তেতুল খাওয়ার উপকারিতা তেতুলের পুষ্টিগণ ও অপকারিতা
তেঁতুল জনপ্রিয় ফল। ফলটি মিষ্টি এবং টক এর স্বাদের জন্য এটি সুপরিচিত বিশেষ করে মেয়েদের কাছে। এটি খুব প্রিয় ফল এই অনন্য সাধ ছাড়াও এর অনেক গুণ রয়েছে। এটি পুষ্টিতে ভরপুর প্রাচীনকাল থেকে তেতুল তার ওষুধি বৈশিষ্ট্য গুলির জন্য ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এটি কোষ্ঠকাঠিন্য গলা ব্যথা এমন কি সানস্ট্রোকের মতো স্বাস্থ্য সমস্যার চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে এটি ত্বকের যত্ন এবং চুলের যত্নের ও অংশ হয়ে উঠেছে।
আরো পড়ুন ঃ পেঁয়াজ খাওয়ার উপকারিতা ও অপকারিতা সমূহ
তেঁতুল দীর্ঘজীবী বৃক্ষ। কয়েক শত বছর ধরে বেঁচে থাকে তেতুল গাছ। আকারেও বেশ বড় হয়। দেখতে খুব সুন্দর। অধিক শাখা-প্রশাখা থাকাই প্রতিকূলতার সহ্য ক্ষমতা রয়েছে যথেষ্ট। গাছের উচ্চতা সাধারণত ৭০ থেকে ৮০ ফুট হয়ে থাকে। এর আদি নিবাস আফ্রিকার সাবানা অঞ্চল। তবে সুদান থেকে বীজের মাধ্যমে বাংলাদেশে বংশবিস্তার হয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
তেঁতুল দেখে জিভে জল আসে না এমন মানুষ পাওয়া খুব কঠিন ব্যাপার। তেতুল পছন্দ করে না এমন নারী খুঁজে পাওয়া মুশকিল । তাহলে কি ছেলেরাও এ তালিকায় নেই তাও কি করে বলি খেতে বসলে দেখা যায় কোন কোন পুরুষ মেয়েদের ও হার মানায়। আসলে এ ফলটি সবার কাছে অন্য এক আকর্ষণ । দক্ষিণ আফ্রিকার মূল্যবান খাবারের মধ্যে তেঁতুলের স্থান অন্যতম। বিশেষ করে তরুণীদের বেলায়। তবে অনেকেরই ধারণা তেঁতুল খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এবং তেঁতুল খেলে রক্ত পানি হয়।
তেঁতুল খেলে রক্ত পানি হয়ে যায় কিংবা তেঁতুল মস্তিষ্কের জন্য ক্ষতিকর আধুনিক ডাক্তারদের মতে এ ধারণা সম্পন্ন ভুল। সব কিছুরই যেমন ভাল ও মন্দ আছে তেমনি তেঁতুলের ও ভালো ও মন্দ এবং উপকারিতা এবং অপকারিতা উভয়ই আছে। গরমে এটির খুব কদর বাড়ে অন্য সময়ের তুলনায়। ছেলে মেয়ে উভয়েই তেঁতুল খেতে পারেন । তেঁতুল ভরা পেটে খাওয়া ভালো।
তেতুলের উপকারিতা
পেট ব্যথা বা কোষ্টকাঠিন্যর মতো সমস্যার সমাধান যদি চান, তেঁতুলের সাহায্য নিন, তেতুলের মধ্যে টার্টারিক তা অ্যাসিড, ম্যালিক অ্যাসিড এবং পটাশিয়াম আছে যা কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। আয়ুর্বেদে এখনো তেতুল পাতা ডায়রিয়া সারাতে ব্যবহার হয় । এছাড়াও তেঁতুল গাছের ছাল এবং শিকড় পেটের ব্যথা দূর করতে ব্যবহার করা হয়।
তেঁতুলের পাল্পে কার্বো-ব্লকিং বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এটি শরীরকে কার্বোহাইড্রেট শোষণে সহায়তা করে। ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য তেতুল বেশ উপকারী। এটি রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা কমায়। তেতুলে অ্যান্টি ইনফ্লামেটরি বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যা অগ্ন্যাশয়কে প্রদাহজনক ক্ষতি থেকে রক্ষা করে।
তেঁতুলের বীজ ডায়াবেটিস কন্ট্রোল করতে সাহায্য করে ।আবার রক্তে চিনির মাত্রা ঠিক রাখে এতে উপস্থিত এক ধরনের এনজাইম যার নাম (alpha amylase) রক্তে চিনির মাত্রা কমায়।
