আল ফারাবীর পরিচিতি ও আল ফরাবীর রাষ্ট্রদর্শন

আল ফারাবীর পরিচিতি বর্ণনা করতে পারবেন,আল ফরাবীর রাষ্ট্রদর্শন আলোচনা করতে পারবেন।

ভূমিকা

মোহাম্মদ আল ফারাবীর আসল নাম হচ্ছে আবু নসর ইবনে মোহাম্মদ আল ফারাবী। আল ফারাবী ৮৭০ খ্রিষ্টাব্দে তুর্কি সভ্যতার পীঠস্থান ফারাব শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি জাতিতে তুর্কি ছিলেন। এ জন্য ফারাবী আল তুর্কি উপাধি ব্যবহার করতেন। তাঁর সম্পর্কে যতদূর জানা যায় তিনি ফারাবেই তাঁর বাল্যজীবন ও শিক্ষাজীবন সমাপ্ত করেন। অতঃপর তিনি বুখারায় কাজীর পদে নিযুক্ত হন। ঘটনা বৈচিত্রে তাঁর জীবন ছিল পরিপূর্ণ। তিনি জ্ঞান অর্জনের অদম্য বাসনা নিয়ে বাগদাদ শহরে গমন করেন। জ্ঞান বিজ্ঞানের কেন্দ্রভূমি বাগদাদে তিনি ৪০ বছর অতিবাহিত করেন। সেখানে তিনি বিভিন্ন শাস্ত্রে গভীর জ্ঞান অর্জন করেন। তিনি আরবী ও গ্রীকভাষা আয়ত্ত করেন। তিনি জ্ঞান অর্জনের উদ্দেশ্যে অনেক দেশ ভ্রমন করেন।

আল ফারাবী দর্শন, ধর্মতত্ত্ব, রাষ্ট্রনীতি, অর্থনীতি, বিজ্ঞান, চিকিৎসা, সঙ্গীত, গণিত প্রভৃতি বিষয়ের উপর শতাধিক গ্রন্থ রচনা করেন। তিনি সর্বপ্রথম ইসলামী তর্কশাস্ত্র ও ইসলামী বিশ্বকোষ রচনা করেন। তিনি ইসলামী দর্শনের জনকস্বরূপ ছিলেন। রাষ্ট্রতত্ত্বের উপর তাঁর নিম্ন লিখিত গ্রন্থগুলো খুবই উল্লেখযোগ্য যথাঃ আলমদিনাতুল ফাজিলাহ বা আদর্শ রাষ্ট্র, আলমদিনাতুল মাদানিয়া বা নগর রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থা, জওয়ামিনুস সিয়াসাত, ইজতিমাউ মাদানিয়া, খাওয়ামি নিয়ামত।

উল্লেখ্য গ্রন্থগুলো ছাড়াও ফারাবী এরিস্টটলের দর্শন উত্তম রূপে পাঠ করেন এবং এরিস্টটলের পলিটিকস্ ও লজিকের উপর বিশ্লেষণ মূলক পুস্তক রচনা করেন। জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় তিনি বিচরণ করলেও মূলত: গ্রীকদর্শন সম্পর্কে তাঁর গভীর জ্ঞানই তাঁকে অমরত্ব দান করেছে। তিনি সিয়াসত ও আরা গ্রন্থে রাষ্ট্র সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়ে বিচার বিশ্লেষণ ও আলোচনা করেছেন। ফারাবী শেষ জীবনে সিরিয়ার আলেপ্পাতে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন এবং জ্ঞান সাধনায় নিমগ্ন হন। তিনি প্রাচ্যের দ্বিতীয় মহাগুরু হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। ৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

আরা পড়ুন: সংস্কার আন্দোলন মার্টিন লুথার (১৪৮৩-১৫৪৬ খ্রিঃ)

রাষ্ট্রদর্শন

আল ফারাবী গ্রীক দার্শনিক প্লেটোর 'দি রিপাবলিক' ও 'দি লজ' গ্রন্থের উপর নির্ভর করে রাষ্ট্রতত্ত্ব বিষয়ক চিন্তা ভাবনা শুরু করলেও নিজের ব্যক্তিগত বিচিত্র অভিজ্ঞতার আলোকে রাষ্ট্রের নতুন ব্যাখ্যা দান করেন। তাঁর আলোচনা অনেক ক্ষেত্রেই প্লেটোর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ থেকে স্বতন্ত্র ও ভিন্নতর। আল ফারাবীর মতে, মানুষ তার সুখ, শান্তি, আরাম, আয়েশ ও সমৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন ধরনের সমবায় গঠন করে থাকে। গ্রাম-শহর, জনপদ, রাষ্ট্র, জাতি সবই সমবায় ব্যবস্থার প্রতিচ্ছবি। রাষ্ট্র এ সমবায় ব্যবস্থারই পূর্ণাঙ্গ রূপ। তিনি এরিস্টটলের সুরে বলেন যে, রাষ্ট্র হচ্ছে সকল সমবায়ের শ্রেষ্ঠতর সংগঠন। রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে আল ফারাবীর মতবাদে সপ্তদশ ও আষ্টদশ শতাব্দীর হস্, লক ও রুশোর মত সামাজিক চুক্তিবাদীদের মতবাদের সঙ্গে সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য দুইই বিদ্যমান। তিনি এ সব চুক্তিবাদীদের কাল্পনিক প্রকৃতির রাজ্যে বিশ্বাস করতেন না। তাঁর মতে, রাষ্ট্রের অস্তিত্ব আগে থেকেই ছিল, কিন্তু এই রাষ্ট্রে ইনসাফ বা ন্যায়বিচার ছিল না। আদিকালে মানুষে মানুষে দ্বন্দ্বকলহ ও সংঘাত

