১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন
১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন বলতে কী বুঝায় তা বর্ণনা করতে পারবেন।১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের অধীনে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের প্রকৃতি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করতে পারবেন। প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের কার্যকরিতা সম্পর্কে বলতে পারবেন।
ভূমিকা
ভারতবর্ষের জনগণকে ব্রিটিশ সরকারের শাসন ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ত করার অভিপ্রায়ে এবং তাদেরকে অপেক্ষাকৃত উত্তমরূপে শাসন করবার লক্ষ্যে ব্রিটিশ সরকার বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন আইন পাস করেছে। এ সমস্ত আইন ব্রিটিশ ভারতের সাংবিধানিক ক্রমবিকাশের ইতিহাসের অগ্রগতিকে বহুদূরে এগিয়ে নিয়ে যায়। ১৮৬১ সালের ভারতীয় কাউন্সিল আইন সাংবিধানিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে সর্বপ্রথম এবং সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য স্তম্ভ বা ফলক। কারণ এই আইনের মধ্যে দিয়েই প্রতিনিধিত্বশীল ব্যবস্থার জন্ম হয়। যদিও এ ব্যবস্থা ছিল পরোক্ষ পদ্ধতির। অচিরেই এই আইনের ত্রুটিগুলো ধরা পড়ে। এরপর ১৮৯২ সালে কাউন্সিল আইন পাস হয়। তবে ১৯০৯ সালের মর্লি-মিন্টো সংস্কারের ফলে ভারতবর্ষে প্রথমবারের মতো নির্বাচনের নীতি প্রবর্তন করা হয়। ১৯০৯ সালের আইন অনুসারে প্রাদেশিক আইন পরিষদগুলোতে নির্বাচিত সদস্যের সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে এই সব আইন পরিষদগুলো গভর্নর ও গভর্নর জেনারেলের উপদেষ্টা কমিটি হিসাবেই কাজ করত। এদের আইন প্রণয়নের প্রকৃত কোন ক্ষমতো ছিল না। পরবর্তীতে ব্রিটিশ সরকার ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইন পাস করে ভারতবর্ষে পর্যায়ক্রমে দায়িত্বশীল শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তনের পদক্ষেপ গ্রহণ করে। কিন্তু ভারতের সব রাজনৈতিক দলই একে অসম্পূর্ণ, অসন্তোষজনক ও নৈরাজ্যকর বলে ঘোষণা করে। ফলে ব্রিটিশ সরকার ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন ঘোষণা করেন। ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন ভারতের শাসনতান্ত্রিক ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে রয়েছে। বস্তুত ভারতীয় জনগণের মধ্যে জাতীয়তাবোধের উন্মেষ, রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ এবং ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইনের ব্যর্থতার ফলশ্রুতি হলো ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন। বলা যায় এ আইন পরবর্তীকালে ভারতের রাজনৈতিক অগ্রগতি এবং ১৯৪৭ সালের ভারতীয় স্বাধীনতা আইনের মূলভিত্তি রচনা করে। অবসান ঘটে ব্রিটিশ শাসনের। স্বাধীনতা লাভ করে ভারত ও পাকিস্তান নামের রাষ্ট্র।
সুতরাং এদিক থেকে বিবোচনা করলে ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইন এবং ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। 'ভারত শাসন আইন ও রাজনৈতিক ক্রমবিকাশ (১৯১৯-১৯৩৭)' শীর্ষক ইউনিটের বিষয়কে আমরা দুটি ভাগে বিভক্ত করে আলোচনা করব।
আরো পড়ুন: ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচন ও তার ফলাফল
প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের অর্থ কী?
