ইসলামি অর্থনীতিতে উৎপাদন ব্যবস্থা


ইসলামি অর্থনীতিতে উৎপাদন ব্যবস্থা অর্থনীতির ভাষায় উৎপাদন কি  ইসলামি অর্থনীতিতে উৎপাদন ব্যবস্থা সম্পর্কে আলোকপাত উৎপাদনের উপকরণের বর্ণনা দিতে পারবেন।

অর্থনীতির ভাষায় উৎপাদন

ব্যাপক অর্থে উৎপাদন বলতে কোন কিছু সৃষ্টি করাকে বুঝায়। কিন্তু অর্থনীতিতে এর একটি বিশেষ অর্থ রয়েছে। কেননা মানুষ কোন কিছু সৃষ্টি বা ধ্বংস করতে পারে না। বরং তার গঠন-আকৃতি পরিবর্তন করে এক নতুন প্রকৃতি তৈরি করতে পারে। মানুষের এই নতুন আকৃতি সৃষ্টির নামই উৎপাদন।

প্রাচীন অর্থনীতিবিদদের মতে, মৌলিক (Material) দ্রব্যসামগ্রীর নতুন সৃষ্টিই উৎপাদন।

মার্শাল বলেন- এ পৃথিবীতে মানুষ নতুন কিছু সৃষ্টি করতে পারে না। কোন বস্তুর মৌলিক অবকাঠামোকে নতুন রূপে পরিবর্তন করতে পারে মাত্র।

আধুনিক অর্থশাস্ত্রবিদগণের মতে, ব্যাবহার উপযোগী কোন সামগ্রী তৈরিই উৎপাদন।

Cain Cross Zvi Introduction to Economics গ্রন্থে বলেন- The making of good for sale or the rending of paid services.

অতএব উৎপাদন হল- নির্দিষ্ট সময়ে মানবীয় শ্রম-শক্তি ও মৌলিক বস্তুর (Material Thinks) সন্নিবেশন ও উত্তম বস্তু সৃষ্টির প্রচেষ্টা যা মানুষের অভাব পূরণ করে। আর এ শ্রম বা প্রচেষ্টা বস্তুর আকৃতি দাংস বা পরিবর্তন করেও হতে পারে আবার তাকে স্থানান্তর বা গুদামজাতকরণের মাধ্যমেও হতে পারে। একই ভাবে ব্যক্তি কর্তৃক অন্য ব্যক্তির প্রগতির প্রচেষ্টাও হতে পারে। যেমন- শিক্ষা ও চিকিৎসা।

ইসলামি অর্থনীতিতে উৎপাদন ব্যবস্থা

১. উৎপাদনে উৎসাহ দানঃ ইসলাম মানুষকে উৎপাদনে উৎসাহ প্রদান করেছে। রাসূল (সা) বলেন-

"যখন কোন মুসলমান বীজ বপন করে অথবা শস্য উৎপাদন করে এবং তা থেকে কোন পাখি বা মানুষ অথবা প্রাণি ভক্ষণ করে তখন ওটা ঐ মুসলিম ব্যক্তির জন্য সাদকাহ বা দান হয়ে যায়।" 
( বুখারী ও মুসলিম )

অত্র হাদীসে মুসলিম ব্যাক্তিকে উৎপাদনের প্রতি উৎসাহ দেয়া হয়েছে। তার এ উৎসাহ শুধুমাত্র ইহকালিন সুখ সমৃদ্ধির মধ্যেই সীমিত নয় বরং পরকালিন শান্তিতেও বিস্তৃত।

মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে উৎপাদন ও শ্রমকে ঈমানের সাথে সম্পর্কিত করেছেন এবং একে ইহ ও পরকালিন সৌভাগ্যের মাপকাঠি নির্ধারণ করেছেন। তিনি বলেন:

"নারী ও পুরুষ যে কেউ সৎকর্ম সম্পাদন করবে এমতাবস্থায় যে সে মুমিন, আমি তাকে পবিত্র জীবন দান করব এবং তাদেরকে তাদের কর্মের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার দান করবো।" (সূরা আন- নাহল:৯৭)

২. ইবাদতের সাথে উৎপাদনের সম্পর্ক:
অন্যত্র আল্লাহ বলেন:


