ইবন সিনার চিকিৎসা ও অন্যান্য

এই আর্টিকেলটিতে ইবন সিনার চিকিৎসা ও অন্যান্য বিজ্ঞান সম্পর্কে জ্ঞানের পরিচয় পাবেন, ইবন সিনার উপর গ্রীসীয় প্লেটোনিক-এরিস্টটলীয় দর্শনের প্রভাব বর্ণনা করতে পারবেন, ইসলামী শরীয়াভিত্তিক নীতির ভিত্তিতে জীবন, সমাজ ও আদর্শ রাষ্ট্র গঠনের অনুকূলে ইবন সিনার চিন্তা সম্পর্কে ব্যাখ্যা করতে পারবেন।

ভূমিকা ও বৈচিত্র্যময় ব্যক্তি জীবন 

ইবন সিনার পিতা আবদুল্লাহ "মাওরাউন নাহার"-এর সামানী আমীর দ্বিতীয় নুহের সময়ে (৯৭৬-৯৯৭ খ্রি:) নিজ জন্মভূমি বাল্ব থেকে বুখারায় উচ্চপদে নিযুক্ত হয়ে আগমন করেন। এর স্বল্প কাল পরে রাজস্ব বিভাগের এক পদে নিয়োগ দিয়ে তাকে পাঠানো হয় খারামসীন-এ। এই স্থানের সন্নিকটে আফাসানা নামক গ্রামে তিনি বিয়ে করেন এবং এখানেই সফর ৩৭০, আগষ্ট ৯৮০ খ্রিষ্টাব্দ ইব্‌ন সিনা জন্মলাভ করেন। মুসলিম জাহানের এই চিন্তাবিদের পুরো নাম আবু আলী আল হুসাইন ইব্‌ন আবদুল্লাহ ইবন সিনা। তিনি ল্যাটিন ভাষায় Avicenna এবং হিব্রু ভাষায় Aven Sina নামে খ্যাত। সাম্প্রতিককালে পাশ্চাত্যে তাঁর ইবনে সিনা নামটি চালু হয়েছে। ইব্‌ন্ন সিনা বহু বিদ্যায় দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন। তিনি চিন্তাবিদ, চিকিৎসক, সাহিত্যিক, জ্যোতির্বিদ ছিলেন। মুসলিম বিশ্বের প্রতিভাধর মুসলিম বিজ্ঞানী ইব্‌ন সিনা "আশ শায়খুর রাঈস" বা প্রধান শায়খ নামে পরিচিত হয়ে আছেন আজো। বস্তুতঃ দুনিয়ার সব জাতি, দেশ, কালের সেরা চিন্তাবিদ ব্যক্তিদের একজন তিনি।

রচনাবলী ও জ্ঞানের প্রসারতা

ইবন সিনা অল্প বয়সেই লেখালেখি শুরু করলেও জুরজান, হামাদান ও ইসফাহানের শাহী দরবারেই তাঁর রচনাশক্তির বহিপ্রকাশ ঘটে। গদ্যে ও পদ্যে এবং আরবী ও ফারসীতে রচিত ইবন সিনার রচনাবলী বিশাল। অল্প বয়সে রচনা করলেও ইবন সিনার কয়েক খন্ডে প্রকাশিত "আশ্ শিফা" অত্যন্ত প্রভাব বিস্তারকারী হয়ে উঠে। এতে তিনি দর্শন, ন্যায়শাস্ত্র ও অধিবিদ্যার উপর তাঁর মতামত তুলে ধরেন। এই গ্রন্থের সংক্ষিপ্ত রূপ হিসেবে তিনি রচনা করেন "আন্ নাজাত"। জীবন সায়াহ্নে এসে নিজের চিন্তার সংশোধন করে তিনি "আল ইশারাত ওয়াত তান্নীহাত" নামক গ্রন্থ রচনা করেন। ইন্ন সিনার এ সব গ্রন্থ বহু ভাষাতে প্রকাশিত হয়েছে এবং বহু সংখ্যক পন্ডিত এ সব গ্রন্থের টীকা-ভাষ্য লিখেছেন।

চিকিৎসা বিজ্ঞানে মৌলিক অবদানের স্বাক্ষর ইবন সিনার "আল কানুন ফিত্ তিব্ব" বা সংক্ষেপে "আল-কানুন"। প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের সকল স্থানে সাতশ বছর ধরে অর্থাৎ সতের শতক পর্যন্ত চিকিৎসা বিজ্ঞানের অধ্যাপনা আল কানুনের ভিত্তিতে হতো।

