হযরত ইউনুস (আ) এর সংক্ষিপ্ত জীবনী

আজ

হযরত ইউনুস (আ) একজন বিশিষ্ট নবী ছিলেন। তাঁর জীবনে একটি ঘটনা অত্যধিক উল্লেখ-যোগ্য। একটি সামান্য ত্রুটির জন্য তাঁকে একটি মাছের পেটে গিয়ে চল্লিশ দিন পর্যন্ত থাকতে হয়েছিল। তাঁর মাছের পেটে যাওয়ার ঘটনাটি না জানা লোক মুসলমানদের মধ্যে খুব কমই আছে।

হযরত ইউনুস (আ) চল্লিশ বছর বয়সে নবুয়ত প্রাপ্ত হয়ে তাঁর কওমের মধ্যে ধর্ম প্রচারের জন্য আদিষ্ট হলেন।

একদিন হযরত আবুবকর (রা) রাসূলে করীম (স)-এর কাছে আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ (স)! হযরত ইউনুস (আ)-এর কওমের লোকসংখ্যা কত ছিল?

তিনি এরশাদ করলেন, প্রাপ্ত বয়স্ক বুদ্ধিমান পুরুষ লোকদের সংখ্যা ছিল একলক্ষ। তাছাড়া স্ত্রীলোক ও বালক-বালিকার সংখ্যা ছিল প্রায় তিন লক্ষ। লোকদের প্রায় সকলেই ছিল আল্লাহর নাফরমান কাফের।

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন হযরত ইউনুস (আ)-কে পূর্বেই জানিয়ে দিয়েছেন যে, ইউনুস! তোমার কওমের লোকজন যদি হেদায়াত কবুল না করে, তবে আমি তাদেরকে সেভাবে ধ্বংস করে দিব, যেভাবে আমি ইতোপূর্বে আদ ও সামুদ জাতি ধ্বংস করেছি।

হযরত ইউনুস (আ)-এর ধর্মপ্রচারের মূলকথা ছিল

'হে আমার কওম! আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোন উপাস্য নেই। আমি তাঁর প্রেরিত নবী। তোমরা দেব-দেবীর পূজা বাদ দিয়ে এক নিরাকার ও সর্বশক্তিমান আল্লাহ তায়ালার উপাসনা কর এবং আমাকে তাঁর সত্য নবী বলে বিশ্বাস কর আর আমার উপদেশ অনুযায়ী কাজকর্ম কর।'

কিন্তু কওমের লোকজন তাঁর কথার প্রতি কর্ণপাতই করল না; বরং তারা জবাব দিল, হে ইউনুস! তুমি যদি আমাদেরকে কেটে টুকরা টুকরা করে ফেল, তথাপি তোমার কথায় আমরা আমাদের পূর্বপুরুষের ধর্ম ও দেব-দেবীর উপাসনা ছাড়ব না।

হযরত ইউনুস (আ) বললেন, তোমরা যা বলছ, তা তোমাদের জন্য ভীষণ বিপদের কারণ। তোমাদেরই ভাল হবে যদি তোমরা আমার কথায় বিশ্বাস কর। যদি তোমরা কল্যাণ এবং মঙ্গল কামনা কর, তবে তোমাদের ভুল পথ ছেড়ে দিয়ে নিরাকার আল্লাহর ইবাদাতে লিপ্ত হও। নতুবা কিন্তু অবশ্যই তোমাদের প্রতি আল্লাহর গজব অবতীর্ণ হবে। আর আখেরাতে তোমরা অনন্তকাল ধরে দোযখের আগুনে জ্বলতে থাকবে।

একদিন একটি লোক হযরত ইউনুস (আ)-কে বলল, আচ্ছা ইউনুস। তুমি যে শুধু গজবের কথা বলছ, গজবটা কিরূপ বস্তু বলতো শুনি!

হযরত ইউনুস জবাব দিলেন, গজব হল অতর্কিত আল্লাহ তায়ালা তোমাদের উপর ভীষণ কোন বিপদাপদ অবতীর্ণ করবেন। যেমন ধর, প্রবল ভূমিকম্প, ঝড়, তুফান, বন্যা, মহাপ্লাবন কিংবা আসমান হতে অগ্নিবৃষ্টি প্রভৃতির কোন একটি কিংবা বহু ধরনের বিপদ নাযিল হতে পারে।

হযরত ইউনুস (আ)-এর কথা শুনে একব্যক্তি বিদ্রূপ করে বলল, ঐগুলোর মধ্যে কোনটি আসবে তাই ঠিক করে বল না!

