ছোট্ট বাবুদের মজার গল্প ঝিঁঝি পোকার গান

 ঝিঁঝি পোকার গান

আরশোলা মায়ের একমাত্র ছেলে গেদুতেলা। বড় ডানপিটে। মা ছেলেকে নিয়ে বেশ ভয়ে ভয়ে থাকে। ওই এলাকার মোড়ল গুবরে পোকা। একদিন সন্ধ্যায় মোড়ল এসে গেদুতেলার মায়ের কাছে হাজির। গুবরে মোড়ল শুধু হাঁসছে তো হাসছেই।

'

কি হয়েছে মোড়ল কাকা? এত হাসছেন কেন? 

'হাসবো না কেন? তোমার ছেলেকে সামলাও। না হলে আমি কিন্তু বিচার ডাকব।

কি হয়েছে খুলেই বলুন না ।

আরে আমি বলব কেমন করে? হাসি তো থামাতেই পারি না।

 গেদুতেলার মা সরষের ফুলের মধু দিয়ে পিঁপড়ের ডিম রান্না করেছে। কচু পাতায় বেড়ে গিয়ে বলল,

আগে খেয়ে নিন। তারপর সব শুনব।

গুবরে মোরল হাসছে আর খাচ্ছে। হাসির দমকে হঠাৎ খাবার গলায় গেল আটকে। কাশতে কাশতে গুবরে মোড়ল গেল চিত হয়ে। হাত -পা ,ছোড়ে ,হাসে আর কাশে। সোজা হতে পারে না। অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে মোড়ল বলে।

আমাকে সোজা করে বসিয়ে দাও।

আরশোলা মা শুর দিয়ে, মাথা দিয়ে অনেক ঠেলাঠেলি করেও সোজা করতে পারলো না। শেষে পাড়াপড়শিরা কেউ ঘাসের লাঠি কেউ বা শনের লাঠি দিয়ে মোড়লকে সোজা করে বসিয়ে দিল। হাত-পা ছোড়া আর গুতাগুতির চোটে মোড়লের হাসি থেমে গেছে । হাঁপাতে হাঁপাতে মোড়ল বলে,

 শোন, তিন দিন আগে তোমার ছেলে হঠাৎ আমার পিঠে উড়ে এসে বসে। ভাবলাম নাতি, তাই বুঝি ঠাট্টা করে পিঠে বসেছে। কিছুক্ষণ লাফালাফি করে আবার ফুর ফুর করে উড়ে চলে গেল। সে দিন গেল তারপর দিনও গেল। আমি কিছু বুঝিনি । আজ দুপুরের পর বুঝলাম ও আমাকে কাতুকুতু দিয়েছিল। তখন থেকেই আমার হাসি শুরু হয়েছে। কিছুতেই থামে না । চিৎ না হলে তো আর দুদিন যেত আমার হাসি থামাতে। শোন গেদুতেলার মা, ওকে একটা বিয়ে দিয়ে দাও। গেদুতেলার চেহারাটা সুন্দর। যেমন তেলতেলা শরীর! দেখতেও গাবদা-গোবদা।  তুমি ফড়িং আর প্রজাপতিকে খবর দাও। ঘটক হিসেবে ওদের অনেক নাম ডাক।

 প্রজাপতি আর ফড়িং এর কাছে খবর গেল। খবর পেয়ে ফড়িং ফর ফর করে উড়ে আসে। একটু পরে প্রজাপতি ও হাজির হয়। আরশোলার মা আর মোড়লকে দেখে দুজনেই বলে ওঠে।

 মোড়ল কাকু, কোন বিপদ- আপদ হয়নি তো?

