১৯৪০ লাহোর প্রস্তাব ও লাহোর প্রস্তাবের পটভূমি

১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব ও লাহোর প্রস্তাবের পটভূমি সম্পর্কে বলতে পারবেন লাহোর প্রস্তাবের মূল বক্তব্য বা বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে পারবেন লাহোর প্রস্তাবের ফলাফল ও পরবর্তী রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া ব্যাখ্যা করতে পারবেন।


ভূমিকা

ব্রিটিশ ভারতের শেষের দিনগুলো খুবই গুরুত্ব ও তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। বিশেষ করে ১৯৪০ সালে মুসলিম লীগের 'লাহোর প্রস্তাব' (যা 'পাকিস্তান প্রস্তাব' নামেও অভিহিত) গৃহীত হওয়ার পর ভারতের রাজনীতি দ্রুত বিভক্তির পথে অগ্রসর হয়। ভারত বিভক্তির লক্ষ্য নিয়ে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এ সময় তাঁর বহুল আলোচিত 'দ্বিজাতিতত্ত্ব' নিয়ে হাজির হন। ১৯৪৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে পাকিস্তান দাবির সমর্থনে মুসলিম লীগের ভারতীয় মুসলমানদের বিপুল সমর্থন লাভ ভারত বিভক্তিকে প্রায় নিশ্চিত করে তোলে। অন্যদিকে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবসান অবধারিত হয়ে উঠে। তবে ভারত ছেড়ে আসার পূর্বে ব্রিটিশদের নীতি ও অগ্রাধিকার ছিল একে অখন্ডিত রাখা। ভূ-রাজনীতি স্বার্থ ও কৌশলগত দিক বিবেচনায় তা তাদের কাছে কাম্য ছিল। সে লক্ষে ১৯৪৬ সালে 'মন্ত্রি মিশন পরিকল্পনা' পেশ করা হয়। সেটি ছিল ভারতকে কোনো প্রকারে ঐক্যবদ্ধ রাখার শেষে সুযোগ। কিন্তু সে উদ্যোগ সফল হয় নি। ফলে ভারত বিভক্তি অনিবার্য হয়ে পড়ে। আর তা কার্যকর করার জন্য পাস হয় ১৯৪৭সালের ভারত স্বাধীনতা আইন। এ ইউনিটে মোট চার (৪) টি পাঠে এসব বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।

আরো পড়ুন: ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচন ও তার ফলাফল

লাহোর প্রস্তাবের পটভূমি

১৯৩৭ সালের সাধারণ নির্বাচনে কংগ্রেসের জয় এবং মুসলীম লীগের পরাজয় পরবর্তীতে মুসলিম লীগের নেতৃবৃন্দকে শঙ্কিত করে তোলে। কংগ্রেস আইন সভার নেতৃত্ব গ্রহণ করে এবং মুসলিম লীগের সাথে আলোচনা ছাড়াই এমন কি মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশে (যেমন, উত্তর প্রদেশ) মন্ত্রিসভা গঠন করে। ফলে কংগ্রেস শাসিত এলাকায় মুসলমান জনসাধারণের মনে ক্ষোভ ও ভীতির সঞ্চার হয়। কোথাও কোথাও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে কংগ্রেস নেতা পন্ডিত জওহরলাল নেহেরুর সম্মিলিতভাবে কাজ করার মনোভাব না থাকার কারণে উপমহাদেশের হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কে দ্রুত অবনতি ঘটে। এমতাবস্থায়, মুসলিম লীগ নেতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ সুযোগমত মুসলমানদের স্বার্থের উপর গুরুত্ব আরোপ করে 'দ্বিজাতিতত্ত্ব'- প্রচারে উৎসাহী হন। তিনি ভারতের মুসলমানদের একটি স্বতন্ত্র জাতি হিসাবে ঘোষণা করেন। যার ফলশ্রুতিতে পরবর্তীতে মুসলমান জনসাধারণের মধ্যে আলাদা আবাসভূমির চিন্তা জাগ্রত হয়।