পদার্থ বিদ্যা, নভোমন্ডলীয় বিদ্যা, মানবীয় বৃত্তি বিদ্যা, আইন সম্পর্কীয় বিষয়, ভাষা ও বর্ণমালা, চুক্তি, নীতিশাস্ত্র, তাল-মান-লয়সহ সঙ্গীত ইত্যাদি সকল বিষয়ে গভীর পারদর্শিতা দেখিয়েছেন ইবন সিনা। তাঁর "আশ্ শিফা" গ্রন্থের সঙ্গীত ও সুর লহরীর বিশদ বিশ্লেষণ আল ফারাবী অপেক্ষাও উন্নততর।

"ফী আক্সামিল উলুমিল আক্লিয়া" যার অন্য নাম তাকাসীমুল হিকমা ওয়াল উলুম বা জ্ঞান বিজ্ঞানের শ্রেণী বিভাগ, সেখানে ইবন সিনা চিন্তামূলক, পদার্থ বিষয়ক ছাড়াও অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে ব্যবহারিক বিজ্ঞান হিসেবে নীতি বিজ্ঞান, গার্হস্থ্য বিজ্ঞান, অর্থনীতি ও রাজনীতিকে চিহ্নিত করেছেন। ইবন সিনা ফী ইসবাতিন নুবুওয়াত বা নবী প্রেরণের সত্যতা সম্বন্ধেও গভীর জ্ঞান সমৃদ্ধ আলোচনা পেশ করেছেন।

আরা পড়ুন:

বিশ্বাসের সঙ্গে যুক্তির সমন্বয়

মধ্যযুগের চিন্তার চূড়ান্ত বিকাশ ঘটেছে ইব্‌ন সিনার মাধ্যমে। ইব্‌ন সিনা বিশ্বাসের সঙ্গে যুক্তিকে সমন্বিত করেছেন। তিনি তাঁর চিন্তায় একদিকে ইসলামের ও অন্যদিকে গ্রীসীয় প্রভাবের স্বাক্ষর রেখেছেন। প্রায় ক্ষেত্রেই এ্যারিস্টটলীয় মতবাদকে বহাল রাখলেও তিনি প্লেটোনীয় মতবাদের সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন। বস্তুত তিনি মুক্ত মননের অনুসন্ধিৎসু এমন এক চিন্তাবিদ ছিলেন যিনি পূর্বের ও সমসাময়িক কালের যাবতীয় দর্শন ও বিজ্ঞান চেতনাকে সামনে রেখে ইসলামী আধ্যাত্মিকতার প্রেক্ষাপটে নিজস্ব চিন্তাধারার উদ্ভাবনে প্রয়াসী ছিলেন।