হযরত ইউনুস (আ) বললেন, কোনটি যে আসবে তা আমি সঠিকভাবে বলতে পারব না, তা জানেন শুধুমাত্র আল্লাহ তায়ালা। তবে তার যে কোন একটি বিপদ যে আসবে তাতে সন্দেহ নেই। কেননা তা আমাকে আল্লাহ জানিয়েছেন।

এবার হযরত ইউনুস (আ)-এর কথায় সকলেই অট্টহাসি হাসল।

তাদের হাসির বেগ মন্দিভূত হলে আর একজন আবার জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা তবে এ কথাটা বলতো, ঐরূপ গজব কোনদিন আসবে?

হযরত ইউনুস (আ) বললেন, কোনদিন আসবে তাও আমি সঠিকভাবে বলতে পারব না। অবশ্যই এতে সন্দেহ করার কোন কারণ নেই। তোমরা যদি সৎপথ অবলম্বন না কর, তবে বিপদ আসবেই এবং তোমরা তাতে একেবারেই ধ্বংস হয়ে যাবে।

অবাধ্য কাফেরগণ তার কথায় আবারও হাসতে লাগল। কেউ কেউ হযরত ইউনুস (আ)কে পাগল ও মূর্খ বলে তাঁর গায়ে থুথু নিক্ষেপ করল। কেউ বা তার শরীরে ইট পাথর মারল।

হযরত ইউনুস (আ) ব্যথিত মনে তাদের নিকট হতে উঠে চলে গেলেন।

হযরত ইউনুস (আ)-এর মনে খুবই ব্যথা লেগেছিল। কেননা যাদেরকে তিনি সদুপদেশ দিচ্ছিলেন, তারা তাঁর উপদেশের প্রতি কর্ণপাত তো করলই না, বরং তারা তাঁকে বিদ্রূপ ও উপহাস করছিল। এভাবে একাধারে চল্লিশ বছর পর্যন্ত তাঁর আপ্রাণ চেষ্টা সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হওয়ার পর তিনি আল্লাহর দরবারে দু'হাত তুলে দোয়া জানালেন, 'হে মাবুদ! তুমি এ অবাধ্য লোকগুলোর উপরে গজব নাযিল কর। আল্লাহ পাকের তরফ হতে জবাব আসল, হাঁ ইউনুস। যথাসময়ে আমি এদের প্রতি অবশ্যই গজব নাযিল করব; কিন্তু গজব নাযিল হওয়ার কোন সুনির্দিষ্ট তারিখ তাঁকে জানানো হল না।

এদিকে কাফেরগণ হযরত ইউনুস (আ)-এর সাথে দেখা হলেই জিজ্ঞেস করে, কিহে ইউনুস! তোমার আল্লাহর তরফ হতে আমাদের উপর গজব আসবে, কিন্তু তা আর কবে আসবে? আমরা তো তার জন্য অপেক্ষা করতে করতে একেবারে অধীর হয়ে পড়েছি।

হযরত ইউনুস (আ) তাদের এ ধরনের বিদ্রূপসূচক কথা শুনতে শুনতে একেবারে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছিল। এ আর তাঁর সহ্য হচ্ছিল না। আল্লাহ তায়ালার পক্ষ হতেও তিনি আর কোন রকম কিছু আভাস-ইঙ্গিত পাচ্ছেন না। তাঁর লজ্জা এবং দুঃখও হচ্ছিল। অবশেষে তিনি একদিন আল্লাহ পাকের অনুমতি ব্যতিরেকেই নিজের পুত্র সন্তান এবং স্ত্রীকে নিয়ে বাড়ীর বের হয়ে পড়লেন। উদ্দেশ্য এ যে, তিনি আর এ দেশে থাকবেন না। কোন দূরদেশে চলে যাবেন।

হযরত ইউনুস (আ) আল্লাহর নবী হওয়া সত্ত্বেও এ যে কাজটি করলেন, এ তাঁর জন্য ঠিক হয়নি। তাঁর জন্য উচিত ছিল আল্লাহর নির্দেশের অপেক্ষা করা অথবা আল্লাহর অনুমতি নিয়ে বিদেশ যাত্রা করা।

