ফসলের যাকাত: উশর ও খারাজ

ভূমির প্রকারভেদ ভূমি রাজস্বের আইনগত ভিত্তি উশর ও নিসফুল উশর সম্পর্কে ধারণা খারাজ ও উশরের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করতে পারবেন।

ভূমিকা 

প্রত্যেক মানুষ ব্যক্তিগতভাবে খন্ড খন্ড ভূমি ভোগ দখলের মালিক হলেও ইসলামি রাষ্ট্র আল্লাহর পক্ষ থেকে তার খিলাফতের দায়িত্ব পালন করে। তাই খলিফার উপর রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব ও অধিকার বিরাজমান। ফলে জনসাধারণকে ভূমি ভোগের বিনিময়ে এক ধরনের কর প্রদান করা আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় যেমন ভোগকারীর উপর কর্তব্য, ইসলামি রাষ্ট্র ব্যবস্থায়ও অনুরূপ কর্তব্য।

ভূমির প্রকারভেদ

ইসলামি রাষ্ট্রের ভূমিকে প্রধানত দুভাগে বিভক্ত করা যায়- উশরি জমি ও খারাজী জমি।

উশরি জমি

যে জমির মালিক মুসলমান অথবা মুসলমানই যে জমি সর্ব প্রথম আবাদ ও চাষোপযোগী করে তুলেছে, অথবা যথারীতি যুদ্ধ করে যে সব জমি মুসলমানগণ দখল করেছে, এক কথায় যে জমির মালিক মুসলমান তা উশরি হিসেবে গণ্য।

খারাজী জমি

আর যে সকল জমির মালিক অমুসলিম, অমুসলিমগণই যে জমি আবাদ ও চাষোপযোগী করে তুলেছে অথবা ইসলামি রাষ্ট্র যেসব জমি অমুসলিমদের কাছ থেকে যুদ্ধের মাধ্যমে লাভ করার পর তাদের মতামত নিয়ে তাদেরকে চাষাবাদ করার জন্য হস্তান্তর করে দিয়েছে তা সবই 'খারাজী' জমি হিসেবে স্বীকৃত।

উশরি ও খারাজীর নামকরণ

'উশর' শব্দটি আরবী। এর অর্থ হচ্ছে এক-দশমাংশ। মুসলমানদের চাষাবাদকৃত জমিতে ফসলের এক-দশমাংশ (উশর) বা এক-দশমাংশের অর্ধেক (নিসফুল উশর) পরিমাণ রাজস্ব গ্রহণ করা হয় বলে একে ওশরি জমি বলে। আর 'খারাজ' শব্দটি আরবী শব্দ। খারাজা থেকে উৎপত্তি। খারাজা শব্দের অর্থ হল 'কর'। যেহেতু অমুসলিমদের জমির উপর 'কর' ধার্য করা হয় তাদেরকে ফসলের অংশ বিশেষ কর হিসেবে দিতে হয় না তাই তাদের ভোগকৃত জমিকে খারাজি জমি বলে। তবে অমুসলিমদের যে সব জমি মুসলমানদের হস্তগত হয়েছে তা যদি মুসলমানরা অমুসলিমদেরকে ফসলের অংশ বিশেষের ভিত্তিতে সাময়িকভাবে বর্গা চাষের জন্য প্রদান করে তাহলে অমুসলিমগণ ফসলের অংশ বিশেষ ইসলামি রাষ্ট্রকে প্রদান করবে। খাইবারের দখলকৃত জমিতে মহানবী (সা) তাই করেছেন।

ভূমি রাজস্বের আইনগত ভিত্তি

ইসলামি রাষ্ট্রের আয়ের উৎস হিসেবে ভূমির উপর রাজস্ব ধার্য করা হয়। আল্লাহ তাআলা ভূমি রাজস্ব সম্পর্কে কুরআন মাজীদে বলেন-

 "তোমরা যা উপার্জন কর এবং আমি যা ভূমি হতে তোমাদের জন্য উৎপাদন করি তন্মধ্যে যা উৎকৃষ্ট তা ব্যয় করো।" ( সূরা আল-বাকারা: ২৬৭ )

এ আয়াতের প্রথম অংশ হতে প্রমাণিত হয় যে, যাবতীয় নগদ ধন-সম্পদ বা টাকা পয়সার উপর যাকাত ফরয হয়। শেষাংশ হতে ভূমি রাজস্ব বা উশর দেয়ার আদেশ প্রমাণিত হয়। মুসলমানদের জমি থেকে রাজস্ব হিসেবে যে ফসল নেওয়া হয় তা ভূমির যাকাত হিসেবে গণ্য।