 আরে না না তোমাদের একটা কাজে ডেকেছি।

 প্রজাপতি আর ফড়িং গলে ওঠে,

আপনার দেওয়া কাজ আমরা সাধ্য মত করতে চেষ্টা করব।

 গেদুতেলাকে তো তোমরা চেন । ছেলেটা বড় হয়েছে। ওকে বিয়ে দেওয়া দরকার। 

ওর জন্য একটা কনে দেখ। ঘটকালির জন্য যা যা লাগে আমি দেব।

মোড়লের কথা শুনে ফড়িং ফরফর করে উড়ে এসে সামনে বসে। প্রজাপতি উড়াল দিয়ে মোড়লের কাছে এসে দাঁড়ায় । দুজনেই বলে ওঠে।

মোড়ল কাকু আপনি কোন চিন্তা করবেন না গেদুতেলার জন্য বউয়ের কোন অভাব হবে না। এমন তেল চিকচিক, হোঁদল কুতকুত চেহারা ছেলের। আপনি কিছু চিন্তা করবেন না। আমরা সব ব্যবস্থা করে ফেলব।

ফড়িং আর প্রজাপতি পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে। গ্রামের গ্রামে যায়। একদিন বাঁশঝাড়ের পাশ দিয়ে উড়ে উড়ে যাচ্ছে। পেছন থেকে ঝিঁঝি পোকাদের মাতবর পানশে ঝিঁঝিঁ ওদেরকে ডাক দিয়ে বলে।

কোথায় যাচ্ছো গো ভাইয়েরা?

প্রজাপতি জবাব দেয়, আর কোথায় যাব বল। যে গেদুতেলার জন্য বউ খুঁজতে বেরিয়েছি ঘটকালি করে খাই। ডানা দুটোর উপর ভর করে গ্রামে গ্রামে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরি। তাই বেরিয়েছি আর কি!

তা গেদুতেলার জন্য কি কনে মিলল?

না, এখন পর্যন্ত কোন খোঁজ পাইনি।

তা এত খোঁজাখুঁজির দরকার কী? আমার মেয়েকেই তো তোমরা নিতে পার। আমি তো গেদুতেলারদের চিনি জানি। ওরা রাজি থাকলে আমি এক কথায় বিয়ে দিতে পারি।

গুবরে মোড়ল আর মুরুব্বী আরশোলারা মিলে আলোচনায় বসল। সকলেই একমত। এ বিয়ে হবে। এমন ভালো মেয়েকে হাতছাড়া করা যাবে না। কোন রকম দেনা পাওনা ও নেই। এখন দিনক্ষণ ঠিক করে পানসে ঝিঁঝিঁ কে জানিয়ে দিলেই হল।

দুই বাড়িতে বিয়ের সাজ সাজ রব । কতজন বরযাত্রী যাবে, কবে বৌভাত হবে সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে গেল। বিয়ে হবে রাতে। ঝিঁঝিঁদের আবদার বিয়ের আসরে গান-বাজনার আয়োজন থাকবে।

গেদুতেলাকে  নয়ন তারা ফুলের পাপড়ি দিয়ে বানানো শেরওয়ানি পড়ানো হল। নাপিত এসে লম্বা মোচটা একটু ছেঁটে দিয়েছে। মাথায় শুকনো ঘাসের পাগড়ি। বরযাত্রীরা ঠিক সময়ে রওনা হয়ে গেল। ভরের পিছন পিছন মৌমাছিদের গান। বর মাছিদের ভনভন সুর আর ঘাসফড়িং এর ফর ফর আওয়াজ। সে এক এলাহি কান্ড। বরযাত্রীরা সময়মত পৌঁছে গেল।

বাঁশঝাড়ে ঝিঁঝিদের বাড়ি। বাঁশপাতার বিশাল প্যান্ডেল। বরযাত্রীদের জন্য কচুপাতা,, আম পাতা ও তেঁতুলের পাতার সন বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। জোনাকিরা আলোয় আলোয় ভরিয়ে দিয়েছে। ঝলমল করছে চারিদিক। পানসে  ঝিঁঝিঁ খুব চটপটে ও কাজের। ঝটপট বিয়ে করানো হয়ে গেল। আরশোলা বর আর ঝিঁঝিঁ বউকে পাশাপাশি বসানো হল। ঝিঁঝিঁ বউকে ভারী মিষ্টি লাগছে দেখতে।  মাকড়সা জালের মিহি সুতোর তৈরি শাড়ি পরা ঠোঁটে রক্তজবা ফুলের রসের লিপিস্টিক। মুখে টগর ফুলের রেনুর পাউডার মাখানো। গলায় ঘাসফুলের মালা। দুজনকে পাশাপাশি দেখে যেন চোখ জুড়িয়ে যায়।