তিনিই তো তোমাদের জন্য পৃথিবীকে সুগম করেছেন; অতএব তোমরা তার দিগ-দিগন্তে বিচরণ কর এবং তাঁর দেয়া রিঝক আহার কর। আর তাঁর কাছেই তো পুনরুত্থান হবে।" (সূরা আল-মুলক: ১৫)

তিনি আরো বলেন:

"যখন নামায শেষ হবে তখন তোমরা ভূখন্ডে ছড়িয়ে পড় এবং আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান করবে ও তাকে অধিক স্মরণ করবে যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার।" (সূরা আল-জুমুআহ: ১০)

রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন-

"যে ব্যক্তি নিজ হাতে উৎপাদন ও শ্রম করতে যেয়ে ক্লান্ত ও অবসাদগ্রন্থভাবে সন্ধ্যায় ফিরে আসে কিয়ামত দিবসে তাকে নিষ্পাপ অবস্থায় উঠানো হবে।" (তাবরানীঃ আল-আওসাত)

আল-কুরআনে মহান আল্লাহ রিযক অন্বেষণকারীকে আল্লাহর পথে সংগ্রামকারীর পর্যায়ভুক্ত ঘোষণা করেছেন:

"কেউ কেউ আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধানে দেশভ্রমণ করবে এবং কেউ কেউ আল্লাহর পথে লড়াই করবে।" (সূরা আল-মুযযাম্মিল: ২০)

কোন কোন স্থানে রাসূল (সা) রিযক অন্বেষণের প্রচেষ্টাকে ইবাদত বন্দেগীর উচ্চতর স্তর হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তাঁর সম্মুখে এমন এক ব্যক্তি সম্পর্কে আলোচনা করা হচ্ছিল যে ব্যক্তি অধিক মাত্রায় ইবাদত করে, তখন রাসূল (সা) বললেন, তার ভরণপোষন কে করে? সাহাবীগণ বললেন, তার ভাই। রাসূল (সা) বললেন:

তার ভাই তার চেয়ে অধিক ইবাদতকারী। ( সুয়ূতী জামে উসসগীর )

৩. পৃথিবী আবাদকরণের নির্দেশ: মহান আল্লাহ এ পৃথিবী এবং এর মধ্যকার সবকিছু মানুষের জন্য বাধ্যগত করেছেন। গোটা বিশ্বপ্রকৃতিতে ছড়ানো ছিটানো আল্লাহর অনুগ্রহ রাজির একত্রিকরণ ও এসব উপকরণকে ব্যবহারের মাধ্যমে উৎপাদন সৃষ্টি এবং পৃথিবী আবাদ করা মানুষের অন্যতম দায়িত্ব। এ পৃথিবীতে মানুষকে আল্লাহর খলিফা হিসেবে এ দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে:

"আমি ছামুদ জাতির কাছে তাদের ভাই সালেহকে প্রেরণ করেছিলাম। সে বলল, হে আমার গোত্র। তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর, তিনি ছাড়া তোমাদের কোন ইলাহ নেই। তিনি তোমাদেরকে মাটি থেকেই সৃষ্টি করেছেন এবং তাতেই তোমাদের বসতি স্থাপন করেছেন।" ( সূরা হুদ: ৬১ )

এ আয়াতে পৃথিবী আবাদ করার নির্দেশ এসেছে। আয়াতটির ব্যাখ্যায় ইমাম শাওকানী বলেন- তিনি তোমাদেরকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং গৃহ নির্মাণ ও গাছ রোপনের মাধ্যমে পৃথিবীকে আবাদ করার নির্দেশ দিয়েছেন- (তাফসীরে ফাতহুল কাদীর, ২/৫০৭)। এটাই উৎপাদনের নির্দেশ। কেননা পৃথিবী আবাদকরণের নির্দেশ পরোক্ষভাবে উৎপাদনের নির্দেশ বহন করে এজন্য যে, উৎপাদন ব্যতীত পৃথিবী আবাদ করণ সম্ভব নয়।

৪. পৃথিবীতে আল্লাহর খিলাফত পরিচালনায় উৎপাদনঃ পৃথিবীতে আল্লাহর খিলাফতকার্য পরিচালনার জন্য মানুষের পরস্পরের সাহায্যের প্রয়োজন রয়েছে। আল্লাহ মানুষকে পৃথিবীতে খলীফা হিসেবে মনোনয়ন দিয়েছেন। তিনি বলেন-