১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ছিল প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন। স্বায়ত্তশাসন বলতে বুঝায় 'স্বশাসন'। শব্দগত অর্থে তাই প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন বলতে বুঝায় প্রদেশের নিজস্ব শাসন। কিন্তু 'রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন কথাটির অর্থ আরও ব্যাপক। সংবিধানের আওতায় কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়শ ণমুক্ত থেকে প্রাদেশিক সরকার পরিচালনার ক্ষমতোাকেই তারা প্রাদশিক স্বায়ত্তশাসন বলে অভিহিত করেছেন।
প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের ধারণা যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থার সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কযুক্ত। যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থায় সরকারের সব ক্ষমতো সংবিধানের মাধ্যমে সংবিধানিক নিয়মানুযায়ী কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকার একে অপরের কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ হতে মুক্ত ও স্বাধীন থেকে নিজ নিজ কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করবে। এটিই যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সাধারণত প্রতিরক্ষা, বৈদেশিক সম্পর্ক এবং অর্থ এ তিনটি বিষয় কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে থাকে।
প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের ধারণা তিনটি নীতির উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে
১। আইন প্রণয়ন ও শাসনকার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রদেশগুলো কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণমুক্ত থাকবে এবং সেই সাথে প্রাদেশিক আইন সভা প্রাদেশিক সরকারেরও নিয়ন্ত্রণমুক্ত হবে। অর্থাৎ সংবিধানে প্রদেশের জন্য যে বিষয়গুলো নিদিষ্ট করে দেওয়া হবে সেগুলো পরিচালনার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকার প্রাদেশিক সরকারের উপর কোনরূপ হস্তক্ষেপ করতে পারবে না।
২। প্রদেশগুলোতে দায়িত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে। অর্থাৎ প্রাদেশিক মন্ত্রিসভা গঠিত হবে। প্রাদেশিক আইনসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের সমর্থনে মন্ত্রিসভা তাদের কাজের জন্য আইন সভার কাছে দায়ী থাকবে।
৩। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে প্রদেশগুলোকে আত্মনির্ভরশীল হতে হবে। জাতীয় সম্পদ ও রাজস্ব বণ্টনের ক্ষেত্রে এমন নীতিমালা গ্রহণ করতে হবে যেন কোন প্রদেশকে আর্থিক ক্ষেত্রে কেন্দ্রের ওপর নির্ভরশীল হতে না হয়।
১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের আওতায় প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের প্রকৃতি
১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে সর্বভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনা করা হয়। প্রস্তাবিত এ যুক্তরাষ্ট্রে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন প্রবর্তনের ব্যবস্থা করা হয়। প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের লক্ষ্যকে সামনে রেখে এই আইনে শাসন সংক্রান্ত বিষয়গুলোকে কেন্দ্রীয়, প্রাদেশিক ও যুগ্মতালিকায় ভাগ করা হয়। প্রাদেশিক বিষয়গুলোর পরিচালনার ভার প্রাদেশিক সরকারের উপর অর্পিত হয়। একই সঙ্গে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইনে প্রদেশে যে দ্বৈতশাসন প্রবর্তন করা হয়েছিল তা বাতিল করে দেওয়া হয়। গভর্নর ও মন্ত্রিসভা গঠিত হয় প্রাদেশিক আইনসভার সদস্যদেরকে নিয়ে। প্রাদেশিক মন্ত্রিসভাকে আইনসভার নিকট দায়ী করা হয়। এভাবেই ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে তত্ত্বগতভাবে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়।
