এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম ৭ই মার্চ ১৯৭১সাল

 আজ এই আর্টিকেলটিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষণ সহ এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম এর মূল প্রতিপাদ্য বিষয় সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো


এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম

পূর্ব কথাঃ ১৯৭৯ উত্তরের গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানের সামরিক একনায়ক আইয়ুব খান ক্ষমতাচ্যুত হন। এরপর ক্ষমতায় এসে নতুন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচন দিতে বাধ্য হন। নির্বাচনে আওয়ামীলীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। গণতন্ত্রের ধারা অনুসারে পাকিস্তানের শাসনভার পাওয়ার কথা আওয়ামী লীগের অর্থাৎ বাঙালি অভিসংবাদিতা নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। কিন্তু পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী বাঙ্গালীদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করার ও গণতন্ত্র হত্যার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ এর ৩রা মার্চ ঢাকায় পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের প্রথম অধিবেশন ডেকেছিলেন। কিন্তু কোন কারণ ছাড়াই তিনি হঠাৎ ১লা মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন। এই ষড়যন্ত্রমূলক ঘোষণা শুনেই পূর্ব পাকিস্তানের সর্বত্র প্রতিবাদ ও বিক্ষোভের ঝড় উঠে। জয় বাংলা, বীর বাঙালি অস্ত্র ধর বাংলাদেশ স্বাধীন কর, তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা, জাগো জাগো বাঙালি জাগো ইত্যাদি স্লোগানে গ্রাম আন্দোলিত হয়।

আরো পড়ুনঃ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস ১৯৭১ সাল

এই পটভূমিতে ১৯৭১ এর ৭ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) প্রায় ১০ লক্ষ লোকের উপস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। ১৮ মিনিটের এই ভাষণে তিনি বাঙালি এর মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত স্বাধীনতা সংগ্রামের আহ্বান জানান। আবেগে বক্তব্যে দিক-নির্দেশনায় ওই ভাষাটি ছিল অনবদ্য ‌। বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণটিকে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের  ঐতিহাসিক গেটিসবার্গ ভাসানের সঙ্গে তুলনা করা হয়। ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর ইউনেস্কো এই ভাষণটিকে ইন্টারন্যাশনাল মেমরি অব্ দা ওয়ার্ল্ড রেজিস্টারে অন্তর্ভুক্ত করে। ঐতিহাসিক ভাষণটি এখানে লিপিবদ্ধ হলো।

ভাইয়েরা আমার

আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সবই জানেন এবং বোঝেন। আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি কিন্তু দুঃখের বিষয় আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম ,রাজশাহী, রংপুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে। আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায় বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়‌। কী অন্যায় করেছিলাম? নির্বাচনের পর বাংলাদেশের মানুষ সম্পূর্ণভাবে আমাকেও আওয়ামী লীগকে ভোট দেন। আমাদের ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি বলবে, আমরা সেখানে শাসনতন্ত্র তৈরি করব এবং দেশকে আমরা গড়ে তুলবো। এদেশের মানুষ অর্থনীতি, রাজনীতি ও সাংস্কৃতি মুক্তি পাবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় আজ দুঃখের সাথে বলতে হয় ২৩ বছরের করুণ ইতিহাস বাংলার অত্যাচারের, বাংলার মানুষের রক্তের ইতিহাস। ২৩ বছরের ইতিহাস মুমূর্ষ নর-নারীর আত্মনাদের ইতিহাস। বাংলার ইতিহাস এদেশের মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস।

১৯৫২ সালের রক্ত দিয়েছি। ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করেও আমরা গদিতে বসতে পারেনি ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান মার্শাল-ল জারী করে ১০ বছর পর্যন্ত আমাদের গোলাম করে রেখেছে। ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলনে ৭ই জুনে আমার ছেলেদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। ১৯৭৯ সালের ৬ দফা আন্দোলনে আইয়ুব খানের পতন হওয়ার পরে যখন ইহাহিয়া খান সাহেব সরকার নিলেন, তিনি বললেন দেশের শাসনতন্ত্র দেবেন গণতন্ত্র দেবেন, আমরা মেনে নিলাম। তারপর অনেক ইতিহাস হয়ে গেল, নির্বাচন হলো। আমি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া  খান সাহেবের সাথে দেখা করেছি।

