ভারতের সংবিধানের বিকাশ বৈশিষ্ট্য তাৎপর্য ও পদ্ধতি

ভারতের সাংবিধানিক বিকাশ সংক্ষেপে বর্ণনা ভারতের সংবিধানের মূল বৈশিষ্ট্যগুলো সংবিধানের প্রস্তাবনার তাৎপর্য বিশ্লেষণ  ও সংবিধানের সংশোধন পদ্ধতিগুলো ব্যাখ্যা করতে পারবেন।

ভূমিকা

যে কোন দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সে দেশের সংবিধান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সংবিধান হলো দেশের একটি প্রামাণ্য সামাজিক-ঐতিহাসিক দলিল। এটি হল দেশ ও দেশবাসীর প্রয়োজনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রণীত একটি দলিল বিশেষ। রাজনৈতিক ব্যবস্থার মূল ভিত্তি হচ্ছে সে দেশের সংবিধান। তাই অধ্যাপক ফাইনার (Finer) একে "মৌলিক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানাদির ব্যবস্থা এবং ক্ষমতাগত পার্থক্যের আত্মজীবনী" বলে আখ্যায়িত করেছেন। আর ভারতীয় সংবিধানের ক্ষেত্রে বলা যায়- এটি পৃথিবীর মধ্যে সর্ববৃহৎ সংবিধান। ১৯৪৯ সালের ২৬ শে নভেম্বর ৩৯৫ টি ধারা এবং ৮টি তফশীল নিয়ে গণপরিষদ কর্তৃক সংবিধান গৃহীত হয়েছিল। ১৯৯১ সালের আগস্ট পর্যন্ত ৭৮ বার সংশোধন করা হয়েছে। বর্তমানে সংবিধানে ৪০৭ টি ধারা ১০টি তফশীল আছে।

আরো পড়ুন:

ভারতের সংবিধানের বিকাশ

১৯৪৭ সালের ২০ শে আগস্ট বি. আর. আম্বেদকরের নেতৃত্বে একটি খসড়া সংবিধান তৈরীর জন্য কমিটি গঠন করা হয়। ১৯৪৮ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি এ কমিটি গণপরিষদে একটি খসড়া সংবিধান পেশ করে। সুদীর্ঘ আলাপ আলোচনার পর সংবিধানটি গৃহীত হয়। অন্যান্য দেশের মত ভারতের সংবিধানও একটি গতিশীল দলিল। বিগত বছরগুলোতে কেবল আয়তনের দিক থেকেই নয়, বক্তব্য ও উদ্দেশ্যের দিক থেকেও সংবিধানের বহু পরিবর্তন এবং বিকাশ সাধিত হয়েছে।

সাংবিধানিক রীতি-নীতি

ভারতের সংবিধানের অনুপূরকরূপে সাংবিধানিক নীতি-নীতির উদ্ভব ঘটেছে। এতে সংবিধানিক আইনের অপূর্ণতা দূর করা সম্ভব হয়েছে এবং সংবিধানের গতিশীল চরিত্রও অব্যহত থেকেছে। ভারতের সংবিধানে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক এই রীতির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। সাংবিধানিক নজীরও সংবিধান বিকাশের একটি কার্যকরী মাধ্যম। তবে নজীর যেমন সৃষ্টি হয়েছে তা' লংঘিতও হয়েছে। রাজনীতির দ্রুত পট পরিবর্তনের ফলে প্রকৃতপক্ষে নজীর রাজনৈতিক সুবিধা অর্জনের মাধ্যমে পরিণত হয়েছে। সুপ্রীমকোর্টে বিচারপতি নিয়োগ, প্রধানমন্ত্রীর মৃত্যুর পর অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ ইত্যাদি ক্ষেত্রে সাধারণত সাংবিধানিক নজীর অনুসরণ করা হয়।

সংশোধন পদ্ধতি

সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে ভারতের সংবিধানের বিকাশ ঘটেছে। সংবিধানের গতিশীলতা বজায় রাখার সর্বোত্তম পদ্ধতি হলো চাহিদা অনুযায়ী-এর সংশোধন। সংশোধন বলতে সংযোজন এবং বর্জন উভয়ই বুঝায়। ১৯৯১ সাল পর্যন্ত মোট ৭৮ বার ভারতের সংবিধান সংশোধিত হয়েছে।

আরো পড়ুন:

আইন প্রণয়ন

সংসদ প্রণীত বিভিন্ন আইনের মাধ্যমে সংবিধান বিকশিত এবং সম্প্রসারিত হয়েছে। সংবিধানে সংসদের হাতে কেন্দ্রীয় তালিকা ও যুগ্ম তালিকা এবং বিশেষ ব্যবস্থায় রাজ্য তালিকায় আইন প্রণয়নের ক্ষমতা ন্যস্ত করা হয়েছে। বিদেশের সাথে সন্ধি ও চুক্তি, মৌলিক অধিকার প্রয়োগ, জন-প্রতিনিধিত্ব, বিচার বিভাগীয় পদ্ধতি, দেওয়ানী ও ফৌজদারী আইন, এবং রাজ্য পুনঃগঠন বিষয়ক বিভিন্ন আইন প্রণয়ন করে সংসদ সংবিধানকে অর্থবহ ও পূর্ণাঙ্গ করে তুলেছে।