"স্মরণ কর, যখন তোমার প্রতিপালক ফিরিশতাকুলকে বললেন, আমি পৃথিবীতে খলীফা বানাতে যাচ্ছি।" (সূরা আল-বাকারা :৩০)

খিলাফত পরিচালনার সাথে ইসলামি অর্থনীতির গভীর সম্পর্ক রয়েছে। কেননা আল্লাহ পৃথিবীর সব কিছু মানুষের অধিনস্ত করে দিয়েছেন।

অত্র আয়াতে মহান আল্লাহ খলীফা শব্দটি ব্যাবহার করেছেন। যার ভাবার্থ আমি পৃথিবীতে আমার খলীফাদের সৃষ্টি করেছি। যাদের একে অন্যের স্থলাভিষিক্ত হবে, যতে করে তাদের খিলাফত চিরকাল থাকবে। ইসলামের দৃষ্টিতে খিলাফত একটি আক্বীদাগত ব্যাপার, যা মুসলিম ব্যক্তির আচার-অনুষ্ঠান ও চাল-চলনে পরিদৃষ্ট হবে। আর মুসলিম ব্যক্তির আচার-অনুষ্ঠান এমন হবে যার মাধ্যমে তাকে খিলাফতের ভার বহন করতে সহায়তা করবে। এজন্য মহান আল্লাহ মানব জাতিকে তাদের জীবিকা নির্বাহের ব্যায়ের সাথে খিলাফতের উল্লেখ করেছেন, যাতে ধন-সম্পদের মালিক একচেটিয়াভাবে নিজের অধিকার মনে না করে, বরং এটা দৃঢ় বিশ্বাস করে যে, ঐ মালের মধ্যে অন্যেরও হক রয়েছে। আল্লাহ বলেন:

"আল্লাহ তোমাদের যে ধন-সম্পদের উত্তরাধিকারী বানিয়েছেন তা থেকে তোমরা ব্যয় কর।" 
( সূরা আল-হাদীদ: ৭ )

অত্র আয়াতে এটাই বোঝা যায় যে, মানব জাতি পৃথিবীতে আল্লাহর খলীফা হিসেবে কাজ করছেন। পৃথিবীতে যে সব ধন-সম্পদ আছে তারা তার ব্যাবহার করতে পারবে। কিন্তু একই সময় তারা আল্লাহ কর্তৃক নির্দেশিত আদেশ-নিষেধের সম্মুখীন হবে। সুতরাং সে অযথাও খরচ করতে পারবে না আবার অতিরিক্ত কৃপণতাও দেখাতে পারবে না। বরঞ্চ দুয়ের মধ্যবর্তী অবস্থা গ্রহণ করবে।

পৃথিবীতে খিলাফত পরিচালনার জন্য মানুষের যে কাজ করা অবশ্য করণীয় তা নিম্নরূপ:

১. নিজ ধন সম্পদে জনগোষ্ঠীর অধিকারের কথা মনে রাখতে হবে। কেননা খিলাফত-এর মানেই হল, কোন জিনিসে তার একচেটিয়া মালিকানা নেই। সুতরাং ইসলাম সম্পদের মালিকদের সঠিক পথে মালের উৎপাদন ও ব্যবহার করার নির্দেশ দেয়। যেমন: উৎপাদন ক্ষেত্রে সুদ, গুদামজাতকরণ ও এমন কাজ থেকে নিষেধ করে, যা সমাজের জন্য ক্ষতিকর। আবার ব্যবহারের বেলায় অযথা খরচ ও অতিরিক্ত কৃপণতা করতে নিষেধ করে।

২. সম্পদের মালিককে মনে রাখতে হবে যে, তার সম্পদের একটি অংশ তাকে যাকাত দিতে হবে। সুতরাং মুসলিম ব্যক্তি তার ধন-সম্পদের একক মালিক নয়, বরং সে হল উহার ধারক ও বাহক। কারণ তার মালের মধ্যে যাকাত তথা ফকীর, মিসকীন ও অন্যান্যদের হক রয়েছে।