প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনকে ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের প্রাণকেন্দ্র বলা চলে। প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনই ছিল এর মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। এন সি রায় এ সম্পর্কে বলেন যে "প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন ভারতের নতুন শাসনতন্ত্রের (১৯৩৫) ভিত্তিপ্রস্তর স্বরূপ।"
ব্রিটিশ সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই ভারতে স্বায়ত্তশাসন প্রদান করবে বলে ঘোষণা করে। ১৯১৭ সালে ঘোষণা করা হয় যে, যত শীঘ্র সম্ভব ভারতের প্রদেশগুলোর পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা করাই ব্রিটিশ সরকারের অন্যতম লক্ষ্য। এ ঘোষণার ফলসরূপ ১৯১৯ সালের মন্টেও চেমসফোর্ড আইনে হস্তান্তরিত বিষয়গুলোর উপর আংশিক স্বায়ত্তশাসন প্রবর্তনের ব্যবস্থা করা হয়।
১৯২৭ সালে সাইমন কমিশন প্রদেশগুলোতে পুনরায় পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রবর্তনের সুপারিশ করে। কিন্তু ভারতীয় জনগণ একে "সাদা কমিশন" নামে আখ্যায়িত করে বর্জন করে। পরে ১৯৩৫ সালের ভদাত শাসন আইনের মাধ্যমে আবার প্রাদেশিক স্বায়ওশাসন প্রবর্তন করা হলেও ভারতীয় জনগণের প্রত্যাশিত আশা আকাঙ্ক্ষা পূরণ সম্ভব হয় নি।
অবশ্য এ আইনের মাধ্যমেই সর্বপ্রথম প্রাদেশিক বিষয়গুলোকে সুস্পষ্ট শ্রেণীতে ভাগ করা হয় এবং প্রাদেশিক বিষয়গুলোকে কেন্দ্রীয় বিষয়গুলো থেকে সম্পূর্ণ আলাদা করে দেওয়া হয়। কাজেই বলা যায় ১৯৩৫ সালের ভারত আইনের মধ্যদিয়ে মোটামুটি ভাবে এক ধরনের দায়িত্বশীল স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থা কায়েম হয়।
যে নীতিগুলোকে সামনে রেখে ১৯৩৫ সনে ভারতে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন প্রবর্তন করা হয়েছিল সেগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, এটি মোটেই পূর্ণাঙ্গ ছিল না। আমরা পরবর্তীতে আলোচনার মাধ্যমে এই বক্তব্যটি যাচাই করবো।
১। প্রাদেশিক গভর্নর নিয়মতান্ত্রিক প্রধান ছিলেন না
সংসদীয় ও দায়িত্বশীল সরকার ব্যবস্থায় প্রাদেশিক গভর্নর নিয়মতান্ত্রিক শাসকে পরিণত হন। প্রকৃত ক্ষমতা নাস্ত থাকে নির্বাচিত প্রাদেশিক সরকারের হাতে। কিন্তু ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে প্রাদেশিক গভর্নররা নিয়মতান্ত্রিক শাসক ছিলেন না। বরং তারাই ছিলেন প্রকৃত শাসক। তাদের ওমাতা ছিল অসীম ও অনিয়ন্ত্রিত। যেমন, তাঁরা যে কোন সময় প্রাদেশিক মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত অগ্রাহ্য করতে পারতেন।
২। গভর্নরের নিয়োগ পদ্ধতি
গভর্নরগণ ছিলেন ব্রিটিশরাজ্যের প্রতিনিধি তাঁরা ব্রিটিশ রাজা কর্তৃক নিযুক্ত হতেন এবং শাসন ক্ষমতা লাভ করতেন। এ ধরনের নিয়োগ পদ্ধতি স্বায়ত্তশাসন নীতির সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ ছিল।
৩। গভর্নরের সীমাহীন ক্ষমতা