দার্শনিক বিবেচনা

এরিস্টটলের মতো ইব্‌ন সিনার সকল রচনা ন্যায়শাস্ত্র থেকে শুরু হয়েছে। ইব্রাহীম মাকদূরের মতে, ইব্‌ন সিনা দর্শনে এরিষ্টটল অপেক্ষাও এগিয়েছেন। দর্শনকে তিনি এক নতুন ন্যায়ের মাত্রা দিয়েছেন। ইবন সিনার মতে, মানতিক একটি চিন্তামূলক শিল্প। এর কাজ হচ্ছে সঠিক সীমা ও সঠিক ধারণা অবধি দার্শনিককে পৌঁছে দেয়া। কেননা জ্ঞান যে ধরনেরই হোক না কেন, সেটা হয় তাসওয়ার অর্থাৎ নিছক ধারণা হবে কিংবা তাসদীক বা সত্যতা প্রতিপাদনকারী হবে। তাসদীকের মাধ্যম হচ্ছে কিয়াস (অনুমান)। এটা সঠিক হতে পারে, নাও হতে পারে। এ ক্ষেত্রে শব্দসমূহের তাৎপর্য বোঝা আবশ্যক। ইব্‌ন সিনা এ কারণে সম্বোধনমূলক, বিতর্কমূলক, বিভ্রান্তিমূলক, সফিস্ট্রি বা কুতর্কমূলক প্রমাণ প্রয়োগ পদ্ধতিসমূহের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে শব্দসমূহকে মাকরাদ ও মারকাব-এই দুইভাগে ভাগ করেছেন। এ ভাবে সামগ্রিক তথা ব্যাপক অর্থবোধক এবং আংশিক শুধু একটি অর্থবোধক শব্দ বিভাজন করেছেন তিনি। সত্তা (being) ও অস্তিত্বের (existence) প্রশ্নেও ইবন সিনা গভীর মত দিয়েছেন। তিনি জিন্স (জেনাস) বা জাতিবাচক, নাও (স্পেসিস) তথা প্রজাতি বা শ্রেণীবাচক, ফাস্স বা বিভাজক, খাস্ বা বিশেষত্ব, আব্দ বা অস্থায়ী বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি নিয়ে বিশদ আলোচনা রেখেছেন। পদার্থের মৌলরূপ, আকৃতি, স্থিতি, গতিশীলতা ও পূর্ণতা নিয়ে আলোচনা করেছেন। পদার্থের সঙ্গে যুক্ত গতি, স্থিতি, কাল, স্থান, শূন্যতা, সসীমতা, অসীমতা, স্পর্শন, সংঘবদ্ধতা, সম্মিলন ইত্যাদি নিয়ে গভীর আলোচনা উপস্থাপন করেছেন। "কিতাবুন নাক্স" গ্রন্থে ইবন সিনা মনোবিজ্ঞানের আলোচনায় উদ্ভিজ্জ মন, জীব মন, মানব মন নিয়ে আলোচনা করেছেন। ইবন সিনা বলেছেন, মানবীয় মন বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ গুণাবলীর দ্বারা প্রাথমিক অনুভূতিসমূহকে বুদ্ধির বিভিন্ন পর্যায়ে পৌঁছায়। মানবীয় মন নিজ সম্ভাবনাসমূহের চরম সীমায় পৌঁছায়। এর ঝোঁক কেবল বুদ্ধিগ্রাহ্য ধারণাসমূহের প্রতি হলেও পরিশেষে এটা পরম সৃজনী আক্স-এর সাথেই মিলিত হয়। ইবনে সিনা রূহ সম্পর্কেও সুগভীর আলোচনা রেখেছেন। তাঁর মতে রূহ জড়বস্তু নয়। রুহের প্রথম পরিপূর্ণতাই দেহের পরিপূর্ণতা। তাঁর মতে, রুহ আসলে 'বিমূর্ত'।

ইসলামী চিন্তা: ব্যাপ্তি ও গভীরতা

ইব্‌ন সিনা এবং আল-ফারাবী দু'জনেই ধারণা দেন যে, 'জাত' ও 'ওযুত' পরস্পর থেকে আলাদা। ইবন সিনার মতে, আক্ল মুতলাক সৃষ্ট জগত সম্পর্কে অজ্ঞান নন। তাঁর নিজের 'জাত'-এর অনুভূতি তাঁর রয়েছে। এমন অনুভূতির ভিত্তিতে সৃষ্টির অনুভূতিও বিদ্যমান রয়েছে তাঁর। তিনি সমগ্র জ্ঞানায়ত্ত পদার্থ জগতের বাহক। সে কারণে জ্ঞানায়ত্ত পদার্থসমূহের প্রকাশ আল্লাহ থেকেই হয়। আল্লাহই অবশ্যম্ভাবী সত্তা। তিনিই সৃষ্টির রূপ দানকারী। এই আক্ক ফাআল বা সৃজনী আক্স জ্ঞানায়ত্ত আকারসমূহকে রুহ দান করেন এবং রুহ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য আকারসমূহকে বস্তুনিচয়ের পর্যায়ে পৌঁছে দেয়। এ দিকে আল্লাহ যদি কারণসমূহের কারণ হন, তবে সে ক্ষেত্রে তিনি লক্ষ্যসমূহেরও পরম লক্ষ্য। তদুপরি যেহেতু শেষ কারণ কোনো অন্তে পৌঁছাবেই, সেহেতু এহেন ধারাকে কোথাও সমাপ্ত করা আবশ্যক। ইবন সিনা এজন্যে এটাও জানান যে, আমাদের নিকট প্রথম প্রারম্ভের কোনো প্রমাণ নেই। তিনিই স্বয়ং সকল প্রমাণের প্রমাণ। তাঁকে আমরা বুরহানের পথে পেতে পারি না। তাঁর কোনো ইল্লাত, দলীল, সংজ্ঞা নেই। সমগ্র সৃষ্টিই তাঁর প্রমাণ। তিনিই আউয়াল, আখীর, জাহির, বাতিন। ইবন সিনার দর্শনের চিন্তা বা দর্শন এখানে এসেই মিলে যায় ইসলামের সঙ্গে। কেউ বা তার মধ্যে তাসাওউফের সন্ধানও করেন।

