জাতীয়তাবাদ কি তীয়তাবাদের বিভিন্ন উপাদানের বর্ণনা
আজ এই আর্টিকেলটিতে জাতীয়তাবাদের সংজ্ঞা বলতে পারবেন জাতীয়তাবাদের বিভিন্ন উপাদান বর্ণনা করতে পারবেন।
জাতীয়তাবাদের সংজ্ঞা
বহুদিন ধরে ঐতিহাসিক বিবর্তনের ফলে আমরা সম্প্রদায়গত যে জীবনে এসে পৌছেছি তাকে বলা হয় জাতীয় সম্প্রদায়। এই জাতীয় সম্প্রদায়ের দু'টি দিক আছে: সামাজিক ও রাজনৈতিক। সামাজিক দিক থেকে জাতীয় সম্প্রদায়কে বলা হয় জাতীয় সমাজ (National Society) এবং রাজনৈতিক দিক থেকে তা জাতি-রাষ্ট্র (National State) বলে অভিহিত হয়। জাতিরাষ্ট্রের ভাব বা আদর্শকে বলা হয় জাতীয় ভাব বা জাতীয়তাবাদ (Nationalism)। হ্যান্স কোঁ (Hans Kohn)-এর মতে, 'জাতীয়তাবাদ মূলত এবং প্রথমত একটি মানসিক অবস্থা, একটি চেতনা।' লাস্কি বলেছেন যে 'জাতীয়তাবাদ হল এক প্রকার মানসিক ঐক্যবোধে উদ্বুদ্ধ জনসমাজ, যারা নিজেদেরকে বাকি মানব সমাজ হতে পৃথক মনে করে'। জন স্টুয়ার্ট মিলের মতে, মানব জাতির কোন অংশ যদি পারস্পরিক সহানুভূতির দ্বারা ঐক্যবদ্ধ হয়, পারস্পরিক সহযোগিতার নীতিতে বিশ্বাস করে এবং নিজেদের একাংশের দ্বারা পরিচালিত সরকারের অধীনে থাকার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করে তাহলে জাতীয়তাবাদ গড়ে উঠে। অধ্যাপক পাইডারের বক্তব্য অনুযায়ী, জাতীয়তাবাদ হচ্ছে ইতিহাসের এক বিশেষ স্তরে রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও আধ্যাত্মিক চেতনার ফল। একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক এলাকার মধ্যে বসবাসকারী জনসাধারণের মানসিকতা ও ভাবগত ঐক্যই এর প্রধান শর্ত। এসকল সংজ্ঞাগুলা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, জাতীয়তাবাদ হল কোন জনসমাজের মধ্যকার মানসিক অনুভূতি ও পারস্পরিক বন্ধনের চেতনা। এর ফলে তারা নিজেদেরকে অভিন্ন সত্ত্বার অধিকারী এবং অন্যদের থেকে স্বতন্ত্র বলে মনে করে। অর্থাৎ জাতীয়তাবাদের নেপথ্যে দু'টি শর্ত থাকে (১) নিজেদের মধ্যে ঐক্যচেতনা এবং (২) অন্যদের থেকে স্বাতন্ত্র্যবোধ।
ঐক্যবোধে আবদ্ধ এবং স্বাতন্ত্র্য চেতনাসম্পন্ন জনসমাজ রাষ্ট্র গঠন করতে পারলে কিংবা রাষ্ট্র গঠনে সচেষ্ট হলেই জাতীয়তাবাদ পূর্ণতা লাভ করে। এ পরিস্থিতিতে কোন জনসমাজ নিজেদেরকে রোমান, খ্রিস্টান বা পাভিক হিসেবে বিবেচনা না করে আমেরিকান, ফরাসি বা রাশিয়ান হিসেবে ভাবতে শেখে। আর একারণেই আধুনিক জাতীয়তাবাদ সংকীনতা পরিহার করে রাষ্ট্রীয় পরিচিতি লাভ করে।
আরো পড়ুন: উদারতাবাদের অর্থ ও সংজ্ঞা ও উদ্ভব ও বিকাশের ব্যাখ্যাসহ বিস্তারিত
জাতীয়তাবাদের উপাদানসমূহ
ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, অনেকগুলো উপাদানের উপর ভিত্তি করে জাতীয়তাবাদ গড়ে ওঠে। এসকল উপাদানগুলোকে বাহ্যিক এবং ভাবগত বা মানসিক-এই দুই ভাগে বিভক্ত করা যায়। ভৌগোলিক ঐক্য, বংশগত ঐক্য, ভাষা, এগুলো হল জাতীয়তাবাদের বাহ্যিক উপাদান। অপরদিকে ধর্ম, ঐতিহ্য চেতনা, রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা ইত্যাদি মূলত: ভাবগত উপাদান। এই দুই ধরণের জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠার জন্যে অপরিহার্য। তবে তুলনামূলক বিচারে ভাবগত উপাদানগুলোর প্রাধান্যই বেশি। এ পর্যায়ে আমরা জাতীয়তাবাদের বিভিন্ন উপাদান নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করব।
