ওয়াকফ কি ওয়াকফের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ ওয়াকফের প্রক্রিয়া কোন কোন সম্পদ ওয়াকফ করা যায়

ওয়াকফের সংজ্ঞা, প্রকারভেদ ও গুরুত্ব ওয়াকফের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ সম্পর্কে আলোকপাত ওয়াকফের প্রক্রিয়া কোন কোন সম্পদ ওয়াকফ করা যায় তা উল্লেখ করতে পারবেন। ওয়াকফ শুদ্ধ হওয়ার শর্ত সম্পর্কে বিস্তারিকত আলোচনা করা হলো।


 ওয়াকফ সংজ্ঞা

আভিধানিক দৃষ্টিকোণ থেকে ওয়াকফ শব্দের অর্থঃ আটকানো বা বন্দী করা। ওয়াকফ করা অর্থ কোন কিছু আটক করে কারো জন্য নির্ধারণ করা।

পরিভাষায় ওয়াকফ বলা হয়, আল্লাহর রাস্তায় কোন কিছুর মূলস্বত্ত ও তার ভোগাধিকার প্রদান করা।

ওয়াকফ প্রকারভেদ

ইসলামি আইনশাস্ত্রের পরিভাষায় ওয়াকফ দু' প্রকার:

১. পারিবারিক ওয়াকফঃ নাতী-নাতীন বা নিকটতম কোন দরিদ্রকে ওয়াকফ করা।

২. কল্যাণমূলক ওয়াকফ: মানবকল্যাণের জন্য ওয়াকফ করা।

আরো পড়ুন: ইসলামি ব্যাংক ও সুদভিত্তিক ব্যাংকিং পদ্ধতির মধ্যে পার্থক্য

ওয়াকফ-এর গুরুত্ব

মহান আল্লাহ ওয়াকফ-এর বিধান প্রদান করেছেন এবং এ বিধানকে তার নিকটতম হওয়ার মাধ্যম সমূহের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে ঘোষণা করেছেন। ইসলাম পূর্ব জাহেলিয়াতের মানুষরা ওয়াকফ ব্যবস্থার সাথে পরিচিত ছিল না। রাসূল (সা)-ই এ বিধান প্রণয়ন করেন, তা পালনের আহবান জানান এবং এর মাধ্যমে ফকির অসহায় ও দুর্বলের প্রতি সহনশীল হতে উৎসাহ প্রদান করেন। অর্থনীতির ক্ষেত্রে ওয়াকফ-এর বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ দিক হল, এর দ্বারা দুনিয়াতে দারিদ্রদের পূনর্বাসন আর পরকালে ওয়াকফকারীর সওয়াব হাসিল।

আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত হাদীসে রাসূল (সা) বলেন-

মানুষ যখন মরে যায় তখন তার সকল আমল বন্ধ হয়ে যায়। তিনটি আমল ব্যতীত আর তা হচেছ সাদকায়ে জারিয়াহ, এমন ইলম যা দ্বারা মানুষ উপকৃত হয় এবং সৎ সন্তান যে তার জন্য দোয়া করে।" (মুসলিম, আবু দাউদ ও তিরমিযী)

এখানে সাদকায়ে জারিয়াহ বা প্রবাহমান সাদকাহ বলতে ওয়াকফ বুঝানো হয়েছে। ইমাম ইবনু মাজাহ বর্ণনা করেন, রাসূল (সা) বলেছেন-

"মুমিনের মৃত্যুর পর যে সব আমল ও ভাল কাজের ফলাফল সে পেতে থাকে তা হলঃ তার বিতরণ করা ইলম, রেখে যাওয়া সৎ সন্তান, ওয়ারিস হিসেবে পরিত্যক্ত কুরআনের পান্ডুলিপি, তার তৈরী করা মসজিদ বা মুসাফির খানা, তার খনন করা কুপ অথবা এ জাতীয় এমন সব সাদকাহ যা সে জীবিতাবস্থায় করেছিল তা মৃত্যুর পর তার সাথী হবে।"