আমি শুধু বাংলার নয়, পাকিস্তানের মেজরিটি পার্টির নেতা হিসেবে তাকে অনুরোধ করলাম, ১৫ই ফেব্রুয়ারি তারিখে আপনি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন দেন। তিনি আমার কথা রাখলেন না তিনি রাখলেন ভূট্টো সাহেবের কথা। তিনি বললেন, প্রথম সপ্তাহে মার্চ মাসে হবে। আমি বললাম ঠিক আছে আমরা অ্যাসেম্বলিতে বসবো। আমি বললাম অ্যাসেম্বলির মধ্যে আলোচনা করব- এমনকি আমিও এ পর্যন্ত বললাম, যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও একজন যদিও সে হয় তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেব।

ভুট্টো সাহেব এখানে এসেছিলেন, আলোচনা করলেন। বলে গেলেন যে আলোচনার দরজা বন্ধ নয়, আরো আলোচনা হবে তারপর অন্যান্য নেতাদের সঙ্গে আমরা আলোচনা করলাম আপনারা আসুন, বসুন, আমরা আলাপ করে শাসনতন্ত্র তৈরি করব। তিনি বললেন পশ্চিম পাকিস্তানের মেম্বাররা যদি এখানে আসে তাহলে কসাইখানা হবে অ্যাসেম্বলি। তিনি বললেন, যে যাবে তাকে মেরে ফেলা হবে, যদি কেউ আছে তাহলে পেশোয়ার থেকে করাচি পর্যন্ত দোকান জোর করে বন্ধ করা হবে। আমি বললাম অ্যাসেম্বলি চলবে। তারপর হঠাৎ ১ তারিখে অ্যাসেম্বলি বন্ধ করে দেয়া হলো।

আরো পড়ুনঃ বাংলাদেশের দিবস, বৈবিশ্ব দিবস ও আন্তর্জাতিক দিবস সমূহ 

ইয়াহিয়া খান প্রেসিডেন্ট হিসেবে অ্যাসেম্বলি ডেকেছিলেন । আমি বললাম আমি যাব। ভুট্টো বললেন তিনি যাবেন না। ৩৫ জন সদস্য পশ্চিম থেকে এখানে আসলেন। তারপর হঠাৎ বন্ধ করে দেয়া হলো, দোষ দেওয়া হলো বাংলার মানুষকে, দোষ দেয়া হলো আমাকে। বন্ধ করার পর এদেশের মানুষ প্রতিবাদ মুখর হয়ে উঠলো।

আমি বললাম শান্তিপূর্ণভাবে আপনারা হরতাল পালন করুন। আমি বললাম, আপনারা কল কারখানা সবকিছু বন্ধ করে দেন। জনগণ সাড়া দিল। আপনার ইচ্ছায় জনগণ রাস্তায় বেরিয়ে এলো, তারা শান্তিপূর্ণভাবে সংগ্রাম চালিয়ে যাবার জন্য স্থীর প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো। কি পেলাম আমরা? আমরা পয়সা দিয়ে অস্ত্র কিনেছি বহিশত্রুর আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য, আজ সেই অস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে আমার দেশের গরীব দুঃখী নিরস্ত্র মানুষের বিরুদ্ধে, তার বুকের উপর হচ্ছে গুলি। আমরা পাকিস্তানি সংখ্যাগুরু- আমরা বাঙালিরা যখনই ক্ষমতায় যাওয়ার চেষ্টা করেছি তখনই তারা আমাদের উপর ঝাপিয়ে পড়েছে।

টেলিফোনে আমার সাথে তার কথা হয়। তাকে আমি বলেছিলাম জেনারেল ইয়াহিয়া খান সাহেব আপনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট দেখে যান কিভাবে আমার গরিবের উপর , আমার মানুষের বুকের উপর গুলি করা হয়েছে।  কি করে আমার মায়ের কোল খালি করা হয়েছে। কি করে মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। আপনি আসুন দেখুন বিচার করুন। তিনি বললেন আমি নাকি স্বীকার করেছি ১০ তারিখে রাউন্ড টেবিল কনফারেন্স হবে।

আমি তো অনেক আগেই বলে দিয়েছি কিসের রাউন্ড টেবিল কার সাথে বসবো? যারা আমার মানুষের বুকে রক্ত নিয়েছে, তাদের সাথে বসবো? হঠাৎ আমার সাথে পরামর্শ না করে পাঁচ ঘন্টার গোপন বৈঠক করে যে বক্তিতা তিনি করেছেন তাতে সমস্ত দোষ তিনি আমার উপর দিয়েছেন, বাংলার মানুষের উপর দিয়েছেন।