ভৌগোলিক ঐক্য: ভৌগোলিক ঐক্য জাতীয়তাবাদের একটি অপরিহার্য উপাদান হিসেবে বিবেচিত হয়। কোন নির্দিষ্ট ভূখন্ডে দীর্ঘকাল ধরে যদি কোন জনসমষ্টি বসবাস করে তাহলে তাদের মধ্যে ঘনিষ্ট সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ভাবের আদান-প্রদান চলতে থাকে। একে অপরকে আপনজন বলে মনে করে। স্বাভাবিকভাবেই তাদের মধ্যে একটি নিবিড় ঐক্যের বন্ধন গড়ে ওঠে। একই ভূখন্ডে স্থায়ীভাবে বসবাস করার কারণে সেই জনসমষ্টির মধ্যে নিজ ভূখন্ডের প্রতি অধিকারবোধ ও মমত্ববোধ গড়ে উঠে। এর ফলে মাতৃভূমির ধারণা প্রতিষ্ঠা পায় এবং মাতৃভূমিকে কেন্দ্র করে স্বাদেশিকতা জাগ্রত হয়।
বংশগত ঐক্য: জাতীয়তাবাদের একটি উপাদান হিসেবে অনেক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বংশগত ঐক্যের উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। কোন সঙ্ঘবদ্ধ জনসমষ্টি যখন নিজেদের একই পূর্ব-পুরুষের বংশধর বলে মনে করে তখন তাদের মধ্যে এক সুদৃঢ় একাত্মতা-বোধ পরিলক্ষিত হয়। এই বংশগত ঐক্যের ধারণা গভীর জাতীয়তাবোধের সঞ্চার ঘটায়। কিন্তু আধুনিক নৃতাত্ত্বিক গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে যে, বংশগত বিশুদ্ধতা নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। প্রতিটি জাতিই একাধিক বংশের সংমিশ্রণে গঠিত হয়েছে। এ কারণেই বংশগত ঐক্যকে জাতীয়তাবাদের অপরিহার্য উপাদান বলা যায় না। তবে জার্মানদের আর্যজাতির বংশধর রূপে প্রচার করে হিটলার জার্মানিতে ব্যাপক জাতীয়তাবোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন।
ভাষাগত ঐক্য: মানুষের ভাব প্রকাশের সর্বপ্রধান মাধ্যম হল ভাষা। তার মাধ্যমেই মানুষ পরস্পরের মধ্যে সংযোগ রক্ষা করে। ভাষার মাধ্যমেই তারা নিজেদের সংস্কৃতি ও ধ্যান-ধারণা প্রকাশ করে। যখন কোন জনসমাজের মধ্যে ভাষাগত ঐক্য থাকে তখন তাদের মধ্যে একটি মানসিক একাত্মতার পরিবেশ গড়ে ওঠে। ঐক্য দৃঢ়তর হয়। লক্ষ্য করা যায় যে, যখন নির্দিষ্ট ভূখন্ডে বসবাসকারী জনসমষ্টির মধ্যে একটি ভাষা সার্বজনীনভাবে প্রচলিত থাকে তখন তাদের মধ্যে অতি সহজেই ঐক্যবোধ গড়ে ওঠে। ভাষা তখন তাদের জাতীয় সাহিত্য, ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ধারক ও বাহকে পরিণত হয়। ভাষাকে কেন্দ্র করেই স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছে। কিন্তু একথাও অনস্বীকার্য যে, ভাষাগত ঐক্যের অভাব জাতীয়তাবাদের অন্তরায় হয় না। সুইজারল্যান্ড এর প্রমাণ। সুইসরা বিভিন্ন ভাষাভাষী হয়েও এক জাতি।
ধর্মীয় ঐক্য: ধর্ম হল জাতীয়তাবাদের একটি ভাবগত উপাদান। জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠায় এর ভূমিকা বিশেষ গুরুত্বের সাথে উল্লেখিত হয়। মধ্যযুগে ধর্মীয় ঐক্য জাতি গঠনের একটি অতি প্রয়োজনীয় উপাদান হিসেবে বিবেচিত হোত। আধুনিক কালেও জাতীয়তাবাদের বিকাশে ধর্মের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। আরব জাতীয়তাবাদ মূলত ধর্মের উপরই প্রতিষ্ঠিত। একই ধর্মীয় বিশ্বাসের দ্বারা