাকে বলে কিছু গবেষণায় দেখা গেছে।
- হজমে সমস্যা: অনেক অভিভাবক শিশুকে মোবাইল দেখিয়ে খাওয়ান। এতে শিশু খাবারের দিকে মনোযোগ দিতে পারে না এবং লালা নিঃসরণ (যা হজমের প্রথম ধাপ) ব্যাহত হয়। এর ফলে হজমে সমস্যা, ডায়রিয়া বা কোষ্ঠকাঠিন্য হতে পারে।
অন্যান্য বিপদ ও ঝুঁকিপূর্ণ দিক
মোবাইল ব্যবহারের মাধ্যমে শিশুরা অন্যান্য অপ্রত্যাশিত ঝুঁকির সম্মুখীন হতে পারে।
- অনুপযুক্ত কন্টেন্টের সংস্পর্শ: ইন্টারনেট ব্যবহারের কারণে শিশুরা সহজে তাদের বয়সের জন্য অনুপযুক্ত বা সহিংস (Inappropriate or Violent) কন্টেন্টের সংস্পর্শে আসতে পারে, যা তাদের নৈতিক অবক্ষয় ঘটায়।
- সাইবার বুলিং ও শিকারী: সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শিশুরা সাইবার বুলিং বা অনলাইন হয়রানির শিকার হতে পারে। এছাড়াও, তারা অনলাইনে শিকারী (Online Predators) বা অসৎ ব্যক্তিদের সহজ লক্ষ্যে পরিণত হতে পারে, যা তাদের নিরাপত্তা ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক।
- গোপনীয়তা ও নিরাপত্তা ঝুঁকি: শিশুরা প্রায়শই ব্যক্তিগত তথ্যের গুরুত্ব বোঝে না এবং অসাবধানতাবশত নিজেদের গোপনীয় তথ্য (Personal Information) অনলাইনে শেয়ার করে ফেলে, যা ভবিষ্যতে গুরুতর নিরাপত্তা ঝুঁকির কারণ হতে পারে।
শিশুদেরকে মোবাইল আসক্তি থেকে দূরে রাখতে অভিভাবকদের সচেতন হওয়া এবং স্ক্রিন টাইমের সীমা নির্ধারণ করে, বিকল্প খেলাধুলার ব্যবস্থা করা এবং তাদের পর্যাপ্ত সময় দেওয়া অপরিহার্য।
এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url