আওয়ামী লীগ সরকার (১৯৭২-৭৫)

আওয়ামী লীগ সরকার (১৯৭২-৭৫)

◆ রাষ্ট্রপরিচালনায় আওয়ামী লীগ সরকারের ভূমিকা ও সাফল্য উল্লেখ করতে পারবেন।

আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতাচ্যুতির কারণসমূহ ব্যাখ্যা করতে পারবেন।

আওয়ামী লীগ সরকারের ভূমিকা ও সাফল্য
১৯৭১ সালে সফল জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য বিশ্বব্যাপী ব্যাপক সহানুভূতির পাশাপাশি এর স্থায়িত্ব সম্পর্কেও সন্দেহ তৈরি হয়। দরিদ্র জনগোষ্ঠী, জনসংখ্যার আধিক্য, যুদ্ধ বিধ্বস্ত অর্থনীতি, অসংগঠিত প্রশাসনিক রাজনৈতিক কাঠামো ইত্যাদি নেতিবাচক দিক থাকা সত্ত্বেও তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার রাষ্ট্রপরিচালনায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করে। নিচে কয়েকটি সাফল্য সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:

সংবিধান প্রণয়ন
রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাত্র নয় মাসের মধ্যে স্বাধীনতা সংগ্রামের চেতনা ধারণকারী একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়ন আওয়ামী লীগ সরকারের অন্যতম সাফল্য। সংবিধান প্রণয়নের লক্ষ্যে ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি 'অস্থায়ী সাংবিধানিক আদেশ' জারী হয়। ১৯৭২ সালের ২৩ মার্চ 'গণপরিষদ আদেশ' জারী করে ১৯৭০ সালে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ ও পূর্ব-পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত বাঙালি জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গণপরিষদ গঠিত হয়। এই গণপরিষদ সংবিধান প্রণয়নের দায়িত্ব প্রাপ্ত হয়। আইনমন্ত্রি ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ৩৪ সদস্য বিশিষ্ঠ খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটি ১৯৭২ সালের ১২ অক্টোবর খসড়া সংবিধানটি বিল আকারে গণপরিষদে উত্থাপন করেন এবং ৪ নভেম্বর তা গণপরিষদে গৃহীত হয়। জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা সংবিধানের মূল স্তম্ভরূপে বর্ণিত হয়। ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে বাংলাদেশের সংবিধান কার্যকর হয়।

নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রচলন
১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জনের কয়েকদিনের মধ্যেই প্রবাসী সরকার দেশে ফিরে আসে। কিন্তু জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন পর্যন্ত পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী ছিলেন। ১০ জানুয়ারি তিনি দেশে ফিরে এসে সরকারের নিয়ন্ত্রণভার গ্রহণ করেন এবং নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থা স্থাপনে মনোনিবেশ করেন। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সক্রিয় দোষর, দালাল এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সিদ্ধান্ত হয়। এ ছাড়াও ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র এবং সমাজতান্ত্রিক নীতিমালার ভিত্তিতে রাষ্ট্রপরিচালনার ঘোষণা দেওয়া হয়। বিভিন্ন বিষয়ে ত্বরিত ও সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ফলে ১৯৭২ সালেই অর্থনীতি পূর্ব বছরের ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে থাকে। এ ছাড়াও দুর্ভিক্ষ এড়ানো সম্ভব হয়, রক্তপাতের আশংকা অমূলক প্রমাণিত হয় এবং বাংলাদেশ সাতানব্বইটি রাষ্ট্রের স্বীকৃতি লাভ করে। আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম বছরটি মিশ্র সাফল্যের বলে মনে করা হয়। এর উপর ভিত্তি করে সরকারের কর্তৃত্ব স্থাপিত হয় এবং রাজনৈতিক কাঠামো তৈরির জটিল প্রক্রিয়া শুরু হয়।

মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রসমর্পণ
স্বাধীনতার পরও বিপুল পরিমাণ অস্ত্র যুদ্ধে অংশ গ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ছিল। দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রয়োজনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৭ জানুয়ারী, ১৯৭২ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র জমা দানের আহবান জানান। এ জন্য দশদিন সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়। তাঁর আহবানে সাড়া দিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র সমর্পণ করেন। ৩০ জানুয়ারী সারা দেশ থেকে আগত প্রায় ৫০,০০০ মুক্তিযোদ্ধা ঢাকায় অস্ত্র সমর্পণ করে শেখ মুজিবের নেতৃত্বের প্রতি আস্থা জ্ঞাপন করেন।

ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাবর্তন
বিজয় লাভের স্বল্পতম সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাবর্তন আওয়ামী লীগ সরকারের অন্যতম সাফল্য হিসাবে বিবেচিত হয়। সাধারণত দেখা যায় যে, কোন দেশের মুক্তি সংগ্রামে সাহায্যকারী বিদেশি সৈন্য স্বাধীনতার পরেও বছরের পর বছর থেকে যায়। এর ফলে নানা সমস্যা দেখা দেয়। আওয়ামী লীগ সরকার এ বিপদ সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। ভারত সরকারের সাথে সমঝোতার ভিত্তিতে ১২ মার্চ, ১৯৭২ সকল ভারতীয় সৈন্য বাংলাদেশ ত্যাগ করে।

পূর্নবাসন ও পুর্নগঠন কর্মসূচি
যুদ্ধের ফলে দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রায় ধবংস হয়ে যায়। যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত জনগণের পুনর্বাসন এবং জাতীয় অর্থনীতির পুনর্গঠনের জন্য সরকার অনেকগুলো পদক্ষেপ গ্রহণ করে। ভারত থেকে প্রত্যাগত এক কোটি শরণার্থী পুর্নবাসন, ৪ ৩ মিলিয়ন বাড়ি ঘর মেরামত ও নির্মাণ, যুদ্ধে গৃহহীনদের আশ্রয় ব্যবস্থা, নিরুপায় জনসাধারণের জন্য জমি, খাদ্য ও অন্যান্য উপকরণের যোগান দান ইত্যাদি গুরুত্ব সমস্যা মোকাবেলা জন্য সরকার বিভিন্ন প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিতে হয়েছিল। এ ছাড়াও নতুন নতুন এজেন্সী তৈরি করা হয়। জাতিসংঘ সহ বহু আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে বিপুল সাহায্য লাভে সরকার সফল হয়। ১৯৭৩ সালের মার্চে জাতীয় বাজেট ঘোষিত হয় এবং একটি পাচশালা পরিকল্পনা গৃহীত হয়।

জাতীয় সংসদ নির্বাচন
আওয়ামী লীগ সরকার নির্ধারিত সময়ের আগে ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন করে। এ নির্বাচনের ফলে সংসদীয় ব্যবস্থা অনুশীলনের পথ উন্মুক্ত হয়। নির্বাচনে জাতীয় সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ২৯৩ টি আসন লাভ করে।

বৈদেশিক নীতি ও জোট নিরপেক্ষতা
আন্তজাতিক রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ সরকার জোট নিরপেক্ষতার নীতি অবলম্বন করে। জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনকে গতিশীল করার জন্য শেখ মুজিবুর রহমান আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রয়াস চালান। বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় অবদানের জন্য তিনি 'জুলিও কুরি' পুরস্কার লাভ করেন। বৈদেশিক সাহায্য এবং কুটনৈতিক স্বীকৃতি লাভের ক্ষেত্রে সরকার সাফল্য অর্জন করে। বিশেষ করে বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করে ও ইসলামি ঐক্য সংস্থার (OIC) সদস্যপদও লাভ করে। সকলের প্রতি বন্ধুত্ব কারো প্রতি বিদ্বেষ নয়- আওয়ামী লীগ সরকারের অনুসৃত এই পররাষ্ট্র নীতি বিশ্বব্যাপী প্রশংসা পায়। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ এই পররাষ্ট্র নীতি অনুসরণ করছে।

রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সম্মোহনী ব্যক্তিত্ব এবং তাঁর প্রতি বাঙালিদের নিরংকুশ আস্থার কারণে আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম দিকে তেমন কোন সমস্যা হয় নি। বরং সমগ্র পরিস্থিতির উপর সরকার ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় সমর্থ হয়। কিন্তু এই স্থিতিশীল অবস্থা দীর্ঘদিন টিকতে পারে নি। মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত পক্ষ বিভিন্ন কৌশলে রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করে তোলার চেষ্টা করে। এছাড়া ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিগুলোর মধ্যে বিভাজন তৈরি হয়। তার সঙ্গে যুক্ত হয় বিদেশি ষড়যন্ত্র।

অর্থনৈতিক দুর্দশা
শুধু রাজনৈতিক স্বাধীনতা নয়, সে সাথে জাতির অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনও ছিলো মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের লক্ষ্য। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার অর্থনৈতিক অবস্থার তাৎপর্যপূর্ণ উন্নয়নে নানরূপ সমস্যা ও সংকটের মখোমুখি হয়। এ ক্ষেত্রে যুদ্ধ বিবধস্ত অর্থনীতি এবং বৈদেশিক সাহায্য লাভের ক্ষেত্রে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মহলের সহযোগিতার অভাব প্রধান প্রতিবন্ধক হিসাবে কাজ করে। ফলে দ্রব্যমূল্য ও জীবন যাত্রার ব্যয় বৃদ্ধিপায়। আমদানি রপ্তানির ব্যবধান বেড়ে যায়। জিডিপি কমে যায়, উৎপাদন হ্রাস পায়। ব্যবস্থাপনার অদক্ষতা, সমন্বয়ের অভাব, মুৎসুদ্দী শ্রেণীর দৌরাত্যু, অসাধুদের দুর্নীতি, ইত্যাদি কারণে আওয়ামী লীগ সরকার অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিভিন্ন নীতি গ্রহণ করলেও সেগুলোর যথাযথভাবে প্রয়োগ করা সম্ভব হয়নি। উপরন্তু সকল কল কারখানা জাতীয়করণ করায় এক ধরনের সংকটের সৃষ্টি হয়। ফলে উৎপাদন হ্রাস পায় ও জাতীয়করণসম্পন্ন শিল্প-কারখানাগুলো কাঙ্ক্ষিত উৎপাদনে সক্ষম হয়নি। দেশি বিদেশি ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে একদল ঘাতক খুনী স্বপরিবারে হত্যা করে।

যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমা
স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যুদ্ধাপরাধের বিচারের ঘোষণা দেন, যা ছিল বাঙালি জাতির দাবির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। পরবর্তীতে বিভিন্ন কারণে বিচার সংগঠিত হয়নি এবং বঙ্গবন্ধু কয়েকটি নির্দিষ্ট অপরাধ বাদে অন্যান্য অভিযুক্তদের সাধারণ ক্ষমা প্রদর্শন করেন। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু সরকার চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য যে আইন পাস করেছিল, '৭৫-র পরবর্তী কালে জেনারেল জিয়ার সরকার ঐ আইন বাতিল করে দেয়। এর সুযোগে স্বাধীনতা বিরোধিরা অবাধ জীবন যাপনের সুযোগ পায় এবং বিভিন্নভাবে সংগঠিত হতে থাকে।

বাঙালি জাতি এখনও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার এবং ২০০৯ সালে জাতীয় সংসদে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে প্রস্তাব পাস হয়েছে। সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে।

সারকথা
স্বাধীনতা পরবর্তীতে জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণের লক্ষ্য নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার পরিচালনা শুরু করে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট দেশি বিদেশি ষড়যন্ত্রের কারণে বঙ্গবন্ধু হত্যার ভেতর দিয়ে শাসনের সাফল্যের অগ্রগতি থেমে যায়। গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়ন, নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রচলন, মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র সমর্পণ, ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাবর্তন, পুনর্বাসন ও পুনর্গঠন, জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান -আওয়ামী লীগ সরকারের সাফল্যে নমুনা রূপে দেখা যেতে পারে। সামরিক অভ্যুত্থানের পূর্ব পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকারের জাতিগঠন ও রাষ্ট্রগঠন মূলত কর্মকান্ড সাফল্য হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে।


এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url