প্রাদেশিক গভর্নরের হাতে যে প্রভূত ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল তা প্রাদেশিক স্বায়ওশাসনের মৌলিক ধারণার সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ ছিল। যেমন
ক. আইন সভার উপর নিয়ন্ত্রণ
প্রাদেশিক গভর্নর তাঁর স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতাবলে আইন পরিষদের নিম্নকক্ষ ভেঙে দিতে পারতেন। আইন সভা প্রণীত বিল গভর্নরের সম্মতির জন্য প্রেরিত হলে তিনি এতে ভেটো প্রয়োগ করতে পারতেন এবং প্রাদেশিক আইন সভায় ইচ্ছোর বিরুদ্ধে গভর্নরের আইন ও অধ্যাদেশ জারি করতে পারতেন।
খ. আইন সভার আর্থিক ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ
প্রাদেশিক সরকারের আয় ব্যয়ের ক্ষেত্রে গভর্ণরগণ আইনসভার উপর প্রাধান্য বিস্তার করতে পারতেন। প্রাদেশিক আইনসভা কর্তৃক বাতিলকৃত কোন ব্যয় বরাদ্দ পুনঃবহাল করার ক্ষমতা গভর্নরদেরকে প্রদান করা হয়েছিল।
গ. মন্ত্রিদের উপর গভর্নরের নিয়ন্ত্রণ
সংসদীয় গণতন্ত্রের রীতিনীতি অনুযায়ী মন্ত্রিসভার হাতেই প্রকৃত শাসন ক্ষমতা ন্যস্ত হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই গভর্নর মন্ত্রিদের সাথে পরার্মশ না করেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন। বিশেষ দায়িত্ব পালনের অজুহাতে গভর্নর মন্ত্রিসভার যে কোন পরার্মশ উপেক্ষা করতে পারতেন। এমনকি গভর্নর মন্ত্রিসভাকে ভেঙেও দিতে পারতেন।
৪। প্রদেশিক আইন সভার সীমাবদ্ধতা
প্রাদেশিক আইনসভা সকল বিষয়ে আইন প্রণয়ন করতে পারতো না। যেমন ব্রিটিশ জনগণের বাণিজ্যিক স্বার্থের প্রতি হুমকি বা বৈষম্য সৃষ্টি করতে পারে এধরনের কোন বিষয়ে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা প্রাদেশিক আইন পরিষদকে দেওয়া হয় নি।
৫। যুগ্ম তালিকার ক্ষেত্রে কেন্দ্রের প্রাধান্য
১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে যুগ্মতালিকাভুক্ত বিষয়গুলোর উপর আইন প্রণয়নের ক্ষমতা কেন্দ্র ও প্রদেশের উপর অর্পণ করা হয়। কিন্তু বাস্তবে যুগ্মতালিকাভুক্ত বিষয়ের উপর প্রাদেশিক সরকারের কোন ক্ষমতা ছিল না বললেই চলে। কারণ যুগ্মতালিকাভুক্ত বিষয়ে মতোবিরোধ দেখা দিলে সব সময় কেন্দ্রের অভিমতোই বলবৎ থাকতো।
৬। প্রাদেশিক বিষয়ে বহিঃশক্তির নিয়ন্ত্রণ
ব্রিটিশ সরকার নির্দেশ নামা জারির মাধ্যমে ভারতবর্ষের যে কোন প্রাদেশিক বিষয় নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন।
৭। প্রাদেশিক সরকারের প্রশাসন নিয়ন্ত্রণের সীমিতো ক্ষমতা
প্রাদেশিক প্রশাসনে নিযুক্ত আই.সি এস ও আই.পি এস প্রভৃতি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাগণ ভারত সচিব কর্তৃক নিয়োগ প্রাপ্ত হতেন। এ সব উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাগণ গভর্নর জেনারেল, গভর্নর ও সচিবের মাধ্যমে পরিচালিত হতেন বলে তারা প্রাদেশিক মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত ও আদেশ নির্দেশের প্রতি ইচ্ছাকৃত ভাবে উদাসীন ও অবহেলা দেখাতেন।
আরো পড়ুন: মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ ১৯৬১
৮। গভর্নরের নিয়ন্ত্রণাধীন আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বিভাগ
বিশেষ করে পুলিশ বিভাগের অভ্যন্তরীণ সংগঠন এবং প্রদেশের আইন শৃংখলা রক্ষার বিষয়ে মন্ত্রিসভার পরিবর্তে গভর্নরের একক নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় প্রাদেশিক স্বায়ওশাসনের মূলনীতিই বিনষ্ট হয়েছিল।