লেগেই থাকত। দুর্বলেরা মার খেত সবলের হাতে। এই নাজুক অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য মানুষ নিজেদের মধ্যে চুক্তি সম্পাদন করে। চুক্তির শর্তানুযায়ী সিদ্ধান্ত হয় যে, কেউ কারো উপর অত্যাচার ও জুলুম করবে না, এবং বল পূর্বক কারো সম্পদ ছিনিয়ে নিবে না। কেউ চুক্তি ভঙ্গ করলে সকলে পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে নিজেদের অধিকার রক্ষা করবে। তাঁর মতে মানুষের যুক্তিবোধের উপর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আল ফারাবীর এই মতবাদ অষ্টাদশ শতাব্দীতে রাজনৈতিক চিন্তা ধারাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। আল ফারাবী বিশ্বভ্রাতৃত্বের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে বিশ্বময় এক রাষ্ট্র গঠনের কথাও কল্পনা করেছেন। তবে তিন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সমবায়ের কথা অস্বীকার করেন নি। তিনি উল্লেখ করেন যে ইতিহাসের বিবর্তন ধারায় সমবায় ব্যবস্থা সমগ্র মানব জাতির জন্য প্রযোজ্য হবে। কালক্রমে জাতি রাষ্ট্রীয় মর্যাদা লাভ করে সাম্রাজ্য গঠন করবে। সাম্রাজ্যবাদের স্বরূপ সম্পর্কে আল ফারাবীর বক্তব্য খুবই প্রনিধানযোগ্য। তিনি বলেন যে, সাম্রাজ্যবাদী জাতিগুলো ক্ষমতা ও ঐশ্বর্য্যের লোভে দূর্বল জাতিগুলোর উপর আধিপত্য বিস্তার করতে চায়। এ পরিস্থিতিতে ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলোর স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়। এই অনাকাঙ্খিত জটিল সমস্যার মোকাবিলায় তিনি ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলোকে জোটবদ্ধ হয়ে শক্তি সঞ্চয়ের কথা বলেছেন। তাঁর এই বক্তব্য বর্তমান যুগে আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও কূটনীতির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।

আরা পড়ুন: ইবন সিনার চিকিৎসা ও অন্যান্য 

আদর্শ রাষ্ট্রের শাসক

ফারাবী আদর্শ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার জন্য প্লেটোর 'দি রিপাবলিক' গ্রন্থে বর্ণিত আদর্শমন্ডিত দার্শনিক শাসকের কথা কল্পনা করেছেন। তাঁর মতে রাষ্ট্রনায়ক হবেন সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। সৃষ্টিকর্তা ব্যতীত অন্য কারও আদেশ তিনি পালন করবেন না। মানব দেহে আত্মার স্থান যেমন সর্বোচ্চ তেমনি রাষ্ট্রে ও সমাজে রাষ্ট্র নায়কের স্থান সর্বোচ্চ। প্লেটোর মত ফারাবীও জোরালো কন্ঠে বলেন কেবল দার্শনিকদেরই শাসক হওয়া উচিৎ। কারণ তাঁরাই সমস্ত সৎগুণের অধিকারী। ফারাবী সার্বভৌমকে 'রাইসুল আউয়াল' বা প্রধানতম নেতা বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি অন্য কোন শক্তির অধীনে থাকবেন না। তাঁর আদেশ অন্য সকলের জন্য বাধ্যতামূলকভাবে পালনীয় হবে। তিনি বলেন যে, রাষ্ট্রনায়ক সততার সাথে কাজ করবেন এবং ন্যায়নীতি অনুসরণ করবেন। তিনি স্বেচ্ছাচারকে ঘৃণা করবেন। শাসক উদার চিত্তের অধিকারী হবেন এবং ক্ষমতার প্রতি লোভ থাকবেন না। ইংরেজ আইনবিদ জন অস্টিন সার্বভৌমের যে ব্যাখা প্রদান করেছেন আল ফারাবী কয়েক শতাব্দী পূর্বেই তার ইঙ্গিত দিয়েছেন।

সারকথা

বিশিষ্ট চিন্তাবিদ আল ফারাবী যৌক্তিক রাষ্ট্রতত্ত্ব ও ধর্মতত্ত্বের মধ্যে সুষ্ঠু সমন্বয় সাধনের চেষ্টা করেছেন। নিঃসন্দেহে বলা যায় তিনি ছিলেন প্রাচ্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দার্শনিক। গ্রীক দার্শনিক প্লেটোর ন্যায় ফারাবী রাষ্ট্রনায়কের সুন্দর চিত্র অংকন করেছেন। প্রাচীন গ্রীক দার্শনিক প্লেটো ও এরিস্টটলকে প্রায় বিলুপ্ত অবস্থা থেকে তিনি তুলে এনেছিলেন। তাঁর এ অবদানের মূল্য অপরীসীম।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url