সম্পদ ও সম্পদের প্রকারভেদ
◆ সম্পদ বলতে কি বুঝায় তা বলতে পারবেন।
সম্পদের শ্রেণীবিভাগ আলোচনা করতে পারবেন।
◆ সম্পদের বৈশিষ্ট্য আলোচনা করতে পারবেন।
সম্পদের পরিচয়
সাধারণ অর্থে ধন-সম্পত্তি ও টাকা পয়সাকে সম্পদ বলা হয়। কিন্তু অর্থনীতিতে যেসব দ্রব্য সামগ্রীর উপযোগ আছে, যোগান অপ্রচুর, বাহ্যিকতা ও বিনিময় মূল্য আছে তাকেই সম্পদ বলা হয়। অর্থাৎ সব রকম অর্থনৈতিক দ্রব্যকে অর্থশাস্ত্রে সম্পদ বলে। বস্তুগত ও অবস্তুগত উভয় প্রকার দ্রব্যকে সম্পদরূপে গণ্য করা হয়। যেমন-চশমা, ঘড়ি ছাতা, আসবাবপত্র, খাদ্যদ্রব্য প্রভৃতি বস্তুগত সম্পদ। আবার উপযোগ, সীমিত যোগান ও হস্তান্তর মূল্য থাকায় ব্যবসায়ের সুনাম অবস্তুগত সম্পদ। তাছাড়া ইসলামি সমাজ ব্যবস্থায় মানবিক গুণাবলীও সম্পদ হিসেবে বিবেচিত। ইসলামি সমাজ ব্যবস্থায় আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাস, সৎকাজ, নৈতিক চরিত্রের উৎকর্ষা, মানবতার কল্যাণ সাধান, জ্ঞানদান, জ্ঞানঅর্জন প্রভৃতির কোন হস্তান্তর যোগ্যমূল্য না থাকা সত্বেও ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে এগুলো উত্তম সম্পদ হিসেবে বিবেচিত। কেননা, অর্থ কড়ির ন্যায় এগুলোও মানুষকে উন্নত ও মর্যাদা সম্পন্ন করে তোলে। তাই এগুলো অবস্থাগত সম্পদ। এসকল মহামূল্যবান সম্পদের দ্বারা ব্যক্তি, সমাজ এবং রাষ্ট্র প্রভূত কল্যাণ লাভ করে থাকে। এ সকল সম্পদের মাধ্যমে মানুষের আধ্যাত্মিক কল্যাণ বৃদ্ধি পায়। সুতরাং ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য বস্তুকেই শুধু সম্পদ বললে সঠিক হবে না। অবস্তুগত এবং আধ্যাত্মিক সম্পদ মানুষের সামাজিক চাহিদার আলোকে মানবিক কল্যাণ ও তৃপ্তি দিতে পারে। কিন্তু যেসব বস্তু প্রকৃতির অবাধ দান ও সহজ লভ্য, যেমন-আলো-বাতাস ইত্যাদি সেগুলোকে সম্পদ বলা যায় না। কেননা, এসব দ্রব্যের উপযোগ থাকলেও যোগানের সীমাবদ্ধতা ও বিনিময় মূল্য নেই। বস্তুগত ও অবস্তুগত সম্পদ সৃষ্টি করা মানুষের অর্থনৈতিক ও নৈতিক কার্যকলাপের প্রাথমিক উদ্দেশ্য।
সম্পদের বৈশিষ্ট্য
অর্থনীতিতে কোন দ্রব্যকে সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হতে হলে সাধারণত তার চারটি বৈশিষ্ট্য থাকা দরকার। যথা-১. উপযোগ, ২. অপ্রাচুর্যতা, ৩. হস্তান্তর যোগ্যতা এবং ৪. বাহ্যিকতা। এ বৈশিষ্ট্যসমূহ নিম্নে আলোচনা করা হলঃ
১. উপযোগঃ উপযোগ সম্পদের প্রধান গুণ। মানুষের কোন অভাব মোচনের ক্ষমতাকে উপযোগ বলা হয়। কোন দ্রব্য সম্পদরূপে বিবেচিত হতে হলে অবশ্যই তার উপযোগ থাকতে হবে। অর্থাৎ মানুষের কোন না কোন অভাব পূরণের কাজে তাকে লাগতে হবে। উপযোগহীন দ্রব্য সামগ্রী দাম দ্বারা ক্রয়-বিক্রয়ের যোগ্য নয় এবং সে জন্য তা সম্পদ হতে পারে না।