খিলাফত প্রতিষ্ঠা করতে গেলে মানুষ একে অন্যকে সাহায্য করবে। সুতরাং উৎপাদনের ক্ষেত্রে ইসলামের বিধি-নিষেধ মানতে হবে। সমাজে সম্পদ পূঞ্জীভূত ও গুদামজাত করা যাবে না, সুদের আশ্রয় নেয়া যাবে না, অযথা খরচ করা যাবে না। কেউ মালের উৎপাদন ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে এ জাতীয় অন্যায়ের আশ্রয় নিলে তাকে বাধা দান করতে হবে। যাতে পৃথিবীতে আল্লাহর সঠিক খিলাফত প্রতিষ্ঠিত হয় এবং মানব সমাজের কল্যাণ রক্ষিত হয়। (ড. মুহাম্মদ ফারুক আননাবহানী: আল-ইত্তেজাহ আল-মেজায়ী: ১২ ও ড. মাহমুদ বাবেলী: আল-ইকতেছাদ: ৯৭)

৪. মৃত জমিন পুনরুজ্জীবিত করা: মৃত জমিন বা পতিতভূমিতে গাছ রোপন, শস্য উৎপাদন, গৃহ নির্মাণ ইত্যাদির মাধ্যমে আবাদ করার প্রতি ইসলাম মানুষকে উৎসাহ প্রদান করে। আল-কুরআনে আল্লাহ তা'আলা এটাকে তাঁর অস্তিত্বের অন্যতম নিদর্শন বলে উল্লেখ করেছেন।

 "তাদের জন্য একটি নিদর্শন হল মৃত পৃথিবী, আমি একে জীবিত করি এবং তা থেকে উৎপন্ন করি শস্য যা তারা ভক্ষণ করে।" ( সূরা ইয়াসিন: ৩৩ )

ইসলামি অর্থনীতিতে পতিত ভূমি যে আবাদ করবে সেটা তার মালিকানা বলে স্বীকৃত হবে। রাসূল (সা) বলেনঃ

"যে কোন ব্যক্তি মৃত অর্থাৎ অনাবাদী জমিকে জীবিত করবে সেটা তারই হবে। অন্য কেউ যদি তা থেকে খায় তবে তা তার জন্য সাদকাহ হবে।" (আহমদ ও নাসাঈ) পতিতভূমি বলতে ঐভূমিকে বলা হয় যা কোন ব্যক্তি মালিকনাভুক্ত নয় বা সামষ্টিক সম্পত্তিও নয় বা জনসাধারণ উপকৃত হয় এমন সাধারন ভূমিও নয়।

মৃতভূমি পূনরুজ্জীবিত করার শর্তাবলী

১. তা কোন মুসলিম ব্যক্তি অথবা মুসলিম বিশ্বে বসবাসরত আহলুজ্জীম্মার মালিকানাধীন হবে না।

২. তা শহর বা লোকালয়ে হবে না। যা দ্বারা ভবিষ্যতে উপকৃত হওয়ার আশা পোষণ করা যেতে পারে।

৩. তা সর্বসাধারণের উপকারের জায়গা হতে পারবে না। যেমন: হাট-বাজার, নদী-নালা ইত্যাদি।

৪. তা জীবিতকরণের সময়সীমা সুন্নাত মোতাবেক তিন বছরের অধিক হতে পারবে না। তবে হ্যাঁ সমাজের মঙ্গলার্থে যদি বেশী সময় লেগে যায় তবে অতিরিক্ত সময়ের অনুমতি দেয়া যেতে পারে।

৫. ইমাম বা শাসকের অনুমতি নিতে হবে।

৬. তা পুনরুজ্জীবিতকারী এমন যোগ্য তার অধিকারী হতে হবে যাতে সে ভূমি পূনরুজ্জীবিত করতে পারে। অন্যথায় তার থেকে ঐ জমি কেড়ে নিয়ে মুসলমানদের কল্যাণে ব্যবহার করতে হবে।

পতিতভূমি পুনরুজ্জীবিতকরণের উপকারিতা
১. সমাজের জনগোষ্ঠীর প্রতিটি ব্যক্তিকে কর্মে উৎসাহ দান করা এবং পতিতভূমি থেকে মুনাফা ভোগ করা।

২. বেকার সমস্যা লাঘব করা। কেননা অধিক পতিত জমি আবাদ হলে কর্মসংস্থান বেড়ে যাবে, যাতে বেকার সমস্যা দূর হবে।