ইবনে সিনা আল্লাহকে কারণসমূহের কারণ, চূড়ান্ত লক্ষ্য, আদি, অন্ত, অনিবার্য, অবশ্যম্ভাবী সত্তা হিসেবে মনে করেন। কাজেই আল্লাহর সত্তা সব রকম ইস্কান, কুওয়াত ও মাদ্দা থেকে পবিত্র নিঃসন্দেহে। আল্লাহ্র নেই আকৃতি, নেই আকৃতির জ্ঞানগত উপাদান বা মাদ্দা মাকুল। তিনি কোনো জ্ঞানগত উপাদানের জ্ঞানগত আকারও নন। তিনি জ্ঞান, ইচ্ছা, জীবন নন। এসব আল্লাহর বুনিয়াদী সিফাত নয়। এ সমস্ত সিফাতের সঙ্গে তাঁকে সম্পর্কিত করা হলে তাঁর এককত্বের পরিবর্তন হয় না। মুতাযিলীগণের মতে, এরূপ সিফাতের যোগ আল্লাহর ওয়াহদানিয়াতের বিপরীত। এরিস্টটলের দর্শনে পরম সত্তার পরিপূর্ণতা তাঁর গতিহীনতার পরিণাম। অথচ এর একেবারেই বিপরীত শিক্ষা দেয় ইসলাম। ইসলামের বক্তব্য এই যে, আল্লাহ্র জ্ঞান সমস্ত সৃষ্টিব্যাপী। ইব্‌ন সিনাও এ কথাই তুলে ধরেন। তিনি বলেন, আল্লাহ্ সৃষ্টি সম্পর্কে বেখবর নন, সকল কিছু ও সকল জ্ঞান তাঁর করায়ত্ত। ইবনে সিনা তাব্দীর তথা অদৃষ্ট বা ভাগ্য প্রসঙ্গে বলেন, 'খায়রুহ শারুহু মিনাল্লাহি' অর্থাৎ অদৃষ্টের ভাল ও মন্দ আল্লাহ থেকে আসে। এ ক্ষেত্রে মুতাযিলা ও জাবারিয়াগণের সঙ্গে তিনি একমত নন।

সক্রেটিস ও প্লেটো বিশ্বাস করতেন, প্রতিটি বস্তু হতে সেটাই প্রকাশ পায় যার জন্যে তা সৃষ্ট। এ দু'জনই ন্যায়ধর্মে বিশ্বাসী হলেও তাদের ন্যায়ধর্ম (Justice) শ্রেণী কাঠামো ও মানব অসাম্যের উপর ভিত্তিশীল। সক্রেটিস ও প্লেটো ন্যায়ধর্ম প্রতিষ্ঠাকল্পে নৈতিক চরিত্রের চিন্তার বিশুদ্ধতাকেই প্রয়োজনীয় ভেবেছেন। এরিস্টটলের মতো ইন্ন সিনাও মনে করেন যে, নৈতিকতার লক্ষ্য হচ্ছে অভ্যাসগতভাবে সৎ গুণাবলী অর্জন করা। কিন্তু ইব্‌ন সিনা এদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েও বিশ্বাস করেন যে, ন্যায়ধর্ম, সৌভাগ্য, নৈতিকতা সবকিছুর সঙ্গে 'আঙ্গুল আউয়াল'-এর উৎসগত ও চূড়ান্ত সার্বিক সম্পর্ক রয়েছে।

ইবনে সিনার ইলাহিয়াত বা আল্লাহ তত্ত্ব আল ফারাবী ও রাসাইল ইখওয়ানিস সাফার সমন্বয়। তিনি স্বীকার করেন যে, আক্লের সকল পর্যায়ে ঈমান থাকা জরুরী। ঈমান ও আক্লের পারস্পরিক সম্পর্ক বিষয়ে তিনটি বিবেচনা দেখা যায়। (ক) আক্স ও ঈমান পরস্পর বিরোধী। এ কারণে এ দু'টির মাঝে পার্থক্য রাখা জরুরী। (খ) ঈমান আক্কের পরিপূর্ণ রূপ। কাজেই এটা আক্লকে দেয় পূর্ণতা। (গ) ঈমান কার্যত জ্ঞানের পরিপূর্ণতার কারণস্বরূপ হয়। ইবন সিনা এক্ষেত্রে 'খ' মতটির পক্ষে। তাঁর মতে শরীয়াহ্ হিক্কা তথা প্রজ্ঞার বিপরীত বা বিরোধী নয়। এ গুলো পরস্পর সম্পর্কিত।