আদালত

বিচার-বিভাগীয় সিদ্ধান্তকে ভারতের সংবিধান বিকাশের একটি পদ্ধতি হিসাবে বিবেচনা করা যায়। আদালত আইনের ব্যাখ্যা ও বৈধতা বিচারের মাধ্যমে সাংগঠনিক আইনের ত্রুটি দূরীকরণে সাহায্য করে।

শাসন বিভাগীয় সিদ্ধান্ত

শাসন বিভাগীয় কার্যকলাপ সংবিধান বিকাশে সাহায্য করেছে। শাসন বিভাগের প্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে নির্ধারিত নীতি সংবিধানকে সরাসরি প্রভাবিত করেছে। বিভিন্ন সরকার কর্তৃক গৃহীত নীতি ও কার্যক্রম সংবিধানের বিভিন্ন ধারা পরিবর্তন এবং সংবিধানের বিকাশে সাহায্য করেছে। সুতরাং, আমরা দেখতে পাই উপরোক্ত বিষয়াবলী ভারতের সংবিধান বিকাশে সহায়তা করেছে। ভারতের সংবিধানের মূল বৈশিষ্ট্যগুলো নিম্নরূপঃ
  • সংবিধানের বিশালতা বা বৃহৎ আয়তন;
  • ঔপনিবেশিক শাসনের প্রভাব:
  • বিভিন্ন অভিজ্ঞতা ও চিন্তার প্রভাব;
  • প্রস্তবনা;
  • মৌলিক অধিকার;
  • নির্দেশমূলক নীতি:
  • নাগরিকের কর্তব্য;
  • ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র:
  • যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা;
  • ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণের অস্বীকৃতি;
  • সংসদীয় শাসনব্যবস্থাঃ
  • সংসদের সার্বভৌমিকতা এবং আদালতের প্রাধান্যের সমন্বয় সাধন;
  • সুপরিবর্তনীয়তা এবং দুস্পরিবর্তনীয়তার সম্মিলন;
  • শাসনতান্ত্রিক রীতি-নীতি;
  • সার্বজনীন ভোটাধিকার;
  • দেশীয় রাজ্যের অন্তর্ভুক্তি;
  • সমাজের অনুন্নত অংশের জন্য বিশেষ সংরক্ষণ ব্যবস্থা:
  • বিশেষ পদাধিকারী ও সংস্থার আলোচনা:
  • জরুরি অবস্থা সংক্রান্ত ঘোষণা:
  • ভাষা সম্পর্কিত বক্তব্য:
  • দলত্যাগ বিরোধী ব্যবস্থা।

ভারতের সংবিধানের প্রস্তাবনার তাৎপর্য
ভারতের সংবিধানকে যদি মুকুটের সাথে তুলনা করা হয়, তাহলে প্রস্তাবনা হলো তার শোভাবর্ধনকারী রত্নবিশেষ। গণপরিষদের জনৈক সদস্য এভাবেই প্রস্তাবনার তাৎপর্য ব্যাখ্যা করেছেন। ভারতের সংবিধানের প্রস্তাবনার মূল উৎস হল ১৯৪৬ সালের ১৩ই ডিসেম্বর গণপরিষদে জওহর লাল নেহেরু কর্তৃক উত্থাপিত সংবিধানের উদ্দেশ্য সম্বলিত প্রস্তাব। মূল সংবিধানের প্রস্তাবনায় ভারতকে একটি "সার্বভৌম, গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র" হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছিল। সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, স্বাধীনতা, সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের রূপায়ন রাষ্ট্রের লক্ষ্য হিসাবে ঘোষিত হয়েছিল। ১৯৭৬ সালে ৪২তম সংবিধান সংশোধন আইনের মাধ্যমে 'সমাজতান্ত্রিক', 'ধর্মনিরপেক্ষ' এবং 'সংহতি' শব্দত্রয় সংবিধানে যুক্ত করা হয়েছে।

ভারতের সংবিধানে সংযোজিত প্রস্তাবনার সাহায্যে সংবিধানের আদর্শগত ভিত্তি, উৎস, কাঠামো অনুধাবন করা সম্ভব। সংবিধানের মূল অংশের চাবিকাঠি প্রস্তাবনার মধ্যে নিহিত। এর ঐতিহাসিক তাৎপর্য অপরিসীম। প্রস্তাবনার মাধ্যমে ভারতের সমাজ বিকাশের নির্দিষ্ট পর্যায়ের প্রাধান্যকারী ভাবধারা প্রতিফলিত হয়েছে। ১৯৬৭ সালে ভারতের তৎকালীন বিচারপতি কে সুব্বারাও মন্তব্য করেছিলেন যে, প্রস্তাবনা সংক্ষেপে সংবিধানের আদর্শ ও আকাঙ্খাকে ব্যক্ত করেছে (The preamble contains, in nutshell, its ideals and aspirations)