৩. সমাজে ব্যক্তি মালিকানার সম্প্রসারণ ঘটে। যাতে সমাজে খাদ্যের ঘাটতি হ্রাস পায় এবং রাষ্ট্রে আমদানী-রপ্তানী বেড়ে যায়। এ ছাড়া পূনরুজ্জীবিতকারীর সম্পদ থেকে রাষ্ট্রে যাকাত, ওশর (ফসলের এক-দশমাংশ) ও জমির খাজনা (যদি ওশর ও খাজনা বিষয়ক জমি হয়) রাজকোষে জমা করতে হবে। সাধারণ অর্থনীতিতে উৎপাদন ধারণায় এক ব্যাপক পার্থক্য বিদ্যমান। সাধারণ অর্থনীতিতে উৎপাদন তার উপকরণের উপর নির্ভরশীল। উৎপাদনের উপকরণসমূহের যথার্থ ব্যবহার ও প্রয়োগের মাধ্যমে উৎপাদন সম্ভব। কিন্তু ইসলামি অর্থনীতিতে শুধু এর মধ্যেই উৎপাদন প্রক্রিয়া সীমিত নয়, বরং সবকিছুর যথাযথ ব্যবহারের পরেই উৎপাদন সংক্রান্ত এক বিশেষ ধারণা প্রদান করা হয়। আর তা হল, উৎপাদনের ফলাফল সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী আল্লাহর উপর নির্ভরশীল।

"তোমরা যে বীজ বপন কর সে সম্পর্কে ভেবে দেখেছ কি? তোমরা তা উৎপন্ন কর না আমি উৎপন্ন কারি? আমি ইচ্ছা করলে তা খড়কুটায় পরিণত করতে পারি, তখন তোমরা হয়ে যাবে হতবুদ্ধি। তখন তোমরা বলবে, আমরা তো ঋণের চাপে পড়ে গেলাম বরং আমরা হৃতসর্বস্ব হয়ে পড়লাম।" 
( সূরা আল-ওয়াকিয়াঃ ৬৩-৬৭ )

উৎপাদনের উপকরণ

কোন দ্রব্য সৃষ্টি বা সেবামূলক কর্মে যেসব বস্তু-সামগ্রী ব্যবহৃত হয়ে থাকে তাকে উৎপাদনের উপকরণ বলা হয়। উৎপাদন প্রক্রিয়ায় যেসব উপকরণ ব্যবহৃত হয় তার মধ্যে কতকগুলো স্থির এবং কতকগুলো পরিবর্তনশীল। আর এ উপকারণ নিয়ে অর্থনীতিবিদদের মধ্যে একমতের অভাব রয়েছে।

পুজিবাদী অর্থব্যবস্থায় উপকরণগুলোকে মোট চার শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয়। যাথা- (১) জমি, (২) শ্রম, (৩) মূলধন ও (৪) সংগঠন। সংগঠনকে আধুনিক পরিভাষায় উদ্যোগ হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়। উৎপাদিত দ্রব্য ও সেবা থেকে প্রত্যেকটি উপকরণ তাদের প্রাপ্য অংশ পেয়ে থাকে এভাবে। জমির জন্য ভাড়া, শ্রমের জন্য মজুরী, মুলধনের জন্য সুদ এবং সংগঠন বা উদ্যোগের জন্য মুনাফা।

সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় উৎপাদনের উপকরণ একটিই তা হল শ্রম। দৈহিক, বুদ্ধিভিত্তিক বা পরিচালনাগত সকল প্রকার শ্রমই এর পর্যায়ভুক্ত। শ্রমের বিনিময়ে মজুরী প্রদান করা হয়। উৎপাদনের বাকী উপকরণসমূহ রাষ্ট্রীয় উপকরণ হিসেবে বিবেচিত হয়। রাষ্ট্র তার দৃষ্টিভঙ্গি ও পরিকল্পনার ভিত্তিতে তা পরিচালনা করে। কেননা এ অর্থব্যবস্থায় সমস্ত সম্পদের মালিকানা রাষ্ট্রের।