রান্নাবান্না শেষ। ঘাসের বিচির পোলাও। উইপোকা রোস্ট। ডিমের ঝোল, আর ফুলের রেনুর পায়েস। খাবার দেওয়া হল খেয়ে সবাই খুশি এমন খাওয়া নাকি এই এলাকায় আগে কেউ খাওয়ায়নি।

এখন গানের আসর । প্রথমে মশার দল গান গাইবে গান শুরু হল। আহা, সেকি মিহি সুরের গান।  সকলের চোখে ঘুমের ঢুলুনি  এসে গেল। গান থামে। এবার ঝিঁঝিঁদের পালা। ঝিঁঝিদের দলে দশজন গায়ক। প্রথমে একজন শুরু করে গিয়ে উঠল। তারপর একে একে সবাই বিয়ের আসরে এবং আশেপাশে যত ঝিঁঝিঁ ছিল সকলেই কান ফাটানো সুরে গান ধরল।

ঝিঁঝিঁদের অভ্যাস একজন গাইলে অন্যরা চুপ থাকতে পারে না। সকল ঝিরির কান ফাটানো সুরের ধাক্কায় বরযাত্রীদের অবস্থা কাহিল । কারো কারো কানে তালা ধরেছে। কেউ ছটফট করছে। কেউ বা জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে । এদিকে বর গেদুতেলা চিৎ হয়ে  হাত-পা ছুঁড়ছে। বরের অবস্থা দেখে বউয়ের শুরু হল কান্না।  অনেক হুমকি ধামকি দিয়ে পানসে ঝিঁঝিঁর গান থামিয়ে দিল।

বরযাত্রীদের মধ্যে অনেকে পালিয়ে গেছে। বেশিরভাগই কাত, চিৎ উপুর আবার কেউ বা জ্ঞান হারিয়ে পড়ে আছে। পানশে ঝিঁঝিঁ কোন উপায় না দেখে শুধু ছুটাছুটি করে। ঝিঁঝিঁদের মধ্যে একজন এমন অবস্থা সামলানোর উপায় জানত। বিয়ের আসরের চারিদিক ঘিরে এসে তামাক ডাঁটাই আগুন ধরিয়ে দিল।

তামাকের ঝাঁজালো গন্ধে সবার সুর হলো হাঁচি। চারিদিকে শুধু হাসির শব্দ। হাঁসতে হাঁসতে যাদের জ্ঞান ছিল না তাদের জ্ঞান ফিরলো। যারা চিৎকাত হয়েছিল তারা সোজা হয়ে গেল। গুবরে মোড়ল 

সোজা হয়ে বসে পানসে ঝিঁঝিঁকে বলল।

দেখো পানসে আমি আগে বুঝলে এমন কাজে হাত দিতাম না।

 পানসে ঝিঁঝিঁ হাতজোড় করে বলল, 

ছেলেছোকরারা এমন করবে আমি আগে বুঝিনি। আমাদের আর লজ্জা দিবেন না।

ঠিক আছে ।তবে একটা কথা তোমার মেয়েকে বলে দাও ও যেন শ্বশুরবাড়ি গিয়ে গান না গায়। তাহলে ওর শ্বশুর বাড়ির সবাই কানের তালা ফেটে কালা হয়ে যাবে।

বরযাত্রীরা সবাই ঝিঁঝিঁ বউকে নিয়ে বাড়ি ফিরে গেল। ঝিঁ ঝিঁ বৌ আর গেদুতেলার সুখের সংসার। গেদুতেলা এখন ভালো হয়ে গেছে । ঝিঝি বউ শ্বশুরবাড়িতে গান গায় না। গাইতে ইচ্ছে হলে বাবার বাড়ির বাঁশ তলায় গিয়ে মনের সুখে গেয়ে আবার ফিরে আসে।





এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url