মোবাইল দেখার ফলে চোখের কি কি ধরনের ক্ষতি হতে পারে
আজ এই আর্টিকেলটিতে মোবাইল ফোন ব্যবহারের ফলে চোখের কি কি ধরনের ক্ষতি হতে পারে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
ভূমিকা
আধুনিক জীবনে মোবাইল ফোন একটি অপরিহার্য সঙ্গী। যোগাযোগ, কাজ, বিনোদন—সবকিছুতেই এর অবাধ ব্যবহার। কিন্তু এই স্ক্রিনের দিকে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থাকা আমাদের চোখের জন্য নীরব বিপদ ডেকে আনছে। অত্যাধিক মোবাইল ফোন ব্যবহারের ফলে আমাদের চোখে নানা ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে, যা সাময়িক অস্বস্তি থেকে শুরু করে দীর্ঘমেয়াদী দৃষ্টিশক্তির ক্ষতি পর্যন্ত হতে পারে।
আরো পড়ুন:
কম্পিউটার ভিশন সিনড্রোম (Computer Vision Syndrome - CVS)
মোবাইল ফোন ব্যবহারের কারণে চোখের সমস্যার মধ্যে এটি সবচেয়ে সাধারণ। CVS বা ডিজিটাল আই স্ট্রেন মূলত স্ক্রিনের দিকে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থাকার ফলে সৃষ্ট একাধিক চোখের ও দৃষ্টিজনিত সমস্যার সমষ্টি।
- শুষ্ক চোখ (Dry Eyes): স্ক্রিনে মনোনিবেশ করার সময় আমাদের পলক ফেলার হার স্বাভাবিকের চেয়ে প্রায় ৫০% কমে যায়। স্বাভাবিকভাবে প্রতি মিনিটে প্রায় ১৫ থেকে ২০ বার পলক ফেলা উচিত, কিন্তু স্ক্রল করার সময় এই সংখ্যা কমে ৫ থেকে ৭ বারে দাঁড়ায়। এর ফলে চোখের জলীয় অংশ বা টিয়ার ফিল্ম দ্রুত শুকিয়ে যায়, যার কারণে চোখ জ্বালা করা, লাল হওয়া, এবং চুলকানির মতো সমস্যা দেখা দেয়।
- দৃষ্টি ঝাপসা হওয়া: দীর্ঘক্ষণ একটানা কাছ থেকে কোনো কিছু দেখার পর যখন চোখ দূরত্বের কোনো বস্তুর দিকে তাকায়, তখন দৃষ্টি সাময়িকভাবে ঝাপসা হতে পারে। চোখের পেশিগুলোর অতিরিক্ত চাপের কারণেই এমনটি হয়।
- চোখে অস্বস্তি ও ক্লান্তি: স্ক্রিনের কনট্রাস্ট, ঝলকানি (glare), এবং ক্ষুদ্র ফন্টের দিকে তাকিয়ে থাকার জন্য চোখকে অতিরিক্ত কাজ করতে হয়, যা চোখের পেশিতে ক্লান্তি ও ব্যথা সৃষ্টি করে।
ঘুমের চক্রে ব্যাঘাত এবং মেলাটোনিন হ্রাস
মোবাইল স্ক্রিন থেকে নির্গত নীল আলো (Blue Light) চোখের রেটিনার জন্য ক্ষতিকর বলে মনে করা হয়। তবে এর তাৎক্ষণিক ও গুরুতর প্রভাব হলো এটি আমাদের শরীরের স্বাভাবিক ঘুমের চক্রকে (Circadian Rhythm) ব্যাহত করে।
- মেলাটোনিন হরমোনের উৎপাদন হ্রাস: রাতে বা অন্ধকারে নীল আলোর সংস্পর্শে এলে মস্তিষ্ক মেলাটোনিন (Melatonin) নামক ঘুমের হরমোন উৎপাদন বন্ধ করে দেয়। এই হরমোন আমাদের ঘুম আনতে সাহায্য করে। মেলাটোনিন উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটলে ঘুমের মান খারাপ হয়, ঘুম কম হয়, এবং এর ফলে পরোক্ষভাবে চোখের ক্লান্তি ও অন্যান্য সমস্যা বাড়ে।
মায়োপিয়া বা নিকটদৃষ্টির ঝুঁকি বৃদ্ধি
বিশেষ করে শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে মোবাইল ব্যবহারের অন্যতম দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব হলো মায়োপিয়া (Myopia) বা নিকটদৃষ্টি-এর ঝুঁকি বৃদ্ধি।
- কাছের বস্তুর উপর অতিরিক্ত মনোযোগ: ছোট স্ক্রিনের দিকে দীর্ঘক্ষণ ধরে কাছ থেকে তাকিয়ে থাকার অভ্যাস চোখের পেশির ওপর চাপ সৃষ্টি করে এবং চোখের স্বাভাবিক আকার পরিবর্তনের প্রবণতা বাড়িয়ে তোলে। এর ফলে দূরের বস্তু ঝাপসা দেখার সমস্যা সৃষ্টি হয়।