ইবন সিনা বলেন, রাসূলগণের মর্যাদা দার্শনিকদের চেয়ে উপরে এবং ওয়াহহি বা প্রত্যাদেশের অবস্থা হল মহান ও উন্নত এক অনুভূতির। এটি এক পবিত্র শক্তি। ওয়াহয়ী, ইলহাম ও রুইয়া বা সত্যস্বপ্ন আল্লাহর প্রজ্ঞার অংশ। ইবন সিনার কিতাবুন নাফসের শেষ দিকে যেসব অভ্যন্তরীণ জ্ঞানেন্দ্রিয়ের কথা রয়েছে, সেটার ইঙ্গিত উল্লিখিত পবিত্র শক্তির দিকে।

শরীয়ার কাজ হলো বিশ্ব মানব সমাজের সংশোধন। এর এক দিকে রয়েছে রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, প্রশাসনিক কর্মকান্ড, আর অন্যদিকে রয়েছে আধ্যাত্মিক বিষয়াদি। এ সবের পূর্ণতা সাধনের জন্য নবী-রাসুলদের যে ইখতিয়ার, সেটা অন্য সাধারণ মানুষের সীমা বহির্ভূত। শরীয়ত এবং হিকমত বা প্রজ্ঞার প্রশ্নে ইব্‌ন সিনার ঝোঁক শরীয়ার দিকে। ইবন সিনা তাই গ্রীসীয় প্লেটোনিক-এরিস্টটলীয় দর্শন দ্বারা প্রভাবিত হয়েও শেষাবধি ইসলামের সীমার মধ্যে স্বীয় চিন্তাকে অন্তর্ভুক্ত করেছেন।

ইবনে সিনা পরমসত্তা আল্লাহকে একান্তই একক সত্তা হিসেবে জেনেছেন। আল্লাহ অভিজ্ঞতার জগতের সকল সাপেক্ষ আর শর্তধর্মী সত্তা অপেক্ষা একেবারেই আলাদা। কেননা আল্লাহ আবশ্যিক অনিবার্য অবশ্যম্ভাবী সত্তা। তাঁর অস্তিত্বের প্রমাণ যৌক্তিকভাবে যুক্ত থাকে উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যের সাথে। আল্লাহ একমাত্র রব, প্রভু, ইলাহ্। তিনি খালিক আর অন্যরা মাখলুক। তিনি সৃষ্টিকর্তা, অন্যরা তাঁর ইচ্ছায় সৃষ্ট। জীবন-জগতের, আকাশ- জমীনের বস্তুনিচয়ের অনুক্রম যতদূরেই এগোক, সে সবকে শেষাবধি এরূপ এক অনিবার্যতার নীতিতে এসে থামতে হবেই, যার উপর নির্ভরশীল এই অনুক্রম। আর এই অনুক্রমের প্রথম কারণ, নিমিত্ত, লক্ষ্য, উদ্দেশ্যের সঙ্গে আকস্মিকভাবে নয়, বরং অবশ্যম্ভাবীভাবে যুক্ত আল্লাহ রাব্বুল আলামীন।

গ্রীসীয় সংযোগ ও রাষ্ট্রচিন্তা

ইবনে সিনার সরাসরি রাষ্ট্র চিন্তা সম্পর্কিত কোনো গ্রন্থ নেই। কিন্তু তাঁর দার্শনিক, নীতি বিষয়ক, আধ্যাত্মিক ও চিকিৎসা সংক্রান্ত গ্রন্থগুলির ভিতরই তাঁর রাজনৈতিক মতাদর্শের সন্ধান পাওয়া যায়। ইবন সিনার রাজনৈতিক চিন্তার লক্ষ্য ছিল মানবিক সমাজে শান্তি ও পূর্ণতা হাসিল করা। এ লক্ষ্যের পানে এগিয়ে তিনি আল্লাহর ধ্যানে বা ইসলামের সত্য সাধনায় সমাধান খুঁজে পান। ইসলামের জীবনবোধকে মেনে নিয়ে, এরই পরিপ্রেক্ষিতে তিনি রাজনৈতিক জীব বা নাগরিক হিসেবে মানুষকে বিচার করেছেন। গ্রীসীয় প্লেটো-এরিস্টটলের দর্শন দ্বারা প্রভাবিত হলেও, পরবর্তীকালের কাছে এ দু'য়ের দর্শন তুলে ধরায় ও ব্যাখ্যায় ভূমিকা রাখলেও ইবন সিনার চিন্তায় রাষ্ট্র-রাজনীতির উপরও আল্লাহ প্রদত্ত দ্বীন তথা ইসলামের সিদ্ধান্তের গ্রহণযোগ্যতার পরিচয় পাওয়া যায়।