ওয়াকফ-এর উৎপত্তি ও ক্রম বিকাশ

রাসূল (সা) নিজে ওয়াকফ করেছেন। সাহাবীগণ মসজিদ, জমি, কুপ, বাগান ইত্যাদি ওয়াকফ করেছেন। রাসূল (সা)-এর আমলে কৃত কিছু ওয়াকফ-এর দৃষ্টান্ত:

১. আনাস (রা) বলেন, রাসূল (সা) মদীনায় আগমন করে মসজিদ নির্মাণের নির্দেশ দিলেন এবং বললেন, হে বনী নাজ্জার গোত্রের লোকেরা। তোমরা কি তোমাদের এ বাগানের জায়গাটুকু বিনিময়ের মাধ্যমে আমাকে প্রদান করবে? তখন তারা বললঃ হে আল্লাহর রাসূল (সা) আমরা সেটাকে দান করব। তখন রাসূল (সা) সেটাকে (ওয়াকফ সম্পত্তি ) হিসেবে গ্রহণ করলেন এবং তাতে মসজিদ তৈরি করলেন। 

( তিন বিশুদ্ধ হাদীস গ্রন্থ )

২. হযরত উসমান (রা) বলেন, রাসূল (সা) বললেনঃ যে ব্যক্তি রুমা কুপ খনন করবে তার জন্য জান্নাত নির্ধারিত। অতঃপর আমি সে কূপ খনন করলাম। (বুখারী, তিরমিজী ও নাসায়ী)

৩. সায়াদ বিন ওবাদা রাসূল (সা)-কে জিজ্ঞেস করেন, হে আল্লাহর রাসূল (সা)। উম্মে সায়াদ ইন্তেকাল করেছে। সর্বোত্তম সাদকাহ কি? উত্তরে রাসূল (সা) বললেন, সর্বোত্তম সাদকাহ হল পানি দান করা। তখন তিনি একটি পানির কুয়া খনন করলেন অতঃপর বললেন, এ কুয়াটি উম্মে সায়াদের জন্য ওয়াকফ করা হল।

ওয়াকফ সাধারণত: দু' উপায়ে হয়।

১. মানুষের ক্রিয়া কর্ম দ্বারা। যেমন- কেউ মসজিদ তৈরি করে তাতে মানুষকে নামাজের হুকুম দেয়। এ ব্যাপারে ওয়াকফ চালু হওয়ার জন্য কোন সরকারী নির্দেশের প্রয়োজন হবে না।

২. কথা দ্বারা। তা প্রকাশ্যে হোক কিংবা আকার ইঙ্গিতে হোক। প্রকাশ্যের মানে হচ্ছে, ওয়াকফকারী বলবে আমি আমার এ মাল আল্লাহর রাস্তায় ওয়াকফ করলাম। আকার ইঙ্গিতে ওয়াকফের মানে হচ্ছে, ওয়াকফকারী বলবে আমার এ মালটি সাদকাহ করলাম এবং সে মনে মনে ওয়াকফের নিয়াত করবে। তাহলে সেটা ওয়াকফ হিসেবে পরিগণিত হবে।

ওয়াকফ যেমনভাবে মানুষের জীবদ্দশায় সম্পন্ন হতে পারে তেমনিভাবে মৃত্যুর পর শর্ত সাপেক্ষেও ওয়াকফ হতে পারে। যেমন- কোন ব্যক্তি বলল, এঘরটি বা ঘোড়াটি আমার মৃত্যুর পর আল্লাহর রাস্তায় ওয়াকফ করলাম। এ জাতীয় ওয়াকফ ইমাম আহমদের নিকট বৈধ। কেননা তা অন্তিম ওসিয়তের শামিল।

উপরোক্ত দু' উপায়েই ওয়াকফ প্রতিষ্ঠিত হবে। তবে সে জন্য ওয়াকফকারীর মধ্যে নিম্নোক্ত শর্ত পাওয়া যেতে হবে। ১. বুদ্ধি-বিবেক সম্পন্ন হওয়া, ২. প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া, ৩. স্বাধীন হওয়া ও ৪. নিজ ইচ্ছায় ওয়াকফ হওয়া।