তিনি দেশ হতে চলে যাওয়ার পর দেশে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিল।

অর্থাৎ কেউ কেউ তাঁর নিন্দাবাদ আবার কেউ কেউ তাঁর প্রশংসাও করতে লাগল।

ভীতি ও আতঙ্ক সৃষ্টি, যার ফলে ঈমান গ্রহণ

হযরত ইউনুস (আ) দেশ হতে বের হয়ে যাবার পর পরই একদিন দ্বিপ্রহরকালে সহসা ঐ দেশে একটি দূরবস্থার সৃষ্টি হল। কোথা হতে কতকগুলো মেঘখণ্ড এসে তা একত্রিভূত হয়ে ঘন ঘোর কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করে সারা দেশটিকে অন্ধকার করে ফেলল। দেশের লোকজন এমন দৃশ্য আর কোনদিন দেখেনি। তারা এ দৃশ্য দেখে ভীত-শঙ্কিত হয়ে পড়ল। দেখতে দেখতে ঐ মেঘরাশির ভিতর হতে ভীতিব্যঞ্জক বিদ্যুৎ চমকে কামানের গর্জনতুল্য মুহূর্মুহু গর্জন শুরু হল, যাতে দেশবাসীর মনে অত্যন্ত আতঙ্কের সৃষ্টি হল। মেঘরাশি ক্রমশঃই নিচের দিকে নেমে আসছিল। মনে হচ্ছিল যে, সে প্রলয়ঙ্করী মেঘ দুনিয়ার সবকিছু গ্রাস করে ফেলবে। আর তার গর্জনগুলোও ক্রমেই এমন ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছিল যে, একেকটি আওয়াজে মানুষ ও পশুপাখি সকলেরই হৃদয়ের মধ্যে প্রবল কম্পন ধরে যাচ্ছে। আতঙ্কে সকলে হতবুদ্ধি হয়ে এদিক-সেদিক ছুটাছুটি শুরু করল। এ সর্বগ্রাসী বিপদ হতে কে কোথায় গিয়ে আশ্রয় নিবে, তা কেউই বুঝতে পারেনি।

সকলের মনে হতে লাগল যে, এ আর কিছু নয়, হযরত ইউনুস (আ) যে তাদেরকে বার বার আল্লাহর গজবের ভয় দেখিয়েছিলেন, নিশ্চয়ই এ সে আল্লাহর গজবই তাদের প্রতি নেমে এসেছে। সত্যই হযরত ইউনুস (আ) আল্লাহর নবী ছিলেন এবং তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী সত্য ছিল। হায়! এখন আমরা কি করব, কে আমাদেরকে এ বিপদ হতে রক্ষা করবে? তিনি তো দেশ ত্যাগ করে চলে গেছেন।

দেশে থাকলে না হয় তাঁর নিকট গিয়ে কেঁদে-কেটে বলা যেত, আমরা তোমার কথা না শুনে অন্যায় করেছি। আর সেরূপ করব না। এখন হতে আমরা তোমার উপদেশ মেনে চলব। তুমি আল্লাহর নিকট সুপারিশ করে আমাদেরকে বিপদমুক্ত কর এবং ধ্বংসের হাত হতে রক্ষা করে বাঁচার পথ করে দাও। 

কিন্তু হযরত ইউনুস (আ)-কে আর কোথায় পাওয়া যাবে? তিনি তো দেশত্যাগ করে না জানি কোন সুদূর রাজ্যে চলে গেছেন। এভাবে তাঁর সাক্ষাৎ সম্পর্কে হতাশ ও নিরাশ হয়ে তারা সকলে এরূপ করল যে, হযরত ইউনুস (আ) যেভাবে কখনও ভূমিতে মাথা লুটিয়ে আল্লাহর দরবারে দোয়া করতেন, আমরাও তদ্রূপ করে দেখি, আল্লাহ আমাদের উপর হতে এ বিপদ দূর করেন কিনা।