ভূমি রাজস্ব আদায় করার আদেশ নিম্নলিখিত আয়াতে অধিক সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। আল্লাহ বলেন-

"যখন তা ফলবান হয় তখন এর ফল আহার করবে আর ফল তোলার দিনে এর হক আদায় করবে এবং অপচয় করবে না। নিশ্চয় তিনি অপচয়কারীদের পছন্দ করেন না।" (সূরা আল-আনয়াম: ১৪১)

এখানে 'হক' অর্থ জমির ফসল ভোগ করার বিনিময়। এটা আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত এবং ইসলামি রাষ্ট্রের বায়তুল মালে এটা আদায় করতে হবে।

ভূমি রাজস্বের প্রকার

ইসলামি রাষ্ট্রের ভূমি থেকে তিন ধরনের রাজস্ব আদায় করা হয়। যেমন- (১) উশর, (২) নিসফুল উশর, (৩) খারাজ।

উশর

পূর্বে আলোচনা করা হয়েছে যে, ওশর মানে এক-দশমাংশ। মুসলমানরা যে সকল জমির মালিক এবং যা আবাদ ও চাষোপযোগী করা হয়েছে। চাষাবাদ করার সময় নিজের খরচে সেচ দেয়ার প্রয়োজন হয়নি বরং উক্ত জমি বৃষ্টি, ঝর্ণাধারা বা নদীর পানিতে সেচের কাজ সম্পাদিত হয়েছে। এ ধরনের জমিতে ওশর বা এক-দশমাংশ ফসল ইসলামি সরকারকে ভূমি রাজস্ব হিসেবে দিতে হয়। এ ব্যাপারে রাসূল (সা) ইরশাদ করেন-

যে সকল জমি বৃষ্টি, ঝর্ণাধারা বা খালের পানিতে সিক্ত হয় কিংবা যা স্বতই সিক্ত হয়ে থাকে সে জমিতে উৎপাদিত ফসলের এক-দশমাংশ এবং যে জমি পানি সেচের মাধ্যমে সিক্ত হয় তার বিশ ভাগের একভাগ ফসল রাজস্বরূপে দিতে হবে। ( আবু দাউদ )

হযরত মুয়ায ইবনে জাবাল (রা)-কে ইয়ামানের শাসনকর্তা নিযুক্ত করে নবী করীম (সা) যে নিয়োগ পত্র দিয়েছিলেন, তাতে তিনি বলেন-

মুসলমানদের জমি হতে উৎপাদিত ফসলের এক-দশমাংশ রাজস্ববাবদ আদায় করবে। এ রাজস্ব সে জমি হতে গ্রহণ করা হবে, যা বৃষ্টি বা ঝর্ণার পানিতে স্বাভাবিকভাবে সিক্ত হয়, কিন্তু যেসব জমিতে স্বতন্ত্রভাবে বালতি ইত্যাদি দ্বারা পানি দিতে হয় তা হতে এক-দশমাংশের অর্ধেক (বিশ ভাগের এক ভাগ) রাজস্ব বাবদ আদায় করতে হবে।

অনুরূপভাবে হেমইয়ার-এর রাজার নিকট প্রেরিত ফরমানেও রাসূল (সা) বলেছিলেন, আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের আনুগত্য স্বীকার কর, নামায পড়, যাকাত দাও, গনীমতের মাল হতে এক-দশমাংশ আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের জন্য আদায় কর। এতদ্ব্যতীত ভূমি রাজস্বও দিতে থাক। যে ভূমি বৃষ্টি বা ঝর্ণার পানিতে বিনা পরিশ্রমে ও অতিরিক্ত ব্যয় ব্যতীত সিক্ত হয়, তার এক-দশমাংশ ফসল এবং সেচ ব্যবস্থার সাহায্যে কৃত্রিম উপায়ে সিক্ত জমির বিশ ভাগের একভাগ ফসল ভূমি রাজস্ব বাবদ আদায় করতে থাক।

নবী করীম (সা) হযরত মায়ায ইবন জাবাল (রা)-কে ইয়ামেনের ট্যাক্স কালেক্টর হিসেবে নিযুক্ত করে পাঠিয়েছিলেন এবং খেজুর, গম, যব, আংগুর বা কিশমিশ হতে এক-দশমাংশ বা তার অর্ধেক রাজস্ব বাবদ আদায় করার নির্দেশ দিয়েছিলেন।