ওয়াকফ প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে ওয়াকফকৃত সম্পদ বিক্রি করা অথবা অন্যকে দান করা যাবে না। এমন কি তাতে এমন কোন কাজ করা যাবে না, যাতে ওয়াকফের উদ্দেশ্য লংঘিত হয়। ওয়াকফকারী মৃত্যুমুখে পতিত হলে তার উত্তরাধিকারীরা তার মালিকানা ভোগ করতে পারবে না। কারণ মহানবী (সা) বলেন-

"ওয়াকফকৃত মাল বেচাও যাবে না, পূনরায় দানও করা যাবে না এবং কেউ তার উত্তরাধিকারী হতে পারবে না।" ( ফিকহুসসুন্নাহঃ ৩/৩৮১ )

ইমাম আবু হানীফার মতে, ওয়াকফকৃত মাল বিক্রয় জায়িয। আবার ইমাম মালেক ও আহমদ বলেন: ওয়াকফকৃত সম্পদের মালিকানা মৃতব্যক্তির উত্তাধিকারের মালিকানায় প্রবর্তিত হবে।

আমাদের কথা হল, কোন মাল ওয়াকফ করা হলে তার মালিকানা আল্লাহর হাতে চলে যায়। তার মালিক ওয়াকফকারীও থাকে না এবং ওয়াকফকৃত ব্যক্তির উপর তার মালিকানা পতিত হয় না।

আরো পড়ুন: ইসলামি রাষ্ট্রের ব্যয়ের খাতসমূহ

ওয়াকফ পদ্ধতি

ইতিপূর্বে আমরা উল্লেখ করেছি যে, ইসলামের দৃষ্টিতে ওয়াকফ দু' প্রকার: ১ নিকট আত্মীয়দের মধ্যে ওয়াকফ,

২. সেবা ও কল্যাণমূলক কাজে ওয়াকফ।

উল্লিখিত দু' প্রকার ওয়াকফের মধ্যে প্রথম প্রকার ওয়াকফ অর্থাৎ- নিকটাত্মীয়দের মধ্যে ওয়াকফ করাই উত্তম। কারণ এতে প্রথমতঃ ওয়াকফের সওয়াব মিলবে, দ্বিতীয়তঃ সিলা-রেহমী বা আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা পাবে।

ক) আনাস (রা) থেকে বর্ণিত আছে, মদীনায় সাহাবীগণের মধ্যে আবু তালহা আনসারী (রা) সর্বাপেক্ষা ধনী ছিলেন। বায়রুহা নামে তার একটি কূপ ছিল। তা মসজিদের নিকটবর্তী ছিল। রাসূল (সা) তা হতে পানি পান করতেন। যখন নিম্নোক্ত আয়াত অবতীর্ণ হয়-

"তোমরা যা ভালোবাস তা থেকে ব্যয় না করা পর্যন্ত তোমরা কখনো পুন্য লাভ করতে পারবেনা” 

( সূরা আলে-ইমরান: ৯২ )

তখন আবু তালহা রাসূল (সা)-এর নিকট এসে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল। বায়রুহা কুপটি আমার সর্বাপেক্ষা প্রিয়বস্তু। তা আমি আল্লাহর রাস্তায় দান করে দিলাম। তা আপনি যে কোন খাতে খাটাতে পারেন। আল্লাহর রাসূল (সা) অত্যন্ত খুশী হয়ে বললেন, এটা অত্যন্ত লাভজনক (পরকালের জন্য) সম্পদ। এটাকে তুমি তোমার নিকটাত্মীয়দের মধ্যে ওয়াকফ করে দাও। তখন আবু তালহা ঐ কুপটি তার আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে ওয়াকফ করে দেন। ( বুখারী ও মুসলিম )