দেশবাসীগণ তখন সকলেই একযোগে মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে আল্লাহর দরবারে এরূপ দোয়া করতে লাগল, 'হে আমাদের মালিক ও প্রতিপালক! আপনার কাছে আমরা পরম দোষে দোষী, চরম অপরাধি, আমাদের পাপের শেষ নেই। আপনার নবী হযরত ইউনুস (আ) সত্যই আমাদেরকে কল্যাণ এবং মঙ্গলের পথ দেখিয়েছিলেন; কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ আমরা তাঁর বিরোধিতা করে নিজেরাই বিপদে লিপ্ত হয়েছি। হে প্রভু! আমরা আমাদের ভুল বুঝতে পেরেছি। আমরা আপনার কাছে লজ্জিত ও অনুতপ্ত হয়ে এখন আশ্রয় প্রার্থনা করছি। আমরা এখন চরম অনুতপ্ত। আর কোনদিনই আমরা এরূপ ভুল করব না। আপনি তো বান্দার প্রতি মহা দয়াবান এবং পরম কৃপাশালী। অতএব আপনার সে দয়া ও কৃপাগুণে এ হতভাগ্য বিপদগ্রস্ত বান্দাদেরকে বিপদ হতে মেহেরবানী করে রক্ষা করুন।


তাদের এরূপ করুণ ও আন্তরিক দোয়ার ফলে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের তাদের প্রতি দয়া হল এবং তিনি তাদের উপর হতে প্রায় আসন্ন গজবকে প্রত্যাহার করলেন। অল্পক্ষণের মধ্যেই আকাশ হতে মেঘরাশি দূরীভূত হয়ে গেল। দেশে আবার স্বস্তি এবং নিরুদ্বিগ্নতা ফিরে আসল।


এরপর দেশের লোকেরা সর্বত্র হযরত ইউনুস (আ)-কে খুঁজতে লাগল, কিন্তু কোথাও তাঁর সন্ধান পাওয়া গেল না। তখন তাঁরা সকলে মিলে আবার দোয়া করল, 'হে মাবুদ। তুমি আমাদের নবীকে আমাদের মধ্যে আবার ফিরিয়ে দাও। আমরা তাঁকে সাদরে গ্রহণ করব এবং তাঁর সকল উপদেশ মেনে চলব।' সত্যই তাদের ঈমান গ্রহণ এবং আন্তরিকতাপূর্ণ দোয়া দুনিয়ার ইতিহাসে একটি অনন্য ঘটনা ছিল। একটি বিরাট কওমের সমস্ত লোকেরা এরূপ দলবদ্ধভাবে সৎপথ অবলম্বনের ঘটনা আর কখনও দেখা যায়নি।

হযরত ইউনুস (আ)-এর বিপদ

হযরত ইউনুস (আ) স্বদেশ হতে বের হয়ে কিছুদূর চলার পর পথে একটি নদীর তীরে গিয়ে উপস্থিত হলেন। তখন তিনি সকলকে নিয়ে নদী পার হওয়ার জন্য বড় ছেলেটিকে নদীর এপারে বসিয়ে রেখে ছোট ছেলেটিকে কাঁধে নিয়ে স্ত্রীকেসহ হেঁটে নদী পার হতে লাগলেন। কিছুদূর যাওয়ার পর হঠাৎ তাঁর স্ত্রী নদীতে ডুবে যেতে লাগলেন। হযরত ইউনুস তাড়াতাড়ি তাকে ধরতে গেলে তাঁর কাঁধ হতে ছেলেটি নদীর মধ্যে পড়ে গেল এবং সঙ্গে সঙ্গে নদীর প্রবল স্রোতে ভেসে গেল। এদিকে তিনি স্ত্রীকেও ধরতে পারলেন না। তিনিও নদীর স্রোতে ভেসে গেলেন। এদের উভয়ের কাউকেও উদ্ধার করতে পারা গেল না। তখন তিনি বড় ছেলেটিকে নিয়ে আসার জন্য নদীর কূলের নিকটবর্তী হওয়ামাত্র দেখতে পেলেন, একটি বাঘ দৌড়ে এসে ছেলেটিকে মুখে নিয়ে দ্রুত জঙ্গলের মধ্যে চলে গেল। তখন আর তিনি কি করবেন। এভাবে স্ত্রী-পুত্র হারিয়ে শোকাকুল চিত্তে একাই নদী পার হয়ে সামনে চলতে লাগলেন।