ধান, গম, ভুট্টা, কিশমিশ ইত্যাদির ন্যায় শবজি ও বাগানের অন্যান্য গাছ গাছালীও এর আওতাভুক্ত। কারণ রাসূল (সা) বরেছেন-

জমিতে যাই উৎপাদিত হবে তাতেই এক-দশমাংশ রাজস্ব ধার্য হবে। এমনকি জমির ফসলের ফুল থেকে উৎপাদিত মধুতেও রাজস্ব হিসেবে উশর আদায় করতে হবে। কেননা রাসূল (সা) মধু থেকেও উশর আদায় করেছেন।

নিসফুল উশর

মুসলমানদের ভোগকৃত এক ধরনের জমি আছে যাতে ফসল উৎপন্ন করতে নিজের খরচে সেচের ব্যবস্থা করতে হয়। এ ধরনের জমির উৎপাদিত ফসলের নিসফুল উশর বা উৎপাদিত ফসলের বিশ ভাগের একভাগ রাজস্ব আদায় করতে হয়। এ সম্পর্কে রাসূল (সা) বলেন-

যে জমি কোন প্রকারের সেচের মাধ্যমে সিক্ত করা হয় তার বিশভাগের একভাগ ফসল ভূমি রাজস্ব হিসেবে দিতে হয়।

আমাদের দেশের অধিকাংশ জমি নিসফুল উশর জাতীয় জমি। অর্থাৎ যেহেতু আমাদের দেশের উৎপাদিত ফসলে সাধারণতঃ কৃষক নিজের তত্ত্বাবধানে পানি সেচ করে, সার ও কীটনাষক ঔষধ প্রদান করে তাই এতে বিশ ভাগের একভাগ রাজস্ব দেয়া ওয়াজিব। তবে আমন ধান ও বেশ কিছু ফলফলাদি উৎপাদনে কৃষককে ভূমিতে কোন সেচ করতে হয় না সে সব ফসলে দশভাগের এক ভাগ ভূমি রাজস্ব দিতে হবে।

বর্তমানে জমির যে ভূমি রাজস্ব আমাদের দেশে চালু আছে তা ইসলামি অর্থনীতিতে নিসফুল উশরের পরিপূরক নয়।

পার্থকের কারণ

মুসলমানদেরকে উপরে বর্ণিত দু'ধরনের জমির ওপর উশর এবং নিসফুল উশর রাজস্ব প্রদান করতে হয়। এ পার্থক্যের কারণ বর্ণনায় ইসলামি আইনবিদগণ বলেন-

"কারণ শেষোক্ত জমিতে অধিক শ্রম নিয়োগ করতে হয়। কিন্তু প্রথম প্রকার জমি বৃষ্টি বা ঝর্ণার পানিতে স্বাভাবিকভাবেই সিক্ত হয় বলে তাতে কম শ্রমের প্রয়োজন হয়।"

এ সম্পর্কে ইমাম খাত্তাবী বলেন- যে জমিতে ফসল ফলাতে শ্রম ব্যয় কম হয় এবং লাভ বেশী হয় তাতে নবী করীম (সা) গরীবদের পরিমাণ বৃদ্ধি করেছেন। আর যে জমিতে ফসল ফলাতে শ্রম ও ব্যয় বেশি হয় সে জমিতে গরীবদের পাওনার পরিমাণ কম করে দিয়েছেন। এ বিধানের মাধ্যমে জমির মালিকদের প্রতি অনুগ্রহ দেখান হয়েছে আর এটিই যুক্তিযুক্ত।

খারাজ

আমরা জানি যে ইসলামি রাষ্ট্রের অমুসলিমদের মালিকানা ও ভোগাকৃত জমি হতে যে রাজস্ব আদায় করা হবে তাকে খারাজ বলে।

খারাজের পরিমাণ কি হবে সে ব্যাপারে ফিকহবিদদের পক্ষ থেকে নির্দিষ্টভাবে কিছুই বলা হয়নি। তাই খারাজের পরিমাণ ধার্য করার ভার ইসলামি রাষ্ট্রের উপরই ন্যাস্ত।