তেতুলে উচ্চমাত্রায় ফাইবার আছে। আবার একই সঙ্গে একটা সম্পূর্ণ ফ্যাট ফ্রি। গবেষণায় দেখা গেছে যে রোজ তেঁতুল খেলে ওজন কমে ওজন কমাতে flavonoids and polyphenols এর উপস্থিতি কাজ করে। এছাড়া ও এর উপস্থিতি hydroxyctric Asif খিদে কমায়।
পেপটিক আলসার বেশিরভাগ সময় পেটে এবং ক্ষুদ্রান্তে হয়। এই আলসার খুব বেদনাদায়ক । রিসার্চে দেখা গেছে তেঁতুলের বীজের গুঁড়ো নিয়মিত খেলে পেপটিক আলসার সেরে যায়।
তেঁতুল খুবই হাট ফ্রেন্ডলি এতে, উপস্থিত ফ্ল্যাভরনয়েড ব্যাড কোলেস্টেরল কুমার। আবার রক্ত ট্রাইগ্লিসারাইড (এক ধরনের ফ্যাট) জমতে দেয় না। এতে উপস্থিত উচ্চ পটাশিয়াম রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে।
তেতুলে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এর ফলে এটি বিভিন্ন অঞ্চলের প্রধান ঔষধি উদ্ভিদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আফ্রিকান উপজাতিরা প্রাচীনকাল থেকে ম্যালেরিয়ার চিকিৎসায় জন্য এটি ব্যবহার করে আসছে ।বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া সংক্রমনের কারণে অনেক সময় জ্বর হয়। এক্ষেত্রে তেঁতুলের রস বেশ কার্যকর।
তেঁতুলে উচ্চ পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট আছে যা কিডনি ফেলি ওর এবং ক্যান্সার রোধ করতে সাহায্য করে।
তেঁতুল গাছের পাতা এবং ছাল এন্টি সেপটিক এবং এন্টি ব্যাকটেরিয়াল। এটি ক্ষত সারিয়ে তুলতে সাহায্য করে।
তেঁতুল ক্ষতিকারক আলট্রা ভায়োলেট এর হাত থেকে ত্বককে বাঁচাতে সাহায্য করে, যাদের অ্যাকনে আছে তাদের জন্যেও উপকারী তেতুল। তেতুলে উপস্থিত হাইড্রক্সি অ্যাসিড ত্বকের এক্সফলিয়েশন করতেও সাহায্য করে। যার ফলে মরা কোষ উঠে যায় এবং ত্বক উজ্জ্বল দেখায়।
তেতুলে antihistaminic properties প্রপার্টি আছে। যার ফলে এলার্জি হতে বাধা দেয় আবার এতে উপস্থিত ভিটামিন সি শরীরের ইমিউনিটি বাড়ায়।
তেতুল আমাদের লিভার বা যকৃতকে ও ভালো রাখে। পরীক্ষায় দেখা গেছে যে নিয়মিত তেতুল পাতা ব্যবহার করে উচ্চমাত্রায় মদ্যপানের ফলে ড্যামেজড দেওয়ার অনেকটা সেরে উঠেছে।
বেশিরভাগ গবেষণায় দেখা যায় যে তেঁতুলের বীজের নির্যাসযুক্ত চোখের ড্রপ গুলি প্রতিদিন ৪ থেকে ৫ বার ব্যবহার করলে যাদের চোখে পানি কম তাদের চোখের উন্নতি করে। ব্যবহৃত ড্রপ গুলিতে এক্সট্রাক্টের ১% অবধি থাকে। তেঁতুল বয়সের সাথে সম্পর্কিত ছানি পড়ার ঝুঁকি কমায়। এটিতে এমন যৌগিক রয়েছে যা আপনার চোখকে শুকনো হওয়া চোখের বিরুদ্ধে কাজ করে।
তেঁতুলের রস আপনার স্বাস্থ্যের জন্য জাদুর মত কাজ করবে। সর্দি-কাশি ফল দূর করবে। এতে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং ভিটামিন সি রয়েছে। যা আপনার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। তেতুলে থাকা অ্যান্টি সেফটিক বৈশিষ্ট্য গুলির কারণে শরীর থাকে জীবাণু মুক্ত।
আরো পড়ুন ঃ কলার পুষ্টিগুণ কলার উপকারিতা এবং অপকারিতা
তেতুলের পুষ্টিগুণ
প্রতি ১০০ গ্রাম কাঁচা তেতুলের পুষ্টিগুণ
- ক্যালসিয়াম আছে ২৪ মিলিগ্রাম।
- আয়রন ১ মিলিগ্রাম।
- আমিষ .১ গ্রাম।
- শর্করা ১৩.৯ গ্রাম।
- চর্বি ০.২ গ্রাম।
- ভিটামিন বি১ ০.০১ মিলিগ্রাম।