বহুদূর পথ অতিক্রম করে তিনি আবার তাইগ্রীস নদীর তীরে উপস্থিত হয়ে দেখলেন, একখানি জাহাজ নোঙ্গরকৃত অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। জাহাজে বহুযাত্রী পূর্বেই আরোহণ করেছিল। তিনিও তাতে আরোহণ করলেন। কিছুক্ষণ পরেই জাহাজখানার নোঙ্গর তুলে তা ছেড়ে দিল।

জাহাজখানা কিছুক্ষণ ধরে নদীতে চলে সাগরে গিয়ে উপনীত হল; কিন্তু সাগর বক্ষে চলতে শুরু করেই তা সামনে অগ্রসর না হয়ে একই জায়গায় বসে ঘুরতে লাগল। তদুপরি আরও একটি আশ্চর্য কোন বিপদ এসে উপস্থিত হল। বিরাট বিরাট সামুদ্রিক মাছসমূহ এসে জাহাজের উপর প্রবল আঘাত করতে ও ধাক্কা দিতে শুরু করে দিল।

জাহাজের কাপ্তান, নাবিক এবং আরোহীগণ সকলে বিস্মিত হয়ে ভাবতে লাগল যে, এরূপ হবার কারণ কি? জাহাজে জনৈক ধর্মভীরু কামেল বোযর্গ ছিলেন। তিনি বললেন, নিশ্চয় জাহাজে কোন এমন গোলাম আছে, যে তাঁর মুনিবের কাছে না বলে পালিয়ে যাচ্ছে; এবং সে এ জাহাজে আরোহণ করেছে। আর তারই পাপের জন্য জাহাজের এ অবস্থা। সে ব্যক্তিকে জাহাজ হতে ফেলে না দিলে জাহাজ বিপদমুক্ত হবে না।


এরপর এক এক করে জাহাজের প্রত্যেক আরোহীর কাছে জিজ্ঞেস করতে লাগল যে, তোমরা কেউ তোমাদের মালিকের নিকট হতে পালিয়ে যাচ্ছ না কি?


সকলেই অস্বীকার করল। কিন্তু হযরত ইউনুস (আ)-এর নিকট জিজ্ঞেস করার পূর্বেই তিনি ভাবতে লাগলেন যে, আমিইতো মুনিবের নিকট না বলে আসা পলাতক গোলাম। আমি আমার সর্বশ্রেষ্ঠ মহান আল্লাহ তায়ালার অনুমতি না নিয়ে স্বদেশ ছেড়ে বিদেশে রওয়ানা করেছি। অতএব আমার মত বড় পাপী আর কে হতে পারে? একথা চিন্তা করেই জাহাজ কর্তৃপক্ষের নিকট গিয়ে তিনি বললেন, আমিই আমার মালিকের নিকট না বলে দেশ হতে অন্যত্র চলছি। আমাকে আপনারা সাগরে ফেলে দিন। তা হলেই আপনারা সকলে বিপদমুক্ত হবেন; কিন্তু তিনি একথা বললেও তারা তাঁর চেহারা-সুরত দেখে একথা বিশ্বাস করল না যে, তিনি কারও গোলাম হতে পারেন। কোন গোলামেরই আচরণ এবং কথাবার্তা এরূপ নয়; বরং তাকে সকলেই বিশেষ কোন সম্ভ্রান্ত লোক বলে মনে করলেন। কিন্তু হযরত ইউনুস (আ) যখন বার বার নিজেকে অবাধ্য গোলাম বলে প্রকাশ করতে লাগলেন, তখন জাহাজের লোকজন জাহাজের লোকদের মধ্যে কে সে অপরাধী গোলাম তা বের করার জন্য কোরা ঢালল। কোরায় হযরত ইউনুস (আ)-এর নাম উঠল। একে একে তিনবার নাম উঠল। তখন তাঁকে সমুদ্রের বুকে নিক্ষেপ করা ছাড়া আর উপায় ছিল না। অতএব তাঁকে সমুদ্রের বুকে নিক্ষেপ করা হল। সঙ্গে সঙ্গে জাহাজের চতুষ্পার্শ্ব হতে সে বিরাট বিরাট মাছগুলো চলে গেল এবং জাহাজটির ঘূর্ণন বন্ধ হয়ে তা সোজা সামনের দিকে চলতে লাগল।