খ) ইবনু উমর (রা) হতে বর্ণিত আছে, উমর (রা) খায়বারে একখন্ড সুন্দর জমিন পান। তখন উমর রাসূল (সা)-এর নিকট আসেন তা ওয়াকফ করার অনুমতির জন্য। তিনি রাসূল (সা)-এর নিকট এসে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল। আমি খায়বারে এমন একখন্ড জমি লাভ করেছি, যা আমার নিকট সর্বাপেক্ষা প্রিয়। ঐ জমিটি সম্পর্কে আপনি আমাকে কি আদেশ দেন? উত্তরে রাসূল (সা) বললেন, তুমি ইচ্ছা করলে তা নিজের হাতে রেখে তার ফসল সাদকাহ করতে পার। অর্থাৎ তার মালিকানা নিজ হাতে রেখে তার লব্দ ফসল ওয়াকফ করতে পার। তখন উমর (রা) তার জমিটি আল্লাহর রাস্তায় ওয়াকফ করে দিলেন, এ শর্তে যে, (১) তা কখনো বেঁচা যাবে না। (২) কাউকে হেবা করা যাবে না। (৩) কেউ তার উত্তরাধিকারী হতে পারবে না। (৪) তা দরিদ্র ও নিকটাত্মীয় অথবা দাস আজাদ করার ক্ষেত্রে, আল্লাহর রাস্তায়, মুসাফির এবং মেহমান খাওয়াতে সাদকা করা যাবে। আর যে ব্যক্তি তার ধারক-বাহক বা রক্ষণাবেক্ষণকারী হবে, সে ঐ মাল থেকে প্রয়োজনীয় অংশ খেতে পারবে এবং অন্য দরিদ্রকেও খাওয়াতে পারবে। ইমাম তিরমিযী বলেন, মহানবী (সা)-এর যুগ থেকে আজ পর্যন্ত এই হাদীসটির উপর আমল চলে আসছে। পূর্বপরের আলিমগণের মধ্যে এ বিষয়ে কোন মতবিরোধ আমার জানা নেই।

আর এটাই ইসলামে প্রথম ওয়াকফ।

গ) ইমাম বুখারী আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা) বলেন-

"যে ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধের জন্য কোন ঘোড়া লালন-পালন করবে, ঐ ঘোড়ার খাদ্য-খাদক, পেশাব-পায়খানা কিয়ামত দিবসে তার আমলনামায় যোগ হবে।"

কোন কোন সম্পদ ওয়াকফ করা যায়

সাজ-সরঞ্জাম, বই-পত্র, অস্ত্র-শস্ত্র, জন্তু-জানোয়ার ইত্যাদি স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি ওয়াকফ করা যায়। একইভাবে যে সব জিনিস ক্রয়-বিক্রয় বৈধ এবং তার অবয়ব অপরিবর্তনীয় এবং তা থেকে সর্বদা উপকার পাওয়া যায় সে সব সম্পদ ওয়াকফ করা বৈধ।

পক্ষান্তরে যে সব সম্পদ ক্ষয়প্রাপ্ত হয় মেযন- টাকা-পয়সা, মোম, খাদ্য-দ্রব্য, পানীয়, সুগন্ধি ইত্যাদি ওয়াকফ করা বৈধ নয়। যেসব সম্পদ ক্রয়-বিক্রয় বৈধ নয়, যেমন- বন্ধক রাখা বস্তু, বা কুকুর, শুকর, অন্যান্য হিংস্র জন্ত ও শিকারী পাখী (যা নখর দিয়ে শিকার করে) অর্থাৎ যেসব জানোয়ার ও পাখী হিংস্র এবং যা শিকার করে খাওয়া বৈধ নয়, তাও ওয়াকফ করা যাবে না।

ওয়াকফ শুদ্ধ হওয়ার শর্ত

ওয়াকফ নির্দিষ্ট ব্যক্তির উপর হতে হবে। যেমন- নিজ সন্তান অথবা আত্মীয় অথবা কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তির জন্য। এছাড়া কোন সৎকাজ যেমন- মসজিদ নির্মাণ করা ও পুল নির্মাণ করা অথবা কুরআন, ফিকহ বা দ্বীনী ইলম-এর জন্য ওয়াকফ করা।

পক্ষান্তরে ওয়াকফ অনির্দিষ্ট পুরুষ বা নারীর জন্য করা হলে, অথবা গুনাহর কাজে ওয়াকফ করা হলে, যেমন-ইয়াহুদী ও খৃষ্টানদের গীর্জা নির্মাণের জন্য ওয়াকফ করা হলে তা শুদ্ধ হবে না।