আরো পড়ুন:

সংবিধান সংশোধন পদ্ধতি

পৃথিবীর সব দেশের সংবিধানই পরিবর্তিত হয়। ভারতও এর ব্যতিক্রম নয়। সংবিধানের ৩৬টি ধারায় সংশোধনের পদ্ধতি উল্লেখ আছে। সাধারণত সংবিধানের বিভিন্ন ধারা পরিবর্তনের ৩টি পদ্ধতি আছে। সেগুলো সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা যেতে পারে:

  • ভারতের সংবিধানের বিশেষ কয়েকটি ধারা আছে যাদের সাধারণ আইন প্রণয়ন পদ্ধতির মাধ্যমে সংসদ সংশোধন করতে পারে। সংসদের যে কোন কক্ষেই বিল উত্থাপন করা যায়। প্রত্যেক কক্ষে উপস্থিত এবং ভোটদানকারী সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন লাভ করলে বিলটি সংসদ কর্তৃক অনুমোদিত হয়েছে বলে গণ্য করা হয়। এরপর রাষ্ট্রপতির সমর্থনের দরকার হয়।
  • সংবিধানের যে সব বিষয় ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো অর্থাৎ কেন্দ্র ও রাজ্যের স্বার্থ এবং এক্তিয়ারের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত সে বিষয়গুলোর সংশোধন পদ্ধতি ৩৬৮ (২) নং ধারায় উল্লেখ আছে। এ সংশোধনের জন্য প্রত্যেক সংসদের যে কোন কক্ষে বিল উত্থাপন করা যায়। বিল অনুমোদনের জন্য ন্যূনতম পক্ষে সংসদের প্রত্যেক কক্ষে উপস্থিত এবং ভোটদানকারী সদস্যের দুই-তৃতীয়াংশের সমর্থন প্রয়োজন। কিন্তু ঐ দুই তৃতীয়াংশকে সংশ্লিষ্ট কক্ষের মোট সদস্যসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠের সমান হতে হবে। এভাবে সংসদের উভয় কক্ষ কর্তৃক অনুমোদিত হলে সংশ্লিষ্ট বিলকে অঙ্গ রাজ্যের আইন সভার অনুমোদন নিয়ে রাষ্ট্রপতির অনুমতি নেয়া হয়।
  • সংবিধানে ৩য় অংশে সংযোজিত মৌলিক অধিকার এবং ৪র্থ অংশে বর্ণিত নির্দেশমূলক নীতি এবং পূর্বে আলোচিত সংশোধনে ১ম ও ২য় পদ্ধতির অন্তর্ভুক্ত নয়, এ বিষয়গুলো সংশোধনের জন্য সংসদের যে কান কক্ষে বিল উত্থাপন করা হয়। অনুমোদনের জন্য প্রত্যেক কক্ষে উপস্থিত এবং ভোটদানকারী সদস্যদের ন্যূনতম দুই-তৃতীয়াংশের সমর্থন প্রয়োজন। তবে প্রত্যেক কক্ষের উপস্থিত ও ভোটদানকারী সদস্যদের দুই-তৃতীয়াংশকে ঐ কক্ষের মোট সদস্য সংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠের সমান হতে হবে। এভাবে সংসদের উভয় কক্ষ দ্বারা অনুমোদিত হলে বিল রাষ্ট্রপতির সম্মতির জন্য প্রেরণ করা হয়। রাষ্ট্রপতি কর্তৃক অনুমোদিত হলে বিলটি আইনে পরিণত হয়। ঐ আইন অনুসারে সংবিধান সংশোধিত হয়।

সারকথা

ভারতের সংবিধান পৃথিবীর সর্ববৃহৎ সংবিধান। এটি একটি গতিশীল দলিল। সাংবিধানিক নজীর, সংবিধান সংশোধন, আইনসভা কর্তৃক আইন প্রণয়ন, আদালতের সিদ্ধান্ত এবং শাসন বিভাগীয় সিদ্ধান্ত ইত্যাদি কারণে সংবিধানের ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। বিশাল আয়তন, ঔপনিবেশিক শাসনের প্রভাব, সুপরিবর্তনীয়তা ও দুস্পরিবর্তনীয়তার সম্মিলন, যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার স্বীকৃতি এবং রাষ্ট্রপরিচালনার ক্ষেত্রে গৃহীত বিভিন্ন নীতির কারণে এ সংবিধান স্বতন্ত্র অবস্থানে থেকেছে। ভারতের সংবিধানের প্রস্তাবনা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। সংবিধানে, সংবিধান সংশোধনের ৩টি পদ্ধতির স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url