ইন্ন সিনা তাঁর লেখার বিভিন্ন স্থানে নীতিশাস্ত, অর্থনীতি, রাজনীতি নিয়ে বহু কথা বলেছেন। প্লেটোর 'রিপাবলিক' গ্রন্থের নানা শিক্ষাকে তুলে ধরেছেন। প্লেটোর সংবিধানের বিবর্তন এবং সরকারের শ্রেণীবিভাগ, পরিবর্তন ও বিচ্যুতিকে তিনি লক্ষ্য করেছেন। উচ্চাভিলাষতন্ত্র (টিমোক্রেসী), ধনিকতন্ত্র (অলিগার্কি), গণতন্ত্র (ডিমোক্রেসী) এবং স্বৈরতন্ত্র (টির‍্যানী) ইত্যাদি অসম্পূর্ণ কিংবা আদর্শচ্যুত রাষ্ট্র/সরকারগুলোকে তিনি আল ফারাবীর মতোই ব্যাখ্যায় এনেছেন। কিন্তু ন্যায়ধর্ম ও আদর্শ শাসকের প্রশ্নে ইব্‌ন সিনা প্লেটোর রিপাবলিকের ও এরিস্টটলের মতো দার্শনিক বা রাজতান্ত্রিক/অভিজাততান্ত্রিক শাসকের নগর রাষ্ট্রের ধর্মের বাধ্যবাধকতা মেনেও তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ অবস্থান গ্রহণের সাথে সাথে শরীয়াভিত্তিক শাসকের পার্থক্য নির্দেশ করেছেন। প্লেটোর রিপাবলিকের দার্শনিক রাজা শাসিত আদর্শ রাষ্ট্রের কথা তুললেও এবং প্লেটোর 'দি লজ'-এর ভবিষ্যদ্বক্তার প্রসঙ্গ আনলেও শেষাবধি ইব্‌ন সিনা শরীয়াভিত্তিক ইসলামী রাষ্ট্রশাসন ও শাসকের পক্ষেই থেকে গেছেন।

আবদুল মওদুদের "মুসলিম মনীষা" এবং আরইউন রোজেনথালের "পলিটিক্যাল থট ইন মিডিয়াভাল ইসলাম" গ্রন্থের এবং ঐতিহাসিক ফিলিপ কে, হিট্রির ব্যাখ্যা থেকে দেখা, ইবন সিনা তাঁর পূর্বসূরী আল-কিন্দী ও আল ফারাবী এবং পরবর্তী সময়ের ইবন রুশদের চেয়ে আরো সফলভাবে ইসলামের শিক্ষার সঙ্গে গ্রীক দর্শনের সামঞ্জস্য ঘটিয়েছেন।

আরা পড়ুন:

প্রাজ্ঞ উপলব্ধি ও শরীয়া ভিত্তিক ইসলামী রাষ্ট্র

এরপরও মনে হয় এরিস্টটল ফিলোসফী (দর্শন) ও থিওলজী (ধর্মতত্ত্ব)-এর ভিতর স্পষ্ট পার্থক্য নির্দেশ করতে পারেন নি। তিনি মেটাফিজিক্স বা অধিবিদ্যাকে দর্শন ও ধর্মতত্ত্ব উভয় অর্থে ব্যবহার করেছেন। রোজার বেকন অধিবিদ্যাকে ধর্মতত্ত্বের অংশ তথা সাইন্টিয়া ডিভাইনা বা ঐশী বিজ্ঞান হিসেবে দেখেছেন। কিন্তু, দর্শনের সীমায় প্রবেশ করেও ইবন সিনা দর্শন ও ধর্মতত্ত্বকে আলাদা দুই বিষয় হিসেবে দেখেছেন। তিনি বিশ্বাস (ফেইথ) ও যুক্তির (রিজন) সমন্বয়ের কথা বলেছেন। তা সত্ত্বেও মানবিক মাত্রার দর্শনকে তিনি আল্লাহ প্রদত্ত প্রত্যাদিষ্ট দ্বীন ইসলামের শরীয়ার অধীনস্থ করে বিবেচনায় এনেছেন। "ফি ইসবাত আন নুবুওয়াহ” গ্রন্থে তিনি নবী-রাসূলদের দ্বিবিধ ভূমিকার কথা বলেছেন। একযোগে একদিকে রাজনৈতিক শাসনের প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দুনিয়ার মানব সমাজে সুশৃংখল শান্তিপূর্ণ কল্যাণকর অবস্থা আনয়ন করা এবং সেই সঙ্গে পারলৌকিক জীবনের কল্যাণ লাভে মানুষকে প্রস্তুত করা। মিথ্যা মতবাদেসমূহকে দমন করে শরীয়ার ভিত্তিতেই কেবল আদর্শ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা যায়।