প্রভাবিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে অতি সহজেই ঐক্যের মানসিকতা গড়ে উঠে। অধ্যাপক গিলক্রিস্ট উল্লেখ করেছেন, ধর্ম বিশ্বাসের পার্থক্য যেখানে প্রবল সেখানে জাতিগত ঐক্য স্বল্পস্থায়ী হতে বাধ্য। তবে জাতীয়তাবাদের বিকাশে ধর্ম অপরিহার্য উপাদান নয়। কেননা, বর্তমানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ধর্মের লোক আছে, কিন্তু বিভিন্নতা সত্ত্বেও তারা এক জাতি। চীনা, ভারতীয়, ফরাসী প্রভৃতি জাতি বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের নিয়েই গঠিত হয়েছে।
আরো পড়ুন: পুঁজিবাদ কি পুঁজিবাদের বৈশিষ্ট্য গুণাবলী দুর্বলতা ও প্রভাব
অর্থনৈতিক স্বার্থের বন্ধন: অর্থনৈতিক স্বার্থের বন্ধন জাতীয়তাবাদের একটি অতি প্রয়োজনীয় উপাদান। অর্থনৈতিক স্বার্থের বন্ধন এমন হওয়া প্রয়োজন যার মাধ্যমে জনসমাজের সবাইকে যেন ঐক্যবদ্ধ করা যায়। সমজাতীয় অর্থনৈতিক স্বার্থের মাধ্যমেই কোন নির্দিষ্ট ভূখন্ডে বসবাসকারী মানুষের মধ্যে ঐক্যের পরিবেশ গড়ে ওঠে।
রাষ্ট্রীয় সংগঠন ও রাজনৈতিক আশা-আকাঙ্ক্ষা: রাজনৈতিক সংগঠন ও আশা-আকাঙ্ক্ষা জাতীয়তাবাদ গঠনের একটা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে বিবেচিত হয়। কোন জনসমাজ দীর্ঘকাল ধরে একই ধরনের সরকারের অধীনে বসবাস করলে এবং একই ধরনের রাজনৈতিক আশা-আকাঙ্ক্ষার দ্বারা অনুপ্রাণিত হলে জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠার অনুকূল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। এখানে ভাষা, ধর্ম কিংবা বংশগত পার্থক্য কোন বাধা সৃষ্টি করতে পারে না।
ভাবগত ঐক্য: সুদীর্ঘকাল ধরে একই ভূখন্ডে বসবাস করলে কোন জনসমাজের মধ্যে সমজাতীয় ঐতিহ্য, জীবন ধারা, কৃষ্টি ও ইতিহাসের সমন্বয়ে এক ভাবগত বা আত্মিক ঐক্য গড়ে ওঠে। সমাজবিজ্ঞানী বার্নস উল্লেখ করেছেন, রক্তের অভিন্নতার তুলনায় একটি যৌথ স্মৃতি এবং যৌথ আদর্শ জাতি গঠনে অধিকতর সাহায্য করে। ভাষা, শিক্ষা- সংস্কৃতি, শিল্পকলা এবং আচার আচরণগত ঐক্যের মাধ্যমেও ভাবগত ঐক্যের উন্মেষ ঘটে। ভাবগত ঐক্য কোন জনসমাজের মানসিক অবস্থাকে প্রতিফলিত করে। সমজাতীয় অনুভূতি, চিন্তা এবং জীবন ধারণের পদ্ধতি নিয়ে ঐ মানসিক অবস্থা সৃষ্টি হয়। এ কারণেই লাস্কী বলেছেন যে, 'জাতীয়তার ধারণা এক প্রকার মানসিক ধারণা।
জাতীয়বাদের উপাদানসমূহ নিয়ে আলোচনার পর একথা বলা যায়, জাতি গঠনে কিংবা জাতীয়তাবাদের বিকাশে সকল উপাদানের উপস্থিতি অপরিহার্য নয়। কোন একটি বা কয়েকটি উপাদানের উপর ভিত্তি করে জাতীয়তাবাদ গড়ে উঠতে পারে। তবে অন্তত: একটি উপাদানের প্রবল উপস্থিতি জাতীয়তাবাদ গঠনে অপরিহার্য।
সারকথা
মানসিক ঐক্যবোধে উদ্বুদ্ধ জনসমাজকে জাতি বলা হয়। কোন জাতির মধ্যকার আত্মচেতনাই হল জাতীয়তাবাদ। জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠার কতকগুলো সুনির্দিষ্ট উপাদান রয়েছে, যেমন- ভৌগোলিক ঐক্য, বংশগত ঐক্য, ভাষাগত ঐক্য, ধর্মীয় ঐক্য, অর্থনৈতিক স্বার্থের বন্ধন, রাজনৈতিক আশা-আকাঙ্খা, ভাবগত ঐক্য ইত্যাদি। এসকল উপাদানের মধ্যে যে কোন এক বা একাধিক উপাদান জনসমাজকে ঐক্যের বন্ধনে আবদ্ধ করতে পারে।
এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url