৯। গভর্নর জেনারেলের অপ্রতিহত ক্ষমতা
গভর্নর জেনারেলের ব্যাপক ক্ষমতা স্বায়ত্তশাসনের মৌলিক নীতিকে খর্ব করেছিল। যেমন:
ক. গভর্নর জেনারেল কর্তৃক গভর্নরদের উপর নিয়ন্ত্রণ
যেসব ক্ষেত্রে গভর্নরগণ 'স্বীয় বিচারবুদ্ধি বলে' বিশেষ দায়িত্ব পালন করতেন সে সব ক্ষেত্রে গভর্নরগণ সরাসরি গভর্নর জেনারেলের নিয়ন্ত্রণাধীনে থেকে কাজ করতে বাধ্য ছিলেন।
খ. গভর্নর জেনারেল কর্তৃক জরুরি অবস্থা ঘোষণা
গভর্নর জেনারেল জরুরি অবস্থা ঘোষণা করলে কেন্দ্রীয় আইন সভা প্রাদেশিক বিষয়ে আইন প্রণয়ন করতে পারতেন। শাসনতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক অচলাবস্থা সৃষ্টির অজুহাতে গভর্নর জেনারেল প্রাদেশিক মন্ত্রিসভা ও আইনসভা ভেঙে দিয়ে প্রদেশের শাসন ক্ষমতা স্বহস্তে গ্রহণ করতে পারতেন।
গ) গভর্নর জেনারেলের উপদেশাবলী
গভর্নর তাঁর ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষেত্রে গভর্নর জেনারেলের কাছ থেকে উপদেশ পেতেন। এসব উপদেশাবলিকে গভর্নরগণ আদেশের মতোই মান্য করতেন।
সুতরাং বলা যায় যে, ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের প্রদত্ত স্বায়ত্তশাসন শুধু তরেই ছিল রাস্তাব ছিল না। ভারত সচিব, গভর্নর জেনারেল ও গভর্নরদের সীমাহীন ক্ষমতার কারণে এ প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন 'আড়ম্বরপূর্ণ প্রহসনে' পরিণত হয়।
১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের কেবলমাত্র প্রাদেশিক অংশটুকুকে কার্যকর করা হয় ১৯৩৭ সালে। এ আইন অনুসারে ১৯৩৭ সালে প্রাদেশিক আইন পরিষদ গঠনের জন্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে সর্বভারতীয় দুটো রাজনৈতিক দল কংগ্রেস ও মুসলীম লীগ সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করে।
নির্বাচনে যে এগারোটি প্রদেশে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় তাতে কংগ্রেস ছয়টি প্রদেশে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। মুসলীম লীগ চারটি প্রদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করলে কোয়ালিশন সরকার গঠনের ইঙ্গিত প্রদান করে। কিন্তু একক ভাবে কংগ্রেস মন্সিভা গঠন করলে রাজনৈতিক পরিস্থিতি চরম আকার ধারণ করে। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে কংগ্রের মন্ত্রিরা একে একে পদত্যাগ করে। অবসান ঘটে ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের কার্যকারিতা।
সারকথা
১৯৩৫ সালের ভারতশাসন আইনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ন বৈশিষ্ট্য ছিল প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন। এ আইনের মাধ্যমে প্রদেশিক স্বায়ত্তশাসন প্রবর্তনের কথা ব্রিটিশ সরকার ঘোষণা করলেও এই ব্যবস্থা ছিল ত্রুটিপূর্ণ কাজ। ফলে ১৯৩৫ সালের আইন বাস্তব প্রয়োগে ব্রিটিশ সরকার ব্যর্থ হয়। অবশ্য একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে ব্রিটিশ সরকার ভারতবাসীর রাজনৈতিক দাবি জাতীয়তাবাদের উদ্ম্মেয় এবং ক্রমবর্ধমান অধিকার ও সচেতনতার আগে বাধ্য হয়ে ধীরে ধীরে দায়িত্বশীল সরকার গঠনের জন্য ক্রমাগতই উন্নততর ভারত শাসন আইন প্রবর্তনের পদক্ষেপ গ্রহণ করে। ১৮৬১, ১৮৯২, ১৯০৯ ১৯১৯ সালের ভারত আইন অপেক্ষা ১৯৩৫ সালের আইনের প্রস্তুতি, বৈশিষ্ট্যই এর উদাহরণ।
তথাপি এর ত্রুটি, অবাস্তব কাঠামো ক্ষমতা কটন প্রভৃতি নীতিগুলোর কারণে ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url