ইসলামি ব্যাংকের বৈশিষ্ট্য, প্রচলিত ব্যাংক ও ইসলামি ব্যাংকের তুলনা
ইসলামি ব্যাংকের বৈশিষ্ট্য আলোচনা করতে পারবেন
◆ প্রচলিত ব্যাংক ব্যবস্থা ও ইসলামি ব্যাংক ব্যবস্থার মধ্যে তুলনা করতে পারবেন।
ইসলামি ব্যাংক ব্যবস্থা ইসলামি শরী'আত অনুযায়ী পরিচালিত। ইসলামের সুমহান নীতিমালা অনুযায়ী একটি সুদমুক্ত পোষণহীন সমাজ গড়ে তোলার পথে একটি বস্তুনিষ্ঠ প্রয়াস হচ্ছে ইসলামি ব্যাংক ব্যবস্থা। ন্যায় ও ইনসাফের মাধ্যমে যুলম ও নিপীড়নমুক্ত সমাজ ও রাষ্ট্র গড়ে তুলতে ইসলামি ব্যাংক ব্যবস্থা একটি অনন্য সাধারণ ব্যবস্থা। একটি কল্যাণময় আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো বিনির্মাণে ইসলামি ব্যাংকের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।
ইসলামি ব্যাংকের বৈশিষ্ট্য
ব্যাংকিং ক্ষেত্রে ইসলামি ব্যাংক একটি নতুন সংযোজন হলেও প্রচলিত ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে এটি অনন্য বৈশিষ্ট্যের দাবি রাখে। তাই ইসলামি ব্যাংকের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আমাদের ধারণা থাকা প্রয়োজন। ইসলামি ব্যাংকের কতগুলো আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে। নিম্নে ইসলামি ব্যাংকের বৈশিষ্ট্যগুলো তুলে ধরা হলো-
১. ইসলামি ব্যাংকের লক্ষ্য উদ্দেশ্য শরী'আতের আলোকে নির্ধারিত।
২. ইসলামি ব্যাংকের সকল লেনদেন সুদমুক্ত।
৩. এ ব্যাংক কৃষি, শিল্প-বাণিজ্যে লাভ-লোকসানের ভিত্তিতে মূলধন বিনিয়োগ করে বা অংশীদারিত্ব গ্রহণ করে।
৪. এ ব্যাংক নিজস্ব তহবিল দ্বারা যাকাত ফান্ড গঠন করে এবং যাকাত তহবিল দ্বারা জনসেবা করে থাকে।
৫ এ ব্যাংক জনকল্যাণমূলক কাজে করযে হাসানা বা সুদ মুক্ত ঋণ প্রদান করে।
৬. ইসলামি ব্যাংক একটি বাণিজ্যিক ব্যাংক যা ফিকহ শাস্ত্র নির্ধারিত পদ্ধতিতে কারবার করে।
৭. ইসলামি ব্যাংক দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতিতে ত্রাণকার্য পরিচালনার মাধ্যমে মানবতার বিকাশ ঘটায়।
৮ এ ব্যাংক শিক্ষা ও চিকিৎসা ক্ষেত্রে অবদান রাখতে গিয়ে আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো গড়ে তুলে।
৯. ইসলামি ব্যাংক জনসাধারণের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সঞ্চয়কে লাভ-লোকসানের ভিত্তিতে কারবারের অঙ্গীকার আমানত হিসেবে গ্রহণ করে।
১০. ইসলামি ব্যাংক সুদমুক্ত পন্থায় বৈদেশিক বাণিজ্যে অবদান রাখে।
১১. কল্যাণমুখী ব্যাংক ব্যবস্থা প্রবর্তন করা ইসলামি ব্যাংকের অনন্য বৈশিষ্ট্য।
১২. ইসলামি ব্যাংক মানব সম্পদ উন্নয়ন ও আত্মকর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে বেকারত্ব দূরীকরণে অবদান রাখে।
১৩. ইসলামি ব্যাংক ইসলামি অর্থব্যবস্থার লক্ষ্য অর্জনের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে এবং সমাজ থেকে অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণে চেষ্টা করে।