মাছের পেটে হযরত ইউনুস (আ)

হযরত ইউনুস (আ) সমুদ্র গর্ভে নিক্ষিপ্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জাহাজের চতুষ্পার্শ্ব হতে মাছগুলো দূর হয়ে গেল; কিন্তু একটি বিরাট মাছ হযরত ইউনুসকে (আ) গিলে ফেলল।

দুর্যোগের উপরে মহাদুর্যোগ, বিপদের উপরে মহাবিপদ বৈকি! হযরত ইউনুস (আ) দেশত্যাগ করে বাইরে যাওয়ার পথে প্রথমে তিনি নিজের পুত্রদ্বয় এবং স্ত্রীকে হারালেন। তারপর আজ তিনি নিজেই স্বয়ং সমুদ্র গর্ভে নিক্ষিপ্ত হয়ে মাছের পেটে চলে গেলেন। এর অপেক্ষা বড় বিপদ আর কি হতে পারে? তিনি আল্লাহ তায়ালার এক বিশিষ্ট নবী হয়ে আল্লাহর অনুমতি ব্যতীত স্বদেশ ছেড়ে অন্যত্র যাত্রা করার অপরাধেই আল্লাহ তায়ালা তাঁকে এ কঠিন বিপদসমূহে লিপ্ত করলেন; কিন্তু আল্লাহ পাকের এরূপ উদ্দেশ্য ছিল যে, নবীর ঘটনাটা যেন অন্যান্য নবী-রাসূল এবং বিশ্ব মুসলমানদের জন্য একটি শ্রেষ্ঠ এবং আদর্শ শিক্ষা হিসেবে ইতিহাসের পাতায় চিরজাগরুক হয়ে থাকে। তাই আল্লাহ তায়ালা হযরত ইউনুস (আ)-কে দুনিয়া হতে তুলে নেয়ার বদলে তাঁকে বাঁচিয়ে রাখতেই ইচ্ছুক ছিলেন। এ কারণে উক্ত মাছটিকে তিনি সঙ্গে সঙ্গে হুকুম করলেন, হে মাছ! আমার প্রিয়নবী তোমার পেটের মধ্যে আশ্রয় গ্রহণ করেছে। সাবধান! তার যেন কোন প্রকার কষ্ট কিংবা অসুবিধা না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রেখো।


হযরত ইউনুস (আ) মাছের পেটে যাওয়ামাত্র কেঁদে উঠলেন এবং মহান আল্লাহর দরবারে কেঁদে কেঁদে তাওবা ইস্তেগফার করে বলতে লাগলেন, 'হে মাবুদ! তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও, আমি আর কোনদিনই তোমার অসন্তুষ্টিমূলক কোন কাজ করব না। তুমি আমার এবারকার অপরাধ দয়াপূর্বক ক্ষমা কর।' তিনি আল্লাহর দরবারে এভাবে কাকুতি-মিনতি করছিলেন আর বার বার দোয়াটি পাঠ করতে লাগলেন।

উচ্চারণঃ 'লা-ইলাহা ইল্লা আনতা সুবহানাকা ইন্নী কুনতু মিনাজ্জোয়ালিমীন।'

একাধারে চল্লিশদিন এ অবস্থায় কাটল। এর মধ্যে একটি মুহূর্তমাত্র ঐ দোয়া পাঠ হতে বিরত হলেন না। মাছের পেটের গভীরে অন্ধকারে আটক হয়ে একাগ্র মনে তিনি ঐ দোয়াটি অনবরত পড়তে লাগলেন। অন্ধকারে তাঁর বুঝিবার সাধ্য ছিল না যে, কখন দিবাগমন করছে আর কখন রাত্রি হচ্ছে।

কথিত আছে যে, একদিন দু'দিন করে চল্লিশটি দিন অতিবাহিত হল। চল্লিশদিন তিনি সর্বমোট একলক্ষ চল্লিশ হাজারবার এ দোয়াটি পাঠ করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত আল্লাহর কৃপা হল। তিনি আর তাঁর প্রিয় নবীর এ করুণ অবস্থায় অবিচল থাকতে পারলেন না। তিনি তাঁর প্রিয় নবীর পাঠ করা উক্ত দোয়ার জবাবে বলে উঠলেন।

