ইসলামের দৃষ্টিতে যৌথ চাষাবাদ
ইসলামের দৃষ্টিতে যৌথ চাষাবাদ
◆ পাঠ-২: বর্গা প্রথা উচেছদের সমস্যাগুলো বলতে পারবেন
◆ পাঠ-২: ইসলাম বর্গাচাষ সম্পর্কে কি নীতি । অবলম্বন করে তা উল্লেখ করতে পারবেন।
◆ পাঠ-৩: বর্গাচাষ বা অপরের জমি চাষাবাদ সম্পর্কে ইমাম আবু হানীফা (র)-এর মতবাদ উল্লেখ করতে পারবেন।
◆ পাঠ-৪: বর্গাচাষ সম্পর্কে ১৯৮৪ সালের ভূমি সংস্কার আইনে যে নীতি গ্রহণ করা হয়েছে তার বিবরণ দিতে পারবেন।
ভূমিকা
বর্গাচাষ বা যৌথ চাষাবাদ সম্পর্কে অর্থনীতিবিদগণ দুইভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। তাঁদের মধ্যে একাংশ মনে করেন, দেশের উন্নতির স্বার্থে বাংলাদেশ হতে বর্গাদারী প্রথা তুলে দেয়া উচিত। কেননা বর্গাদারী প্রথায় সুবিধার চেয়ে অসুবিধা অনেক বেশি। আবার একাংশ মনে করেন, বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ না করে বর্গাদারী ব্যবস্থা হঠাৎ বাতিল করা উচিত হবে না। কারণ-
বড় বড় জমির মালিকরা যান্ত্রিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ শুরু করলে বহুলোক বেকার হয়ে পড়বে। এতে সমস্যা সমাধানের চেয়ে সমস্যা আরো প্রকট হয়ে দেখা দেবে।
- দেশে পতিত জমির পরিমাণ বেড়ে যাবে।
- দেশে ফসল উৎপাদনের হার কমে যাবে।
- গরীব শোষণের মাত্রা আরো বেড়ে যাবে।
- ভূমিহীন প্রান্তিক চাষীগণ বেকার হয়ে পড়বে নতুবা ক্ষেতমজুরে পরিণত হবে।
দেশে শিল্পোন্নয়ন যত বেশি হবে ততই কর্মসংস্থানের পরিমাণ বেড়ে গিয়ে বেকারত্ব কমে যাবে, তাতে ভূমিহীন ও প্রান্তিক চাষীদের কর্মসংস্থান হবে। তখন লোকজন বর্গাচাষ করতে আর এগিয়ে আসবে না। তখন বর্গাদারী প্রথা এমনিতেই উঠে যাবে। দেশ থেকে যতদিন বর্গাদারী প্রথা উঠে না যায় ততদিন বর্গাদারের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ১৯৮৪ সালের ভূমি সংস্কার আইনে বর্গাচাষীদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য বেশ কিছু ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেছে। সেগুলো নিম্নে আলোচনা করা হলো:
১. ২৬-৩-১৯৮৪ তারিখে যারা কোন জমিতে বর্গাচাষী হিসেবে জমি চাষ করেছেন তারা বর্গাদার হিসেবে আইনগত স্বীকৃতি পাবেন।
২. জমির মালিক জমি বিক্রি করতে চেষ্টা করলে বর্গাদারকে জমি ক্রয়ে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
৩. জমির মালিক শ্রম ব্যতীত বাকি খরচ বহন করলে তিনি ফসলের ৬৬.৬৭% ভাগ পাবে, বর্গাদার পাবে ৩৩.৩৩% ভাগ।
8. বর্গাদার জমি ক্রয় করতে অপরাগতা প্রকাশ করলেও জমিতে তার বর্গাধিকার মোট পাঁচ বছর বহাল থাকবে। যিনি জমি ক্রয় করবেন তাকেও বাকি পাঁচ বছরের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
৫ জমির মালিক কোন খরচ বহন না করলেও তিনি পাবেন ৩৩.৩৩% ভাগ এবং বর্গাদার পাবে ৬৬.৬৭% ভাগ।
৬. জমির মালিক ও বর্গাদার শ্রম ছাড়া বাকি সব খরচ বহন করলে জমির মালিক পাবে ফসলের ৫০% এবং বর্গাদার পাবে ৫০% ভাগ।
ইসলামের দৃষ্টিতে বর্গাচাষ
ইসলামের দৃষ্টিতে বর্গাচাষ সম্পর্কে হানাফী মাযহাবের ইমামগণ দু'দলে বিভক্ত হয়েছেন। এক মতে বর্গাদারী প্রথা হারাম। ইমাম আযম আবু হানীফা (র) ও ইমাম মুহাম্মদ (র) এ মতের প্রবক্তা।
বর্গাচাষ সম্পর্কে ইমাম আবু হানীফা (র)-এর মতামত নিম্নে তুলে ধরা হলো:
ইমাম আবূ হানীফা (র) বর্গাচাষ সম্পর্কে বলেন-
অর্থাৎ "এক-তৃতীয়াংশ ও এক-চতুর্থাংশ ফসলের বিনিময়ে বর্গা দেয়া বাতিল কাজ"। তিনি বলেন- অর্ধেক বা এক-পঞ্চমাংশ বা যে কোন পরিমাণ ফসলের বিনিময়ে বর্গাদারী প্রথা জায়েয হবে না। তবে যেহেতু হাদীস শরীফে ثلث ও ربع শব্দদ্বয় উল্লেখ আছে তাই তিনি তাঁর ফতোয়ায় এক-তৃতীয়াংশ বা এক-চতুর্থাংশের কথা উল্লেখ করেছেন। তা না হলে তিনি সব রকমের বর্গাদারী প্রথা হারাম একথাই বলতেন।
হাদীস শরীফে এসেছে- অর্থাৎ নবী (সা) মুখাবারাহ নিষেধ করেছেন। মহানবী (সা)-কে مخابره সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন- المزارعة بالثلث والربع-তৃতীয়াংশ ও এক-চতুর্থাংশের বিনিময়ে জমির বর্গাদান। মহানবী (সা)-এর এ বাণী ব্যাখ্যা হিসেবে তিনভাগে এক অংশ, চার ভাগের এক অংশ, দুই ভাগের এক অংশ, পাঁচ ভাগের এক অংশ ও ছয় ভাগের এক অংশ ইত্যাদি যে কোন ভগ্নাংশকে ধরা হয়েছে এজন্যই ইমাম আবু হানীফা (রহ) বর্গাদারী প্রথা স্বীকার করেন না। ইমাম আবু ইউসুফ (র) ও ইমাম মুহাম্মদ (র)-এর মতামত: ইমাম আবু ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মদ (র) বলেন-বর্গাদারী প্রথা জায়িয। তবে বর্গাদারীর চারটি অবস্থা রয়েছে। যেমনঃ
প্রথমত: অর্থাৎ "যখন জমি ও বীজ এক ব্যক্তির হয় আর শ্রম ও গরু অপর ব্যক্তির হয়, তখন বর্গাদারী জায়েয হবে।"
দ্বিতীয়ত: অর্থাৎ "যখন জমি এক ব্যক্তির এবং গরু বীজ এবং শ্রম অপর ব্যক্তির তখন বর্গাদারী প্রথা জায়িয হবে।"
তৃতীয়ত: অর্থাৎ- "যখন জমি ও গরু একজনের এবং শ্রম ও বীজ অন্যজনের, তখন বর্গাদারী প্রথা জায়িয হবে।"
চতুর্থত: অর্থাৎ- "যদি জমি একজনের এবং গরু, বীজ ও শ্রম এন্যজনের হয় তখন বর্গাদারী প্রথা বাতিল হবে।"
তারা বলেন- "সময় নির্দিষ্ট না হলে এবং উৎপন্ন ফসল দুজনের মধ্যে ভাগ না হলে বর্গাদারী প্রথা জায়িয হবে না।" বর্গাদারী ব্যবস্থাকে যারা জায়িয বলেন, তাদের মতে বর্গাদারী এক ধরনের ইজারা বা তাড়া। প্রথম অবস্থায় জমি ও বীজের মালিক বর্গাদারকে কৃষিকাজের জন্য ইজারা দিয়েছে এবং উৎপন্ন ফসলের একটি অংশ মজুরি হিসেবে নির্ধারণ করেছে এবং সে নিজের গরু নিয়ে মজুরি করেছে। দ্বিতীয় অবস্থায় বীজওয়ালা চাষের জন্য জমি ইজারা নিয়েছে এবং উৎপন্ন ফসলের একটি অংশ মজুরি হিসেবে নির্ধারণ করেছে, আর তৃতীয় অবস্থায় বীজওয়ালা বর্গাদারকে কৃষিকাজের জন্য মজুরি হিসেবে নিয়েছে এবং উৎপন্ন শস্যের একটি অংশ মজুরির জন্য নির্ধারণ করেছে। এজন্য এসব অবস্থায় বর্গাদারী প্রথা জায়িয। কিন্তু চতুর্থ অবস্থায় বর্গাদার জমি ও গরু উভয়ই ইজারা নিয়েছে এবং উৎপন্ন শস্যের একটি অংশ মজুরি হিসেবে নির্ধারণ করেছে এবং একটি গরু মজুরি হিসেবে যাচ্ছে যা জায়িয নয়।
বর্গাদারী প্রথা সম্বন্ধে প্রখ্যাত ইসলামি অর্থনীতিবিদ শামছুল আলম বলেন, "জমির মালিক সেই, যে জমি চাষ করতে পারে।" তার মতে, লাঙ্গল যার জমি তার। তিনি আরো বলেন- অনুপস্থিত মালিকানা বৈধ নয়। কোন কোন ফকীহ্ বর্গাদারী প্রথা জায়িয মনে করলেও তিনি ইমাম আযমের মতকেই প্রাধান্য দিয়ে অচাষী মালিকানাকে অবৈধ মনে করেন। তার মতে, বর্গাদারী প্রথা এক ধরনের শোষণ। প্রখ্যাত ইসলামি ব্যক্তিত্ব মাওলানা আব্দুর রহীমের মতে, "বর্গাদারী কোন শোষণ নয়।" তিনি