ইবনে সিনাকে গ্রীক দর্শনের ইসলামী ভাষ্যকার বলা হয়। তিনি প্লেটোর দর্শনের ইসলামী সংশ্লেষণ করেন এবং এরিস্টটলীয় দর্শনের সঙ্গে ইসলামী শিক্ষার সংযোগ সাধন করেন বলে গবেষকরা মত দেন। কিন্তু ইবন সিনা সম্পর্কে বলা যায়, তিনি "মুক্তবুদ্ধি সঞ্জাত তওহীদবাদে একান্ত বিশ্বাসী, আত্মার অমরতায় আস্থাশীল এবং সৌন্দর্যের চিরপিয়াসী"।

রূপকের গভীরতায় ইসলামী দৃষ্টি

ইবন সিনার গোড়ার দিককার রচনাসমূহে মরমী এক রেশ কাজ করেছে। আল ইশারাত, হাই ইবনে ইয়াকজান, পাখি, প্রেম প্রসঙ্গে, নামাজ প্রসঙ্গে, ভাগ্য প্রসঙ্গে গ্রন্থে ইবন সিনার মরমীবাদী একটা ছাপ পাওয়া যায়। বাচনভঙ্গি, মেজাজ, নাটকীয় বদল এসব দিক থেকে উল্লেখিত লেখাসমূহ এরিস্টটলীয় রচনা থেকে আলাদা। এ সব গ্রন্থে রূপক, উপমা, বাগধারা, কল্পনাশক্তি ইত্যাদি প্লেটোর রূপক, উপমার কাছাকাছি যেতে পারে। কিন্তু তবুও তা প্লেটো থেকে মৌলিকভাবে ভিন্ন ধারার ও অন্য অনুভবের। প্লেটোর "ফিড্রাস" ও "রিপাবলিক"-এর গুহার রূপকের (এ্যালিগরি অব কেভ) মাধ্যমে জানতত্ত্ব ব্যাখ্যার গল্পটির তুলনায় ইবন সিনা তাঁর রচনায় এমন রূপক চিত্রায়নে একবারেই যেন ভিন্ন।

ইবন সিনার 'পাখি' নামক রূপক গ্রন্থে সত্যের অনুসন্ধানে আত্মার প্রয়াস-প্রচেষ্টা ও মনজীলে মাকসুদের সন্ধান এবং সেই পথে ইন্দ্রিয়ের দিক থেকে প্রতিবন্ধকতা বা বাধার জালের বিষয়াদি সম্পূর্ণ ভিন্ন অনুভবে উঠে এসেছে।

The Ode on the Soul বা আত্মা বিষয়ে গীতি নামক গ্রন্থে ইব্‌ন সিনা শরীরের বন্ধনে আত্মার শৃংখলিত হওয়া এবং অবশেষে জ্ঞানের সাহায্যে আত্মার মুক্তির কাহিনী বিবৃত করেছেন। এখানে মানবাত্মাকে খাঁচায় বন্দী কিছু পাখিরূপে দেখানো হয়েছে। এরা তাদের বন্দীত্ব মেনে নিতে রাজী নয়। এরা সদা তৎপর মুক্তির অন্বেষায়। এসব বন্দী পাখির কয়েকটি একদা কোনোক্রমে পলায়নে সক্ষম হয়। এরপর তারা উদ্ধার করে অন্য পাখিদের। এরপর মুক্তির লক্ষ্যে তারা যাত্রা শুরু করে। লক্ষ্যস্থল তাদের এক আটতলা পর্বত। বন্দীদশা থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত বিহঙ্গরা একে একে সেই পর্বতের সাত তলায় গিয়ে দেখতে পায় অদ্ভুত সুন্দর তৃণলতা খচিত সবুজ এক প্রান্তর এবং এরই পাশ দিয়ে প্রবাহিত ঝর্ণাধারা বা স্রোতস্বীনী। তারা এখানে বিশ্রাম নিতে থাকে মনের সুখে। এভাবে কিছুকাল বিশ্রাম নেবার পর তারা অনুভব করে আরো উপরে উঠা দরকার। আরো কিছুটা অগ্রসর হয়ে তারা পৌঁছে যায় সেই পর্বতের আটতলা উচুঁতে। সেখানে তারা অবলোকন করে অনিন্দ্য সুন্দর কিছু পাখি। এমন পাখি তারা আগে দেখে নি কোনোদিন।