উচ্চারণ: 'ফাসতাজাবনা লাহু অনাজ্জাইনাহু মিনাল গাম্মি অ কাযালিকা নুনজিল মু'মিনীন।'


অর্থাৎ: এরপর আমি তার ডাকে সাড়া দিলাম এবং তাকে আমি বিপদ হতে মুক্ত করলাম। আর এভাবেই আমি মুমিনগণকে মুক্তিদান করে থাকি।

হযরত ইউনুস (আ) মৎস্যের পেটে চল্লিশদিন থাকাকালে কোনকিছুই পানাহার করেননি বরং আল্লাহ পাকের তাসবীহ পাঠই ছিল তাঁর তখনকার একমাত্র খোরাক। তাই তাঁকে তখন বাঁচিয়ে রেখেছিল।

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পবিত্র কোরআনে এরশাদ করেছেন: 'তিনি যদি এভাবে তাসবীহ পাঠ না করতেন তা হলে রোজ কিয়ামত পর্যন্ত তাকে মাছের পেটেই আবদ্ধ থাকতে হত।

হযরত ইউনুস (আ)-এর মাছের পেট হতে পরিত্রাণ

আল্লাহ তায়ালা হযরত ইউনুস (আ)-এর প্রতি কৃপা প্রদর্শন এবং তাঁর দোয়া কবুল করার সঙ্গে সঙ্গে মাছটির পেটে বেদনা আরম্ভ হল ও যন্ত্রণায় অধীর হয়ে পড়ল। এরপর আল্লাহরই নির্দেশে একটি জনপ্রাণহীন বড় দ্বীপে গিয়ে মাছটি হযরত ইউনুস (আ)-কে তার উদর হতে উদগার করল এবং এভাবে সে পেটের বেদনা হতে মুক্তি পেল এবং শান্তি ও স্বস্তির মুখ দেখল। হযরত ইউনুস (আ) ও তখন প্রায় জীবিত মৃতের মত অবস্থা প্রাপ্ত হয়েছিলেন।

দয়াময় আল্লাহ তায়ালার দয়া ও মমতার সীমা-পরিসীমা নেই। তাঁর কুদরতেরও কোন পারাপার নেই। তিনি মৃতকে জীবিত করেন, জীবিতকে মৃত্যুদান করেন। তিনি শুষ্ক মরুতে পানির ঝর্ণা বয়ে দেন আবার সাগর শুকিয়ে মরু প্রান্তরে পরিণত করার ক্ষমতাও তিনি রাখেন। তিনি করতে পারেন না এমন কিছুই নেই। তিনি অসীম অফুরন্ত ক্ষমতার অধিকারী।

সামুদ্রিক মাছ হযরত ইউনুস (আ)-কে নির্জন দ্বীপে উদগার করে দিয়ে সাগরে চলে গেল, যে দ্বীপে জন-মানবের চিহ্নমাত্র নেই; থাকার কথাও নয়। ক্ষুধায়-তৃষ্ণায় হযরত ইউনুস (আ) অর্ধমৃত প্রায়। তিনি কি খাবেন, কি পান করবেন? সাগরের পানি ভীষণ লবণাক্ত। গাছলতাহীন সুবিশাল উন্মুক্ত দ্বীপে প্রখর রৌদ্রের তাপ মানুষের থাকার জন্য একেবারেই অনুপযোগী।

কিন্তু এ প্রতিকূল পরবেশে হযরত ইউনুসের প্রতি আল্লাহর রহমত অবতীর্ণ হল। যেখানে তিনি অর্ধশায়িতাবস্থায় পড়ে রয়েছিলেন, তার একেবারে নিকটেই হঠাৎ একটি লাউ গাছের পাতার মত পাতা বিশিষ্ট চারা গাছ হল এবং দেখতে দেখতে তা বড় হয়ে গেল। শুধু বড়ই নয়, তা একটি বিরাট ঝোপে পরিণত হল।

এবার নবী (আ) কোন রকমে উঠে ঐ ঝোপের ছায়ায় আশ্রয় নিয়ে তিনি রৌদ্রের তাপমুক্ত হলেন। তাঁর প্রাণ অনেকটা শীতল হয়ে গেল। একটু পরেই দেখা গেল, সে গাছে কতকগুলো ফল ধরেছে, ফলগুলো ইতোমধ্যে বেশ বড় হয়ে গেল। ফলগুলো দেখতে প্রায় লাউয়ের মত হলেও তা অতিশয় সুমিষ্ট এবং সুস্বাদু। তিনি একটি ফল ছিড়ে তা খেলেন। এমন সুমিষ্ট ও সুস্বাদু ফল তিনি জীবনে কখনও খাননি।