ভাইয়েরা আমার

২৫ তারিখে অ্যাসেম্বলি কল করেছে। রক্তের দাগ শুকায় নাই। আমি ১০ তারিখে সিদ্ধান্ত নিয়েছি ওই শহীদের রক্তের উপর পাড়া দিয়ে আরটিসিতে মুজিবুর রহমান যোগদান করতে পারে না। অ্যাসেম্বলি কল করেছেন আমার দাবি মানতে হবে। প্রথমে সামরিক আইন মার্শাল-ল (withdraw)করতে হবে। সমস্ত সামরিক বাহিনীর লোকদের বারাকে ফিরে যেতে হবে। যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তার তদন্ত করতে হবে। আর জনগণের প্রতিনিধির সাথে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। তারপর বিবেচনা করে দেখব আমরা অ্যাসেম্বলিতে বসতে পারবো কি পারবো না এর পূর্বে অ্যাসেম্বলিতে বসতে আমরা পারি না।

আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব চাই না, আমরা এদেশের মানুষের অধিকার চাই আমি পরিষ্কার অক্ষরে বলে দেবার চাই যে, আজ থেকে এই বাংলাদেশে কোর্ট, কাছারি, আদালত ফৌজদারি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে। গরিবের যাতে কষ্ট না হয় যাতে আমার মানুষ কষ্ট না করে সেজন্য সমস্ত অন্যান্য যে জিনিসগুলো আছে, সেগুলোর হরতাল কাল থেকে চলবে না। রিক্সা, গরুর গাড়ি, রেল চলবে, লঞ্চ চলবে শুধু সেক্রেটারিয়েট সুপ্রিম কোর্ট হাইকোর্ট জজকোট সেমিগভমেন্ট দপ্তর অফ দা কোন কিছুই চলবে না। ২৮ তারিখে কর্মচারীরা গিয়ে বেতন নিয়ে আসবেন। এরপর যদি বেতন দেওয়া না হয় আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়, তোমাদের কাছে অনুরোধ রইলো প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল, তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি তোমরা বন্ধ করে দিবে। আমরা ভাত মারব, আমরা পানিতে মারব, তোমরা আমার ভাই তোমরা ব্যারাকে থাকো কেউ তোমাদের কিছু বলবেনা কিন্তু আর আমার বুকের উপর গুলি চালাবার চেষ্টা করো না। ৭ কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবে না। আমরা যখন মরতে শিখেছি তখন কেউ আমাদের দাবাইতে পারবে না।

আরো পড়ুনঃ খলিফা হযরত আবু বক্কর (রাঃ) এর সংক্ষিপ্ত জীবনী

আর যে সমস্ত লোক শহীদ হয়েছে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে আমরা আওয়ামী লীগের থেকে যতদূর পারি তাদের সাহায্য করতে চেষ্টা করব। যারা পারেন আমার রিলিফ কমিটিকে সামান্য টাকা-পয়সা পৌঁছে দিবেন। আর এই ৭ দিনের হরতালে যে সমস্ত শ্রমিক ভাইয়েরা যোগদান করেছে প্রত্যেক শিল্পের মালিক তাদের বেতন পৌঁছে দেবেন। সরকারি কর্মচারীদের বলি আমি যা বলি তা মানতে হবে। যে পর্যন্ত আমার এই দেশের মুক্তি না হচ্ছে ততদিন খাজনা, ট্যাক্স বন্ধ করে দেয়া হলো। কেউ দিবে না শুনুন মনে রাখবেন শত্রু বাহিনী ঢুকেছে নিজেদের মধ্যে আত্ম কলহ সৃষ্টি করবে লুট তারাজ করবে। এই বাংলায় হিন্দু, মুসলমান, বাঙালি ও বাঙালি যারা আছে তারা আমাদের ভাই তাদের রক্ষার দায়িত্ব আপনাদের উপর আমাদের যেন বদনাম না হয়।

মনে রাখবেন রেডিও, টেলিভিশনের কর্মচারীরা যদি রেডিওতে আমাদের কথা না শুনে তাহলে কোন বাঙালি রেডিও স্টেশনে যাবেন না। যদি টেলিভিশন আমাদের নিউজ না দেয় কোন বাঙালি টেলিভিশনে যাবেন না। দুই ঘন্টা ব্যাংক খোলা থাকবে যাতে মানুষ তাদের মাইনেপত্র নিতে পারে। পূর্ব বাংলা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানের এক পয়সাও চালান হতে পারবে না। টেলিফোন, টেলিগ্রাম আমাদের পূর্ববাংলায় চলবে এবং বিদেশের সাথে দেওয়া নেওয়া চলবে না।

কিন্তু যদি এই দেশের মানুষকে খতম করার চেষ্টা করা হয়, বাঙালিরা বুঝে সেজে কাজ করবেন। প্রত্যেক গ্রাম, প্রত্যেক মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোল এবং তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো । মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেবো। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, জয় বাংলা।

(তথ্যসূত্র: গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান)



এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url