সরকার জমির গুণাগুণ বিবেচনা করে সময় ও অবস্থার চাহিদার আলোকে পার্লামেন্টের সাথে আলোচনা করে খারাজের পরিমাণ নির্ধারণ করবেন। খারাজ নির্ধারণের ক্ষেত্রে যাতে কোনভাবেই অমুসলিমদের উপর যুলম না হয়, সেদিকে রাষ্ট্রপ্রধান অবশ্যই সতর্ক থাকবেন।

এজন্যে খারাজের পরিমাণ নির্ণয়ের বেলায় একটা বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা যেতে পারে। তারা অমুসলিমদের সকল জমি জরিপ করবেন, কি কি গুণাগুণ সম্পন্ন জমি আছে তার পার্থক্য করবেন, উর্বরতার পার্থক্য দেখবেন, প্রয়োজনীয় চাষের পরিমাণের পার্থক্যের প্রতি লক্ষ্য রাখবেন, এমনকি পানি সেচের আবশ্যকতা ও অনাবশ্যকতার পার্থক্যের প্রতিও লক্ষ রাখবেন। কোন জমিতে কি পরিমাণ খারাজ (রাজস্ব) নির্ধারণ করলে প্রজাদের উপর অন্যায় করা হবে না তার একটি সুপারিশ উক্ত কমিটি সরকারকে পেশ করবেন। আর সে আলোকে সরকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন।

অমুসলিমদের ভূমি রাজস্ব বা খারাজ টাকার মাধ্যমে যেমন গ্রহণ করা যেতে পারে অনুরূপভাবে সরকার ইচ্ছে করলে তা ফসলের মাধ্যমেও গ্রহণ করতে পারে। তবে খারাজ আদায়ের জন্য এমন সময় নির্ধারণ করবেন যাতে প্রজাদের রাজস্ব আদায়ে কোন প্রকার কষ্ট না হয়।

ওশর ও খারাজের পার্থক্য

১. খারাজ আদায় করা হয় জমির ওপর এবং উশর আদায় করা হয় জমির উৎপন্ন ফসল হতে। একাধিক সহোদর ভাইয়ের কোন 'এজমালি' জমি থাকলে এবং তাদের কেউ কেউ ইসলামে দীক্ষিত হলে- তখন ভূমি রাজস্ব অনুরূপভাবে আদায় করতে হবে। অর্থাৎ মুসলমানের অংশ হতে উশর এবং অমুসলিমের অংশ হতে খারাজ আদায় করা হবে।

মুসলমানদের জমি হতে 'উশর' এবং অমুসলিমদের জমি হতে 'খারাজ' আদায় করার ব্যাপারে কোনরূপ জোর-যুলম, অবিচার কিংবা হিংসা-বিদ্বেষের প্রশ্রয় দেওয়া যেতে পারে না। ইসলামি রাষ্ট্রে মুসলিম নাগরিকগণই প্রকৃতপক্ষে সকল প্রকার দায়িত্বের ভারপ্রাপ্ত হয়ে থাকে এবং সে জন্য তাদেরকে অন্য্যান্য দায়িত্ব ছাড়া রাষ্ট্রীয় প্রয়োজন পূরণের উদ্দেশ্যে বিপুল পরিমাণে অর্থ দানের দায়িত্ব পালন করতে হয় কাজেই জমির রাজস্বের দিক দিয়ে সামান্য পার্থক্য হলেও মোটামুটিভাবে মুসলমানকেই অধিক পরিমাণে অর্থ দান করতে হয়।

২. 'উশর' কখনোই কোন অবস্থায়ই রহিত হতে পারে না। তার পরিমাণ চির-নির্দিষ্ট এবং তাতে হ্রাস-বৃদ্ধির অবকাশ নেই। এমনকি স্বয়ং রাষ্ট্রপ্রধান তা হতে কাউকে নিষ্কৃতি দিতে পারেন না। কারণ এটি শরীয়ত কর্তৃক নির্ধারিত কিন্তু প্রয়োজন হলে এবং উপযুক্ত কারণ থাকলে খারাজের পরিমাণ হ্রাস-বৃদ্ধি করা, এমনকি অবস্থার প্রেক্ষিতে সম্পূর্ণরূপে ক্ষমা করে দেয়ার পূর্ণ অধিকারও রাষ্ট্রপ্রধানের রয়েছে।

৩. খারাজ বৎসরে একবার আদায় করা হয়, কিন্তু উশর আদায় করা হয় প্রত্যেক ফসল হতে। বৎসরের মধ্যে যত প্রকারের ফসল যতবার ফলবে, সকল প্রকার ফসলের উপর ততবারই 'উশর' ধার্য হবে।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url