অবশ্য আহলুযযিম্মা তথা ইসলামি রাষ্ট্রে বসবাসরত অমুসলিমদের জন্য ওয়াকফ করা জায়েয। যেমনভাবে তাদের উপর সাদকাহ করা জায়িয। কেননা রাসূল (সা)-এর স্ত্রী সফিয়াহ তার ইয়াহুদী ভ্রাতার উপর ওয়াকফ করেছিলেন। যদি তওয়াফকারী সাধারণভাবে কিছু ওয়াকফ করে এবং ঐ ওয়াকফ কি খাতে ব্যয় হবে তা নির্ধারণ না করে, যেমন- বলে, এই ঘরটি ওয়াকফ, তবে এ ওয়াকফ ইমাম মালেকের নিকট শুদ্ধ হবে। কিন্তু ইমাম শাফেয়ীর নিকট তা শুদ্ধ হবে না। কারণ এতে ওয়াকফের মাছরাফ উল্লেখ নেই। অর্থাৎ কোন খাতে এ ওয়াকফকৃত মাল ব্যয় হবে তা উল্লেখ করা হয়নি। যদি কেউ নিজ নফসের উপর ওয়াকফ করে তবে কোন কোন আলেমের মতে সে ওয়াকফ শুদ্ধ হবে না। কারণ এতে ওয়াকফের মাছরাফ উল্লেখ নেই। অর্থাৎ কোন খাতে এ ওয়াকফকৃত মাল ব্যয় হবে তা উল্লেখ করা হয়নি। যদি কেউ নিজ নফসের উপর ওয়াকফ করে তবে কোন কোন আলেমের মতে সে ওয়াকফ শুদ্ধ হবে। তাদের দলীল হল, রাসূল (সা)-এর বাণী যা ঐ ব্যক্তি প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, যে ব্যক্তি রাসূল (সা)-কে বলেছিল, আমার নিকট একটি মাত্র দীনার আছে, তখন রাসূল (সা) তাকে বললেন-

"তা তুমি নিজ নফসের উপর সাদকাহ কর।" ( আবু দাউদ ও নাসাঈ )

এছাড়া ওয়াকফ-এর উদ্দেশ্য হল, আল্লাহর নৈকট্য লাভ। নিজ নফসের উপর সাদকাহ করাও আল্লাহর নৈকট্য লাভ বিষয়ক কাজ। এ মত পোষণ করেন ইমাম আবু হানীফা, আবু ইউসুফ ও আহমদ। অবশ্য ইমাম শাফেয়ী, মালেক ও তাদের অনুসারীদের নিকট নিজ নফসের উপর ওয়াকফ করলে তা শুদ্ধ হবে না। কারণ নিজ নফসের উপর ওয়াকফ করার মানে হল, নিজেকে মালিক বানানো। প্রকৃতপক্ষে ওয়াকফ করলে তওয়াফকারীর মালিকানা লোপ পায়।

ওয়াকফ বা ওসিয়তের সীমারেখা

ওয়াকফকারী বা ওসিয়তকারী তার অন্তিম শয্যায় যদি অনাত্মীয় কাউকে ওয়াকফ বা ওসিয়ত করতে চায়, তবে তা এক-তৃতীয়াংশের বেশী হতে পারবে না। যদি ওসিয়ত বা ওয়াকফ এক-তৃতীয়াংশের কম হয়, তবে তাতে উত্তরাধিকারীদের অনুমতির প্রয়োজন হবে না। আর যদি এক-তৃতীয়াংশের বেশী হয় তবে উত্তরাধিকারীদের অনুমুতির প্রয়োজন হবে।

ওয়াকফ যদি সকল উত্তরাধিকারীকে সমান ভাবে না দেয়া হয়

কেউ তার অন্তিম শয্যায় যদি তার সকল উত্তরাধিকারীকে সমভাবে ওয়াকফ বা ওসিয়ত না করে বরং কাউকে দেয় আবার কাউকে বঞ্চিত করে, তবে তার বৈধতার ব্যাপারে আলিমগণের মতবিরোধ রয়েছে।

ইমাম শাফেয়ী ও আহমদ বিন হাম্বলের মতে এ জাতীয় ওয়াকফ বৈধ নয়। অবশ্য অন্যদের নিকট এ জাতীয় ওয়াকফ বৈধ।

আমাদের কথা হল, এক্ষেত্রে শাফেয়ী ও আহমদের কথাই গ্রহণযোগ্য অর্থাৎ এজাতীয় ওয়াকফ বৈধ নয়।