২. অপ্রাচুর্যতাঃ কেবল উপযোগ থাকলেই কোন দ্রব্যকে সম্পদ বলা যায় না। সম্পদ হতে হলে দ্রব্যের যোগান সীমাবদ্ধ অর্থাৎ চাহিদার তুলনায় যোগান অপ্রচুর হতে হবে। দ্রব্য অপ্রচুর বা দুষ্প্রাপ্য না হলে তা লাভের জন্য পরিশ্রম বা অর্থমূল্য লাগে না। সুতরাং তা সম্পদ হতে না। নদীর পানি, বাতাস প্রভৃতির যোগান অপ্রচুর নয় বলে সেসব সম্পদ নয়। কিন্তু ধান, পাট, কলম-খাতা, পোশাক এবং শহরের পানীয় জল প্রভৃতির যোগান সীমাবদ্ধ হওয়ায় সেগুলো সম্পদ।
৩. হস্তান্তর যোগ্যতাঃ সম্পদের আরও একটি বৈশিষ্ট্য হল দ্রব্যের হস্তান্তর যোগ্যতা। ক্রয়-বিক্রয় বা বিনিময়ের মাধ্যমে দ্রব্য হস্তান্তর করা না গেলে তার কোন বিনিময় মূল্য থাকে না এবং তা সম্পদ হিসেবে বিবেচ্য নয়। একখন্ড জমি হস্তান্তরযোগ্য না হলেও তার মালিকানা পরিবর্তন করা যায় বলে তা সম্পদ।
৪. বাহ্যিকতাঃ দ্রব্যের বাহ্যিকতা সম্পদের আর একটি বৈশিষ্ট্য। কারণ দ্রব্য বাহ্যিক হলে হস্তান্তর যোগ্য হয়। যেমন-আসবাবপত্র, কাপড়, বইপত্র, ঘড়ি প্রভৃতি অসংখ্য বাহ্যিক বস্তু হস্তান্তরযোগ্য হওয়ায় তা সম্পদ। পক্ষান্তরে মানুষের অভ্যন্তরীণ গুণ, যেমন-প্রতিভা, দক্ষতা ইত্যাদি হস্তান্তর যোগ্য না হওয়ায় তা অর্থনীতিবিদদের মতে সম্পদ নয়।
যেসব দ্রব্যে উল্লিখিত চারটি বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। অর্থনীতিতে সেগুলোকে সম্পদ বলা হয়। এ চারটি বৈশিষ্ট্যের যে কোন একটি না থাকলে তা সম্পদ বলে গণ্য হবে না। কিন্তু ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে সম্পদের এ চারটি বৈশিষ্ট্য থাকলেই তাকে সম্পদ বলা যাবে না। কেননা, শরীআতে কোন দ্রব্য ক্রয়-বিক্রয় করা হারাম বা ভক্ষণ ও পান করা হারাম সাব্যস্থ হলে উপরোক্ত চারটি বৈশিষ্ট্য থাকলেও তা সম্পদরূপে গণ্য হবে না। যেমন-মাদক দ্রব্য সম্পদ নয়, শুকর সম্পদ নয়। আবার সম্পদের উপরিউক্ত বৈশিষ্ট্যের মধ্যে কোন পণ্য বা বস্তুর মধ্যে একাধিক বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান না থাকলে তা ইসলামের দৃষ্টিতে সম্পদ হিসেবে গণ্য হবে। যেমন- সূর্যকিরণ, নদীর পানি, নদী থেকে উত্তোলিত বালি ইত্যাদি সম্পদ। কেননা, এগুলোর দ্বারা মানুষ তার বস্তুগত চাহিদা পূরণ করে থাকে। সাধারণত অর্থনীতিবিদগণ যেমন- কবির প্রতিভা, মেধা ইত্যাদিকে সম্পদ হিসেবে গণ্য করেন না এ কারণে যে, এগুলোর উপযোগ থাকা সত্ত্বে এগুলো হস্তান্তর যোগ্য নয়। এসকল মানবিক গুণ উপযোগ থাকায় এবং প্রয়োজনের তুলনায় অপর্যাপ্ত হওয়ায় এগুলো বাহ্যিকভাবে হস্তান্তর যোগ্য না হলেও এর দ্বারা মানুষ তার প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম। তাই, ইসলামি দৃষ্টিতে এগুলো সম্পদ। বর্তমান বিশ্বে অর্থনীতিবিদরা মানব সম্পদ উন্নয়ন এবং মানব উন্নয়নের কথা বলছেন। এর দ্বারা বোঝা যায় যে তারা এ সকল অবস্তুগত জিনিসকে পরোক্ষভাবে সম্পদ হিসেবে স্বীকার করে থাকেন। বস্তুগত সম্পদের দ্বারা যেমন মানুষের ব্যক্তিগত সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় প্রয়োজন মেটানো হয়; তেমনিভাবে অবস্তুগত মানবিক গুণাবলী দ্বারা ও ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রভূত কল্যাণ সাধিত হয়।