এ চিন্তাধারার আলোকেই ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ পাঞ্জাবের লাহোরে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের বার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশনে তৎতালীন বাংলার মুখ্যমন্ত্রি এ.কে. ফজলুল হক উপমহাদেশের মুসলমানদের স্বার্থ সম্বলিত একটি প্রস্তাব পেশ করেন। জিন্নাহর সভাপতিত্বে সভায় প্রস্তাবটি গৃহীত হয়। এই প্রস্তাবই ঐতিহাসিক "লাহোর প্রস্তাব" ব্য "পাকিস্তান প্রস্তাব" নামে অভিহিত।

লাহোর প্রস্তাবের মূল বক্তব্য বা বৈশিষ্ট্য

লাহোর প্রস্তাবের মূল বক্তব্য ছিল:

১. ভৌগোলিক দিক থেকে সংলগ্ন এলাকাগুলোকে পৃথক অঞ্চল বলে গণ্য করতে হবে।

২. এ সকল অঞ্চলের ভৌগোলিক সীমানা প্রয়োজনমত পরিবর্তন করে ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলের যে সকল স্থানে মুসলমানেরা সংখ্যাগরিষ্ঠ সেখানে 'স্বাধীন রাষ্ট্রগুলো' (Independent States) প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

৩. এ সমস্ত স্বাধীন রাষ্ট্রের অংগরাজ্য হবে সার্বভৌম ও স্বায়ত্তশাসিত।

৪. ভারতের ও নবগঠিত মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক, শাসনতান্ত্রিক ও অন্যান্য অধিকার ও স্বার্থ সংরক্ষণের কার্যকর ব্যবস্থা করা হবে।

৫. দেশের যে-কোনো ভবিষ্যৎ শাসনতান্ত্রিক পরিকল্পনায় উক্ত বিষয়গুলোকে মৌলিক নীতি হিসাবে গ্রহণ করতে হবে।

লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তি ছিল দ্বিজাতিতত্ত্ব। আর এই তত্ত্ব অনুসারেই ভারতীয় মুসলমানদের এলিট গোষ্ঠী মুসলমানদের মধ্যে জাগ্রত করে তোলেন আত্মনিয়ন্ত্রনাধিকারের অদম্য চেতনা। লাহোর প্রস্তাবের আলোচনায় ভারতের উত্তর-পশ্চিম বা পূর্বাঞ্চলে একাধিক রাষ্ট্র গঠন করার কথা বলা থাকলেও, তাদের রাজনৈতিক মর্যাদা কি ধরনের হবে সে ব্যাপারে সুস্পষ্ট কোনো উল্লেখ ছিল না।

আরো পড়ুন: গবাদিপশুর অনধিকার প্রবেশ আইন, ১৮৭১

লাহোর প্রস্তাবের ফলাফল ও পরবর্তী প্রতিক্রিয়া

লাহোর প্রস্তাব ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমান এলিট প্রভাবিত মুসলমান জনসাধারণের মাঝে এক নতুন প্রেরণার সৃষ্টি করে। স্বতন্ত্র আবাসভূমির আশায় তারা আশান্বিত হয়ে উঠে। ফলে, মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের রাজনীতি পৃথক পৃথক রাষ্ট্র গঠনের আন্দোলনে পরিণত হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সম্প্রদায় মুসলমানদের পৃথক রাষ্ট্র গঠনের দাবিকে অস্বীকার করে, যা পরবর্তীতে বিভিন্ন জায়গায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সৃষ্টি করে। লাহোর প্রস্তাব মুসলিম লীগকে একটি সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক কর্মসূচি ও দিকনির্দেশনা এনে দেয়। অতিদ্রুত পাকিস্তান আন্দোলনের বিস্তৃতি ঘটে। ১৯৪৬ সালের নির্বাচনের ফলাফল এর প্রমাণ। মুসলিম লীগের পক্ষে এ নির্বাচন ছিল পাকিস্তান ইস্যুর উপর রেফারেন্ডাম তুল্য।