ধনীদের উপর ওয়াকফ করা বৈধ কি-না

ওয়াকফ-এর উদ্দেশ্য হল, আল্লাহর নৈকট্য লাভ। সে জন্য ওয়াকফ-এর শর্তগুলো মানতে হবে। কিন্তু যদি কেউ শর্ত করে যে, ওয়াকফ শুধু ধনীদের উপরই করবে, তবে সে ওয়াকফ বৈধ হবে কি-না? এ ব্যাপারে আলিমগণের মধ্যে মতভেদ রয়েছে-

ক) কেউ কেউ বলেন, ধনীদের মধ্যে ওয়াকফ করা জায়িয। কেননা তাদের জন্য কোন ওয়াকফ করা গুনাহর কাজ নয়।

খ) আবার কেউ কেউ বলেন এ ওয়াকফ শুদ্ধ নয়। কারণ ধনীদের উপর ওয়াকফ-এর শর্ত করা বাতিল বা অগ্রাহ্য। এছাড়া ধনীদের উপর ওয়াকফ করলে দুনিয়াতেও লাভ নেই আর পরকালেও লাভ নেই। কারণ শুধু দরিদ্র বা অসহায়ের প্রতি দান করেই আল্লাহর নৈকট্য পওয়া যায়।

 ( সাইয়্যেদ সাবেক: ফিহুসসুন্নাহ: ৩৮৩-৩৮৪ )

ওয়াকফকারী বা ওসিয়তকারী এমন কোন শর্তারোপ করে, যা শরীয়তে ওয়াজিবও নয় এবং মুস্তাহাবও নয় অথবা শরীয়ত বহির্ভুত, তবে সে সব শর্ত বাতিল বলে ঘোষিত হবে।

*ওয়াকফ সম্পত্তির রক্ষক বা কর্মচারী তা হতে ভক্ষণ করতে পারবে কি-না?

ওয়াকফ-এর মুতাওয়াল্লী ওয়াকফ সম্পত্তি হতে প্রয়োজনবোধে খেতে পারবে। এ সম্পর্কে রাসূল (সঃ)-এর হাদীস রয়েছে। আব্দুল্লাহ বিন উমর বর্ণনা করেন, রাসূল (সা) বলেন-

"যে ব্যক্তি ওয়াকফ সম্পত্তির মুতাওয়াল্লী হবে, সে তা হতে সৎভাবে খেতে পারবে।" অর্থাৎ প্রয়োজন মতো গ্রহণ করতে পারবে। কিন্তু প্রয়োজনাতিরিক্ত গ্রহণ করতে পারবে না।

ইমাম কুরতুবী বলেন, ওয়াকফ-এর মুতাওয়াল্লী বা কর্মচারী প্রয়োজনবোধে ওয়াকফের মাল থেকে খেতে পারবে। এটাই সাধারণ নিয়ম। এ ক্ষেত্রে যদি ওয়াকফকারী এর উল্টা শর্তও করে তবুও খেতে পারবে। 

( ফিকহুসসুন্নাহঃ ৩/৩৮৫)

আরো পড়ুন: ইসলামি রাষ্ট্রের আয়ের উৎসসমূহ

ওয়াকফকে বদল করা

ওয়াকফকৃত মাল অন্যমালের সাথে বদল করা জায়িয। অবশ্য এক্ষেত্রে শর্ত হল, বদলকৃত মাল প্রথমবারের মালের চেয়ে অধিকতর ভাল হবে।

এ সম্পর্কে ইবনু তাইমিয়া বলেন: মান্নতকৃত বা ওয়াকফকৃত মাল অন্য অধিকতর ভাল মাল দ্বারা বদলানো জায়িয। এটা দু' প্রকারের হতে পারে:

(১) প্রয়োজনের খাতিরে বদল করা, যেমন- কোন ওয়াকফকৃত মাল অকেজো হয়ে গেলে তা বিক্রয় করে লব্দ অর্থ দ্বারা কোন কিছু খরিদ করা। যা প্রথম ওয়াকফের স্থলাভিষিক্ত হবে। যেমন- জিহাদের জন্য রক্ষিত ঘোড়া। যদি ঐ ঘোড়া দ্বারা যুদ্ধে কোন উপকার না হয়, তবে তা বিক্রয় করে ওয়াকফের মাল হিসেবে অন্য কিছু ক্রয় করবে। অনুরূপভাবে যদি কোন মসজিদের পার্শ্ববর্তী স্থান খারাপ হয়ে যায়, তবে তা অন্যত্র স্থানান্তর করা যাবে। অথবা তা বিক্রয় করে তার লব্দ অর্থ দ্বারা তার পরিবর্তে অন্য কিছু খরিদ করা যাবে, যা ঐ মসজিদের বিকল্প হবে। অনুরূপভাবে যদি ওয়াকফকৃত বস্তু দ্বারা ওয়াকফকারীর উদ্দেশ্য সাধিত না হয় তবে, তা বিক্রয় করে ঐ অর্থ দ্বারা ওয়াকফের নামে অন্য কিছু খরিদ করা যাবে। এ সবই জায়িয। কেননা আসল ওয়াকফকৃত বস্তু দ্বারা যদি ওয়াকফের উদ্দেশ্য হাসিল না হয় তবে তা বিক্রয় করে তার অর্থ দ্বারা এমন কিছু কিনতে পারবে, যা দ্বারা ওয়াকফের উদ্দেশ্য হাসিল হয়।

(২) ওয়াকফকৃত বস্তু অধিকতর কল্যাণার্থে বদল করা, যেমন- একটি নির্মিত মসজিদের বদলে অন্য একটি এমন মসজিদ নির্মাণ করা যা শহরবাসীদের জন্য অধিকতর উপকারে আসে। এ ক্ষেত্রে পূর্বের মসজিদটি বিক্রনয় করে দেবে। এটা আহমদ বিন হাম্বল ও তার অনুসারীদের অভিমত। তাদের দলীল হল, উমর ইবনুল খাত্তাব (রা) কুবার পূরাতন মসজিদের বদলে অন্যত্র একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। আর পুরাতন মসজিদটির স্থান পরবর্তীতে খেজুরের ভবন পরিবর্তন করে অন্য ভবন গ্রহণ করা অথবা মসজিদের ভবন বিক্রয় করে এটা দ্বারা অন্য মসজিদভবন ক্রয় করা সাহাবীগণের মধ্যেও ছিল। সূতরাং এটাকে সহজেই জায়িয বলা চলে।

এছাড়া ওয়াকফের ফসলের বদলে অন্য ফসল গ্রহণ করাও বৈধ, যা ওয়াকফের ফসলের চেয়ে অধিকতর ভাল। যেমন- কেউ দোকান ঘর অথবা একটি দোকান অথবা একটি বাগান অথবা একটি পানির মশক দান করল যদি তার বদলে পরবর্তীতে ওয়াকফের জন্য অধিকতর লাভজনক ঘর অথবা দোকান অথবা পানির মশক পাওয়া যায়, তাহলে পুরাতনগুলো বাদ দিয়ে নতুনগুলো সংগ্রহ করতে হবে। চাই তা বদলের মাধ্যমে হোক বা ক্রয়-বিক্রয়ের মাধ্যমে হোক।

অপরপক্ষে ইমাম আবু হানীফা, ইমাম মালেক ও ইমাম শাফেয়ীর মতে, মসজিদের বদল করা জায়িয নেই। তদ্রূপ ওয়াকফকৃত জমির বদলে অন্য জমি গ্রহণ জায়িয নেই। তাদের দলীল হল, রাসূল (সা)-এর হাদীস-

"ওয়াকফের মূলস্বত্ব বিক্রয় করা যাবে না, তার বদলে কিছু ক্রয় করা যাবে না এবং কেউ তার উত্তরাধিকারী হতে পারবে না।"

কিন্তু এখানে ইমাম আহমদ-এর অভিমতই অধিকতর গ্রহণযোগ্য। কেননা এ ব্যাপারে সরাসরি হাদীস থেকে দলীল রয়েছে। আর এটাই অধিক যুক্তি সংগত।