১৪. ব্যবসায় বাণিজ্যে ও অর্থনীতিতে ন্যায়-নীতি ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করে।
১৫. ইসলামি ব্যাংক আন্তরিকতার সাথে উন্নতমানের সেবা প্রদান করে।
১৬. ইসলামি ব্যাংক বিনিয়োগের মাধ্যমে আয়ের শতকতা ৭০ ভাগ আমানতদারদের মধ্যে বণ্টন করে থাকে।
প্রচলিত ব্যাংক ব্যবস্থা ও ইসলামি ব্যাংক ব্যবস্থার মধ্যে তুলনা:
ইসলামি ব্যাংক ও প্রচলিত ব্যাংকের মধ্যে কাঠামোগত কিছু সামঞ্জস্য আছে। তা সত্ত্বে অসামঞ্জ পরিমাণই বেশি। নিম্ন এ দু'ধরনের ব্যাংক ব্যবস্থার একটি তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরা হলো-
১. লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যঃ শরী'আতের বিধান মোতাবিক হালাল ও সহজ পন্থায় দেশের ব্যবসা বাণিজ্যে সহায়তা করা ইসলামি ব্যাংক ব্যবস্থার উদ্দেশ্য। প্রচলিত ব্যাংক ব্যবস্থার উদ্দেশ্য সুদী অর্থাৎ লগ্নী ব্যবসায় পরিচালনা করা।
২. সুদের বিলুপ্তি: শরী'আতের সুদ নিষিদ্ধ ঘোষিত হওয়ায় ইসলামি ব্যাংক সুদ বর্জন করে লেনদেন করে। অপর দিকে প্রচলিত ব্যাংক সুদের মাধ্যমেই সব কারবার করে থাকে।
৩. অর্থের উৎস: সুদী ব্যাংকগুলো সুদ প্রদানের অঙ্গীকারে জনগণের আমানত গ্রহণ করে। কিন্তু ইসলামি ব্যাংক লাভ-লোকসানের ভিত্তিতে জনগণের আমানত গ্রহণ করে।
৪. বিনিয়োগ: ইসলামি ব্যাংকের বিনিয়োগের ক্ষেত্র হচ্ছে- ক. মুদারাবা খ. মুশারাকা গ. মুরাবাহা ঘ. বাইয়ে মুয়াজ্জাল ৬. বাইয়ে সালাম চ. ইজারা ইত্যাদি। প্রচলিত ব্যাংকের বিনিয়োগের মাধ্যম হচ্ছে- ক. ক্যাশ ক্রেডিট খ. ওভার ড্রাফট গ. লোন ইত্যাদি।
৫. সুদ বনাম লাভ-ক্ষতি: প্রচলিত ব্যাংকের সুদ লাভ-লোকসানের সাথে সম্পর্কহীন। এখানে সুদের হার পূর্ব নির্ধারিত। ইসলামি ব্যাংকে সুদ নেই। লাভ-লোকসানের হার বছরের নির্দিষ্ট সময় অন্তে হিসাব করে স্থির করা হয়।
৬. গ্রাহক সম্পর্ক: ইসলামি ব্যাংকের গ্রাহকগণ ব্যাংকের ব্যবসায়ের সংগঠক অথবা আমানতকারী হিসেবে মূলধন দাতা। প্রচলিত ব্যাংকের সাথে গ্রাহকগণের সম্পর্ক পাওনাদার হিসেবে বিবেচিত।
৭. পরিচালন ব্যয়ঃ ইসলামি ব্যাংকের পরিচালন ব্যয় লাভের ওপর নির্ভরশীল। লোকসান হলে খরচ বেড়ে যায় এবং তা ব্যাংকের অস্তিত্বে হুমকি হয়ে দেখা দেয়। তবে ইসলামি ব্যাংকের দক্ষ কর্মীদের নিরলস প্রচেষ্টার কারণে বেশির ভাগ প্রকল্পে ব্যাংকের লোকসান হয় না। প্রচলিত ব্যাংক সুদ আদায় করা ও সুদ প্রদান করা এ দু'য়ের বিয়োগফলের উপরে পরিচালনা ব্যয় নির্ধারণ করে থাকে।
৮. যাকাত ফান্ড: ইসলামি ব্যাংক নিজস্ব তহবিলের জমাকৃত অর্থের যাকাত দিয়ে থাকে। এ অর্থ জনকল্যঅণমূলক কাজে ব্যয় করা হয়। প্রচলিত ব্যাংকে যাকাতের কোন প্রশ্নই উঠেনা। তেমনি সেবামূলক বা ত্রাণকার্য ইসলামি ব্যাংকের বৈশিষ্ট্য হলেও প্রচলিত ব্যাংকে তা নেই।