১৯৪৬ সালে জিন্নাহর নেতৃত্বে মুসলিম লেজিসলেটরস কনভেনশনে মুসলমানদের একাধিক রাষ্ট্র-পরিকল্পনাকে বাদ দিয়ে এক পাকিস্তান রাষ্ট্রের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। এ ছিল লাহোর প্রস্তাবের রাষ্ট্র পরিকল্পনার পরিবর্তিত রূপ। সে অনুযায়ী ১৯৪৭ সালের ১৪ আগষ্ট ভারত বিভক্ত হয়ে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হয়। মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারত উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চল নিয়ে সৃষ্টি হয় পাকিস্তান এবং বাকি অংশ নিয়ে ভারতীয় ইউনিয়ন।

লাহোর প্রস্তাব অনুযায়ী ভারত বিভক্ত হলে পূর্বাঞ্চলে যেখানে বর্তমান বাংলাদেশ সেখানে ঐ সময়ই একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হওয়ার কথা ছিল, তাতো হয়ই নি, উপরন্ত নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন পর্যন্ত অস্বীকৃত হয়। এ সবই ছিল ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের সঙ্গে প্রতারণার সামিল। এ অবস্থা পূর্ব বাংলার বাঙালিদের দারুণভাবে ক্ষুব্ধ করে। তাছাড়া ভারতীয় উপমহাদেশের দুই প্রান্তে অবস্থিত দুই অঞ্চলকে শুধুমাত্র ধর্মীয় কারণে একত্রিত রাখা প্রায় অসম্ভব ছিল। ধর্মীয় ঐক্য বাঙ্গালিদের উপর পাকিস্তানি অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও জাতিগত শোষণ-নিপীড়ন আড়াল করতে সক্ষম হয় নি। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর রাষ্ট্র-ভাষা নীতি ও বাঙালিদের ভাষা-আন্দোলনের প্রতি প্রতিক্রিয়ায় এর নগ্ন প্রকাশ ঘটে। যার কারণে, পাকিস্তানের শুরুতেই পূর্ব বাংলার জনসাধারণ পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবি তোলে ও পরবর্তীকালে নয় মাস ব্যাপী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদ্বয় ঘটে।

সারকথা

১৯৩৭ সালের নির্বাচনের পর মুসলিম লীগকে প্রায় উপেক্ষা করে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে কংগ্রেস সরকার গঠন করে। যেভাবে কংগ্রেসের সরকার পরিচালিত হচ্ছিল তাতে ভারতের মুসলমানদের মধ্যে দ্রুত হিন্দু আধিপত্যের ভীতি ছড়িয়ে পড়ে। এমনি রাজনৈতিক পটভূমিতে মুসলিম লীগের বার্ষিক অধিবেশনে ১৯৪০ সালের লাহর প্রস্তাব গৃহীত হয়। এর মূল কথা ছিলঃ ভারতের উত্তর-পূর্ব ও উত্তর-পশ্চিমে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলে 'স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ' প্রতিষ্ঠা করা। বাংলার মুখ্যমন্ত্রি এবং তৎকালীন মুসলিম লীগ নেতা এ.কে ফজলুল হক ছিলেন এ প্রস্তাবের উপস্থাপক। এ প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পর ভারতের মুসলমান সম্প্রদায় ও তাদের দল মুসলিম লীগ সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক কর্মসূচি ও দিকনির্দেশনা লাভ করে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। লাহোর প্রস্তাবে ব্যক্ত রাষ্ট্রচিন্তার পথ ধরেই তৎকালীন পাকিস্তান ও পরবর্তীতে পাকিস্তান ভেঙে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ১৯৪০ সালে গৃহীত 'লাহোর প্রস্তাব' পরবর্তীতে পরিবর্তিত হয়। এবং রাষ্ট্রসমূহ স্থানে রাষ্ট্র কথাটি যুক্ত করা হয়। আর এ ভাবেই মূল লাহোর প্রস্তাবে সেখানে ভারতবর্ষের মুসলামন সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে "স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহের" যে কথা বলা হয়েছিল, তা বাতিল করে একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url