ওয়কফ দ্বারা উত্তরাধিকারীদের কারো ক্ষতি সাধন করা যাবে না।

ওয়াকফ দ্বারা কোন উত্তরাধিকারীর স্বার্থহানী করা নিষিদ্ধ। যেমন- কোন ওয়াকফকারী কয়েকজন উত্তরাধিকারীর মধ্যে কাউকে বাদ দিয়ে কাউকে কোন কিছু ওয়াকফ করলে তা বাতিল বলে বিবেচিত হবে। কেননা রাসূল (সা) বলেন-

"ইসলামের নীতি অনুসারে কেউ নিজেও ক্ষতিগ্রস্ত হবে না আবার কাউকে ক্ষতিগ্রস্ত করাও যাবে না।"

মূল কথা হল, মহান আল্লাহ সিলাহরেহমী বা আত্মীয়তার বন্ধন সুদৃঢ় রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু উত্তরাধিকারীদের কাউকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে দিলে তাতে আত্মীয়তার ছেদন করা হয়। সূতরাং এ ধরনের ওয়াকফ বাতিল বলে ঘোষিত হবে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, কোন লোক তার উত্তরাধিকারীদের মধ্যে মেয়েদের বাদ দিয়ে শুধু ছেলেদের জন্য ওয়াকফ করলে ইসলামের দৃষ্টিতে সে ওয়াকফ বাতিল বলে ঘোষিত হবে। অনুরূপভাবে ছেলেদের কাউকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে ওয়াকফ করলেও তা বাতিল বলে প্রমাণিত হবে। কেননা এক ব্যক্তি রাসূল (সা)-এর নিকট এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল (সা)। আমি আমার এক ছেলেকে একটি বাগান ওয়াকফ করেছি। রাসূল (সা) জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি সকলকে সমভাবে ওয়াকফ করেছ? উত্তরে লোকটি বলল, না আমি সকলকে সমভাবে দেইনি। তখন রাসূল (সা) বললেন-

"আমি জুলম বা অত্যাচারের সাক্ষী হতে পারি না।"

কেননা এ জাতীয় ওয়াকফ দ্বারা আল্লাহর নৈকট্য লাভের আশা করা হয়নি; বরং এর দ্বারা আল্লাহর বিরোধিতা করা হয়েছে এবং আল্লাহর শরীয়তের বিদ্রোহিতা করা হয়েছে। আর এ ওয়াকফ দ্বারা শয়তানের সন্তুষ্টি চাওয়া হয়েছে।

অথচ আজ-কাল বেশীরভাগ ওয়াকফ এ ধরনেরই হয়ে থাকে। এ ছাড়া কতিপয় লোক এমনও পাওয়া যায় যারা জনস্বার্থে ওয়াকফ না করে নিজেদের উত্তরাধিকারীদের মধ্যে ওয়াকফ করে, যাতে সম্পদ তাদের বংশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। এ জাতীয় ওয়াকফের উদ্দেশ্য হল, আল্লাহর শরীয়তের বিরোধিতা করা। অবশ্য সন্তানসন্ততি নেক্কার হলে অথবা ইলমে দ্বীন হাসিলকারী হলে, তাদের উপর ওয়াকফ করলে তা সঠিক ওয়াকফ বলে বিবেচিত হতে পারে এবং তা দ্বারা আল্লাহর নৈকট্য লাভ সম্ভব হতে পারে। পক্ষান্তরে নিজ উত্তরাধিকারীরা সৎকর্মপরায়ণ না হলে তাদের উপর ওয়াকফ করা প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে নয়, বরং তার মানে হচ্ছে, তাদেরকে একচ্ছত্রভাবে সম্পদ ভোগের অধিকার দেয়া।

উত্তরাধিকারীদের কাউকে বিশেষভাবে কিছু ওয়াকফ না করে সমস্ত সম্পত্তি এমনিতেই ছেড়ে দেয়া ভাল। মৃত্যুর পর উত্তরাধিকারীরা কুরআনের বণ্টন নীতি অনুযায়ী সম্পদের মালিক হবে। আর ওয়াকফ বা ওসিয়ত করতে হলে, তা সাধারণভাবে মঙ্গলময় ও জনকল্যাণমূলক কাজের জন্য করতে হবে। কিন্তু বর্তমান যুগে অহরহ এর বিপরীত ঘটছে।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url