আনন্দের জগতের যাত্রী আট তলায় আগত পাখিরা পরিচয়, ভাব বিনিময় ও গভীর বন্ধুত্ব গড়ে তোলে এ সব নতুন পাখির সঙ্গে। স্বাগতিক পাখিরা তাদের অতিথিদের দুঃখ-ক্লেশহীন সুখের সন্ধান দেয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে যায় সম্রাটের দরবারে। কিন্তু সম্রাটের উজ্জ্বল উপস্থিতির দিকে তাকানোর সাথে সাথে তারা অভিভূত হয়ে পড়ে। তারা বিমুগ্ধ আনন্দিত হয়ে পড়ে। আগত পাখিরা সম্রাটের কাছে তাদের এতদিনকার যাবতীয় নিদারুণ দুঃখ-কষ্ট-বঞ্চনায় ভরা জীবনের কাহিনী তুলে ধরে। সম্রাট তাদের কাহিনী অত্যন্ত সহানুভূতির সঙ্গে শুনলেন। মুক্ত ও শান্তিময় জীবনের আশ্বাস দিলেন তাদের। ইবন সিনার বর্ণিত রূপকে সুন্দর ও কল্যাণের আধার সত্তা (আল্লাহ রাব্বুল আলামীন)-এর সাথে দীদারের ফলে পাখিরা অভাবনীয় আনন্দ ও সুখের অনুভূতি পেলো। তারা ভুলে গেল পার্থিব জীবনের সকল দুঃখ-বেদনা-নিগ্রহের কথা। তারা সন্ধান পেলো দুঃখহীন পরম কাঙ্খিত সেই আনন্দময় জীবনের।

মূল্যায়ন

প্লেটোর রূপকের সঙ্গে ইবন সিনার এই রূপকের পার্থক্য মৌলিক। গ্রীসীয় দর্শন দ্বারা প্রভাবিত হয়ে, এর ভাষ্য তুলে ধরলেও ইবন সিনা সত্যিকার অর্থেই মানবিক সীমানার যে অনিত্য অসম্পূর্ণতার দর্শন চর্চা তার উর্ধ্বে উঠে আল্লাহর দেয়া একমাত্র সত্য বিধানকেই মেনে নিয়েছেন। ইসলামী শরীয়ায় বিশ্বাস এবং এর ভিত্তিতে রাষ্ট্র, সমাজ, সরকার এবং সমগ্র মানবজীবন পরিচালনা করে পার্থিব ও পারলৌকিক জগতের কল্যাণ ও কামিয়াবী অর্জন তাই ইবন সিনার চিন্তা মানচিত্রের মৌল অভিব্যক্তি, একথা নিঃসন্দেহে বলা চলে।

সারকথা

ইন্ন সিনার রাজনৈতিক চিন্তার লক্ষ্য ছিল মানবিক সমাজে শান্তি ও পূর্ণতা হাসিল করা। এ লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে তিনি আল্লাহর ধ্যানে তথা ইসলামের সত্য সাধনায় সমাধান খুঁজে পান। ইসলামের জীবনবোধকে মেনে নিয়ে, এরই পরিপ্রেক্ষিতে তিনি রাজনৈতিক জীব বা নাগরিক হিসেবে মানুষকে বিচার করেছেন। গ্রীসীয় প্লেটো-এরিস্টটলের দর্শন দ্বারা প্রভাবিত হলেও, পরবর্তীকালের কাছে এ দু'য়ের দর্শন তুলে ধরায় ও ব্যাখ্যা প্রদানে ভূমিকা রাখলেও ইন্ন সিনার চিন্তায় রাষ্ট্র-রাজনীতির উপর আল্লাহ প্রদত্ত দ্বীন তথা ইসলামের সিদ্ধান্তের গ্রহণযোগ্যতার পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি রয়ে যান শরীয়াভিত্তিক ইসলামী আদর্শ রাষ্ট্র ও শাসকের পক্ষে।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url