৯. শোষণের অবসান: ইসলামি ব্যাংকের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে আল্লাহ প্রদত্ত পথে সমাজ থেকে শোষণের অবসান ঘটিয়ে সাধারণ মানুষের উন্নয়ন ও কল্যাণ সাধনে সহায়তা করা। প্রচলিত ব্যাংকে সাধারণ মানুষের সেবা ও কল্যাণের ব্যঅপারে কোন পদক্ষেপ নেই। অরে ব্যবসার মাধ্যমে সমাজের কতিপয় মানুষের ভাগ্যোন্নয়নেই প্রধান ভূমিকা হিসেবে কাজ করে।
১০. আয়ের উৎস: ইসলামি ব্যাংকের আয়ের উৎস মুনাফা, প্রাক্কলিত ব্যাংকের আয়ের উৎস সুদ।
১১. সামাজিক সংগঠন: ইসলামি ব্যাংক নিজকে সংগঠনের একটি অংশ মনে করে। এ ব্যাংকের উদ্দেশ্য হচ্ছে দেশের দরিদ্রদ্র্য জনগণকে সম্ভাব্য সকল উপায়ে সাহায্য করা। অপরদিকে প্রচলিত ব্যাংক সমাজের সাথে তার এ ধরনের সম্পর্ক ও সমন্বয়ে কখনোই চিন্তা করে না।
১২. প্রকৃত লোকসানের দায়ভার গ্রহণ: ইসলামি ব্যাংক লাভ-লোকসানের অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে বিনিয়োগ করে; বিনিয়োগে প্রকৃত লোকসানের দায়ভারও ব্যাংক গ্রহণ করে। অপরদিকে প্রচলিত ব্যাংক বিনিয়োগের অর্থও এর উপর নির্ধারিত সুদ এক এক করে আদায় করে। বিনিয়োগের লাভ-লোকসানের ব্যাপারে তার কোন দায়-দায়িত্ব নেই।
১৩. শরী'আ বোর্ডঃ ইসলামি ব্যাংকের কার্যক্রম ইসলামি শরী'আত অনুযায়ী পরিচালিত হচ্ছে কিনা তা দেখার জন্য প্রখ্যাত আলেম, ব্যাংকার, অর্থনীতিবিদ ও আইনবিদদের সমন্বয়ে শরী'আ কাউন্সিল বা বোর্ড গঠন করে থাকে। কিন্তু প্রচলিত ব্যাংকে এ ধরনের কোন ব্যবস্থা নেই।
১৪ কার্যক্রমে পার্থক্যঃ ইসলামি ব্যাংক শিল্প-বাণিজ্য, কৃষি ক্ষেত্রসহ বিভিন্ন প্রকল্পে একজন অংশীদার হিসেবে জড়িত থাকে। এ জন্য ব্যাংক ব্যবসায়, শিল্প বা প্রকল্পের সফলতার দিকে বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখে। ব্যাংক আবার এর সুফলও পায়। লাভ আদায় হয় ভালভাবে। প্রচলিত ব্যাংক ব্যবসা-শিল্পের কোন অংশীদার নয় বলে অর্থ গ্রহণকারী সংগঠনের সফলতার জন্য ব্যাংক উদ্বিগ্ন নয়। তবে এ ব্যাংকগুলো সুদসহ অর্থ ঠিকমত ফেরত দিতে পারবে কিনা তা পরীক্ষা করে দেখে। তা সত্ত্বেও অন্তত সরকারি ব্যাংকগুলো ঋণ আদায় সঠিকভাবে করতে ব্যর্থ। প্রভাবশালী ঋণ গ্রহীতাগণ ঋণের অর্থ প্রদানে উৎসাহী নয়। এ জন্য ব্যাংক ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যায়।
সারকথা
বস্তুত ইসলামি ব্যাংক ব্যবস্থা সফল বিবেচনায় আজ সাধারণ ব্যাংকের চেয়ে অধিক লাভজনক এবং কল্যাণকর বলে প্রমাণিত হয়েছে। সকল ইসলামি ব্যাংকের বৈশিষ্ট্য একই রকম হওয়া জরুরী নয়। তবে মৌলিক বৈশিষ্ট্য অবশ্যই অভিন্ন হবে। আর তা হচ্ছে ব্যাংকের সমুদয় কর্মকান্ড ইসলামি শরীআর ভিত্তিতে পরিচালিত হওয়া। প্রতিটি ইসলামি ব্যাংক তার নিজস্ব কতকগুলো বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করে নিতে পারবে। তবে তা অবশ্যই ইসলামি শরীআর নীতিমালার ভিত্তিতে হবে।
এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url