- সাম্প্রতিক গবেষণা অনুসারে, স্ক্রিন টাইম বৃদ্ধি এবং বাইরের প্রাকৃতিক আলোতে কম সময় কাটানোর কারণে বিশ্বজুড়ে মায়োপিয়ার প্রকোপ বাড়ছে।
চোখের অন্যান্য সম্ভাব্য সমস্যা
দীর্ঘদিন ধরে স্ক্রিনের অতিরিক্ত ব্যবহার আরও বেশ কিছু সমস্যার জন্ম দিতে পারে:
- স্থায়ী মাথাব্যথা ও মাইগ্রেন: চোখের পেশিগুলোর দীর্ঘস্থায়ী চাপ ও শ্রান্তি প্রায়শই মাথাব্যথা বা মাইগ্রেনকে উসকে দিতে পারে।
- ঘাড় ও কাঁধে ব্যথা: মোবাইল ব্যবহারের সময় ভুল ভঙ্গিতে দীর্ঘক্ষণ বসে থাকা বা ঝুঁকে থাকার কারণে ঘাড়, কাঁধ এবং মেরুদণ্ডে ব্যথা সৃষ্টি হয়, যা 'টেক্সট নেক' নামে পরিচিত। এই শারীরিক চাপ পরোক্ষভাবে চোখের অস্বস্তি বাড়াতে পারে।
- রেটিনার সম্ভাব্য ক্ষতি: যদিও এই বিষয়ে গবেষণা এখনো চলছে, কিছু বিজ্ঞানী মনে করেন যে মোবাইল স্ক্রিনের নীল আলো দীর্ঘমেয়াদে চোখের রেটিনার সংবেদনশীল কোষগুলোর ক্ষতি করতে পারে, যা ভবিষ্যতে ম্যাকুলার ডিজেনারেশন (Macular Degeneration) -এর ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
প্রতিরোধের উপায় ও সমাধান (The 20-20-20 Rule)
মোবাইল ব্যবহারের ক্ষতিকর প্রভাবগুলো কমাতে এবং চোখের স্বাস্থ্য বজায় রাখতে কিছু সহজ নিয়ম মেনে চলা প্রয়োজন:
- ২০-২০-২০ নিয়ম: এটি চোখের বিশ্রাম দেওয়ার একটি কার্যকর পদ্ধতি। প্রতি ২০ মিনিট স্ক্রিন ব্যবহারের পর, অন্তত ২০ সেকেন্ডের জন্য ২০ ফুট দূরত্বের কোনো বস্তুর দিকে তাকান।
- স্ক্রিন সেটিং পরিবর্তন: স্ক্রিনের উজ্জ্বলতা (brightness) ঘরের আলোর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ রাখুন। রাতের বেলায় 'নাইট মোড' বা নীল আলো ফিল্টার ব্যবহার করুন।
- সঠিক দূরত্ব: মোবাইল চোখ থেকে কমপক্ষে ১৬ থেকে ১৮ ইঞ্চি দূরত্বে রাখুন।
- নিয়মিত পলক ফেলুন: সচেতনভাবে ঘন ঘন পলক ফেলুন বা কৃত্রিম চোখের জল (Artificial Tears) ব্যবহার করুন (চিকিৎসকের পরামর্শক্রমে) চোখকে সতেজ রাখতে।
- শিশুদের স্ক্রিন টাইম নিয়ন্ত্রণ: শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের জন্য স্ক্রিন ব্যবহারের সময়সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া অপরিহার্য। তাদেরকে বাইরের প্রাকৃতিক আলোতে সময় কাটাতে উৎসাহিত করুন।
উপসংহার
মোবাইল ফোন আমাদের দৈনন্দিন জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলেও, এর অসচেতন ব্যবহার চোখের গুরুতর ক্ষতি করতে পারে। শুষ্ক চোখ, দৃষ্টি ঝাপসা হওয়া এবং মায়োপিয়ার মতো সমস্যা এড়াতে নিয়মিত চোখের যত্ন নেওয়া, সঠিক অভ্যাস তৈরি করা এবং স্ক্রিন টাইম নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চোখের সমস্যা দেখা দিলে দেরি না করে একজন চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া উচিত। চোখের স্বাস্থ্য বজায় রাখলে আমরা আধুনিক প্রযুক্তির সুবিধাগুলো উপভোগ করার পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদী দৃষ্টিশক্তি রক্ষা করতে সক্ষম হব।
এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url