- ভিটামিন বি ২ ০.০২ মিলিগ্রাম।
- ভিটামিন সি ৬ মিলিগ্রাম।
- খনিজ লবণ ১.২ গ্রাম।
- খাদ্যশক্তি ৬২ কিলো ক্যালরি।
প্রতি ১০০ গ্রাম পাকা তেঁতুলের পুষ্টিগুণ
- ক্যালসিয়াম ১৭০ মিলিগ্রাম।
- আইরন ১০.৯ মিলিগ্রাম।
- আমিষ ৩.১ গ্রাম।
- শর্করা ৬৪.৪ গ্রাম।
- চর্বি ০.১ গ্রাম।
- ভিটামিন বি২ ০.৭ গ্রাম।
- ভিটামিন সি ৩ মিলিগ্রাম।
- ভিটামিন ই ০.১ মিলিগ্রাম।
- ফসফরাস ১১৩ মিলিগ্রাম।
- সোডিয়াম ২৮ মিলিগ্রাম।
- পটাশিয়াম ৬২৮ মিলিগ্রাম।
- ম্যাগনেসিয়াম ৯২ মিলিগ্রাম।
- সিলিনিয়াম ১.৩ মিলিগ্রাম।
- দস্তা, ০.১২ মিলিগ্রাম।
- তামা ০.৮৬ মিলিগ্রাম।
- খাদ্য শক্তি ২৮৩ কিলো ক্যালরি।
তেঁতুলের অপকারিতা
রক্তপাত বৃদ্ধি করে নির্দিষ্ট ওষুধের ক্ষেত্রে
তেতুল রক্তপাতের ঝুঁকি বৃদ্ধি করতে পারে এবং মারাত্মক স্বাস্থ্য সমস্যা তৈরি করতে পারে যদি নির্দিষ্ট কিছু ঔষুধের সাথে গ্রহণ করা হয়। এসব এ ধরনের ঔষুধ গুলো হচ্ছে।
অ্যাসপিরিন,ইবুপ্রোফেন, ন্যাপ্রোক্সিন এর মত নন স্টেরয়ডাল অ্যান্টিইনফ্লামেটরি ডাগ (NSIDs)। রক্ত পাতলা করার ঔষধ হেপারিন, ওয়ারফেরিন ইত্যাদি) অ্যান্টি প্লাটিলেট ড্রাগ ক্লপিডোগ্রেল। যদি আপনি এই ঔষুধগুলো গ্রহনের সময় তেতুল খান তাহলে শরীরে এদের শোষণের মাত্রা বৃদ্ধি পাবে এরা শরীরে অনেক বেশি কাজ করা শুরু করে এবং ক্রমান্বয়ে অধিক রক্তপাত শুরু হয়।
অনেক বেশি পরিমাণে তেঁতুল খেলে রক্তের সিরাম গ্লুকোজের মাত্রা কমে যায় বলে হাইপ্রোগ্লাইসেমিয়া হয়। পুষ্টিবিদরা প্রতিদিন ১০ গ্রাম তেঁতুলবনের পরামর্শ দেন। যা নিয়মিত খাদ্য গ্রহণের ০.৮% হতে বা হবে। এর বেশি গ্রহণ করলে শরীরে গ্লুকোজের ঘাটতি দেখা দিতে পারে। তাই ডায়াবেটিসের রোগীরা যারা রক্তের চিনির মাত্রা কমানোর ঔষুধ গ্রহণ করেন তারা এ বিষয়ে সতর্ক থাকবেন।
তেতুলের সাধারণ পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হচ্ছে অ্যালার্জি বা অতি সংবেদনশীলতা। এ কারণে কিছু কিছু মানুষের মধ্যে চুলকানি ইন ইনফ্লামেশন, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, বমি হওয়া বা শ্বাসকষ্ট হওয়ার মত লক্ষণ দেখা যায়।
তেঁতুল উচ্চমাত্রার এসিডিক প্রকৃতির । তাই নিয়মিত তেতুল খেলে দাঁতের এনামেল নষ্ট হয়ে যেতে পারে। তাই অতিরিক্ত তেঁতুল খাওয়া আপনার স্বাস্থ্যের জন্য যেমন খারাপ তেমনি আপনার দাঁতের জন্যও খারাপ।
ভারতীয় গবেষক প্রমাণ করেছেন যে ঘনঘন প্রচুর পরিমাণে তেঁতুল খাওয়া পিত্ত পাথর হতে সাহায্য করে । এর ফলে জন্ডিস, তীব্র জ্বর , পেটে ব্যথা, বমি বমি ভাব, বমি হওয়া পরিপাকের সমস্যা ও লিভারের সমস্যা হতে পারে।
এসিড রিফ্লাক্স বৃদ্ধি করে
তেতুল এসিডিক খাবার তাই এটি বেশি খেলে আমাদের গ্যাস্ট্রোইনটেষ্টাইনাল নালীতে বিশেষ করে পাকস্থলীতে এসিডের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। তাই যদি এসিড রিফ্লাক্সের সমস্যায় ভুগে থাকেন তাহলে আপনার তেঁতুল খাওয়া থেকে দূরে থাকতে হবে।
গর্ভবতী মা ও স্তন্য প্রদানকারী মায়েদের ক্ষেত্রে তেতুল সেবন করা বিরত থাকা উচিত।
যেকোনো সার্জারি করার কমপক্ষে ১৫ দিন আগে তেঁতুল খাওয়া বন্ধ করতে হবে।
ধন্যবাদ*
এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url