সম্পদের প্রকারভেদ
সম্পদকে সাধারণত চারটি প্রধান ভাগে ভাগ বরা যায়। যথা-১. ব্যক্তিগত সম্পদ, ২. সমষ্টিগত সম্পদ, ৩. জাতীয় সম্পদ এবং ৪. আন্তর্জাতিক সম্পদ। নিচে এদের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেওয়া হলঃ
১. ব্যক্তিগত সম্পদঃ কোন ব্যক্তির নিজ মালিকানাধীন সকল সম্পদকে ব্যক্তিগত সম্পদ বলা হয়। যেমন-নিজস্ব জমি, ঘর-বাড়ি, আসবাবপত্র, পোশাক-পরিচছদ, বীমা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সুনাম প্রভৃতিকে ব্যক্তির ব্যক্তিগত সম্পদ বলা হয়। এছাড়া অধ্যাপক মার্শালের অভিমত অনুযায়ী মানুষের কর্মদক্ষতা এবং বিভিন্ন গুণাগুণ ব্যক্তিগত সম্পদের পর্যায়ভুক্ত। কেননা- এসব অভ্যন্তরীণ গুণাগুণ হস্তান্তরযোগ্য না হলেও মানুষের জীবিকা অর্জনে তা সহায়তা করে।
২. সমষ্টিগত সম্পদঃ সরকার বা জনসাধারণের সমষ্টিগত মালিকানাধীন সম্পদকে সমষ্টিগত সম্পদ বলা হয়। জনসাধারণের ব্যবহারের জন্য রাস্থা-ঘাট, পার্ক, চিড়িয়াখানা, পোস্টঅফিস, স্কুল-কলেজ, মাদরাসা, মসজিদ, ইয়াতীমখানা, হাসপাতাল, বাঁধ ইত্যাদি সমষ্টিগত সম্পদের অন্তর্ভুক্ত। সমষ্টিগত সম্পদের উপর সমাজের সকলের সমান অধিকার ও কর্তব্য থাকে।
৩. জাতীয় সম্পদঃ রাষ্ট্রের সকল প্রকার ব্যক্তিগত এবং সমষ্টিগত সম্পদকে একত্রে জাতীয় সম্পদ বলা হয়। জাতি সামগ্রিকভাবে এ সম্পদের মালিক। জাতীয় সম্পদ হিসেবের সময় দেশের অভ্যন্তরে বিদেশী মালিকানাধীন সম্পদ বিয়োগ এবং বিদেশে দেশী মালিকানাধীন সম্পদ যোগ করা হয়।
৪. আন্তর্জাতিক সম্পদঃ যে সকল সম্পদ কোন বিশেষ দেশ বা জাতির মালিকানাধীন নয়, বরং সব দেশই ভোগ করতে পারে তাকে আন্তর্জাতিক সম্পদ বলে। পৃথিবীর সাগর-মহাসাগর, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক নদী, রাষ্ট্রসংঘ প্রভৃতি আন্তর্জাতিক সম্পদের উদাহরণ।
আলোচ্য পাঠে সম্পদের সাধারণ ধারণা দেওয়া হল। ইসলামি অর্থনীতিতে সম্পদের ধারণা সাধারণ অর্থনীতিতে সম্পদের ধারণার সাথে কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে কোন বস্তু বা পণ্যের চারটি গুণ থাকলেই তাকে সম্পদ বলা হয় না। সম্পদ হতে হলে ইসলামি শরীআতে তার উপাদান, উৎপাদন সবকিছু বৈধ হতে হবে। সাধারণ অর্থনীতির তুলনায় ইসলামি অর্থনীতিতে সম্পদের ব্যাপকতা কম।
এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url