ইসলামি অর্থব্যবস্থায় উৎপাদনের উপকরণসমূহের শ্রেণীবিভাগ নিয়ে সকলে একমত নয়। ইসলামি অর্থনীতিবিদ আবু সাউদ সনাতন নিয়মই সমর্থন করেন। মুফতি মোহাম্মদ শফি মনে করেন, সংগঠনকে আলাদাভাবে উৎপাদনের উপকরণ হিসেবে দেখানোর কোন প্রয়োজনীয়তা নেই। কেননা এটা শ্রমেরই পর্যায়ভুক্ত। এম. এ. মান্নানের মতে, যেহেতু মূলধনের মধ্যে নানা ঝামেলা বিদ্যমান সেহেতু এটাকে উৎপাদনের উপকরণের তালিকা থেকে বাদ দেয়া উচিৎ। আল জুনায়েদ অন্যান্য উপকরণগুলোকে অপরিবর্তিত রেখে মূলধনকে মানবমূলধন ও মূলধনী সামগ্রী এ দুভাগে ভাগ করেছেন। (এম. এ. হামিদ: ইসলামি অর্থনীতি: ৭৭)

ড. সুয়াদ ইব্রাহীম সালেহ শ্রম, মূলধনও তাকওয়া এই তিনের মধ্যে উৎপাদনের উপকরণকে শ্রেণীবদ্ধ করেছেন। তাকওয়া বা আল্লাহভীতিকে আলাদা উপকরণ হিসেবে দেখানোর যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেয়। কেননা উৎপাদনের উপকরণ বলতে ঐ সব উপকরণ বুঝায় যা সরাসরি উৎপাদনের সাথে সম্পৃক্ত। কিন্তু তাকওয়া এমন এক গুণ যা ব্যক্তির সাথে সম্পৃক্ত। অতএব তাকওয়া উৎপাদকের গুণাবলী হিসেবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে উৎপাদনের উপকরণ হিসেবে নয়।

অর্থনীতিবিদ ড. মাহমুদ বাবেলী সময় (Time)-কে উৎপাদনের উপকরণ হিসেবে দেখেছেন। সময় মানব জীবনের এমন এক গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ যা প্রতিটি ব্যক্তির সমগ্র কাজের জন্য আবশ্যক। সতন্ত্রভাবে তাকে উৎপাদনের উপকরণ হিসেবে উল্লেখ করা অর্থনীতিবিদদের নিকট অপ্রয়োজনীয়।

উপকরণসমূহের শ্রেণীকরণ বিষয়ে ইসলামি অর্থনীতিবিদগণের মধ্যে এ ধরণের মতপার্থক্যের একমাত্র কারণ হল, কুরআন ও হাদীসে এ সম্পর্কে সরাসরি কোন কিছু না পাওয়া। অর্থনীতিবিদ এ. এইচ. এম. সাদেক দেখিয়েছেন যে, যদিও ইসলামি শরীয়াতে উপকরণের শ্রেণীবদ্ধকরণ সম্পর্কে সুস্পষ্ট কিছু বলা হয়নি, তবুও উপকরণের শ্রেণীকরণ সম্পর্কে সুস্পষ্ট ইংগিত পাওয়া যায়। উদাহরণ স্বরূপ ইসলামি শরীয়াহ থেকে এ তথ্য পাওয়া যায় যে, শ্রম নির্দিষ্ট মজুরীতে এবং পুনঃ ব্যবহারযোগ্য ভৌত সম্পত্তি (যেমন- দালান-কোঠা, যন্ত্রপাতি ও জমি) নির্দিষ্ট ভাড়ায় দেওয়া-নেওয়া করা যায়। এটারও অনুমোদন করা যায় যে, মূলধন ও উদ্যোক্তা লাভের পূর্বনির্ধারিত অংশ পাবে। ইসলামি অর্থনীতিতে এ দুটো উপকরণকে একত্র করা যায় না। কারণ মূলধন ও মুনাফার অংশ এক নয়, এটা পূর্বাহ্নেই নির্দিষ্ট করতে হয় এবং মূলধনকে লোকসানের (যদি হয়) ঝুঁকি বহন করতে হয়। কিন্তু উদ্যোক্তা এ ঝুঁকি থেকে মুক্ত। এ ধরনের শরীয়াহ ভিত্তিক ইংগিত থেকে উৎপাদনের উপকরণসমূহ নিম্নোক্তভাবে শ্রেণীবদ্ধ করা যায়। 
(এম. এ. হামিদ: ইসলামি অর্থনীতিঃ পৃ-৭৮)

১. শ্রম,

২. ভৌত সম্পত্তি

৩. মূলধন

৪. উদ্যোক্তা।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url