দৃষ্টান্ত স্বরূপ খায়বরের বিজিত জমি ইয়াহুদীদের কাছে বর্গা দেয়া এবং ফাদাকের জমিও বর্গা বন্দোবস্ত দেয়াকে নজির হিসেবে গ্রহণ করেছেন, তাছাড়া মদীনায় আনসারদের জমিও বন্দোবস্ত দেয়াকে নজির হিসেবে গ্রহণ করেছেন। মাওলানা আব্দুর রহীম বলেন, সম্প্রতি খোয়া উঠেছে যে, "লাঙ্গল যার জমি তার, যে নিজে জমি চাষ করবে না জমির ফসলের উপর তার কোন অধিকার নেই এবং এসব শ্লোগানের মাধ্যমে যে নতুন ভূমিনীতি প্রচার করা হচ্ছে তা আর যাই হোক ইসলামি ভূমিনীতি নয়। তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।" এসব মন্তব্যে দেখা যায়, তিনি তাঁর বিরুদ্ধ মতকে ইসলাম সম্মত বলতে নারাজ। এ ধরনের বক্তব্য মেনে নেয়া মুশকিল। কারণ বর্গাদারী প্রথা ইমাম আবু হানীফা (র)-এর মতে বৈধ নয়। তবে কি ইমাম আবু হানীফা (র)-এর মতামতকে ইসলাম বিরোধী বলতে হবে?
ইমাম আবূ হানীফা (র) ও তাঁর দুই ছাত্র ইমাম আবু ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মদ (র) এ ক্ষেত্রে পরস্পর বিরোধী ফতওয়া দিলেও কেউ কাউকে ইসলাম বিরোধী বলেননি।
ইমাম আবু হানীফা (র)-এর বর্গাদারী মতামত সম্পর্কে মাওলানা আব্দুর রহীম বলেন- "ইমাম আবু হানীফা (র) থেকে এ সম্পর্কে নিষেধ ও নেতিবাচক যে উক্তি বিভিন্ন কিতাবে উল্লেখিত হয়েছে তা তার সাধারণনীতি নয়।তিনি কেবল ইরাকের শস্য-শ্যামল উর্বর ভূমির ক্ষেত্রেই পারস্পরিক কৃষিনীতি সমর্থন করেননি। তার কারণ এই নয় যে, তিনি নীতিগতভাবে এটাকে সংগত বলে মনে করতেন না। বরং এর প্রকৃত কারণ হলো উল্লিখিত ভূমিগুলো রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি ছিল না। সেখানকার জিম্মিদের মালিকানায় জমি ছিল। তা অনিশ্চিত ছিল এবং সে সম্পর্কে বিশেষ মতভেদ ছিল কাজেই তা কোন ব্যক্তির পক্ষে খরিদ করা এবং অপরের দ্বারা চাষ করানোকে তিনি সমর্থন করেন নি। অন্যথায় অপরের জমি চাষ করানোকে তিনি কখনো নিষিদ্ধ বলে মনে করতেন না।"
উপরে বর্ণিত ইমাম আবূ হানীফারর মতামত নিম্নলিখিত কারণে সমর্থন করা যায় না। যেমন-
- ইমাম আযম (র)-এর মতামত শুধু ইরাকের বেলায় প্রযোজ্য, অন্যত্র নয়। এই মতের সমর্থনে কোন দলীল বা প্রমাণ উপস্থিত করা হয়নি।
- ইমাম আযমের মতামত পূর্বেই কুদুরী গ্রন্থ থেকে উল্লেখ করা হয়েছে, তাঁর এ মতামত ছিল হাদীস ভিত্তিক। নবী করীম (সা)-এর সংশ্লিষ্ট হাদীসটি শুধু ইরাকের বেলায় প্রযোজ্য, অন্যত্র নয়। কথাটি যুক্তিসঙ্গত নয়।
- ইরাকী জমির মালিক ছিল জিম্মিগণ। এজন্য বর্গাচাষ যদি হারাম হয় তবে খায়বার বা ফাদাকে জমির মালিকও ছিল জিম্মিগণ অর্থা ইয়াহুদীগণ, তাহলে খায়বার ও ফাদাকের জমিগুলোও বর্গার আওতায় আসা উচিত ছিল না।
সমসাময়িক অবস্থা পর্যালোচনা করলে একথাই স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, বর্গাচাষের ব্যাপারে আরব ও আরবের বাইরের জমিতে পার্থক্য করা হয়েছিল। আরবের জমির মালিকানা ইসলামি রাষ্ট্র ও মুসলমান মুজাহিদগণকে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু আরবের মুজাহিদগণের কোন মালিকানা স্বত্ব বৈধ করা হয়নি বরং জমির চাষীগণকেই মালিক করা হয়। এমতাবস্থায় ইমাম আবু হানীফার (রহ)-এর উক্ত বক্তব্য গ্রহণ করা যায় না।
এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url