এভাবে আল্লাহ তাঁর ক্ষুধা দূর করলেন। নবী চিন্তা করলেন, এখন তিনি তৃষ্ণা নিবারণ করবেন কি দিয়ে? এরূপ চিন্তা করতেই তিনি দেখতে পেলেন, একটি পাহাড়ী বকরী তাঁরই দিকে ছুটে আসছে। বকরীটি এসেই তাঁর নিকট দণ্ডায়মান হল এবং তিনি তার দুধ দোহাইয়া প্রাণ ভরে পান করে তৃষ্ণা নিবারণ করলেন।

এভাবে কয়েকদিন পর্যন্ত আল্লাহ প্রদত্ত সুমিষ্ট ফল আহার করে ও পাহাড়ী বকরীর দুধ পান করে হযরত ইউনুস (আ) তাঁর দেহে যথেষ্ট শক্তি ও শান্তি অনুভব করতে লাগলেন। এমনি অবস্থায় তাঁর প্রতি আল্লাহর আদেশ আসল-

'হে ইউনুস! তুমি সাগরের অপর পারের দেশগুলোতে গিয়ে কিছুদিন ধর্ম প্রচার কর। তারপর তথা হতে তোমার স্বদেশে গিয়ে নিজ কওমের লোকদেরকে হেদায়াত করতে থাক।'

হযরত ইউনুস (আ)-এর স্বদেশে নিজের কওমের কাছে আগমন

হযরত ইউনুস (আ)-এর দেশ পরিত্যাগ করার পর হতেই তাঁর কওমের লোকজন তাঁকে খুঁজে ফিরছিল এবং তাঁদের নিজেদের মধ্যে ফিরে পাবার জন্য আল্লাহর দরবারে রোনাজারী করছিল।

যথাসময়ে আল্লাহর দরবারে তাঁদের রোনাজারীর প্রতিক্রিয়া দেখা গেল। আল্লাহর দয়া তাদের প্রতি আত্মপ্রকাশ করল। আল্লাহ তাদের মনের আশা ভালভাবেই জানতেন। এবার এতদিনে তিনি তা পুরা করলেন। হযরত ইউনুস (আ) যে নূতন দেশে গেছেন সেখান হতে নিজের স্ত্রী-পুত্রদ্বয়সহ স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করলেন।

আল্লাহ তায়ালার অসীম মেহেরবানী, একসময় যে লোকজন হযরত ইউনুস (আ)-এর কথা শুনে তাঁকে তামাসা ও উপহাস করত, পাগল বলে তাড়িয়ে দিত, তাঁর উপদেশ ও ওয়াজ-নসীহত পাগলের প্রলাপ বলে উড়াইয়া দিত, তিনি দেশ ত্যাগ করার পর আল্লাহ প্রদত্ত গজবের সূচনা দেখে তারা তাঁর অবর্তমানেই সৎপথ অবলম্বন করে তাঁর কথার গুরুত্ব ও নবুয়তের সত্যতা উপলব্ধি করে তাঁকে নিজেদের মধ্যে পাবার জন্য উন্মুখ হয়েছিল। এতদিন পর তাঁকে নিজেদের মধ্যে ফিরে পাবার আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়ল। এখন তিনি তাদেরকে যে কথা বলতে লাগলেন ও যে পথে চলতে বললেন, যে সকল বিধি-বিধান শিখিয়ে দিলেন, সকল কিছুই তারা মনে-প্রাণে গ্রহণ করল এবং তাকে প্রকৃতপক্ষে তাদের কল্যাণ ও মঙ্গল লাভের পথের দিশারী হিসেবে মেনে নিল।

কথিত আছে যে, হযরত ইউনুস (আ) স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের পর আরও একত্রিশ বছর জীবিত ছিলেন এবং এতদিন ধরে নিজের দেশবাসীর মধ্যে হেদায়াত জারী রেখে একশত এগার বছর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেছিলেন।


এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url